দাভোসে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে ক্লাইমেট চেইঞ্জের ‘পাদ্রি’ আল গোর শেখ হাসিনাকে ধর্মকথা শোনাতে চেয়েছিলেন। শেখ হাসিনা শুনলেন না। মুখের ওপর বলে দিলেন, ‘আমি বুঝতে পারি না কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে কেন মানুষ কথা বলে ... আমার মনে হয় যারা রামপালের বিরোধিতা করছেন তাদের মানুষের প্রতি দরদ নাই, বরং তারা সুন্দরবন ও রয়েল বেঙ্গল টাইগার নিয়েই বেশি উদ্বিগ্ন’। মানুষের প্রতি দরদ? আল গোর আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন, হেফাজতে মৃত্যু ইত্যাদি নিয়ে লেকচার দিতে পারতেন, তবে তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রেকর্ড এতই খারাপ যে কিছু বলার সুযোগ ছিল না।
বিল ক্লিনটন যখন প্রেসিডেন্ট, আল গোর তখন মার্কিন মুল্লুকের ৪৫ নম্বর ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি কর্পোরেট মার্কিন সাম্রাজ্যও চান আবার আকাশ ফুটা করা গ্রিন হাউসের ক্ষতিও রোধ করতে চান। আসমান ফুটা হওয়ার বিরুদ্ধে কথা বলেন বলে আল গোরের পরিবেশবান্ধব ভাবমূর্তি আছে। মার্কিন মূলধারার রাজনীতির অধীনে থেকে যতটুকু সম্ভব পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে আল গোর কথা বলেন, কাজ করেন, তাকে খাটোভাবে দেখা ঠিক না। একসময় তিনি ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইন্সটিটিউটের বোর্ড অব ডিরেক্টর্সে ছিলেন; এখন নিজের প্রতিষ্ঠিত ‘এলায়েন্স ফর ক্লাইমেট প্রটেকশন’-এর প্রধান। জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৭ সালে ইন্টারগভর্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেইঞ্জ-এর সঙ্গে নোবেল পুরস্কারও পেয়েছিলেন। ফলে তার মুখের ওপর কথা বলে আসা খুব চাট্টিখানি কথা নয়।
দাভোসের কংগ্রেস সেন্টারে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘লিডিং দ্য ফাইট অ্যাগেইনস্ট ক্লাইমেট চেঞ্জ’ শিরোনামের প্লেনারি সেশনে পাশাপাশি বসা দুইজনের বক্তব্য উপভোগ করেছি। কে ঠিক কে বেঠিক সেই তর্ক এখানে অবান্তর। যুক্তিতে নয়, দুইজনেরই উদ্দেশ্য ছিল নিজেকে উচ্চস্তরের নীতিবান প্রমাণ করে প্রতিপক্ষের তুলনায় নিজ নিজ শ্রোতাদের বেশি প্রশংসা আদায় করা। একজন পরিবেশবাদী, অপরজন উন্নয়নবাদী। আফটার অল, দুজনেই রাজনীতিবিদ, তাদের নিজ নিজ কন্সটিটিউন্সির সমর্থন মজবুত করাই তাদের উদ্দেশ্য হবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নাই। শেষাবধি তর্কে পরিবেশ ও উন্নয়নের বিরোধটাই আরও প্রকট হয়ে উঠল। এ লেখার উদ্দেশ্য এ প্রকটতার চরিত্রটি বোঝার চেষ্টা করা।
আল গোর কিছু তথ্য দিয়েছেন যা কম-বেশি আমাদের জানা। তার মুখ থেকে শোনার অর্থ হচ্ছে সারা বিশ্বে বিষয়গুলো নিয়ে কথা হচ্ছে; এটা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত সৌরশক্তির প্যানেল স্থাপনকারী দেশ ছিল। আল গোর বলেছেন, তার গতি এখন ধীর হয়ে গেছে। তার মানে বিকল্প বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে বাংলাদেশ ঠিকই এগিয়ে যাচ্ছিল; কিন্তু তা থামিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে চাইছে। তিনি শেখ হাসিনাকে বলেছেন, ‘আমার পরামর্শ হল, পরিবেশ দূষণকারী ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ বন্ধ করুন। এর পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের হার দ্রুত করতে দ্বিগুণ উদ্যোগে কাজ শুরু করুন; ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে মুহাম্মদ ইউনূসের সংগঠনসহ বাংলাদেশের অন্যান্য বেসরকারি সংস্থা নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছে’।
দেখা যাচ্ছে, আল গোর শুধু নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের জন্য মন্তব্য করেননি। বলেছেন, সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প দ্রুতগতিতে স্থাপিত হওয়ার কৃতিত্ব ক্ষুদ্র ঋণওয়ালাদের, বিশেষত গ্রামীণ ব্যাংকের। আমরা জানি ডেমোক্রেটরা ডক্টর ইউনূসের বন্ধু বা মিত্র। অতএব আল গোরের কথায় অবাক হওয়ার কিছু নাই; কিন্তু আল গোর সৌরবিদ্যুতের জন্য ফটোভল্টাইক প্যানেল চাইছেন ব্যাপারটা এত সিধা সরল না। তিনি চান ক্ষুদ্র ঋণ। তার পরামর্শ হল সৌর প্যানেল স্থাপন ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের মধ্য দিয়ে এনজিওগুলোর সহায়তায় হোক। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ঋণ আর এনজিওগুলোর দিয়ে বিদ্যুতের অভাব পূরণ করুক, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান করুক, সেটাই তিনি চাইছেন। দারুণ পরামর্শ!
রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যারা বিরোধী তারা শেখ হাসিনার বিপরীতে আল গোরকে পেয়ে যে মাত্রায় খুশি, আমি সেই মাত্রায় খুশি হওয়ার কোনো কারণ দেখিনি। এজন্য নয় যে, আল গোর ভুল বলছেন, কিংবা অযৌক্তিক কিছু বলছেন; কিন্তু তিনি আংশিক বলেছেন। পুঁজিতান্ত্রিক ভোগী জীবনব্যবস্থার সঙ্গে প্রকৃতি ও প্রাণের বিনাশের অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ রয়েছে। হয়তো অতি ভোগের কথা আল গোর বলেন, আমি তার লেখার একনিষ্ঠ পাঠক; কিন্তু ভোগী জীবনের সঙ্গে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের সম্বন্ধ বিচার করবার মানুষ আল গোর নন। সেটা বলাই বাহুল্য। তার অবস্থান বোঝার জন্য এটা খুবই আংশিক একটি দিক। রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরোধিতা বাঘ আর সুন্দরবন বাঁচাবার বিরোধিতা, বড়জোর একটি বিশেষ ধরনের টেকনোলজির বিরূপ সমালোচনা; কিন্তু খোদ ইন্ডাস্ট্রিয়াল জীবনব্যবস্থাই তো গড়ে উঠেছে কয়লা জ্বালানির ওপর ভিত্তি করে। তার বেলা? তাহলে এই জীবাশ্মভিত্তিক তথাকথিত সভ্যতার সমালোচনা ও পর্যালোচনা ছাড়া বাঘ আর সুন্দরী গাছের জন্য আন্দোলন, প্রাণ ও প্রকৃতি রক্ষার রাজনীতি নয়। যে কারণে সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন শহুরে রোমান্টিসিজমের অধিক অগ্রসর হতে পারেনি। কিন্তু রোমান্টিকতার পর্যালোচনা, আমাদের আবেগ, কল্পনা রোমান্টিকতাকে নিন্দা করবার জন্য নয়, বরং পুরো বিষয়টি আত্মস্থ করাই আমাদের উদ্দেশ্য। আমি চাই সামগ্রিকতায় বিষয়গুলো উত্থাপিত হোক।
সংক্ষেপে আল গোরের জাতীয় পরিবেশ সচেতনতা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। যাতে পাশ্চাত্যের পরিবেশ চিন্তার সঙ্গে মৈত্রী ও বিরোধ উভয় দিকটাই খেয়ালে রাখা সম্ভব হয়। খেয়াল করতে হবে, আল গোর একবারও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কথা বলেননি। কেন? যিনি রামপাল নিয়ে উদ্বিগ্ন, তিনি রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প সম্পর্কে নিশ্চুপ। এ কেমন কথা?
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাবটা পুরনো। তবে সম্প্রতি ২০০৯ সালের বাংলাদেশ সরকার আবার রাশিয়ার সঙ্গে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কথাবার্তা শুরু করে আর একই বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক বা গঙট (গবসড়ৎবহফঁস ড়ভ টহফবৎংঃধহফরহম) সই করে। প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য ২০১০ সালের ২১ মে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ ও রাশিয়ান ফেডারেশনের মধ্যে পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারবিষয়ক একটি ঋৎধসবড়িৎশ চুক্তি মস্কোতে সই করেছে বাংলাদেশ। এরই ফল হচ্ছে ২৫ ডিসেম্বর ২০১৫ সালে পাবনার রূপপুরে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার জন্য রাশিয়ার এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সই করা। চুক্তি বাস্তবায়নের সময়কাল ধরা হয়েছে ৭ বছর। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ২০২৩ সালে প্রথম ইউনিট এবং ২০২৪ সালের অক্টোবরে দ্বিতীয় ইউনিটের উৎপাদনের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির মেয়াদকাল হবে ৬০ বছর।
নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের প্রথম প্রস্তাব করা হয় ১৯৬১ সালে পাকিস্তান আমলে। ইসলামী পারমাণবিক শক্তি বৃদ্ধির প্রকল্প হিসেবে। এসময় সরকার ২৫৩ দশমিক ৯০ একর জমি বরাদ্দ দেয়। ১৯৬৪ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য যন্ত্রপাতি বাংলাদেশের উদ্দেশে জাহাজে করে পাঠানো হয়েছিল; কিন্তু সেই জাহাজ আর সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে আসেনি। চট্টগ্রাম বন্দরে না ভিড়ে জাহাজ করাচিতে ভিড়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিষয়ে আলোচনা হলেও কোনো ফলাফল পাওয়া যায়নি। তো ইসলামী প্রকল্পই এখন রুশ প্রকল্প হয়ে ভোল বদলে ফিরে এসেছে।
যেখানে সারা পৃথিবীতে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের বিরোধিতা চলছে, সেক্ষেত্রে আল গোর সুন্দরী গাছ আর বেঙ্গল টাইগারের জন্য যতটা উদ্বিগ্ন, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের বিপর্যয়ে বাংলাদেশের জনগণের সমূহ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা নিয়ে মোটেও বিচলিত নন। কেন? না, অবাক হওয়ার কিছু নাই। তিনি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পক্ষের লোক। তার একটি বক্তৃতা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি। তিনি বলছেন, ‘আমি যদিও নিউক্লিয়ার পাওয়ারের বিরোধী না, এবং পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার কিছুটা বাড়ুক সেটা আমার প্রত্যাশা; কিন্তু প্রায় সব দেশেই পারমাণবিক শক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, আমার তাতে সংশয় আছে’। While I am not opposed to nuclear power and expect to see some modest increased use of nuclear reactors, I doubt that they will play a significant role in most countries as a nwe source of electricity- 'A planetary Emergency' by AlGore 18 September 2016’
পারমাণবিক শক্তি কেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে না সেটা টেকনোলজি বা মানবিক বিপর্যয়ের ভয়াবহতা নয়। আল গোরের কাছে সেটা একান্তই বিপুল খরচের সমস্যা। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট খুবই ব্যয়সাপেক্ষ বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। সব দেশের পক্ষে তার জোগান সম্ভব নয়। সে কারণেই তিনি এর ব্যবহার সীমিত হবে বলে মনে করেন। (দেখুন, ‘AlGore: nuclear power will play 'limited role' in future energy mix’)। আল গোরের বাবা সিনেটর আল গোর, সিনিয়র ‘জয়েন্ট কমিটি অন এটমিক এনার্জি’র সদস্য ছিলেন। একবার তিনি একটা বিল পাস করতে চেয়েছিলেন সেখানে তার প্রস্তাব ছিল এটমিক এনার্জি কমিশন বেশ কয়েকটি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট স্থাপন করুক, যাতে বিনিয়োগকারীরা এ টেকনোলজির বাণিজ্যিক সম্ভাবনার প্রতি আগ্রহী হয়। তিনি টেনেসির সিনেটর ছিলেন।
শেখ হাসিনাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করবার কোনো পরামর্শ দেননি। এখন রামপালের ব্যাপারে তার পরামর্শকে আপনি কতটা সিরিয়াসলি নেবেন, সেটা আপনার ব্যাপার। তিনি বলছেন, ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট (বাদাবন), বেঙ্গল টাইগারের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল সুন্দরবনে পরিবেশ দূষণকারী একটি নতুন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। হাজার হাজার মানুষ এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে। আমার পরামর্শ হল, পরিবেশ দূষণকারী ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ বন্ধ করুন। এর পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের হার দ্রুত করতে দ্বিগুণ উদ্যোগে কাজ শুরু করুন’। আমাদের নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের হার বাড়াতে হবে, এতে কোনো সন্দেহ নাই। তবে কি সর্বনাশ ও বিপর্যয়ের আশংকাযুক্ত রূপপুর আণবিক প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রাণ ও প্রকৃতিবাদীদের দাঁড়ানোর কোনো কারণ ঘটেনি?
বলছিলাম, পরিবেশবাদ ও উন্নয়নবাদ- আমরা এ দুইয়ের একটা আন্তর্জাতিক মহড়া দেখলাম। কোনো পক্ষই জীবাশ্মভিত্তিক সভ্যতা কিংবা আধুনিক ভোগী জীবনের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। কেউই এর বিরুদ্ধে নন। পাশ্চাত্য দেশগুলোর অতি ভোগই যে আসমান ফুটা হওয়ার কারণ এটা এখন অস্বীকার করা কঠিন; কিন্তু ভোগী হচ্ছে পুরা ভোগী ব্যবস্থার প্রান্তসীমার ব্যক্তি। তাহলে ভোগীকে যখন আমরা দোষারোপ করি, তখন আসলে পুরা ব্যবস্থাকে নজরের আড়ালে নিয়ে যাই, ব্যবস্থাকে রক্ষা করবার জন্য। যাতে মুনাফালোভী কর্পোরেশনের স্বার্থ কিংবা বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কম-বেশি অক্ষত রেখে বিজিনেস এজ ইউজুয়াল চলতে পারে। শেখ হাসিনা কিংবা আল গোরের মধ্যে ব্যবস্থার প্রতি এমন কোনো আপত্তি নাই, যার কারণে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাঠামোগত সংকটের পর্যালোচনা করতে তারা তাগিদ বোধ করেন না।
তাহলে আল গোরের পরিবেশবাদের বিপরীতে উন্নয়নবাদ কী জিনিস! সেটা হল এই দাবি যে, ‘আমাদের জনগণের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করতেই হবে। আমাদের দেশের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে আমরা কী করে জনগণকে বাঁচাতে পারব?’ অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নয়ন চাইলে প্রাণ ও প্রকৃতির ক্ষতি ঘটাতেই হবে। আল গোরের পরিবেশবাদ পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংস্কার চায়, কৃৎকৌশলের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে চায়। হতে পারে পারমাণবিক বিদ্যুৎ এখন ঝুঁকিপূর্ণ; কিন্তু বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলের বিকাশ এ ঝুঁকি সামলাতে বা অতিক্রম করতে সক্ষম, এটা আল গোর বিশ্বাস করেন। পুঁজিতান্ত্রিক ভোগী ব্যবস্থার যে মুশকিল সেটা সরকার ও রাষ্ট্রের নীতি ও নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে প্রশমিত করা সম্ভব- এটাও আল গোরের রাজনীতি। যে কারণে উদার ডেমোক্রেটদের একটা বড় অংশ তার সমর্থক; কিন্তু এখানে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অস্পষ্ট। এখানেই উন্নয়নবাদ সংস্কারমুখী পরিবেশ চেতনার কাছে হেরে যায়।
আল গোরের মন্তব্যের জবাবে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বিশ্বের সব জায়গাতেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। আমরা এটা সুন্দরবন থেকে অনেক অনেক দূরে নির্মাণ করছি। শুধু তা-ই নয়, পরিবেশ যাতে আক্রান্ত না হয়, সেজন্য আমরা সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সুপার ক্রিটিক্যাল, খুবই আধুনিক। পরিবেশ রক্ষায় আমরা সব ধরনের উদ্যোগ নিয়েছি।’
দিনাজপুরে বড়পুকুরিয়ায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে শেখ হাসিনা দাবি করেছেন, তার সরকার ২০০০ সালে বড়পুকুরিয়ায় একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ শুরু করে। সেখানে দুটি ‘সাব-ক্রিটিক্যাল’ প্লান্ট নির্মাণ করা হয়েছে এবং বর্তমানে তৃতীয় একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে; কিন্তু ঘনবসতিপূর্ণ এ জেলায় পরিবেশের ওপর নেতিবাচক কোনো প্রভাব পড়েনি। তিনি দাবি করেছেন, সেখানে ফসল হচ্ছে, প্রচুর গাছপালা রয়েছে, এমনকি খুব ভালো আমের ফলনও হয়। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় নির্মিত এ কেন্দ্র নিয়ে কেউ কিছু বলেনি; কিন্তু এখন সুন্দরবন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এ সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে এলাকায় পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে নিরপেক্ষ গবেষণা দরকার, তথ্যের প্রয়োজন।
পরিবেশ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি সম্পর্কে একটি মন্তব্য দিয়ে শেষ করব। ধরিত্রী সম্মেলন হয়েছিল ১৯৯৫ সালে। সেই সময় অতিভোগী দেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুমুল সমালোচনা চলছিল। সেই সময় সমালোচকদের জবাবে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ বলেছিলেন, ‘মার্কিনিদের জীবনযাপন নিয়ে কোনো দরকষাকষি চলবে না, ব্যস!’। ‘The American way of life is not up for negotiations.’ অর্থাৎ মার্কিনিদের অতিভোগ আসমান ফুটা করে দিলেও তাদের জীবনযাপন নিয়ে কেউ কিছু করতে পারবে না মার্কিনিদের এ হুংকার বিশ্বব্যাপী পরিবেশবাদীদের সমালোচনার মুখে পড়েছিল। এ অবস্থা খুব একটা বদলায়নি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের কালে এ দৃষ্টিভঙ্গি আরও তীব্র হবে, এটা আন্দাজ করা যায়। প্রাণ ও প্রকৃতি সুরক্ষার আন্দোলন যারা করছেন, তাদের দেশের ভেতরে ও বাইরে উভয় ক্ষেত্রেরই যুক্তিগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন