শিক্ষা আইন, শিক্ষানীতি ও পাঠ্যবই নিয়ে বিতর্ক চলছে। বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে। পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে মাথায় রেখে সেটা হচ্ছে না। সেটা আশাও করি না; কিন্তু এখন দেখছি জাতিবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষওয়ালারা চরম গোস্বা করেছে। কেন? কারণ সরকার নাকি হেফাজতের দাবি মেনে নিয়েছে। শিক্ষা কোনো ব্যাপার না, পাঠ্যবই সম্পর্কে হেফাজতের আপত্তি সরকার মানল কেন এই হল তর্ক। টুপিপরা, কোর্তাপরা এসব বর্বর অশিক্ষিত পশ্চাৎপদ মানুষ বুঝি মঙ্গলগ্রহ থেকে এসেছে, তারা এ দেশের কেউ না! এদের ছেলেমেয়ে বালবাচ্চা নাই, শিক্ষা নিয়ে এদের কোনো মাথাব্যথা নাই। তো এই টুপিওয়ালাদের আপত্তি শেখ হাসিনা শেষমেশ মেনে নিল? হায় হায়। জাতিবাদী ও সেকুলার হাহাকারে চতুর্দিক দীর্ণ-বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে!
বিবিসি দেখছি রীতিমতো উসকানিমূলক শিরোনাম দিয়ে রিপোর্ট করেছে : ‘বাংলাদেশে পাঠ্যপুস্তকে বিতর্কিত বিষয়, খুশি করেছে হেফাজতকে?’ (১২ জানুয়ারি ২০১৭)। উদ্দেশ্য এটা প্রমাণ করা যে, হেফাজতকে খুশি করার জন্যই বুঝি পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে। তাই কি? হেফাজতে ইসলামীর মুখপাত্র মাওলানা মুনীর আহমেদ বিবিসি বাংলাকে ভালো উত্তর দিয়েছেন : এখানে হেফাজতের খুশি-অখুশির প্রশ্ন নেই। বরং দেশের গণমানুষের প্রত্যাশার দিকটাই বিবেচ্য বিষয়। পাঠ্যপুস্তকে হেফাজতের দাবি শতভাগ পূরণ করা হয়েছে বলে যারা বিতর্ক তুলতে চাচ্ছে, আমরা মনে করি তাদের সবাই চেনে। তারা সমাজবিচ্ছিন্ন অতিক্ষুদ্র একটা অংশ। দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাওলানা মুনীর তুলেছেন। এক. গণমানুষের প্রত্যাশা এবং দুই. গণমাধ্যমের জোরে সমাজের অতিক্ষুদ্র অংশের আধিপত্য। গণমানুষের প্রত্যাশার প্রশ্ন বাদ দিয়ে ইস্যুটির রাজনীতিকরণ ও ক্রমাগত উসকানি।
ভাবুন এবার। তর্কটা আর শিক্ষা আইন, শিক্ষানীতি কিংবা পাঠ্যবই নিয়ে থাকল না। হয়ে উঠেছে হেফাজতের বিরুদ্ধে জাতিবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষতাওয়ালাদের রাজনৈতিক লড়াই। এখন আপনি চাইলে গ্যালারিতে বসে দুই পক্ষের লড়াই উপভোগ করতে পারেন। তবে সেটা বিপজ্জনক বিলাসিতা হবে। ঠিক হবে না। কারণ শিশু-কিশোররা অল্প বয়স থেকেই ঠিকভাবে শিক্ষা পাক সেটা তো চাইতেই হবে। তাদের আত্মিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ জরুরি। এর সঙ্গে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জড়িত; কিন্তু জাতিবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষওয়ালারা আমাদের সেটা করতে দেবে না। তারা ধর্মীয় বিদ্বেষের রাজনীতি করবেই। তারা সমাজের বৃহত্তর অংশের কোনো কথাই শুনবে না। তাদের কথাই সবাইকে শুনতে হবে; তারা যাকে শিক্ষা আইন বলে সেটা আমাদের মানতে হবে; যাকে শিক্ষানীতি বলে সেটা আমাদের বাস্তবায়ন করতে হবে, ইত্যাদি। তারা খামখেয়ালিভাবে ও খেয়ালখুশি মতো বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলের পাঠ্যবই তাদের মতো করে বদলাবে। সেটাও শুদ্ধভাবে নয়, মারাত্মক ভুলভাবে চরম বিনোদনমূলক ‘প্রিন্টিং মিস্টেক’সহ। সেটাও বিনোদন হিসেবে আমাদের মেনে নিতে হবে। এখন তাদের ৮৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি এক বিবৃতিতে দাবি করেছেন চলতি বছরের পাঠ্যবইয়ে নাকি তিন ধরনের ‘ভুল, অসঙ্গতি কিংবা বিকৃতি’ রয়েছে। প্রথম দুই ভুল হল বানান ও তথ্যগত বিকৃতি ও বাক্য গঠনের ভুল। এ ভুলগুলো নাকি ‘সঠিক পরিকল্পনা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা’র অভাবে হয়েছে। গুড। তাহলে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে চাকরি ছাড়ুন, যোগ্যদের নিয়োগ দিন। সেটা তারা দেবেন না। কারণ সেটা নাকি তেমন ধর্তব্যের মধ্যে নয়। কিন্তু তৃতীয় ভুলটি নাকি ‘পরিকল্পিত’। যারা করেছে তারা নাকি সেটা ‘ইচ্ছাকৃতভাবেই’ করেছে। সেটা করা হয়েছে একটি সাম্প্রদায়িক জাতিরাষ্ট্র গঠনের জন্য। দুর্দান্ত চিন্তা!!
তো আপনি যদি জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র গড়ার জন্য পাঠ্যবই তৈরি করেন, তার প্রতিক্রিয়া তো হবেই। সাম্প্রদায়িক জাতি চিন্তার সঙ্গে গণমানুষের প্রত্যাশার বিরোধ আছে। মাওলানা মুনীর ঠিকই বলেছেন, তথাকথিত বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সমাজের ক্ষুদ্র একটি অংশ। এরা এমনই ‘বিশিষ্ট’ যে চরম বিনোদনমূলক বানান ভুল, বাক্য ভুল ও তথ্য ভুলের পক্ষে সাফাই গাইতে বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ করলেন না। পুরো বিষয়টাকে হেফাজত বনাম তাদের সংকীর্ণ জাতিবাদী সাম্প্রদায়িকতা এবং ইসলামবিদ্বেষী রাজনীতির দ্বন্দ্বে পর্যবসিত করলেন। কুকুরের লেজ ইচ্ছা করলেও আপনি সোজা করতে পারবেন না।
দুই
ঠিক আছে। শিক্ষা আইন, শিক্ষানীতি এবং পাঠ্যবই নিয়ে আমাদের চরম মতপার্থক্য আছে। বড়সড় চ্যালেঞ্জ বটে; কিন্তু আমাদের একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে পৌঁছাতে হবে। সেটাই আমাদের কর্তব্য। সেক্ষেত্রে আমরা সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে যেতে চাইলে অগ্রসর হতে পারি। সেটাই সবচেয়ে সমীচীন হয়; কিন্তু সেই তর্ক আমরা করছি না। আমরা ‘ধরো তক্তা মারো পেরেকে’ বিশ্বাস করি, এটাই আমাদের জাতীয় চর্চা। ফলে হেফাজতের ওপর এখন দোষ চাপিয়ে নিজেদের লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করছি। তবুও তর্কে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত রাখার জন্য আমরা প্রশ্নটি এভাবে তুলতে পারি যে, আমরা সবাই নিশ্চয়ই চাইব আমাদের সন্তান সঠিকভাবে ঠিক বিষয়ে শিক্ষা পাক। প্রশ্ন তুলতে পারি, কীভাবে সঠিকভাবে সঠিক শিক্ষা দেয়া সম্ভব?
‘সঠিকভাবে’ শিক্ষা দেয়া শিক্ষা পদ্ধতিসংক্রান্ত তর্ক। আজ এখানে সেই তর্কে যাব না। আজ পাঠ্য বিষয় কেন্দ্র করে আলোচনা করব। মুশকিল হচ্ছে, ‘ঠিকভাবে বা সঠিকভাবে শিক্ষা’ বলতে আমরা কী বুঝব সেটা একটি সমাজবিচ্ছিন্ন বিমূর্ত তর্ক নয়, সামাজিক তর্ক। তর্ক-বিতর্কের একটা সাধারণ ক্ষেত্র চিহ্নিত করার জন্যই এভাবে কথাটা হাজির করলাম। কাণ্ডজ্ঞানেই আমরা বলতে পারি, ‘সঠিক শিক্ষা’ নামক সোনার পাথরবাটিজাতীয় কিছু নাই। শিক্ষা সম্পর্কে সমাজের নানান শ্রেণী ও শক্তির ভিন্ন ভিন্ন মত আছে, রাজনৈতিক অবস্থান আছে। তাহলে উচিত কাজ হচ্ছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সেই মতগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।
গণমাধ্যমের বরাতে আমরা এখন জানি যে, ‘পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন, সংযোজন-বিয়োজনের নিয়ম হচ্ছে, বিদ্যালয় পর্যায়ে ট্রাই-আউটের মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মতামত সংগ্রহ, তার ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে কর্মশালা এবং তার আলোকে এনসিসিতে (ন্যাশনাল কারিকুলাম কো-অর্ডিনেশন কমিটি) চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ। কিন্তু এবারের পাঠ্যপুস্তকের সংযোজন-বিয়োজনের বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত হয়েছে এনসিসিসির সভায়। এনসিসিসির প্রধান হচ্ছেন শিক্ষা সচিব। গত বছরের ২০ আগস্ট অনুষ্ঠিত এনসিসির সভায় সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা একটি তালিকা দিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন না করে সে অনুসারে পাঠ্যপুস্তকে সংযোজন-বিয়োজন করে নেয়ার কথা বলেন বলে জানা গেছে। তার এ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতেই এবারের পরিবর্তন এসেছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।’ (দেখুন কালের কণ্ঠ, ‘পাঠ্যবইয়ে এসব কী’, ৪ জানুয়ারি ২০১৭)।
তাহলে সামাজিক বিষয়ের যেভাবে সামাজিকভাবে নিষ্পত্তির প্রয়োজন ছিল সেটা করা হয়নি। এখন দোষ হেফাজতের ঘাড়ে চাপিয়ে ধর্মবিদ্বেষীরা পচা কাসুন্দি ঘেঁটে মোরাল হাই গ্রাউন্ড অর্জনের সস্তা প্রচার চালাচ্ছে।
সত্য হচ্ছে, ২০১৬ সালে হেফাজতে ইসলাম বলেছিল, স্কুলের বইপত্রে ইসলামী ভাবধারা বাদ দিয়ে ‘নাস্তিক্যবাদ এবং ‘হিন্দুত্ব’ পড়ানো হচ্ছে।’ অনেকে প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক ভান বজায় রাখার জন্য বলছেন, ‘নাস্তিক্যবাদ’ ও ‘হিন্দুত্ব’ পড়ানো কথাটা পলিটিকালি কারেক্ট ভাষা না। এ ভাষা হেফাজতের ব্যবহার করা ঠিক হয়নি। তাদের সঙ্গে আমি অমত করি না; কিন্তু ভাইরে, ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়। আপনি যখন ইসলাম নির্মূলের রাজনীতি করেন আর খেয়ে না খেয়ে বইপুস্তক ও শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ইসলামী ভাবধারা কিংবা ইসলামের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত বিষয়গুলো পরিকল্পিতভাবে বাদ দেবেন, আশা করবেন না যে আপনার প্রতিপক্ষ হাত গুটিয়ে বসে থাকবে। হেফাজত অন্তত বলেনি যে, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা শিবসেনাদের হাতে চলে গিয়েছে। তারা তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছে মাত্র। তাদের আপত্তি অযৌক্তিক হলে আসুন তা নিয়ে তর্ক করি। আপনাদের নিজের জাতিবোধ ও জাত্যাভিমান হিটলারের ফ্যাসিজমকে হার মানায়। আপনি নিজে ইসলামবিদ্বেষী ঘৃণ্য বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার চর্চা করেন, ইসলাম নির্মূলের রাজনীতি করবেন আর আশা করবেন হেফাজত নাস্তিক্যবাদ আর হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ না করে আপনার পাঠ্যবই বসে বসে গিলবে- এটা আশা করেন কীভাবে?
হেফাজতে ইসলাম তো ঠিকই তাদের জায়গা থেকে জানতে চেয়েছে, ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণীর বাংলা বইয়ে ইসলামী ভাবধারার ১৭টি বিষয় বাদ দিলেন কী যুক্তিতে? বাদ দিলেন তো দিলেন তার ওপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো এর বিপরীতে সাতটি ইসলামী ভাবধারার বিপরীত লেখা অন্তর্ভুক্ত করলেন কেন? হেফাজত হুমায়ুন আজাদের লেখা নিয়ে আপত্তি করেছে, কারণ ইসলাম ও মুসলমান সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদের অনেক আপত্তিকর মন্তব্য আছে। যা কোনো ন্যূনতম সাহিত্য রুচির সঙ্গে যায় না। তিনি বাংলাদেশের গণমানুষের প্রত্যাশার বিপরীত একজন মানুষ। এ ধরনের ব্যক্তিদের আপনি লেখক আর কবি হিসেবে শিশু ও কিশোররা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের মনে গেঁথে দেবেন, এ সহজ রাজনীতি বোঝার মতো অক্ষম হেফাজত নয়। ফলে তারা সঙ্গত আপত্তি করেছে। হেফাজত চাইছে না এমন কোনো লেখকের লেখা শিশু বা কিশোর বয়সীরা পড়ুক, যারা ধর্মের প্রশ্নে অসহিষ্ণু এবং ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে আঘাত দিয়ে বিকৃত আনন্দ উপভোগ করে। তারা বড় হয়ে তাদের বিচারবুদ্ধি মোতাবেক কী পড়বে না পড়বে তার সিদ্ধান্ত নিক; কিন্তু শিশু বা কিশোর বয়সে পাঠ্য লেখা হিসেবে নয়।
এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুল মান্নান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘পাঠ্যপুস্তকের বাংলা বইগুলো ধর্ম কিংবা সমাজ বিজ্ঞান শেখানোর বই নয়, এগুলো ভাষা-সাহিত্য শেখানোর বই। ভাষা শিক্ষার জন্য যেসব লেখা থাকা দরকার, তা-ই দেয়া হয়েছে। ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা হচ্ছে ধর্ম শিক্ষার বই, সেখানে ধর্ম শেখানোর জন্য যা দরকার তা আছে। বিজ্ঞানের বইয়ে কি ধর্মের বিষয় থাকবে? বিজ্ঞানের বইয়ে ধর্মীয় বিষয় নেই কেন এমন প্রশ্ন না উঠলে বাংলার ক্ষেত্রেও তা থাকা উচিত নয়। বইয়ের মধ্যে ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে। তবে হলফ করে বলতে পারি, ইসলাম নয়, অন্য যে কোনো ধর্মকে বিন্দুমাত্র হেয় করা হয়েছে, এমন একটি শব্দও পাওয়া যাবে না পাঠ্যবইয়ে।’
তার কথা মেনে নিতে পারলাম না। প্রথমত, ভাষা ও সাহিত্য শেখার বই আর বিজ্ঞানের বই এক নয়। বিজ্ঞানে ধর্ম আছে কী নাই সেটা নিয়ে তর্ক হতে পারে; কিন্তু ভাষা ও ধর্ম পরস্পর বিচ্ছিন্ন কোনো ব্যাপার নয়। ধর্ম বিশ্বাস প্রকাশ ও চর্চা করার মধ্য দিয়েই ভাষার বিকাশ ঘটে ও ঘটেছে। ভাষার গায়ে ধর্মের চিহ্ন খচিত থাকে। তাকে চিহ্নিত করা এবং বর্তমানকালে তার তাৎপর্য আবিষ্কার নৃতত্ত্ব, দর্শন ও ভাষার ইতিহাসের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষেত্র। বাংলা ভাষায় সংস্কৃত ‘ঈশ্বর’ একটি ধর্মীয় শব্দ। একে বাংলা ভাষা থেকে বাদ দেবেন কীভাবে? রবীন্দ্রনাথ পড়তে গিয়ে যখন পড়ি, ‘আমার এই দেহখানি তুলে ধরো, তোমার ঐ দেবালয়ের প্রদীপ করো’, তখন ‘পূজা’, ‘দেবালয়’ ধর্মীয় শব্দ নাকি নয়, সেসব তর্ক অনর্থক নয়। খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলা ভাষা ও বাংলাসাহিত্য ঔপনিবেশিক যুগে উচ্চ বর্ণের হিন্দুর হাতে বিকশিত হয়েছে; ফলে সেই ভাষার রন্ধ্রে রন্ধ্রে হিন্দুর ধর্মীয় অনুষঙ্গ, প্রতীক, উপমা ও উৎপ্রেক্ষা গলাগলি করে জড়িয়ে রয়েছে। এখন কেউ যদি বাংলাসাহিত্য পড়াতে গিয়ে বলে, এটা ধর্মীয় কিছু না, নিছকই সাহিত্য, তার যেমন কোনো যুক্তি নাই, তেমনি কেউ মুসলমান বলে তার সাহিত্যগুণের প্রসাদ কেউ নেবে না, তা-ও হয় না। দেখুন, আমি এখন হিন্দুর ধর্মীয় শব্দ ‘প্রসাদ’ শব্দটি মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য ব্যবহার করেছি। কারণ এটা এখন আমারও ভাষা, সেই ভাষায় আমার অধিকার আছে। অর্থাৎ আধুনিক বাংলাসাহিত্যের ভাষা উচ্চ বর্ণের হিন্দুর বলে এবং তার মধ্যে বিপুল ধর্মীয় অনুষঙ্গ থাকলেও সেটা হিন্দুর নয়, বাঙালির ভাষা। কিন্তু এ দাবি আহাম্মকি যে, ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নাই। এই অসত্য দাবিটা একান্তই রাজনৈতিক।
ঠিক তেমনি বাঙালি মুসলমান ‘কবিতা আমার সাধনা’ না বলে যদি লেখে ‘কবিতা আমার এবাদত’, তখন ‘এবাদত’ মুসলমানের শব্দ হলেও সেটা সব বাঙালির। যদি বলা হয়, বাংলা সাহিত্য পড়াতে গিয়ে ‘এবাদত’ শব্দ ব্যবহার করা যাবে না, তখনই গোলমালটা বাঁধে। সেটা হয়ে ওঠে সাহিত্যের উসিলায় সাম্প্রদায়িকতা। একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উপলব্ধি, ভাষা ও চর্চাকে সাহিত্যে স্থান না দেয়ার চেষ্টা চরম সাম্প্রদায়িক চিন্তা। অন্যদিকে ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় ধর্ম থাকবে না সেটা আজগুবি ও অবাস্তব শুধু নয়, ধর্মনিরপেক্ষতার ছদ্মবেশে বাংলা ভাষাকে বর্ণহিন্দুর ভাষাচর্চার মধ্যে আবদ্ধ রাখা। যদি বলি, বাংলা ভাষা শেখাতে চাই বলে আল্লাহকে ‘ঈশ্বর’ বলেই শিশুদের পড়তে ও শিখতে হবে, আল্লাহ আরবি শব্দ, এটা বাংলা ভাষায় চলবে না, তখন বাংলাদেশের জনগণ কি তা মানবে? মানবে না। তাদের ধর্ম, ধর্মচর্চার নিত্যদিনের শব্দ প্রত্যক্ষভাবে কিংবা উপমা, উৎপ্রেক্ষা, প্রতীক ও প্রত্যয় হিসেবে আসবেই। ইংরেজ ও বর্ণহিন্দুর শাসন থেকে মুক্ত স্বাধীন বাঙালির ভাষায় তাদের ধর্মীয় ও আত্মিক উপলব্ধি আসবেই। তেমনি হিন্দুরও আসবে। কেউ নাস্তিক হোক বা না হোক তাতে কিছুই আসে যায় না। স্বাধীন বাংলাদেশে সেজন্যই ‘গণমানুষের প্রত্যাশা’ কথাটা হেফাজতের খুবই যৌক্তিক চিন্তা। বাংলাদেশের জনগণকে ধর্মবিচ্ছিন্ন ভাষা আর সাহিত্যের কথা আবদুল মান্নান বলে দেখুন। জনগণ মানে কিনা দেখার খুব ইচ্ছা। ধর্ম, ভাষা ও সাহিত্যের নিগূঢ় ও অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক আপাদমস্তক অজ্ঞ ব্যক্তিরা যখন প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমের সদস্য হয়, তখন তা কী ধরনের বিপদ তৈরি করে সেটা পাঠ্যবই বিতর্কের মধ্য দিয়ে উদোম হয়ে পড়েছে।
‘অঞ্জলী’ শব্দটি দেখুন। আমার খুবই প্রিয় বাংলা শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে দুই হাত জোড় করে দেবতার উদ্দেশে নিবেদন করা ফুল, অর্থাৎ সোজা কথায় পূজা। এখন রবীন্দ্রনাথ তার ‘গীত’ দিয়ে সেই পূজা করতে চান বলে তার গানের বইয়ের নাম দিয়েছেন গানের অর্ঘ্য নিবেদন, গান দিয়ে দেবতার পূজা : ‘গীতাঞ্জলী’। তো এখন পূজার অনুষঙ্গ আছে বলে কি বাঙালি মুসলমান এই বই পড়বে না? এই গান গাইবে না? অবশ্যই পড়বে ও গাইবে। তাহলে ধর্ম ও সাহিত্য পরস্পর থেকে আলাদা ও বিচ্ছিন্ন, এই অনুমানের ভিত্তি কী? নাই।
তিন
দেখুন আবদুল মান্নান আরও কী বলছেন। বলছেন, ‘আমাদের দুটি সংস্কৃতি। একটি ধর্মীয় সংস্কৃতি, আরেকটি জাতিগত। যখন জাতিগত সংস্কৃতির কথা উঠবে, তখন হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির কথা আসবে। তখন কোনটা হিন্দু, কোনটা মুসলমান, এটা দেখার বিষয় নয়। কোন কবিতার মধ্যে কোন মিথ আসছে, সেটাকে যারা বলেন হিন্দু মিথ তারা ভুল করেন, আসলে এটা বাঙালি মিথ।’ ধর্ম, ভাষা আর সাহিত্যকে পরস্পর থেকে আলাদা ও বিচ্ছিন্ন করে রাখার এই রাজনীতিটাই বর্ণ হিন্দুর সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। এটা বিশুদ্ধ সাহিত্য, হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি ইত্যাদি নানা নামে চালু রয়েছে। অর্থাৎ ‘হাজার বছরের সংস্কৃতি’র নামে আমি উচ্চ বর্ণের হিন্দুর ভাষা ও সাহিত্য রক্ষা করে যাব। বলব হিন্দুর ভাষা সাহিত্য, আর মুসলমানের ভাষা ধর্মীয়। ইসলামবিদ্বেষী এসব সাম্প্রদায়িক বর্ণবাদী রাজনীতি বাংলাদেশের জনগণের কাছে পরিষ্কার।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এই চরিত্র হিন্দু বা বর্ণ হিন্দু কারোই দোষ নয়। এটা কারও ষড়যন্ত্র নয়, ইতিহাস। এটা অতিক্রম করে যাওয়া ধর্ম নির্বিশেষে সব বাঙালির কাজ। আমি যদি হিন্দু পুরাণ, তার চরিত্র ও কাহিনী আমারই ভাই বা ভগ্নির জীবনচর্চার অংশ বলে জানি, শ্রদ্ধা করি এবং বাংলা ভাষায় তাদের উপস্থিতি মানি ও তা রক্ষা করি, তাহলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে হযরত মোহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে লেখা, তৃতীয় শ্রেণীতে খলিফা আবুবকর (রা.), চতুর্থ শ্রেণীতে খলিফা ওমর (রা), পঞ্চম শ্রেণীতে বিদায় হজ ও শহীদ তিতুমীরকে নিয়ে লেখা অর্ন্তভুক্ত করা হলে অসুবিধা কী? আপত্তিটা কোথায়? তর্ক হতে পারে, সবার পাঠের উপযোগী করে তা লেখা হয়েছে কিনা। কিংবা এমন কিছু আছে কিনা যা অন্য ধর্ম বা সংস্কৃতির প্রতি অবজ্ঞা বা তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে। কিন্তু আমরা তা বলছি না। আমরা বলছি নবী ও নবীর সাহাবাদের জীবনী সাহিত্য হিসেবে আমরা আমাদের সন্তানদের পড়াতে পারব না।
শহীদ তিতুমীর পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করায় আপত্তি উঠেছে। অথচ তিতুমীর সম্পর্কে অবশ্যই আমাদের সন্তানদের জানতে হবে, ইংরেজের বিরুদ্ধে বাঁশের কেল্লা বানিয়ে লড়ার হিম্মত যিনি দেখিয়েছেন, তিনি একজন ঐতিহাসিক নায়ক। গোলাম না হয়ে কীভাবে পরাধীনতার বিরুদ্ধে লড়তে হয়, তিনি তার ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছেন। আমরা ভুলে যাই এ দেশের জনগণ খালি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়েনি, আঠারশ’ সাতান্নর সিপাহী বিদ্রোহ থেকে শুরু করে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, তারপর সাতচল্লিশ- তার দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম-আত্মত্যাগের ইতিহাস আছে। বাংলাদেশ নয় মাসে আকাশ ফুঁড়ে পয়দা হয়নি।
আমরা তর্ককে ইতিবাচক দিকে নিতে চাইলে প্রশ্নটিকে আরও সুনির্দিষ্ট করতে পারি। যেমন নিজেদের প্রশ্ন করতে পারি, বাংলাদেশের বর্তমান ঐতিহাসিক বাস্তবতায় কী ধরনের শিক্ষা আমরা আমাদের সন্তানদের দিতে পারলে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, চাকমা-সাঁওতাল-মনিপুরীসহ সব ধর্ম-জাতি-সম্প্রদায়ের শিশু ও কিশোর শিশুকাল ও বাল্যকাল থেকেই উপলব্ধি করে তারা একই সমাজ একই ইতিহাসের অন্তর্গত। তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য তাদের শক্তি, অনৈক্যের ক্ষেত্র নয়। নিজেদের মধ্যে আমরা তর্ক করতে পারি কাকে আমরা ‘সঠিক শিক্ষা’ বলব। এখানে অনুমান হচ্ছে, রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে আমাদের সমাজের কিছু বৈশিষ্ট্য ও ইতিহাস আছে। সেই জমিনে আমাদের সামষ্টিক ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা-অভিপ্রায় দানা বাঁধে। সঠিক শিক্ষা নির্ণয় করতে গিয়ে সেই বৈশিষ্ট্য ও ইতিহাসকে আমলে নিতে হবে। সেই তর্কে জাতিবাদী, সেকুলার, ইসলামপন্থী শুধু নয়, সেখানে যে কেউই অংশগ্রহণ করতে পারে। পাঠ্যবইয়ে চাকমা, মনিপুরী ও সাঁওতালদের ব্যাপারে কিছু লেখা থাকলে কী লেখা আছে তা আমাদের জানতে হবে। আমরা শুধু জাতিবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষওয়ালাদের কথা শুনব, আর ইসলামপন্থী এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তার কথা শুনব না, সেটা তো হতে পারে না। কিংবা পাল্টা শুধু ইসলামপন্থীদের কথা শুনব আর জাতিবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষওয়ালাসহ বাকি সবাইকে বাদ দেব, সেটাও তো হবে না। জাতিবাদী আর ধর্মনিরপেক্ষওয়ালারা চাইছে শুধু তাদের মতোই পাঠ্যবই লিখতে হবে। সেটা তখন আর শিক্ষাবিষয়ক তর্ক থাকে না। ইসলাম নির্মূলের রাজনীতি হয়ে ওঠে। তারা জোট সরকারের আমলের পাঠ্যবই বাদ দিয়েছে, কারণ তারা বাংলাদেশের ইতিহাস হিসেবে যা গেলাতে চায় তা আওয়ামী ইতিহাস, বাঙালির ইতিহাস নয়। জোট সরকারও তাদের ইতিহাস পাঠ্যবইয়ে যা ঢুকিয়েছিল সেটা তাদের দলীয় ইতিহাস, বাঙালির ইতিহাস নয়। পাঠ্যবই উভয়পক্ষের দলীয় প্রোপাগান্ডার হাতিয়ারের অধিক কিছু ছিল না। উভয়েই পাঠ্যবইয়ের বিষয় নিয়ে বিতর্ককে স্রেফ রাজনৈতিক ময়দানের লড়াইয়ে পরিণত করেছে।
এ অবস্থা থেকে সবাইকেই বেরিয়ে আসার আহ্বান জানাই।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন