‘বুদ্ধিজীবী’ কথাটির একটি আক্ষরিক মানে হতে পারে যারা বুদ্ধি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সবকিছুই পণ্য হয়ে ওঠে, ফলে পণ্যের সাধারণ বাজারের বিকাশ ঘটতে থাকলে ‘বুদ্ধি’ নামক বস্তুও বেচাকেনার জিনিস হয়ে ওঠে। কর্মজীবী বা শ্রমজীবী মানে কর্ম বিক্রি বা শ্রম বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করা, এই অর্থে বুদ্ধিজীবীও বুদ্ধি বেচে জীবিকা নির্বাহ করেন। যেমন, ডাক্তার, উকিল, সাংবাদিক, শিক্ষক, ইত্যাদি। তবে এর ভালো উদাহরণ হচ্ছে যাদের আমরা ‘কনসালটেন্ট’, কিংবা ‘কনসাল্টিং ফার্ম’ বলে থাকি। বুদ্ধি বিক্রিই তাদের কাজ। তার মানে বাংলাদেশে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক যে মাত্রায় বা যে স্তরে বিকাশ ঘটেছে সেখানে বুদ্ধি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ শুধু নয়, মোটামুটি বুদ্ধি বিক্রি করবার মুনাফাকারী প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে অসংখ্য।
তবে, বলাবাহুল্য, শ্রম আর বুদ্ধির চরিত্রগত পার্থক্য আছে। আমরা অনুমান করি মেহনতে বুদ্ধি খরচ হয় না। সেটা অবশ্যই সত্য না, কারণ মানুষ সবজি জাতীয় জিনিস না, তার শ্রম দেয়ার পেছনেও বুদ্ধির একটা ভূমিকা থাকে। তেমনি বুদ্ধি যারা বিক্রি করেন তাদের কোনো শারীরিক পরিশ্রম হয় না সেটাও ধোপে টেকে না। কারণ এক. শরীর ছাড়া বুদ্ধি নাই; দুই. বুদ্ধি খরচ করতে হলেও শরীরের জ্বালানি ক্ষয় হয়। আমরা শরীর আর বুদ্ধিকে যেহেতু আলাদা করে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, ফলে বুদ্ধি খরচ আর শ্রম খরচ ইত্যাদিকেও আলাদা করে ফেলি। এমনভাবে আলাদা করি যাতে মনে হয় শরীর থেকে মস্তিষ্ক আলাদা। ভাবুন, সমাজে একদল ধড় থেকে আলাদা কাটামুণ্ড হয়ে কলকারখানায় কাজ করছে, আরেক দল স্রেফ মাথা, ধড় নাই। তারা কনসাল্টিং ফার্ম চালাচ্ছে, পত্রিকা অফিসে তারাই সাংবাদিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তারাই শিক্ষক, তারাই আমলা, শাসক, ইত্যাদি।
বোঝা যাচ্ছে, যে কোনো সমাজে বুদ্ধি এবং শ্রম কী ধরনের আর্থ-সামাজিক ভূমিকা রাখে তার বিচার দরকারি এবং তাদের ফারাক বা সম্পর্ক সমাজ কীভাবে বোঝে সেটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি সমাজ টিকে থাকতে পারে তার শরীর এবং মস্তিষ্ক (অর্থাৎ বুদ্ধি) উভয়ের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন নিশ্চিত করবার মধ্য দিয়ে। সেই দিক থেকে পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিছকই বুদ্ধি তৈয়ারির কারখানার অধিক কিছু নয়। এই শিক্ষিত শ্রমিকরা কলকারখানায় উৎপাদনের জন্য জরুরি বুদ্ধির জোগান দেয়। এরা অফিসার, এক্সিকিউটিভ, ইত্যাদি। তারা শ্রমিকের মতো জীবনযাপন করেন না বটে, অফিসে সুট-টাই পরে কেতাদুরস্ত হয়ে থাকেন; কিন্তু শ্রমিকের মতোই পুঁজির হাস্যোজ্জ্বল স্মার্ট দাস ছাড়া তারা অধিক কিছু নন। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক বিচার করতে গিয়ে যদি শারীরিক মেহনত আর বুদ্ধির পরিশ্রমকে আমরা খামাখা আলাদা না করি, তাহলে এতে মনঃক্ষুণœ হওয়ার কিছু নাই। সমাজে যখন পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন প্রধান হয়ে ওঠে তখন উৎপাদনকেন্দ্রিক চিন্তার প্রাধান্য অত্যধিক হয়ে ওঠে, তখন আমরা মনে করতে শুরু করি উৎপাদনে বুদ্ধির ব্যবহার ছাড়া সমাজে বুদ্ধির আর কোনো উপযোগিতা নাই। চিন্তারও তাহলে আর কোনো ভূমিকা নাই। উৎপাদনে কাজে না লাগলে সেই বুদ্ধি বা চিন্তারও আর বিশেষ দরকার নাই।
এই অনুমান থেকেই আমরা ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে উঠি যে, শিক্ষাকে হতে হবে অর্থকরী। অর্থাৎ টাকা কামানো কিংবা কারখানার উৎপাদনের অধীনে সহযোগী ভূমিকা ছাড়া বুদ্ধি বা চিন্তার আর কোনো ভূমিকা থাকতে পারবে না। তখন মানুষের মানসিক, আত্মিক কিংবা প্রজ্ঞার বিকাশ ঘটায় এ ধরনের শিক্ষার বিরুদ্ধে সমাজের এক শ্রেণী- যারা কলকারখানা পুঁজিপাট্টার মালিক তারা ঘোরতরভাবে বিরোধী হয়ে ওঠে। তারা এমন শিক্ষাব্যবস্থা খাড়া করে যার উদ্দেশ্য স্রেফ কলকারখানা কিংবা তাদের ব্যবসার জন্য শ্রমিক তৈয়ারি হোক, তারা শ্রমজীবী কিংবা বুদ্ধিজীবী। তারা তখন আধ্যাত্মিক, নৈতিক কিংবা দার্শনিক শিক্ষা- যাকে এখনও পাশ্চাত্যে ‘লিবারেল এডুকেশন’ বলা হয়- তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। তারা দাবি করে আমাদের কোনো আধ্যাত্মিক শিক্ষার দরকার নাই। ধর্ম শিক্ষার তো প্রশ্নই আসে না। নীতিবিদ্যা পাঠ করা কিংবা নৈতিক শিক্ষারও বা কী দরকার? বাজার ব্যবস্থা এবং আমাদের ব্যক্তি বাসনার খায়েশই ঠিক করে দেবে কী ভালো আর কী মন্দ। ইউটিলিটারিয়ানরা বা উপযোগিতাবাদীরা বলবে বাজারে যার উপযোগিতা নাই, তা প্রাচীন, তাকে ফেলে দাও।
তাহলে দর্শন? হা হা হা! দর্শনের কী দরকার? কী হবে ফালতু দার্শনিক কচকচানির। তারপরও প্রাচীন অভ্যাসের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘দর্শন’ নামে একটা বিষয় পড়ানো হয়। যেসব তরুণ, এমনকি মেধাবী হলেও অন্য কোনো বিভাগে চান্স পায় না তারা দর্শন পড়তে যায়। শিক্ষার দিক থেকে বিচার করলে একটি জনগোষ্ঠী আধ্যাত্মিক, নৈতিক কিন্তু দার্শনিক বুদ্ধি বা চিন্তায় কতটা বিকশিত তার দ্বারাই আসলে তার সামষ্টিক শক্তির পরিমাপ হয়। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে দর্শন বিভাগের অবস্থান এবং তার প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে আমরা জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের খানিক বিচার করে দেখতে পারি।
দুই.
বাংলাদেশ একটি সস্তা শ্রম উৎপাদকের দেশ, একে যতই মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করার কথা বলা হোক, এটা শেষাবধি ‘মিসকিন’দের দেশ হিসেবেই আন্তর্জাতিক পরিচিতি লাভ করছে। ‘মিসকিন’ কথাটা আমি মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের শ্রমিকদের কাছে শুনেছি। আরবরা বাংলাদেশকে মিসকিন সরবরাহ করবার দেশ হিসেবেই চেনে, যারা সস্তায় ভিনদেশে উত্তপ্ত মরুভূমিতে তাদের সন্তানদের শ্রমিক হিসেবে পাঠায়। এখন নিজ দেশে কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না থাকায় মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে নদী-সমুদ্র পার হয়ে বাংলাদেশীরা ইউরোপ ও আমেরিকায় যাচ্ছে। আমরা বাংলাদেশকে ‘মিসকিন’ সরবরাহের কিংবা দেশের ভেতরে ও বাইরে সস্তা শ্রম রফতানির কারখানায় পরিণত করেছি। অভিবাসন বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের এক বড় উৎস। আজকাল এই রফতানিযোগ্য শ্রমকেও ‘শিক্ষা’ দেয়ার কথা বলা হয়, যাতে তারা ভিনদেশে গিয়ে ভালো শ্রমিক হতে পারে। শিক্ষা এখানে উদ্দেশ্য নয়, কিংবা নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের নাগরিকদের অধিকার হিসেবে আলোচিত হয় না। আলোচিত হয় স্রেফ শ্রম রফতানির বিষয় হিসেবে।
বলতে চাইছি, বাংলাদেশে শিক্ষার ভাবনা একান্তই পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনৈতিক চিন্তা ও সংশ্লিষ্ট ভাব ও ভাষার সঙ্গে জড়িত। তা-ও আবার সস্তা শ্রম রফতানির আলোকে। সেভাবে ভাবতেই আমরা অভ্যস্ত। যেমন, আজকাল দাবি উঠেছে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত সবার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত যাতে কলকারখানার মালিকরা সস্তায় শিক্ষিত শ্রমিক হিসেবে তাদের পেতে পারে। কিংবা শিক্ষিত শ্রমিক রফতানি করা যায়, ইত্যাদি। কিন্তু আসলে ‘শিক্ষা’ কী, কীভাবে তা দিতে হয়, তার ফল সমাজে ও জনগোষ্ঠীতে কীভাবে পড়ে, আমরা তা আলোচনা করতে আগ্রহী না। অর্থকরী শিক্ষার দাপটে আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও দার্শনিক শিক্ষা গৌণ, নাই বললেই চলে। এর অভাব বাংলাদেশকে একটি পঙ্গু জনগোষ্ঠীতে পরিণত করে দিয়েছে। আমাদের মাথাব্যথা নাই বললেই চলে। এর কুফলও আমরা ভোগ করছি। সন্ত্রাস, সহিংসতা, হানাহানি ভয়ংকর পর্যায়ে পৌঁছেছে। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ যখন ভাঙে তখন হিংসা হানাহানি নিত্যকার ঘটনায় পর্যবসিত হয়- সেই কথা আমি বলছি না। যে বিভেদ বা বিভাজন আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের মধ্যে মীমাংসা করা সম্ভব, আমরা তা করতে অক্ষম। কারণ আমরা বুদ্ধিহারা, চিন্তাহারা হয়েছি। এমনই বিকার ঘটেছে আমাদের যে আমরা পরস্পরের সঙ্গে কোনো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয়ে কথা বলতেও আর সক্ষম নই। টেলিভিশনের তথাকথিত টকশো সম্ভবত তার একটি নজির; কিন্তু মূল বিপদ হচ্ছে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রব্যবস্থা, গণতন্ত্র, নাগরিক ও মানবিক অধিকার ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমরা পরস্পরের সঙ্গে কথা কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠ মত, কিংবা সামষ্টিক স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে মীমাংসায় বসতে অক্ষম। সেই আলোচনার জন্য ন্যূনতম নৈতিক, দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দরকার; কিন্তু সেই শিক্ষা আমাদের নাই।
এ কথাগুলো যদি বোঝাতে সক্ষম হই তাহলে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশে যারা আসলে গভীরভাবে ভাবেন তারা বুঝবেন, বাংলাদেশের শিক্ষা সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা আদতে মোটেও শিক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে নয়, বরং উৎপাদন বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা বা নীতির অধীনস্থ একটি বিষয় হিসেবে আলোচিত হয়। শিক্ষার দিক থেকে আধুনিক পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটা গুরুত্বহীন নয়; কিন্তু তার গুরুত্ব শুধুই অর্থনৈতিক যতক্ষণ না আমরা আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও দার্শনিক শিক্ষাকে সত্যিকারের ‘শিক্ষা’ হিসেবে গুরুত্ব না দেই। কারণ এটাই সমাজ বলি, জনগোষ্ঠী বলি, জাতি বলি- তার শক্তি ও বিকাশের পূর্বশর্ত। শুধু অর্থনীতিকে একটি জনগোষ্ঠীর বিকাশের ভিত্তি গণ্য করা পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চিন্তার বিকার মাত্র। চিন্তার এই বিকারের কারণে আমরা বাংলাদেশে শিক্ষাকে অর্থকরী দক্ষতা অর্জনের অধিক কিছু ভাবতে পারি না। ভাবতে পারছি না।
মাদ্রাসা ও মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে আমাদের যে বিদ্বেষ সেটা ‘শিক্ষা’কে অর্থনৈতিক বিচার-বিবেচনার বাইরে শিক্ষার নিজস্ব পরিমণ্ডলে শিক্ষা নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে আলোচনার অক্ষমতা মাত্র। আমাদের এ অক্ষমতা প্রকট। আমার বিভিন্ন লেখায় আমি বারবার বলেছি, মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কার হতে পারে, হওয়া বাঞ্ছনীয়ও বটে; কিন্তু শিক্ষা নিছকই শ্রমিক উৎপাদনের কারখানা নয়। অর্থাৎ মাদ্রাসা শিক্ষা কেন শিক্ষার্থীদের অন্যের গোলামি করবার বা শ্রমের বাজারে সস্তা শ্রমিক হিসেবে নিজেকে বেচাবিক্রি করবার শিক্ষা দেয় না- এই অভিযোগ শিক্ষা সংক্রান্ত তর্ক নয়। বরং পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার ‘শিক্ষা’কে শ্রমিক উৎপাদনের কারখানায় পর্যবসিত করাকেই ‘শিক্ষার আদর্শ’ করবার মানসিক বিকৃতি বা বিকার। এই বিকারই নানানভাবে ইনিয়ে-বিনিয়ে প্রকাশ করা হয়। বলা হয় মাদ্রাসার ছাত্ররা চাকরি পাচ্ছে না, যে শিক্ষা তারা পায় তাতে তারা কোনো অর্থকরী কাজ করতে পারে না, ইত্যাদি।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য দক্ষ শ্রমিক দরকার, সেটা তর্কের বিষয় নয়। আমাদের ইঞ্জিনিয়ার, পদার্থবিজ্ঞানী, কম্পিউটার বিজ্ঞানী, রসায়নবিদ দরকার- অবশ্যই। কিন্তু সেটা ভিন্ন তর্ক; কিন্তু আমাদের আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও দার্শনিক শিক্ষাও সমান মাত্রায় দরকার। সমাজে দক্ষতা বৃদ্ধি যেমন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য জরুরি, আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও দার্শনিক শিক্ষাও আমাদের চিন্তাশীল ও দায়িত্ববান করে তোলার জন্য জরুরি; কিন্তু মাদ্রাসার প্রতি বিদ্বেষবশত আমরা যা চাই তা হচ্ছে মাদ্রাসাকে ধ্বংস করা। আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও দার্শনিক শিক্ষার যে অবশিষ্ট জায়গাগুলো রয়েছে সেগুলো নষ্ট করা। হতে পারে আধ্যাত্মিক, নৈতিক বা দার্শনিক শিক্ষার জন্য মাদ্রাসা- ‘আদর্শ’ হিসেবে নিজেদের হাজির করতে পারেনি। সেটা হতেই পারে। আসুন, তা নিয়ে আলোচনা হোক। আর সেই ক্ষেত্রে সংস্কারের কাজ মাদ্রাসা নিজেই করতে সক্ষম; কিন্তু তাদের ধ্বংস করে ‘আধুনিক’ পুঁজিতান্ত্রিক কারখানায় পর্যবসিত করা কোনো যুক্তি হতে পারে না। মাদ্রাসাকে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার ‘যুগোপযোগী’ করার অর্থ মাদ্রাসাকে একটি পুঁজিতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা। মাদ্রাসার কাজও হবে আধুনিক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষিত শ্রমিক সরবরাহ। সে কারণে আমি সবসময় মাদ্রাসাকে ‘যুগোপযোগী’ করবার চিন্তাভাবনার বিরোধিতা করেছি ও করি। বারবার দাবি করেছি মাদ্রাসা যখন ‘আধ্যাত্মিক’ শিক্ষাকেই ‘শিক্ষা’ বলে দাবি করে তখন পুঁজিতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থার বিপরীতে এর রাজনৈতিক ও দার্শনিক অবস্থানের গুরুত্ব আমার কাছে অপরিসীম। সিপাহি বিদ্রোহের (১৮৫৭) পর ঔপনিবেশিক আমল থেকেই গোলামির জিঞ্জির ভাঙবার যে লড়াই শুরু হয়েছে মাদ্রাসা তারই ধারাবাহিকতা মাত্র। হতে পারে, মাদ্রাসা আমাদের প্রত্যাশা মেটায়নি, বা তার ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি; কিন্তু তার সমাধান মাদ্রাসার ‘আধুনিকীকরণ’ নয়। শিক্ষা সম্পর্কে আমাদের পুঁজিতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা বদলানো এবং মাদ্রাসাসহ আমাদের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অন্যান্য শিক্ষার পাশাপাশি আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও দার্শনিক শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা।
পরিশেষে ‘আধ্যাত্মিক’ কথাটার একটা ব্যাখ্যা জরুরি। ‘আধ্যাত্মিক’ শব্দটি আমরা মরম, মিস্টিক বা ধর্মীয় ব্যাপার হিসেবে এখন বুঝি। পাশ্চাত্যে দার্শনিকরা যখন ‘স্পিরিট’ কথাটি ব্যবহার করেন তখন যেভাবে আমরা ‘আধ্যাত্মিক’ বুঝি, সেই অর্থে ব্যবহার করেন না। সেই ব্যবহারে ধর্মচেতনার সম্পর্ক থাকে; কিন্তু স্পিরিট একইসঙ্গে ঐতিহাসিক কর্তাও বটে। আমাদের উপলব্ধি, ইচ্ছা, অনিচ্ছা, অভিপ্রায়ের সঙ্গে যুক্ত।
আধ্যাত্মিক শব্দটি বাংলা ভাষায় বানানো। অর্থাৎ যা ‘আত্মা’ বিষয়ক। আত্মার কারবার ‘আমি’ নিয়ে। শরীরী মানুষের অভ্যন্তরে যে সচেতনতা ‘কর্তা’ হিসেবে বিরাজ করে তাকে সজ্ঞান ও সচেতন করবার শিক্ষাই আধ্যাত্মিক শিক্ষা। উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজে ও ইতিহাসে এমন কর্তার আবির্ভাব যার কাজ হবে বিদ্যমান ব্যবস্থার রূপান্তর ও মানুষের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার বৈপ্লবিক নজির স্থাপন করা।
আমি সবসময়ই সেই আবির্ভাবের স্বপ্ন দেখি, যেন সেটা শুধু স্বপ্ন না হয়, স্বপ্ন হিসেবে ফুরিয়ে না যায়, তাই ব্যবহারিক কায়কারবারে কীভাবে তাকে বাস্তবায়িত করা যায় তার মওকা খুঁজি।
শিক্ষা তেমনি একটি ক্ষেত্র। বুদ্ধি, চিন্তা ইত্যাদির চর্চাও কর্তার পরিগঠন ও আবির্ভাবের জন্য জরুরি।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন