মার্কিন নির্বাচনী ব্যবস্থার নিয়মেই ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিজয় লাভ করেছেন। তিনি কোনো কারচুপি করেননি। গণতান্ত্রিকভাবেই, এমনকি বিরূপ গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জয়ী হয়েছেন। বলা হচ্ছে, তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগ্য ব্যক্তি নন। এমনকি তাকে পাগল প্রমাণ করারও চেষ্টা চলছে। কয়েকজন সাইকোলজিস্টের বরাতে বলা হয়েছে, তার আচরণের মধ্য দিয়ে নাকি প্রমাণিত হচ্ছে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ। এগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির অভ্যন্তরীণ খেয়োখেয়ির গল্প। দিল্লি কা লাড্ডু। আপনি খেলে পস্তাবেন, না খেলে মজা লস করবেন।
আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নই এবং আমরা মার্কিন নাগরিকও নই। মার্কিন দেশের রাজনীতির অভ্যন্তরীণ খেয়োখেয়ির প্রতি নজর রাখার দরকার আছে; কিন্তু অতি উৎসাহিত হওয়ার কোনো যুক্তি নাই। ভাবার কোনো কারণ নাই যে হিলারি ক্লিনটন এলে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির বিশেষ হেরফের হতো। যারা ভেবেছিলেন হিলারি ক্লিনটন এলে ডক্টর ইউনূসের বন্ধু বলে শেখ হাসিনাকে কষে শায়েস্তা করবেন, বোঝা যায় তারা মুড়ি খেতে খেতে গালগল্প করতে ভালোবাসেন। রাজনীতি, বিশেষত বিশ্ব রাজনীতি এত পান্তাভাত না। তাছাড়া যুদ্ধবাজ হিসেবে হিলারির কুখ্যাতি আছে, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ও হত্যাযজ্ঞের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা রয়েছে। বারাক ওবামার আমলে ড্রোন হামলায় নিরীহ নারী-পুরুষ হত্যার সংখ্যা কম নয়। তার আমলেই আইসিসের উত্থান ঘটেছে এবং সিরিয়াকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বিচার করতে গেলে নানান দিক থেকে বিচার করতে হবে। সামগ্রিকভাবে বিচার করার সামর্থ্য অর্জন করা দরকার। কালো মানুষ হিসেবে বারাক ওবামাকে মার্কিন দেশের কৃষ্ণাঙ্গদের লড়াই-সংগ্রামের আলোকে আমরা দেখি, সেটা অন্যায় কিছু নয়। কিন্তু ভুলে যাই তিনি কালোদের নেতা নন, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। হিলারি ক্লিনটনকে যতই নারী বলে মনে রাখি না কেন, তিনি একইসঙ্গে যুদ্ধবাজ, ইসরাইলবান্ধব এবং মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী। ডোনাল্ড ট্রাম্প ভিন্ন হবেন এটা দাবি করছি না; কিন্তু হিলারির প্রতি আমাদের বিশেষ পক্ষপাতের কারণ আছে বলে মনে করার যুক্তি নাই। এতটুকুই শুধু মনে করিয়ে দিচ্ছি।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ে গরিব ও পুঁজির প্রান্তসীমার দেশগুলোর কী হাল হতে পারে সেটাই আমাদের জন্য বাস্তবসম্মত প্রশ্ন হতে পারে। ট্রাম্পের প্রতি আমাদের বিশেষ ভালোবাসা থাকার কথা নয়, বাংলাদেশ বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রান্তসীমার একটি দেশ। ট্রাম্পের ইসলামবিদ্বেষ এবং ক্ষমতায় আসার পরপরই সাতটি মুসলিমপ্রধান দেশ থেকে অভিবাসীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা তার প্রতি আমাদের নজর আরও ঘনিষ্ঠ করতে বাধ্য করেছে। কিন্তু লিবারেলিজম মার্কিন সমাজের বর্ণবাদ ও যুদ্ধবাজ সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রের ওপর লিপস্টিক মাখে। তার চেয়ে খোলামেলা ডোনাল্ড ট্রাম্প আমাদের জন্য খারাপ না। তার দক্ষিণপন্থী চিন্তা মার্কিন লিবারেল বা উদারবাদীদের দুশ্চিন্তার কারণ বটে, কিন্তু একইসঙ্গে সেটা পচে যাওয়া লিবারেলিজম সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করে। আমাদের প্রথাগত অনুমানগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সমাজ, সংস্কৃতি, রাষ্ট্র, বিশ্বব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। সে কারণে মার্কিন দেশে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতা অর্জন সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ধর্ম, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এই ‘বিজয়’ গুরুত্বপূর্ণ মেরুকরণ ও পরিবর্তনের সূচনা।
পরিস্থিতি বদলাচ্ছে
ট্রাম্প জিতলে দ্রুত কিছু পরিবর্তন ত্বরান্বিত হবে যারা বলেছিলেন, তাদের ট্রাম্প আশাহত করেননি। তিনি প্রেসিডেন্টের গদিতে বসার এক সপ্তাহের মধ্যেই একটা মেমোরেন্ডামে স্বাক্ষর দিয়েছেন যাতে Trans-Pacific Partnership (TPP) চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিযুক্ত হয়। ব্রেক্সিটের পর বিলাতের সঙ্গে মার্কিনিদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক কী হতে পারে সে বিষয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে-র সঙ্গে তিনি ইতিমধ্যেই কথাবার্তা শুরু করে দিয়েছেন। জাতিসংঘে তার নতুন দূত নিকি হ্যালি ইতিমধ্যেই সংস্থাটির সংস্কারের কথা বলেছেন। সবাইকে এই বলে শাসিয়েছেন যে, যারা আমাদের পেছনে নাই, আমরা তাদের নাম টুকে নিচ্ছি। সেই পুরনো বুশীয় হুমকি-ধামকি! তোমরা হয় আমাগো লগে, নইলে আমাগো দুশমনদের খাতায়, মাঝখানে কোনো অলিগলি নাই। তো এসব গরম গরম ঘটনা ঠাণ্ডা হওয়ার আগেই তিনি আরেকটি বোমা ছুঁড়লেন। মার্কিন দেশে মুসলমান প্রবেশ করতে পারবে না। সাতটি দেশের নামও তার নিষিদ্ধ তালিকায় রেখেছেন। এসব দেশে বোমা মেরে যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ হত্যা করা, ড্রোন উড়িয়ে আকাশ থেকে গুলি-বোমা চালিয়ে নিরীহ মানুষ খুন এবং বিপুল শরণার্থী সংকট তৈরি করেছে মার্কিনিরাই। এতে দুনিয়াজুড়ে সমালোচনা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের এয়ারপোর্টে বৈধ ভিসা বা গ্রিনকার্ডওয়ালাদের মার্কিন ইমিগ্রেশন ঢুকতে না দেয়ায় বিক্ষোভ হচ্ছে। সমালোচনার মুখে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সাফাই গাইতে হচ্ছে। এই নির্বাহী আদেশ, মার্কিনি পরিভাষায় ‘এক্সট্রিম ভেটিং’ বলে পরিচিত। তবে ফেডারেল কোর্ট ট্রাম্পের এই নির্বাহী আদেশ স্থগিত রেখেছে।
আজ আমি যে কথা এই লেখায় বলতে চাইছি তা হল, ডোনাল্ড ট্রাম্পকে গালি দেয়া সহজ; কিন্তু বিশ্বব্যবস্থার এই নয়া সিম্পটম বোঝা ততো সহজ নয়। সেটা বুঝতে হলে পুরো ব্যবস্থাকে বোঝার দরকার পড়ে। সেটা গবেষণার বিষয় বটে, পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায় বোঝানোর ব্যাপার নয়। অর্থাৎ এতটুকুই আপাতত বলা যে, পুঁজির প্রান্তের দেশে থেকেও এই সিম্পটম নিয়ে বিস্তর গবেষণার দরকার আছে। ট্রাম্প মার্কিন দেশে হাওয়া খেয়ে জয়ী হয়ে আসেননি, তার সমর্থক আছে। তারা কম নয়। তাদের শক্তিও কম নয়। ট্রাম্প বিশ্বে রসিকতা করার জন্য হাজির হননি। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ভূমিকা সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতা আছে। মার্কিন গণমাধ্যম ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যেসব প্রচার-প্রপাগান্ডা চালায় তাকে বাছবিচার করেই আমাদের বুঝতে হবে। তাদের ভূমিকাও বাংলাদেশের গণমাধ্যমের তুলনায় বিশেষ ভিন্ন নয়। ট্রাম্প মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার দোস্তালি পাননি, তাকে সোশাল মিডিয়ার ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। ট্রাম্পের বিজয় একদিক থেকে সোশাল মিডিয়ার শক্তি সম্পর্কেও আমাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। ট্রাম্প একে সফলভাবেই ব্যবহার করেছেন।
কথাগুলো বলা দরকার এ কারণে যে, প্রপাগান্ডা বা বাহ্যিক খবরাখবরের বাইরে অনেক তথ্য ও সত্য আছে, যা নির্মোহ গবেষণা করেই খুঁজে বের করা দরকার। ট্রাম্পের বর্ণবাদী সিদ্ধান্ত, নারী অধিকারবিরোধিতা, মুসলিমবিদ্বেষ কিংবা মার্কিন সংবিধানবিরোধী অবস্থানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের নিজস্ব রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। কেউ সঠিক কী বেঠিক সেই বিচার সাময়িক লড়াইয়ের দিক থেকে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যেদিকে বিশেষভাবে নজর দেয়া দরকার সেটা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং তার সঙ্গে বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার দ্বন্দ্ব ও মিলের জায়গাগুলো। বিশ্বব্যবস্থার সিম্পটম হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বুঝতে হলে বিশ্বব্যবস্থা কোথায় যাচ্ছে, তার সম্ভাব্য পরিণতি কী হতে পারে সে ব্যাপারে কিছু আগাম বোঝাবুঝি সম্পন্ন করা জরুরি। সামগ্রিকভাবে বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে কোথায় কী ঘটছে এবং তার সঙ্গে ট্রাম্প নামক উপসর্গের উৎপত্তি কীভাবে সেসব প্রশ্ন তোলার আগ্রহ তৈরি করাই আজকের লেখার উদ্দেশ্য। এ দিকটি বোঝা গেলে একইসঙ্গে বিশ্বব্যাপী ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের তাৎপর্য বোঝা সহজ হবে।
বাহ্যিক ঘটন-অঘটন এবং তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দিয়ে ট্রাম্পকে বোঝা যাবে না। কেন বোঝা যাবে না তার যুক্তি হিসেবে বলা যায়, ট্রাম্প আপাতদৃষ্টিতে এ যাবৎকাল চলে আসা নিউ লিবারেল ইকোনমিক পলিসি বা যাকে বাংলায় আমি কাছাখোলা অবাধ বাণিজ্যনীতি বলে থাকি, তিনি তার বিরুদ্ধের লোক। এটা তথাকথিত বামপন্থী নীতি বা অবস্থান। যেমন বামরাই ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপের (টিপিপি) বিরুদ্ধে ছিলেন। এখন সাদা বর্ণবাদ বা জাতিবাদী অবস্থান থেকে ট্রাম্প টিপিপির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, সাদাদের বর্ণবিদ্বেষ নতুন কিছু নয়, লিবারেলিজম যার ওপর স্যুট-টাই পরিয়ে ভদ্রলোক করে রাখে। সেদিক থেকে যারা মার্কিন দেশের আদিবাসীদের হত্যা করে সেটেলার আমেরিকা গড়ে তুলেছে, সেই মার্কিন সভ্যতা ও রাষ্ট্রের ভিত্তি বর্ণবাদ। কিন্তু বোঝা দরকার বর্ণবাদ বা জাতিবাদ দিয়ে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থায় অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকা কঠিন। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টিকে থাকতে হলে সস্তা শ্রমের জোগান দরকার, অভিবাসীরা সেই চাহিদা মেটাচ্ছিল। তাহলে মার্কিন অর্থনীতিতে কী এমন ঘটনা ঘটেছে যাতে এর প্রয়োজনীয়তার কথা জেনেও ট্রাম্প সাদা ‘মধ্যবিত্ত’ শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে বিদেশী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন?
সাদা চোখে আমরা বুঝি, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের বিজয় সাদা আমেরিকার দক্ষিণপন্থী বর্ণবাদী মানুষদের বিজয়। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধংদেহি রণমূর্তি, নারীদের নিয়ে রং-তামাশামূলক অপমানজনক কথাবার্তা, এগুলো তো আমরা জানি। এগুলো মিথ্যা নয়। কিন্তু এগুলো বাইরের দিক। ভেতরের দিকটা একাট্টা কিছু নয়, তাকে নানান দিক থেকে বোঝার দরকার আছে। যে দিকটার ওপর বিশেষভাবে নজর দেয়ার দরকার সেটা হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি। আজ শুধু তার দু’-একটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করব, যাতে সাদা ও বর্ণবাদী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিদেশী, বিশেষভাবে বিদেশী শ্রমিকদের অভিবাসন বিরোধিতার কারণ আমরা কিছুটা আন্দাজ করতে পারি। যাতে তাদের বোঝানো যায় বহুজাতিক কোম্পানি নয়, বরং বিদেশী শ্রমিকদের কারণেই সাদা শ্রমিকদের আয় বাড়ছে না। মার্কিন অর্থনীতিতে বহুজাতিক কোম্পানি বিনিয়োগ করছে অধিক মুনাফার জন্য পুঁজির নিজস্ব কারণে। ট্রাম্পের ধারণা, তিনি নির্বাহী আদেশ দিয়ে পুঁজির ধর্ম ঠিক করতে পারবেন। অর্থাৎ তিনি কোম্পানিগুলোকে আদেশ দিলেই তারা চীন দেশে কম দামে পণ্য উৎপাদন না করে মার্কিন দেশে উচ্চ হারে মজুরি দিয়ে বিনিয়োগ করবে। এটা যে তারা করবে না ট্রাম্প সেটা জানেন না তা নয়, তিনি বাতাসে বড় হননি। আসলে তিনি মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থরক্ষা করতে চাইছেন, তাদের অতি মুনাফা মার্কিন দেশে চাকরিজীবী মধ্যবিত্ত ও শ্রমিকের আয়-উপার্জনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যা তিনি সচেতনভাবেই আড়াল করতে চান। মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থরক্ষা করতে গিয়েই ট্রাম্প বহুজাতিক কোম্পানির ওপর দোষারোপ না করে অভিবাসনবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। এই সারকথাটা আমরা বুঝলে মার্কিন রাজনীতির আর্থ-সামাজিক দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রটা খানিক ধরতে পারব।
বিশ্ব অর্থনীতি ও বহুজাতিক কর্পোরেশন
গত তিন দশকব্যাপী বিশ্ব অর্থনীতির ফলাফল হিসেবে যে দিকটায় অর্থনীতির গবেষকরা জোর দিচ্ছেন সেটা হল কর্পোরেশনগুলোর মুনাফার অবিশ্বাস্য স্ফীতি। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বাইরে থাকা বিভিন্ন দেশে, যেখানে প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক কিছুটা হলেও অবশিষ্ট ছিল, তারা পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের বিস্তারের মুখে ছারখার হয়ে গিয়েছে। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের বিস্তারও ঘটেছে অসম্ভব দ্রুততায়। সাধারণ মানুষ অনিশ্চয়তায় ভুগেছে, বিভিন্ন দেশ তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সচল রাখতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছে, কিন্তু এ সময় কর্পোরেশন, বিশেষত বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর জন্য ছিল রমরমা অবস্থা। তাদের সামনে নতুন নতুন বাজার খুলে গিয়েছে, অথচ অন্যদিকে কর্পোরেট ট্যাক্স, টাকা ধার নেয়ার খরচ কিংবা ঋণের মূল্য বা সুদ, শ্রমিকের মজুরি, মেশিনপত্র ও টেকনোলজি সবকিছুরই দাম বেড়েছে হু হু করে।
শুরুতেই সাধারণ পাঠকরা মনে রাখতে পারবেন এমন একটি পরিসংখ্যান দিয়ে শুরু করি। ১৯৮০ সালের পর থেকে ধনী ও শিল্পোন্নত দেশের শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের আয়ে যে আনুপাতিক হ্রাস ঘটেছে তার একটি চিত্র।
দেশ ১৯৮০ ২০১২
ফ্রান্স ৮০ ৬৯
ইটালি ৭৯ ৬৯
জার্মানি ৭৬ ৬১
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৭০ ৬৪
জাপান ৭৩ ৬১
গড় ৭৬ ৬৬
অর্থাৎ ১৯৮০ সালে মার্কিন শ্রমজীবী জনগণ যদি জাতীয় আয়ের একশ’ ডলারের মধ্যে ৭০ ডলার পেয়ে থাকেন, এখন তার ভাগ্যে জুটছে মাত্র ৬৪ ডলার। চামড়া পোড়ে এমন পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। ট্রাম্পকে কেন্দ্র করে যে বর্ণবাদী রাজনীতি গড়ে উঠেছে, তার শেকড়ের সূত্রটা এখানে। ট্রাম্প তাই বলছেন, তিনি মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে বাঁচাতে চান। সাদা মধ্যবিত্ত শ্রেণী সেই ডাকে সাড়া দিয়েছে। সাড়া দেয়ার অর্থনৈতিক শর্ত যে রয়েছে সেটা এই ছোট পরিসংখ্যানেই আমরা বুঝি। এই পরিসংখ্যান থেকে আমরা বুঝতে পারি বর্ণবাদ ফ্রান্স, ইটালি, জার্মানিতেও মাথাচাড়া দিচ্ছে কেন।
অর্থনীতি বিষয়ে কিছু গবেষণাজাত পরিসংখ্যান পাওয়া যায়। যদি ১৯৮০ থেকে ২০১৩ সালকে একটি অর্থনৈতিক কালপর্ব ধরি, তাহলে বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানির আয় তিনগুণ বেড়েছে। এটা সুদ ও আয়কর দেয়ার আগে। বিভিন্ন দেশে এর হারও আলাদা। যদি বিশ্ব অর্থনীতির গড় প্রবৃদ্ধির আনুপাতিক হিসাবে ধরা হয়, তাহলে ১৯৮০ সালে ছিল ৭.৬ শতাংশ, এই অনুপাত ২০১৩ সালে এসে ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যদি সুদ, খাজনা ইত্যাদি বাদ দেয়া হয় তাহলে বহুজাতিক কোম্পানির নিট লাভ বিশ্ব অর্থনীতির গড় প্রবৃদ্ধির অনুপাতের হিসাবে ১৯৮০ সালের তুলনায় ২০১৩ সালে বেড়েছে ৭০ শতাংশ। অর্থাৎ বিশ্বজুড়ে বহুজাতিক কর্পোরেশনের আর্থিক শক্তি বেড়েছে বিপুলভাবে। সারা দুনিয়ার যে প্রবৃদ্ধি হয় তার ১০০ টাকার ১০ টাকাই পুঞ্জীভূত হয় বহুজাতিক কোম্পানির হাতে। যেসব কোম্পানি এই বিপুল মুনাফা কামাচ্ছে, তাদের হেড অফিস কোনো না কোনো ধনী দেশে, যাদের আমরা ‘পরাশক্তি’ বলে চিনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেসব বহুজাতিক কোম্পানির হেড অফিস দেখা যায়, গড়ে তারা ১৯৮০ সালে মোট বিক্রি থেকে ৫.৬ শতাংশ হারে মুনাফা কামাত। সেটা ২০১৩ সালে ৯ শতাংশ হয়েছে। মুনাফার হারের এই উল্লম্ফন বিশ্ব অর্থব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ সূচক। মনে রাখতে হবে, আমরা মুনাফার হার নিয়ে কথা বলছি, পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতিতে পুরো ব্যবস্থার মধ্যে মুনাফার হারই নির্ধারক ভূমিকা পালন করে। ইউরোপের শহরগুলোতে হেড অফিস আছে এমন কোম্পানিগুলোও ১৯৮০ সালের সময় থেকে ভালোই করছিল। তাদের মন্দা দেখা দিয়েছে ২০০৮ সালের পর থেকে। চীন, ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোম্পানিগুলোও মন্দ করেনি, তবে আয়ের দিক থেকে তাদের বৃদ্ধি ঘটেছে, তুলনায় মুনাফার হারে অতটা নয়।
মুনাফার বৃহৎ অংশই গিয়েছে বড় বড় কর্পোরেশনের ভাগে, যাদের বছরে বিক্রি এক বিলিয়ন ডলার স্পর্শ করে বা ছাড়িয়ে যায়। বেচাবিক্রির ৬০ ভাগই তারা করে। তাদের মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশনের অনুপাত শতকরা ৬৫ ভাগ, আর সব কোম্পানি মিলে যত মুনাফা কামায় তার ৭৫ ভাগই যায় তাদের খাতায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বছরে বেচাবিক্রি ১০ বিলিয়ন ডলার, তারা ১৯৯০ সালে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মোট মুনাফার ৫৫ শতাংশ আত্মসাৎ করেছে, আর ২০১৩ সালে করেছে ৭০ শতাংশ। দুনিয়ায় যত কোম্পানির নাম আমরা জনসাধারণ চিনি-জানি কিংবা তাদের তালিকা পাই, তাদের একশ’টির মধ্যে মাত্র দশটি কোম্পানি পায় দুনিয়াব্যাপী পুঞ্জীভূত মুনাফার শতকরা ৮০ ভাগ। অর্থাৎ একশ’ টাকা মুনাফার ৮০ টাকা পায় মোট কোম্পানির মাত্র শতকরা দশটি। এদের উপরের চাঁইগুলোকে হিসাবে ধরলে দেখা যায়, একশ’ ডলার মুনাফার ৮০ ডলারই যায় তাদের পকেটে।
বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগের নতুন প্রবণতা ইন্টারেস্টিং। তারা তাদের আয় বা মুনাফা ফের বিনিয়োগ করতে চাইছে না। বরং তাকে তরল রাখছে। সুবিধা হচ্ছে, এতে ডলার নগদানগদি শেয়ার মার্কেটে খাটানো যায় এবং দ্রুত মুনাফা কামানোর সুযোগ পাওয়া যায়। সেই সুযোগ বেড়েছে। এর ফল হয়েছে এই যে, ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলোয় কলকারখানা বাড়েনি, শিল্পোন্নয়নের অগ্রগতি তুলনামূলকভাবে কমেছে, বিনিয়োগের ক্ষেত্র সরে গিয়েছে তৃতীয় বিশ্বের মতো দেশে। এর পরিণতি হিসেবে বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফার হার বাড়লেও সেখানে শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের আয়ের কোনো উন্নতি হয়নি। তাদের কাজের অবস্থারও কোনো উন্নতি হয়নি।
এ অবস্থাটাও বহুজাতিক কোম্পানির পক্ষে গিয়েছে, তাদের বিনিয়োগে আগ্রহী করার জন্য কর্পোরেট ট্যাক্স কমানো হয়েছে, তারা কর সুবিধা পেয়েছে বিপুল। অন্যদিকে এক দেশের শ্রমিককে অন্য দেশের শ্রমিকের বিরুদ্ধে সময়ে-অসময়ে লাগিয়ে দিয়ে তারা মজুরির দামও কমাতে পেরেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে সাধারণভাবে অভিবাসন এবং বিশেষভাবে অভিবাসী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে যে বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়া আমরা দেখছি, তার পেছনে কর্পোরেট অর্থনীতির যোগ রয়েছে। এই দিকটা বোঝা খুবই দরকারি।
কিছু বিষয় আগামী বিভিন্ন লেখায় আরও স্পষ্ট করার প্রয়োজনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে আজ শেষ করি।
১. বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অল্প কয়েকটি বহুজাতিক কর্পোরেশনের মুনাফাকারী ভূমিকা নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র, বিশেষত ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলোর রাষ্ট্র, সমর ব্যবস্থা এবং মতাদর্শিক বয়ানের ভূমিকা এ কালের বিশ্ব রাজনীতি বোঝার প্রধান চাবিকাঠি। এ লড়াইয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যে হাতিয়ার ব্যবহার করে তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে মারণাস্ত্র তৈরির কোম্পানি ও ব্যাংক। অর্থাৎ সমরাস্ত্র ও মুদ্রা ব্যবস্থা। এমন এক মুদ্রা ব্যবস্থা, যা কার্ল মার্কসের ভাষায় ‘ফিক্টিশিয়াস’ বা ভুয়া। তাহলে ‘মুদ্রা’, ‘পুঁজি’ এবং আন্তর্জাতিক বিনিময় মাধ্যম হিসেবে ‘ডলার’ কথাটার আসলে কী মানে, সেটা নতুন করে পর্যালোচনা ছাড়া বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার কিছুই আমরা বুঝব না।
২. টাঁকশালে ডলার ছাপানো এবং তাকেই বিশ্ব বিনিময়ের একমাত্র কাগজ হিসেবে বহাল রাখার সাফল্যের ওপর সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের টিকে থাকা না থাকা নির্ভর করে। আর সেটা টিকিয়ে রাখার জন্যই বিশাল মারণাস্ত্র ইন্ডাস্ট্রি ও সৈন্যসামন্ত দরকার। যুদ্ধবিগ্রহ নিত্য ঘটনা হতে বাধ্য। বর্তমান আধুনিক রাষ্ট্র এই ব্যবস্থার অধীনস্থ প্রতিষ্ঠা, ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প একটা যুদ্ধ লাগাবেন, কথাটা আজকাল জোরেশোরে বলা হচ্ছে। সেটা অমূলক নয়। কারণ বহুজাতিক কোম্পানি যুদ্ধের মধ্যে মুনাফা দেখে, মানুষের রক্ত কিংবা লাশ দেখে না।
৩. বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই স্বল্প কয়েক বহুজাতিক কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম থেকে আলাদা কিছু নয়। সামগ্রিকভাবে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এটি একটি নতুন পর্ব মাত্র। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের স্বার্থেই বিশ্বব্যবস্থার দ্বন্দ্বকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে পর্যবসিত করেছে।
আশা করি এ বিষয়গুলো নিয়ে আমরা আরও লেখালিখি করতে পারব।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন