কওমি মাদ্রাসা সনদের স্বীকৃতিকে কেন্দ্র করে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে শেখ হাসিনার ‘সন্ধি’ বাংলাদেশের রাজনীতির অনেক হিসাব-নিকাশ নিমেষে বদলে দিয়েছে।
সমাজে বিভিন্ন শক্তির ভারসাম্যের ক্ষেত্রে এই ‘সন্ধি’ গুণগত রূপান্তরের ইঙ্গিত। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির টানাপড়েনে বদল ঘটছে। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী, শক্তি ও মতাদর্শের পারস্পরিক সম্পর্ক ও বিরোধের ক্ষেত্রগুলোর ওপর এর প্রভাব পড়বে গভীরভাবে। গণমাধ্যমে, বিশেষত টিভি টকশোতে এখন হেফাজতের নেতাদের ডাকা হচ্ছে।
একজন হেফাজত নেতার ওপর টকশোর সঞ্চালকসহ তিন-চারজন একসঙ্গে হামলে পড়ছে। রাজনীতির নয়া সমীকরণে হেফাজত নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে গণমাধ্যমের গুণেই হাজির হয়ে যাচ্ছে। সেকুলার মহলে চরম ক্ষোভ ও হতাশা। অভিনব পরিস্থিতি।
কিন্তু শক্তির ভারসাম্যে এই বদলের ফলাফল শেষাবধি কী দাঁড়াবে আগাম বলা কঠিন, কারণ বলার সময় এখনও আসেনি।
এটা পরিষ্কার যে, ঢাকা শহরকেন্দ্রিক চরম সুবিধাবাদী ও এলিট শ্রেণীর উৎকট ইসলাম বিদ্বেষের গালে হেফাজত দুর্দান্ত চপেটাঘাত করতে সক্ষম হয়েছে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘পোয়েটিক জাস্টিস’। এই পরিভাষাটির মধ্যে এক প্রকার আধ্যাত্মিকতা আছে। আমরা যখন বলি আল্লাহর বিচার আল্লাহ করেছেন- সেটা পোয়েটিক জাস্টিসের কথাটাই আসলে ধর্মীয় কায়দায় বলা। সেকুলার ভাষা হলেও পোয়েটিক জাস্টিস প্রায় একই আধ্যাত্মিক মর্ম ব্যক্ত করে। অর্থাৎ ইতিহাসের বিচার ইতিহাসের নিজস্ব গতি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই সাব্যস্ত হয়।
তার ওপর কারও হাত নাই। আইন আদালত দিয়ে নয়, বল প্রয়োগের দ্বারাও নয়। ইতিহাসের এই বিচারটাই কাব্যিক ইনসাফ। যাদের মাত্র ২০১৩ সালে গুলি করে মেরে এই শহর থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, যাদের লাশের হিসাব পর্যন্ত করা যায়নি, আজ সেই তাড়া খাওয়া এবং হত্যা, গুম ও নির্যাতনের শিকার কওমি মাদ্রাসার আলেম-ওলেমাদের স্থান হয়েছে সরকারের উচ্চ দরবারে। খোদ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও শক্তির সর্বোচ্চ দরবারে তারা উচ্চ মর্যাদার মেহমান হয়ে হাজির হয়েছেন। আল্লাহর কুদরত দারুণ!!
তুমি ডুবাইয়া ভাসাইতে পার ভাসাইয়া কিনার দাও কারো
রাখো মারো হাত তোমারো, তাইতে দয়াল ডাকি আমি
এলাহি আলামিন গো বাদশা আলমপানা তুমি!! (ফকির লালন শাহ)
দুই
আমি ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরোধী। তবুও শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশলের আমি সব সময়ই প্রশংসা করেছি।
কওমি সনদের স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে তার ইন্টেলিজেন্ট সিদ্ধান্তেরও তারিফ না করে পারি না। ইতিহাসের প্রহসন হচ্ছে, খালেদা জিয়া হেফাজতের নেতাদের তার ঘরের মধ্যে দীর্ঘকাল পেয়েও যা অর্জন করতে পারেননি, শেখ হাসিনা কয়েক মাসের ব্যবধানে অসাধ্য সাধন করে ফেলেছেন।
তাকে তারিফ না করা হবে বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা। তার নিজের সমর্থক মতাদর্শিক শ্রেণী ও গোষ্ঠীকে উপেক্ষা করে প্রথমে পাঠ্যক্রম এবং এখন কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতির দাবি তিনি মেনে নিয়েছেন। দেবী থেমিসকে উচ্চ আদালতের প্রাঙ্গণ থেকে সরাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অর্থাৎ তার নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শের সমর্থক কন্সটিটিউন্সির সঙ্গে ছাড়াছাড়ির সম্ভাবনা ঘটিয়েও তিনি হেফাজতের সঙ্গে এক ধরনের রাজনৈতিক ‘সন্ধি’ করেছেন। হতে পারে সেটা সাময়িক রাজনৈতিক সুবিধা নেয়ার জন্য। তার এখনকার অবস্থান আগামী দিনে যে কোনো মুহূর্তে বদলে যেতেও পারে। কিন্তু তার রাজনীতির সেকুলার সমর্থকদের সাময়িক নিন্দা ও ছাড়াছাড়ির হুমকি উপেক্ষা করে তিনি কাজটা করতে পেরেছেন।
এর জন্য সাহস ও দূরদর্শিতা দরকার। সেটা তার আছে, পরিষ্কারই বোঝা গেল। এটা গুরুত্বপূর্ণ। এটা ঠিক যে, সবার মতো শেখ হাসিনাও ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন। তিনি বামপন্থীদের মতো আহাম্মক নন। তাকেও রাজনৈতিক তোষামদি দিয়ে প্রবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে জয় করতে হয়।
ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার, কিংবা ধর্মীয় শক্তিকে রাজনৈতিক তোষামদি দিয়ে জয় করার বিরুদ্ধে নীতিবাগীশ বকোয়াজগিরির চেয়ে চরম তামাশা আর কিছুই নাই। রাজনীতি নীতিবিদ্যা চর্চার জায়গা নয়। কাল যাকে মেরেছ, আজ তার সঙ্গে কিভাবে হাত মেলালে ধরনের দীর্ঘশ্বাসসমেত ফাঁপা অভিমান নয়। রাজনীতি ব্যবহারিক অর্থ রাজনৈতিক ক্ষমতা তৈরির জন্য সমাজে শক্তির ভারসাম্য বদলানোর কারিগরি।
কওমি মাদ্রাসার অনেক আলেম-ওলেমা ও তরুণ ছাত্রদের অনুভূতি ও উপলব্ধি বোঝার জন্য কথা বলেছি। তারা পাল্টা প্রশ্ন আমাকে করেছেন, রক্তের দাগ এখনও শুকায়নি, হেফাজতের দিক থেকে কাজটা কি ঠিক হল? এটা আসলে সাধারণ মানুষেরও প্রশ্ন।
আমি বলেছি, আপত্তি করছেন কেন? ‘কওম’ বা গণসমাজের স্বীকৃতিতে আপনারা তো সন্তুষ্ট না। জনগণের অর্থেই কওমি মাদ্রাসা চলে, আর ঠিক এটাই কওমি মাদ্রাসার শক্তির জায়গা। জনগণ শুধু স্বীকৃতি দিয়ে ক্ষান্ত না, তারা কওমি মাদ্রাসার খরচেরও জোগানদার। এই মাদ্রাসা রাষ্ট্রের টাকায় চলে না।
জনগণের স্বীকৃতি, মহব্বত ও প্রাণের সম্পর্কের চেয়েও এখন আপনাদের কাছে আধুনিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি কি প্রধান হয়ে ওঠেনি? আমরা তো বাইরে থেকে এটাই দেখছি। এখন গেজেট নোটিশ দিয়ে রাষ্ট্র বা সরকারের দেয়া সার্টিফিকেট ঘরে বাঁধিয়ে রাখবেন, অসুবিধা কী? দেখেন চাকরি-বাকরি পান কিনা।
প্রশ্ন হচ্ছে, কওমি সনদের স্বীকৃতি বা রাষ্ট্রের কাছ থেকে সার্টিফিকেট পাওয়ার দাবিটি উঠল কেন? উঠেছে, কারণ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের চেয়েও দুনিয়াবি সার্টিফিকেট এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। কোরআন-হাদিসের আলোকে আধ্যাত্মিক শিক্ষা বা কওমি মাদ্রাসার ভাষায় ‘সাচ্চা মুসলমান’ কিংবা সেকুলার ভাষায় ‘আধাত্মিক গুণাবলীতে সমৃদ্ধ প্রকৃষ্ট মানব সন্তান’ তৈরির মধ্য দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ এখন প্রধান লক্ষ্য নয়। কাকে দোষ দেবেন? আমরা পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা ও বাজার ব্যবস্থার মধ্যে বাস করি।
আর এই ব্যবস্থার নষ্টামি এভাবেই মোমিনের নফসে প্রবেশ করে এবং রুহানিয়াতের সদর রাস্তা থেকে মোমিনকে বিচ্যুত করে। যুগে যুগে এভাবেই রুহানিয়াতের পথ থেকে আলেম-ওলেমারা সরে এসেছেন। অনেকে মিন মিন করে বলেছেন, কিন্তু ছাত্ররা তো কওমি সনদের স্বীকৃতি চায়। চাইছে। অল্প কিছু ছাত্র চাইতেই পারে।
তাহলে কওমি আলেম-ওলেমাদের সেই ছাত্রদের বলা উচিত ছিল, বাবারা, তোমরা তাহলে ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত আলিয়া মাদ্রাসায় যাও, কওমি মাদ্রাসায় এত পরিশ্রমের কী দরকার! এই পড়া পড়ে তো তোমরা চাকরি পাবা না।
সরকার ইতিমধ্যেই একটি গেজেট প্রকাশ করেছে। ভালো। কওমি মাদ্রাসার আদৌ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দরকার আছে কি? একে চাকরি-বাকরি পাওয়ার তর্কে পরিণত করাটাই ছিল ভুল। করার কোনো যুক্তি নাই। কারণ কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার উদ্দেশ্য আধাত্মিক শিক্ষা। এটাই সত্যিকারের শিক্ষা। আধ্যাত্মিক শিক্ষা কথাটা শুনতে খুব মিষ্টিক মনে হয়। মোটেও তা না। মানুষের মধ্যে সুপ্ত পরমার্থিক গুণাবলিকে বিকশিত করাই শিক্ষার প্রথম উদ্দেশ্য। কওমি মাদ্রাসা সেই সুনির্দিষ্ট কাজটি করে।
সেটা একটা ধর্মতাত্ত্বিক জায়গা থেকে করা হয়। আধ্যাত্মিক শিক্ষার ক্ষেত্রে মাদ্রাসা কওম বা গণমানুষের প্রত্যাশা মেটাতে পারছে কিনা, সেই তর্ক হতেই পারে। কিন্তু মাদ্রাসায় পড়ে চাকরি-বাকরি পায় না, কারণ এর কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নাই, অতএব রাষ্ট্রের কাছ থেকে কওমি সনদের স্বীকৃতি আদায় করতে হবে, এটা ইবলিসের তর্ক।
কওমি পাস করা ছাত্র অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারল কিনা কিংবা কোনো সরকারি চাকরি পেল কী পেল না সেটা আধ্যাত্মিক শিক্ষার জন্য অবান্তর ও কূট তর্ক। বরং সে সত্যিকার অর্থে পরমার্থিক জ্ঞানে বা রুহানিয়াতের প্রজ্ঞায় আলোকিত হতে পারছে কিনা, সেটাই হচ্ছে তর্কের বিষয়।
কওমি মাদ্রাসার প্রতি আমার নিঃশর্ত সমর্থনের পেছনে পরামার্থিক শিক্ষার গুরুত্বের কথাই আমি বারবার আমার লেখায় বলেছি। মানুষ জন্তু-জানোয়ার নয় যে তার অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থান নিশ্চিত করলে তার অন্তরের তাগিদ নিবৃত্ত হয়। সেই আকুতি সেকুলার ভাষায় পরমার্থে, কিংবা আধ্যাত্মিক ভাষায় রুহানিয়াতে- অর্থাৎ জীবের অতিরিক্ত মনুষ্য সত্তার ভূমিকা নিশ্চিত করার মধ্যে। মানুষের সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠার মধ্যে। কওমি মাদ্রাসা গণমানুষের এই প্রত্যাশা মেটাতে পারছে কিনা তা নিয়ে অবশ্যই তর্ক হতে পারে।
না পারলে কওমি মাদ্রাসার সংস্কার করতে হবে। কিন্তু মাদ্রাসার ছেলেরা চাকরি পায় না, অতএব কওমি মাদ্রাসাকে ‘আধুনিক’ করতে হবে, তাদের সরকারি ‘সার্টিফিকেট’ দিতে হবে, যেন তারা চাকরি-বাকরি করে খেয়ে-পরে থাকতে পারে- ইত্যাদি যারপরনাই কূট তর্ক। শিক্ষা নিয়ে মৌলিক তর্ক থেকে প্রস্থান। যে কারণে একে আমি ঠাট্টা করেই ইবলিসের যুক্তি বলছি। অর্থাৎ মানুষের অসীম পরমার্থিক সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করে তাকে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার গোলামে পরিণত করার ফন্দি। জয় ইবলিস!!
কওমি মাদ্রাসার বিস্তর সমালোচনা হতে পারে। অবশ্যই। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা পাশ্চাত্য সভ্যতা ও পুঁজিতান্ত্রিক শোষণের গোলাম তৈরির কারখানা। কিন্তু শিক্ষার পরিমণ্ডলে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে কওমি মাদ্রাসাই কওম বা গণমানুষের সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিরোধ। এ কারণেই পাশ্চাত্য শক্তি কওমি মাদ্রাসাকে ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর। এখন বোঝা যাচ্ছে, কওমি মাদ্রাসার ভেতর থেকে এর সর্বনাশ ঘটানোর বিপদ তৈরি হয়েছে।
যাকে আধুনিককালে ‘শিক্ষা’ বলা হয় তার প্রধান উদ্দেশ্য মানুষের আত্মিক বিকাশ নয়, বরং পুঁজিবাজারের জন্য দক্ষ শ্রমিক উৎপাদন। এই শিক্ষার অর্থনৈতিক তাগিদ হচ্ছে, পুঁজিবাজারের জন্য দক্ষ শ্রমিক সরবরাহ। কওমি মাদ্রাসার শক্তির প্রধান ক্ষেত্র এর সম্পূর্ণ বিপরীত। বাজারের জন্য গোলাম তৈরি এর উদ্দেশ্য নয়।
এই মাদ্রাসা গণমানুষের অর্থে চলে। গণমানুষের আধ্যাত্মিক প্রত্যাশা মেটায়। আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্র গণমানুষের এই অতি আবশ্যকীয় আধ্যাত্মিক পিপাসা বা চাহিদা মেটাতে অক্ষম। কওমি মাদ্রাসা সেই চাহিদা মেটাবে বলেই আধুনিক বাজার ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের পরিমণ্ডলের বাইরে একান্তই গণমানুষের ‘দান’ বা সহায়তার ওপর টিকে আছে। আর ঠিক সমাজের মধ্যে যারপরনাই সামাজিকভাবে টিকে থাকাই কওমি মাদ্রাসার সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তির জায়গা।
পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার বিপরীতে এবং বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ যেসব সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে, কওমি মাদ্রাসা তার অবিশ্বাস্য কিন্তু দুর্দান্ত নজির। দেওবন্দ ঔপনিবেশিক ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়ে ক্ষান্ত দেয়নি, তার লড়াই নিত্যদিনের সংগ্রাম।
প্রশ্ন হচ্ছে, এখন কওমি মাদ্রসা আধুনিক ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বীকৃতি চাইছে এবং পেয়েছে- এটাই গুরুত্বপূর্ণ বোঝাবুঝির জায়গা। কওমি মাদ্রাসা যা চেয়েছে, শেখ হাসিনা ঠিক সেটাই দিয়েছেন। কওমি মাদ্রাসার সবাই রাষ্ট্রের স্বীকৃতির জন্য কাতর ছিলেন না।
কিন্তু সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেম-ওলেমা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার কারণে সাময়িক পরাজিত হয়েছেন। একদিকে বাহ্যিকভাবে তারা ইসলামবিদ্বেষী সমাজের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের চরম চপেটাঘাত করেছেন। ঠিকই। কিন্তু তাদের নিজেদের দুর্গে ভুল লোকজনদের জন্য জায়গা ছেড়ে দিচ্ছেন। এটা ঠিক না। এখনই তা রুখে না দিলে এর পরিণতি কওমি মাদ্রাসার জন্য ভালো হবে বলে আমি মনে করি না।
তাহলে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে হেফাজতের সন্ধিতে ফরিদ উদ্দীন মাসুদ ও তার অনুসারীগণ আনন্দিত হতে পারেন, কিন্তু কওমি আলেম-ওলেমাদের অতিরিক্ত খুশি হওয়ার কোনো কারণ নাই। কৌশলগত কারণে, বিশেষত এই দুঃসময়ে কওমি সনদ পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে কওমি আলেম-ওলেমাদের মধ্যে যেন কোনো বড় বিভক্তি না ঘটে, সেদিকে যারা সতর্ক নজর রেখেছেন তাদের বিচক্ষণতাকে আমি প্রশংসা করি।
এটা সঠিক কৌশল। কওমি আলেম-ওলেমা ও ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে সার্টিফিকেট পাওয়ার বিষয়টিকে তারা বিভেদের কারণে পরিণত করতে চাননি। চাইছেন না। ঠিকই করেছেন। ফলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাদের বসাকে আমরা সেই আলোকেই বিচার করতে পারি। প্রধানমন্ত্রীর দরবারে অধিকাংশ নেতাই হাজির ছিলেন।
ঐক্যের প্রয়োজনে এই কৌশল ভুল নয়। কিন্তু কওমি সনদের স্বীকৃতিতে অতিরিক্ত উল্লসিত হওয়া এবং একে বিশাল অর্জন গণ্য করে পুরো প্রক্রিয়ার পর্যালোচনা না করা মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
তিন
তাহলে যেসব আলেম-ওলেমা এবং তরুণ কওমি মাদ্রাসার ছাত্র প্রশ্ন করছেন, রক্তের দাগ এখনও শুকায়নি, হেফাজতের দিক থেকে কাজটা ঠিক হল কিনা- তাদের ক্ষোভ ন্যায্য ও গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটা নৈতিক সমালোচনা। বর্তমান সরকারের সঙ্গে সন্ধিকে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ এবং ক্ষোভজনিত নৈতিকতার নিরিখে ভালো-মন্দ বিচার। কিন্তু ওর মধ্যেও অন্তর্নিহিত রয়েছে রাজনৈতিক সমালোচনা। সেটা কী?
এক. ক্ষমতাসীন শক্তি মানবিক অধিকারবিরোধী; তারা বিরোধী দলের ওপর চরম দমন-নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। এখনও। তাহলে এদের কাছ থেকে সনদের স্বীকৃতি কেন? দুই. আলেম-ওলেমা ও কওমি মাদ্রাসাসহ ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের নিষ্ঠুর ও নির্মম দমন-নিপীড়ন চালাতে এই সরকার কুণ্ঠিত নয়।
আগামী দিনে হেফাজতের বিরুদ্ধেও যে তারা তা আবার করবে না তার গ্যারান্টি নাই। তাহলে কিসের আশায় হেফাজত ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে? তিন. এই সরকারকে সত্যিকার অর্থে ‘নির্বাচিত’ সরকার বলা যায় না। এদের ক্ষমতায় থাকাটা শক্তির জোরে, জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে নয়। সরকারের নৈতিক ভিত্তি প্রশ্নবিদ্ধ। এহেন সরকারের কাছ থেকে কওমি সনদের স্বীকৃতি কি কওমি আলেম-ওলেমাদের দিক থেকে অর্জন? নাকি বোঝা? এগুলো গুরুতর প্রশ্ন। এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নাই।
রাজনৈতিক সমালোচনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে। সেটা হল, এটা স্পষ্ট, ক্ষমতাসীন সরকার কওমি সনদের স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চাচ্ছে। সেটা হল, বিএনপি ও অন্যান্য ইসলামপন্থী দলকে আরও বিপর্যস্ত করা। বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের জন্য সেটা ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক?
এটা স্পষ্ট, ক্ষমতাসীনরা হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সন্ধির মধ্য দিয়ে অন্যান্য ইসলামী আন্দোলন বা ধারা থেকে তাদের আলাদা করতে চাইছে। আগামী নির্বাচনে হেফাজতে ইসলামের সমর্থকদের ভোটব্যাংক হিসেবে পাওয়ার ইচ্ছা এখানে অবশ্যই কাজ করছে। সামগ্রিকভাবে বিচার করলে কওমি সনদের স্বীকৃতি ইসলামের হেফাজত নিশ্চিত করবে, নাকি বিভক্তি ও বিভাজন বাংলাদেশে ইতিবাচক ইসলামী আন্দোলনের সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, তা নিয়ে ভাবা দরকার আছে।
বাংলাদেশে প্রধান রাজনৈতিক কর্তব্য হচ্ছে ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা। একইসঙ্গে এই ঐক্যকে দিল্লির আগ্রাসন ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ভিত্তি হিসেবে দাঁড় করানো। প্রশ্ন হল, বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের এই নতুন সম্পর্ক ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দীর্ঘায়িত করার শর্ত তৈরি করতে পারে কি? হ্যাঁ পারে। আগামী দিনে হেফাজতে ইসলামের ভূমিকার ওপর সেটা অনেকাংশেই নির্ভর করবে।
দেওবন্দী নীতি বা উসুল অনুযায়ী কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি অবশ্যই হেফাজতের বিজয়। আমি তাকে অভিনন্দন জানাই। কিন্তু হেফাজতে ইসলামের এই সন্ধি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আরও স্থায়িত্ব দেবে কিনা, তার ওপর নির্ভর করবে হেফাজতের প্রতি গণমানুষের আস্থা ও ভালোবাসার জায়গা ধরে রাখার প্রধান চ্যালেঞ্জ।
আশা করি বিচক্ষণ আলেম-ওলেমারা ভেবে দেখবেন।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন