শুরুতে সবাইকে ঈসায়ী নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে রাখছি। আমার কর্মকাণ্ডের বড় একটি অংশ লেখালেখি। নতুন বছরে ভাবছিলাম আজ দৈনিক যুগান্তরে এমন একটি বিষয় নিয়ে লিখব যা লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত, একই সঙ্গে সংবাদপত্রেরও বটে। মনে হল, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিয়ে লিখি। তবে বিষয়টিকে আরও কংক্রিটভাবে হাজির করার জন্য এই বিষয়ে আমাদের সমাজের বিদ্যমান তর্ক-বিতর্ক নিয়ে লেখাই উত্তম। এতে পাঠকের কাছে পৌঁছানো বোধহয় সহজ হবে।
তর্কটা ফেসবুকের; কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। যেভাবে ফেসবুকে তর্কটা চলছে সেখান থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি না। তবে তর্কের মর্মটা পেশ করছি।
ধরুন আপনি দাবি করছেন আপনি মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। ফাইন। তার মানে হল এই যে, আপনি যে মতের সমর্থক শুধু সেই মতের স্বাধীনতায় নয়, যে মতের আপনি বিরোধী সেই মতের ধারকরাও তাদের মতপ্রকাশ ও প্রচার করুক, এটাও আপনি চান। সবার মতপ্রকাশ ও প্রচারের স্বাধীনতাতে আপনি বিশ্বাস করেন। তাই না? বেশ। আপনি যে মতপ্রকাশ ও প্রচার করতে চান রাষ্ট্র বা সরকার সেটা কোনো আইনের দ্বারা বা কোনো প্রকার প্রশাসনিক ক্ষমতাবলে কিংবা গায়ের জোরে বন্ধ না করুক, এটাই আপনি চান। ঠিক তেমনি আপনি যে মতের বিরোধী সেই প্রকার বিরুদ্ধ মতও রাষ্ট্র বা সরকার নিষিদ্ধ করুক এটা চান না। গুড।
তাহলে সেই আপনাকেই তো দেখা গিয়েছিল শাহবাগে দৈনিক আমার দেশ বন্ধের দাবি জানাতে। আপনি সফলও হয়েছিলেন। সরকার যখন দৈনিক আমার দেশের তালা বন্ধ করে দিল, আপনি তো তার পক্ষেই ছিলেন। সেই তালা কিন্তু এখনও বন্ধই আছে। তখন কিন্তু আপনি হাততালি দিয়েছিলেন এবং শাহবাগে মিষ্টি খেয়েছিলেন। এতদিনে হয়তো ভুলে গেছেন কিভাবে আপনি মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরোধী অবস্থান নিয়েছিলেন। ভুলে যাবেন না, দিগন্ত টেলিভিশনও কিন্তু বেআইনিভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। এখনও বন্ধই আছে। বন্ধ আছে ইসলামিক টিভি। তাহলে সঙ্গত প্রশ্ন উঠবেই, মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলতে আপনি আসলে কী বোঝেন! নিজের বেলায় দইয়ের হাঁড়ি, পরের বেলায় মাথায় বাড়ি। তাই না? এটা কি ঠিক? এটাই হচ্ছে তর্কের এক নম্বর বিষয়।
সেই আপনাকে এখন দেখা যাচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য কান্নাকাটি করছেন। প্রতিবাদ করে বীরত্ব দেখাচ্ছেন। কার বিরুদ্ধে? সরকার? রাষ্ট্র? আরে না না, ওই হিম্মত আপনার নাই। বাংলাদেশের সংবিধানের এখন যে দশা, তা আদৌ মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করে কিনা সেটা আপনার জন্য খুবই দূরবর্তী বিষয়। ধরা যাক রাষ্ট্র রাজনীতি, সংবিধান ইত্যাদি বোঝার মতো লায়েক আপনি না, তাই প্রতিবাদ জানাচ্ছেন বাংলা একাডেমির বিরুদ্ধে। বাংলা একাডেমির শামসুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে আপনার প্রতিবাদ। কেন? কারণ একটি প্রকাশনা সংস্থাকে আগামী দুই বছরের জন্য বইমেলায় স্টল দেবার অনুমতি বাংলা একাডেমি দেয়নি। একটু ভাবুন, প্রকাশনীটির কোনো বই একাডেমি নিষিদ্ধ করেনি কিংবা তার কার্যক্রমের ওপর কোনো প্রকার বাধানিষেধও আরোপ করেনি। এটা করতে পারে এই অনুমানও হাস্যকর। কারণ সেই এখতিয়ার একাডেমির নাই। একাডেমির মহাপরিচালকেরও নাই। সেটা রাষ্ট্র করে, সরকার করে, বাংলা একাডেমি না। পরিচালকের কাজের পরিমণ্ডল শুধুই বাংলা একাডেমি। বেচারা শামসুজ্জামান খান!
ঠিক। একাডেমির কার্যক্রম সংক্রান্ত প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত পরিচালক অবশ্যই নিতে পারেন। সেই সিদ্ধান্তের সমালোচনা ও বিরোধিতা করা যায়। অবশ্যই যায়। সেটাই করুন। কিন্তু মত প্রকাশের স্বাধীনতার কেচ্ছা গাইবেন না। বাংলা একাডেমি বই নিষিদ্ধ করেছে, এই প্রপাগান্ডা করবেন না। প্রকাশনীটির কোনো কাজেই কোনো নিষেধাজ্ঞা নাই। প্রকাশনীটি আগে যেমন ছিল তেমনি আছে। আমার ধারণা, বইমেলার অংশগ্রহণ করতে না পারার সিদ্ধান্ত প্রকাশনীটির পক্ষে যাবে। এই বিতর্ক প্রকাশনীটির পরিচিতি বাড়িয়েছে। বাড়ুক। শামসুজ্জমান খান ফেসবুকে তার কোনো একটি মন্তব্যে ঠিক এই রকমই বলেছিলেন যার মানে দাঁড়ায় প্রকাশক তার বই বেচার জন্য কিছু বিতর্ক তৈরি করে। সেই অভিযোগ উপেক্ষা করা যাক। কারণ ফেসবুকের তর্ক অন্যত্র। সেটা হল যেসব বীরপুরুষ মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বাংলা একেডেমির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে এরা শাহবাগী ব্লগারকুল। এরা অন্যের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করার দাবি জানায়, দাবি সফল হলে মিষ্টি খায়। অথচ এখন নির্লজ্জভাবে তাদের দলভুক্ত একটি প্রকাশনীর পক্ষে দাঁড়িয়ে আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা শেখাচ্ছে। ফেসবুকে দেখছি বাংলা একাডেমির সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েও এই সব ভণ্ড মতপ্রকাশের স্বাধীনতাওয়ালাদের বিরুদ্ধে বিপুল জনমত গড়ে উঠেছে। এই তর্ককে আমরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সচেতনতার লক্ষণ হিসেবে মেনে নিতে পারি। আমরা এই ফাঁকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে দুই-একটি কথা বলে ফেলার সুযোগ নেব।
জ্বি, আমি একমত যে, কোনো প্রকাশনীকে বইমেলায় অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখা বা নিষিদ্ধ করা ঠিক না। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রে ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ একটি স্ববিরোধী ও অমীমাংসিত ধারণা। সেই তর্কে আমরা একটু পরে আসছি। নির্বিচারে মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে দঁড়াানো একটি বিমূর্ত ও বাস্তবতাবর্জিত ধারণা। এই প্রকার সোনার পিতলা কলস দুনিয়ার কোত্থাও নাই। বাংলাদেশের সংবিধানেও নাই। ‘বাক ও ভাবপ্রকাশ’ এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করার কথা বলে বটে, কিন্তু সেটা শর্তহীন নয়, শর্তযুক্ত। অর্থাৎ কাছাখোলা স্বাধীনতা বলে কিছু নাই। রাষ্ট্র সেই স্বাধীনতা অবশ্যই ‘আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধসাপেক্ষে’ হরণ কিংবা সংকুচিত করতে অবশ্যই পারবে। যে সব ক্ষেত্রে রাষ্ট্র তা পারবে সেইগুলো হল, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বন্ধুতাপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃংখলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা’ ইত্যাদি। বাংলাদেশের সংবিধানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ কিংবা সংকুচিত করার বিপুল ও বিস্তৃত এখতিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতায় ক্ষমতাসীনদের সংবিধান দিয়েছে। ক্ষমতাসীনরা তা হামেশা ব্যবহারও করছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাওয়ালারা এইসব গোড়ার বিষয় নিয়ে নীরব। অথচ তারা বাংলা একাডেমি একটি প্রকাশনী সংস্থাকে কেন দুই বছরের জন্য বইমেলায় স্টল বরাদ্দ দিল না, তা নিয়ে হৈচৈ করছে!
দুই.
কিন্তু স্টল না দেয়ার পক্ষে বাংলা একাডেমির বইমেলা কমিটির সচিব জালাল আহমেদ যে বক্তব্য দিয়েছেন তা গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেছেন, ‘গত ১০ নভেম্বর বাংলা একাডেমির কাউন্সিলের সভায় শ্রাবণ প্রকাশনীকে বইমেলায় দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। গত বইমেলায় বাংলা একাডেমি পরিস্থিতি বিবেচনায় ‘ইসলাম বিতর্ক’ নামে একটি বই নিষিদ্ধ করেছিল। আর একাডেমির সেই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন শ্রাবণ প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী রবিন আহসান; যা বাংলা একাডেমির বইমেলার স্বার্থের পরিপন্থী। আর এ জন্য বৃহত্তর স্বার্থে বাংলা একাডেমির বইমেলায় শ্রাবণ প্রকাশনীকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’ এই বক্তব্য ধোঁয়াশা এবং অর্থহীন। কারণ ১. বাংলা একাডেমির যে কোনো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার অধিকার বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিকেরই রয়েছে, পুস্তক প্রকাশকের তো আছেই, তার জন্য একতরফা কাউকে শাস্তি দেয়ার অধিকার বাংলা একাডেমির নাই; ২. বাংলা একাডেমির সিদ্ধান্তের বিরোধিতা কিভাবে ‘বাংলা একাডেমির বইমেলার স্বার্থের পরিপন্থী’, একজন প্রকাশককে বইমেলায় অংশগ্রহণে অনুমতি না দেয়ার মধ্যে ‘বইমেলার স্বার্থ’ কী? এরপর রয়েছে আরেক বিস্ময়কর দাবি, সেটা হল- ৩. ‘বৃহত্তর স্বার্থ’। এইটা আবার কী জিনিস! জালাল আহমেদের বক্তব্য বিতর্কটিকে খামাখা আরও প্রলম্বিত করেছে। তিনি যে যুক্তিতে ‘বাধা-নিষেধ আরোপ’ করছেন, তা ‘যুক্তিসঙ্গত’ নয়। আশা করি তিনি লেখাটি পড়বেন এবং ‘একাডেমির বইমেলার স্বার্থ’ , ‘বৃহত্তর স্বার্থ’ ইত্যাদি বলতে তিনি কী বোঝাচ্ছেন সেটা আমাদের বুঝিয়ে বলবেন।
জালাল আহমেদের তুলনায় শামসুজ্জামান খান বলেছেন, ‘গত বছরে বইমেলায় ইসলাম ধর্ম নিয়ে একটি বিতর্কিত বই প্রকাশ করে বদ্বীপ প্রকাশনী। পরবর্তী সময়ে ওই বই নিষিদ্ধ এবং প্রকাশককে গ্রেফতার করা হয়। আমরা বদ্বীপ প্রকাশনীকে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। তারা ধর্মীয় বিষয়ে অশ্লীল বই প্রকাশের কারণে অভিযুক্ত হয়েছে। এ নিয়ে হেফাজতে ইসলাম বইমেলায় আক্রমণের হুমকি দেয়। ওই প্রকাশনা থাকলে বইমেলা পুড়িয়ে দেয়া হতো। কিন্ত সে (রবিন আহসান) ওই প্রকাশনীর পক্ষে টিএসসিতে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছে। এজন্যই তাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।’
যুক্তি হচ্ছে গত বছর আরেকটি প্রকাশনা ধর্মীয় বিষয়ে অশ্লীল বই প্রকাশ করেছিল, বাংলা একাডেমি সেই প্রকাশনীকে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। কারণ বইটিকে ঘিরে মেলায় দাঙ্গাহাঙ্গামা হতে পারত, সংবিধানের ‘মৌলিক অধিকার’ অংশের অনুচ্ছেদ থেকে যদি এই ক্ষেত্রে নীতি নিয়ে তর্ক করি তাহলে বলা যায়, তিনটি যুক্তি শামসুজ্জামানের পক্ষে রয়েছে : বইটির কারণে ১. জনশৃংখলা অবনতির আশংকা; ২. বইটিতে শালীনতার অভাব এবং ৩. বইটির নৈতিকতার সমস্যা। হ্যাঁ। এই তিনটি কারণে বাংলাদেশে বদ্বীপ প্রকাশনীকে বইমেলায় নিষিদ্ধ করা যায়। যদি আমরা তা বন্ধ করতে চাই তাহলে বাংলা একাডেমির বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করে বাংলাদেশের জন্য নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধানের জন্য আমাদের লড়তে হবে। আপাতত তর্ক এতটুকুই খাটানো যায় যে, ‘ইসলাম বিতর্ক’ বইটির বিরুদ্ধে বাংলা একাডেমির অভিযোগগুলো সঠিক কিনা। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাওয়ালাদের কাছ থেকে অভিযোগ সঠিক না বেঠিক সেই বিষয়ে কোনো লেখা আমার চোখে পড়েনি। অর্থাৎ বাংলা একাডেমির বাধানিষেধ যুক্তিসঙ্গত কিনা সেই তর্ক অবশ্যই করা যেত। করা উচিতও বটে। এখনও করা যায়। বোঝাতে চাইছি, যদি আমরা আসলেই মুক্তচিন্তার পক্ষে হই, তাহলে তর্কটা কোথায় এবং কী নিয়ে সেই বিষয়ে আমাদের সজ্ঞান ও সচেতন হতে হবে। কিন্তু ভুয়া মতপ্রকাশের স্বাধীনতাওয়ালারা সেই তর্ক করতে চান না। করেন না। তাদের মুক্তবুদ্ধির অন্তঃসারশূন্যতা এখানে সাফ সাফ ধরা পড়ে।
‘ইসলাম বিতর্ক’ বইটির জন্য হেফাজতে ইসলাম হামলার হুমকি দিয়েছিল কি? শামসুজ্জামান খান হেফাজতের নিন্দা করে কিছু হাততালি পেতে চাইতে পারেন বটে, তবে হুমকি যদি কেউ আসলেই দিয়ে থাকে তবে তারা সাংবিধানিক দায়িত্বই পালন করছে। কারণ অশ্লীলতা এবং নৈতিকতাবিরোধী বক্তব্যের জন্যই ইসলামপন্থীরা প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং সরকার ও একাডেমি উভয়েই বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী কাজ করেছেন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাওয়ালারা যদি আসলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চান তাহলে মতপ্রকাশের অধিকার বাংলাদেশের রাষ্ট্র অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধসাপেক্ষে হরণ করতেই পারে।
তর্কটা আরও গভীরে। ‘ইসলাম বিতর্ক’ বই প্রকাশের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি আইনের মামলায় গ্রন্থটির সম্পাদক শামসুজ্জোহা মানিক, ছাপাখানা শব্দকলি প্রিন্টার্সের মালিক তসলিম উদ্দিন কাজল ও বদ্বীপের বিপণন শাখার প্রধান শামসুল আলম- লেখক-প্রকাশকসহ তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। তথ্যপ্রযুক্তি আইনে কেন মামলা হল? পুলিশ জানিয়েছে, তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলার কারণ একটি ওয়েবসাইটে এই বইটি অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে, তাই তাদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে যদি আমরা দাঁড়াতে চাই তাহলে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের মতো কালো আইনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং জনগণকে সচেতন করে তোলাই আসল কাজ। যদি এই দিকগুলো আমরা বুঝি তাহলে এটাও বুঝব যারা বাংলা একাডেমির সামনে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ করছেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা তাদের উদ্দেশ্য না। বইমেলা পণ্ড করাই তাদের উদ্দেশ্য। পুস্তক ব্যবসায়ীদের অন্তর্দ্বন্দ্ব^ই এখানে মুখ্য।
তিন.
বলেছি, আধুনিক রাষ্ট্রে ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ একটি স্ববিরোধী ও অমীমাংসিত ধারণা। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ ঘোষণা দেয়, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিশ্চয়তা দান করা হইল’। গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা। কিন্তু আইনের দিক থেকে চ্যালঞ্জ এতে বাড়ে, কমে না। এর কারণ, আমরা সাধারণত মনে করি ‘চিন্তা’ মানে কী, আমরা তা জানি ও বুঝি। কিন্তু আইনের দিক থেকে প্রশ্ন থেকে যায়। চিন্তা কী, এই প্রশ্নের সুরাহা না হলে, রাষ্ট্র কীসের নিশ্চয়তা দিচ্ছে তা অস্পষ্ট ও অপরিচ্ছন্ন থেকে যায়। ‘চিন্তা’ করা ‘মত’ ইত্যাদিকে দর্শন বা বুদ্ধিবৃত্তির চর্চার জায়গা থেকে বুঝলে আইনের চলে না। আইনি অর্থে ‘চিন্তা’, ‘বিবেক’ ইত্যাদিকে আমরা বুঝব? এই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই আধুনিক রাষ্ট্র নানান অস্পষ্টতা ও পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যার গহ্বরে পড়ে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ ‘মত’, ‘মত প্রকাশ’ বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি পরিভাষা ব্যবহার করেনি। ইংরেজি ফ্রিডম অব স্পিচ অ্যান্ড এক্সপ্রেশনের অনুবাদ হিসেবে বলা হয়েছে, ‘বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার’। ফ্রিডম অব প্রেস কথাটার অনুবাদ ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা’। আমরা অনুমান করি চিন্তা-বিবেক, মত ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ধারণা হিসেবে এবং আইনি পরিভাষা বা বর্গহিসেবে পরিচ্ছন্ন ও স্পষ্ট বিষয়। কিন্তু কথাটা মোটেও ঠিক নয়। যে কারণে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কার্যত একটি অমীমাংসিত বিষয় হিসেবেই রয়ে গেছে। যারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলেন, তাদের এই গোড়ার দিকটি মনে রাখতে হবে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে যে কথাটি আমি বলে রাখতে চাই সেটা হল, ভাবনা-চিন্তার বিকাশ ও বিবেকের স্বচ্ছতা আইন বা গঠনতন্ত্র (সংবিধান বা কন্সটিটিউশন) দ্বারা নিশ্চিত করা যায় না। দরকার আইন ও সামাজিক নীতিনৈতিকতা বোধের মধ্যে কার্যকর সমন্বয়। তাহলে প্রশ্ন, একটি সমাজে সেই সমন্বয় ঘটানোর ক্ষেত্রে সামাজিক সচেতনতার মাত্রা কতটুকু? সমাজে সেই সচেতনতা কতটুকু বিরাজমান এবং তা কতটা কার্যকর? বই বা সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করার ফল কখনই সমাজ, সংস্কৃতি বা রাজনীতির জন্য ভালো হয় না। তাতে সমাজে বিভক্তি, বিভাজন, অস্থিরতা ইত্যাদি বাড়ে। আমরা যখন কোনো বিষয়ে চিন্তার পরিমণ্ডলে মতাদর্শিক বিতর্কের মধ্য দিয়ে মীমাংসা করি না, আইন-আদালত-পুলিশি ব্যবস্থা করি, তখন আমরা নিজেরাই একটি পুলিশি রাষ্ট্রের আবির্ভাব ও দানবে পরিণত হওয়ার বীজ পুঁতি। যখন সেই দানব আসলেই চোখের সামনে হাজির হয়, তখন আমরা হতচকিত হয়ে পড়ি।
যে কোনো বিতর্কের সামাজিক মীমাংসার ধারা শক্তিশালী না হলে সমাজে চিন্তার বিকাশ ঘটে না তাকে আইন দ্বারা নিষিদ্ধ করলে সমাজ পিছিয়ে পড়ে। সে কারণে আমি বই বা সংবাদপত্র নিষিদ্ধের বিপক্ষে। কিন্তু সেটা মতের স্বাধীনতা সমর্থন করি বলে নয়। সমাজ বা রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে ‘মতের স্বাধীনতা’ নামক ব্যক্তির এমন কোনো সার্বভৌম ক্ষমতায় আমি বিশ্বাস করি না, যার দ্বারা ব্যক্তি ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা, কিংবা সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য ধর্ম নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা, ফালতু মন্তব্য কিংবা নবী-রসূল, কৃষ্ণ, রাম, যীশু, মুসার জীবন নিয়ে কদর্য ভাষায় লেখালিখি করতে পারে। নিজের মতের নির্বিচার স্বাধীনতার দাবি বিমূর্ত ভূতের মতো। এই স্বাধীনতা একবার কাঁধে চাপলে নামানো মুশকিল হয়ে পড়ে। তখন ব্যক্তি ভাবতে শুরু করে যে, কোনো বিষয় নিয়ে উস্কানিমূলক, দায়িত্বহীন ও সামাজিক শৃংখলা এলোমেলো করে দিয়ে মজা দেখার চরম ব্যক্তিতান্ত্রিক আচরণই বুঝি মতের স্বাধীনতা। এই প্রকার মতের স্বাধীনতার আমি সমর্থক নই।
প্রশ্ন হচ্ছে কথা বা লেখালেখির দ্বারা কাউকে আহত করা, কারও অমর্যাদা করা, মানবিক মর্যাদা ক্ষুণœ করা কি আইন দ্বারা প্রতিরোধ করা সম্ভব? আমি মনে করি, সেটা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের সংবিধান অবশ্য কারও ‘মানহানি’ হয় এমন অপরাধের বিরুদ্ধে যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ আরোপ করার বিধান রেখেছে। কিন্তু তারপরও ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো, নবী-রসুলদের অপমান বন্ধ করার কোনো আইন নাই। ‘ধর্মীয় অনুভূতি’ আহত করার পুরনো ধারণা দিয়ে কাজ চলছে। কিন্তু আইন সমাধান নয়। আইনের দ্বারা কোনো মত, রচনা বা লেখলেখি নিষিদ্ধ ও শাস্তি দেয়ার বিধান জারি মূলত রাষ্ট্রকেই শক্তিশালী করে। তখন রাষ্ট্র তথ্যপ্রযুক্তির মতো মানবাধিকারবিরোধী আইন জারি করে।
এই অনতিক্রম্য মুশকিল ও অনিবার্য স্ববিরোধিতার পরিপ্রেক্ষিতে ঈসায়ী নববর্ষের আলোকে আমাকে যাত্রার বিবেকের মতো ‘বিবেক’, ‘বিবেক’ বলে ইতিহাসের মঞ্চে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছা করছে। তাকে স্মরণ করি, যিনি ক্রুশবিদ্ধ হয়েও তার প্রতি যারা এই নিষ্ঠুর কাজ করেছিল তাদের ক্ষমা করে দিতে পেরেছিলেন। বিবেক হচ্ছে সেই দিব্যশক্তির চর্চা যা বাস্তবতাকে শুধু বুদ্ধি-যুক্তি বা আইন দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়ে ও ভবিষ্যতের দিকে নজর রেখে বোঝার চেষ্টা করে। বিবেক বাইরে থেকে আরোপিত কোনো আইন নয়, আমাদের অন্তরের উপলব্ধি থেকে জাত ইনসাফ বা ন্যায়বিচারের ধারণা। এটা আমাদের ভেতর থেকে আসা সনির্বন্ধ তাগিদ, যা আমাদের শেখায় অপরকে হাতে মারা বা দেহে আঘাত করার চেয়েও কথা বা লেখালিখি দ্বারা কষ্ট দেয়া বা আঘাত করা অধিক অন্যায়। অপরকে কষ্ট দেয়া, কুৎসিত ও কদর্য ভাষা দিয়ে অপমান করা, এর চেয়ে অধিক অপরাধ আর কিছুই হতে পারে না। এই ক্ষরণ দীর্ঘকাল জারি থাকে। সেটা মত প্রকাশের স্বাধীনতা হতে পারে না, ক্ষরণ অব্যাহত থাকলে কোনো সমাজই রক্তপাত ও হানাহানি বন্ধ করতে পারে না। অসংখ্য জীবন দিয়ে শোধ করেও পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পাওয়া যায় না।
বিবেক বিবেক। নিজের বেলায় দইয়ের হাঁড়ি, পরের বেলায় মাথায় বাড়ি। না ভাই, এই ব্যবসা চলবে না।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন