পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায় লিখতে গিয়ে ‘পাশ্চাত্য’, ‘ইসলাম’ ইত্যাদি নানান পরিভাষা আমাকেও ব্যবহার করতে হয়। নামচিহ্ন হিসেবে ব্যবহারের ভুল না হলেও এর অন্তর্নিহিত মুশকিলের দিক হচ্ছে, যে প্রসঙ্গের মধ্যে দাঁড়িয়ে পরিভাষাগুলো আমরা ব্যবহার করি তার স্থান-কাল-পাত্র অনুধাবন না করলে পরিভাষা ভুল ধারণা তৈরি করতে পারে। যেমন, ইসলাম একটি ধর্মের নাম। একে নানানভাবে বিভিন্ন ধারা, ফেরকা, মজহাব, সম্প্রদায় নিজেদের মতো করে বোঝে। ফলে ‘ইসলাম’ কথাটা নিলেই আমরা সবাই তার একই অর্থ বুঝব তার কোনো গ্যারান্টি নেই। অতএব ভুল বোঝার বিপদ থেকেই যায়। ইসলামের বিরোধিতা করলেই কেউ রাতারাতি ইসলামবিদ্বেষী হবেন তা নয়, তিনি হয়তো ইসলামের নামে চালু এমন কিছুর বিরোধিতা করছেন যা ইসলামের মহিমা রক্ষার জন্যই জরুরি।
তাহলে ইসলামবিদ্বেষ কথাটা বললেও এ বিদ্বেষের অর্থ পূর্ণ হয় না। বিদ্বেষটা কীসের? কীভাবে তার প্রকাশ ঘটে? এটা কি নবী-রসুলদের জীবন নিয়ে কুৎসিত লেখালেখি মাত্র? নাকি কথা বা লেখালেখির ঔদার্যের মধ্যে কোনো বিদ্বেষের ছিটেফোঁটা না থাকলেই আরও নানানভাবে মধুর ভাষায় ইসলামবিদ্বেষ চর্চা সম্ভব। তাকে চিহ্নিত করাও অসম্ভব কিছু নয়। সেটা দরকারও বটে। এ চিহ্নিতকরণ কোনো মানুষকে অপদস্থ বা নিন্দা করার জন্য নয়। এটা বোঝা দরকার যে, আমাদের অনেক সৎ ও সরল অনুমানের মধ্যে ইসলামবিদ্বেষ ও বর্ণবাদের গভীর অসুখগুলো লুকিয়ে থাকে। নির্লজ্জভাবে তারা প্রকাশিত হয়ে পড়ে, তখন তাদের কিলবিল চলন দেখে বোঝার উপায় থাকে না আমরা এসব কীট চিন্তার গভীরে বয়ে বেড়াই।
ঠিক তেমনি ‘পাশ্চাত্য’ কিংবা ‘প্রাচ্য’ নামক স্থির ও অবিচল কোনো ধারণা যেমন নেই, তার কোনো চিরায়ত মানেও নেই। অথচ ‘পাশ্চাত্য’ কথাটা যখন আমরা বলি তখন এ সিম্পল নামোচ্চারণ ‘পাশ্চাত্য’কে একটি চিরায়ত সত্তা প্রদান করার বিপদ ঘটায়। দার্শনিকরা বলে থাকে এ বিপদ হচ্ছে কোনো বিষয় বা ধারণাকে ঐতিহাসিকভাবে না বুঝে তাকে এসেন্সিয়ালাইজ করার প্রবণতা, ওর মধ্যে একটা চিরায়ত সত্তা অনুমান করার বিপদ। তাহলে বাস্তব ইতিহাসের জায়গা থেকে যে কোনো পরিভাষা, ধারণা বা প্রত্যয়কে বোঝার একটা কর্তব্য আমাদের থেকেই যায়। এ কাজটার পনেরো আনা দর্শনের কাজ, এক আনা (সম্ভবত) ইতিহাসবিদদের। দর্শন কেন? কারণ কোনো নামচিহ্নের মধ্যে চিরায়ত অর্থ অনুমান করা কেন বিপদের সেটা দর্শন, বিশেষত একালের ভাষা পর্যালোচনা বা চিহ্নবিচার যতটা পারঙ্গম, অন্যান্য শাস্ত্র সেই তুলনায় অসহায়। ইতিহাসও লিখতে হয় কোনো না কোনো ভাষায়। যে ভাষায় ইতিহাস লেখা হয় সেই ভাষার অধীনে থেকে ইতিহাসবিদকে লিখতে হয়। সেই ইতিহাস পাঠকের মধ্যে কী ধরনের অর্থ তৈরি করবে ভাষা সেটা শুধু নির্ণয় করে না, সরাসরি ভূমিকাও রাখে। অথচ ভাষার বিচার সরাসরি ইতিহাসবিদের কাজ নয়। সেটা দার্শনিকের ক্ষেত্র। ইতিহাসবিদ ভাষা বা নামচিহ্ন বিচার করবেন না তা নয়; কিন্তু তখন তাকে ইতিহাসের পরিমণ্ডলের বাইরে এসে দাঁড়াতে হয়। এজন্য বলি, কাজটার পনেরো আনা দর্শনের।
প্রাচ্য/পাশ্চাত্যের দ্বন্দ্ব কথাটা যখন আমরা আমাদের লেখালেখিতে ব্যবহার করি, তখন কোন অর্থে কী প্রয়োজনে ব্যবহার করছি সেদিকে মনোযোগ নিবিষ্ট না রাখলে পরিভাষাগুলোর মধ্যে একটি চিরায়ত বা চিরস্থায়ী অর্থ তৈরির বিপদ দেখা দেয়। দুটি পরিভাষা বা ধারণাকে পরস্পরের বিপরীতে রেখে চিন্তা করার যে অভ্যাস, তা বাইনারি বা নদিয়ার ভাবচর্চার ভাষায় ‘দুইয়ের গণ্ডগোল’ নামে খ্যাত। বাইনারি চিন্তা বিচার করতে গিয়ে একদল বলে থাকে, একটিকে অন্যটির বিপরীতে রেখে ভাবনা শুধু মুশকিলের নয়, বরং এটি একটিকে অধিক মূল্য দিয়ে অন্যটিকে হীন প্রমাণের চেষ্টা। যেমন প্রাচ্যের যা খারাপ তা পাশ্চাত্যে নেই- এ বাইনারি ভাবনা দ্বারা পাশ্চাত্যকে সংজ্ঞায়িত করে পাশ্চাত্যকে মহান আর প্রাচ্যকে ছোট করা বাইনারি চিন্তার একটি ধরন। এর পাল্টা চিন্তাও বাইনারি দোষে দুষ্ট। যেমন পাশ্চাত্যের যা খারাপ তা প্রাচ্যে নেই এ অনুমান দিয়ে পাশ্চাত্যকে সংজ্ঞায়িত করা এবং প্রাচ্যের তুলনায় পাশ্চাত্য খারাপ প্রমাণ করাও বাইনারি চিন্তা বটে।
নদিয়ার ভাবান্দোলনে জহরদ্দি শাহ যে বাইনারি চিন্তাকে বহু বছর আগে নাকচ করেছিলেন, সেটা ধর্ম চিন্তা বা ভাবচর্চার সঙ্গে যুক্ত। যেমন, যারা মনে করে দুনিয়া হল এপারে, আর ধর্মকর্ম সব ওপারের কারবার- এই যে দুই জগতে বাস করার অভ্যাস এটাই দুইয়ের গণ্ডগোল। বাইনারি চিন্তার অভ্যাসের কারণে মানুষের জগৎকে আমরা এভাবে দ্বিখণ্ডিত করি।
এপারে দুনিয়া ওপারে দ্বীন
আশেক জনা না করে ভিন
হয়েছে মাশুকের অধীন, ভিন্ন নাই এক রতিমাশা।।
নদিয়ার চৌধুরীর ঘরের জহরদ্দি শাহের একটি বিখ্যাত গান। এইদিকে বা এপারে দুনিয়া, দুনিয়াবি কাম-কাজ আর ওই পারে বা পরকালের জন্য ধর্মকর্ম, সত্যিকারের ধার্মিক বা ভাবুকই দুই ধরনের গণ্ডগোলে খাবি খায় না। ভাবুক তার মাশুক বা আল্লাহর দাসে (প্রেমিকে) পরিণত হয়েছে। তার আবার ইহকাল/পরকাল ভেদ কী?
সহজ মানে হচ্ছে, পরকালের কথা বলে কোনো ধার্মিক যেমন ইহকালের দায় অস্বীকার করতে পারেন না, ঠিক তেমনি ইহকালের কথা বলে পরকালের কর্তব্যও কোনো ইহলৌকিক মানুষ বাদ দিতে পারে না। কিন্তু এ দ্বিবিভাগই তো ঘটে। কারণ আমরা দুইয়ের গণ্ডগোলে দুষ্ট, দূষিত। আমরা দুই ছাড়া ভাবতে পারি না। বাইনারি চিন্তা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ধার্মিক কী নাস্তিক উভয়েই একই দোষে দুষ্ট। এ কারণে ফকির লালন শাহসহ নদিয়ার সব ভাবুক ‘দুইয়ের গণ্ডগোল’ থেকে নিজেদের মুক্ত করার জন্য সারাজীবন সাধনা বা প্রাণপাত করে গিয়েছেন। বাইনারি চিন্তার বিপদ আমরা এখন জাক দেরিদাসহ পাশ্চাত্য দার্শনিকদের কাছ থেকে নতুন করে শিখছি বটে, নদিয়ার ভাবচর্চার সঙ্গে আমাদের নাড়ির যোগ থাকলে আমরা বাইনারি চিন্তার গোড়ার বিপদ সম্পর্কে বহু আগেই সচেতন হয়ে উঠতাম।
দুই
তাহলে এটা আমরা ধরে নিতে পারি যে, প্রাচ্যকে মহান প্রমাণ করার জন্য পাশ্চাত্যের নিন্দা, কিংবা পাশ্চাত্যের মহিমা গাইবার জন্য প্রাচ্যকে হীন প্রমাণের প্রয়াস দুটোই দুইয়ের গণ্ডগোল। বাইনারি চিন্তার খাসিলত বর্জন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। চিন্তার বিকার বা নিরর্থক নিজেকে মহিমান্বিত করার জন্য অপরকে হীন করার অভ্যাস থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা খুবই জরুরি। আমি ইসলাম প্রসঙ্গে লেখালেখি করি। আমি মনে করি ইসলাম সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করার মধ্যে ষোল কোটি বাংলাদেশীর বিশ্বসভায় টিকে থাকা না থাকার প্রশ্ন নিহিত। ফলে ‘ইসলাম’ আশির দশক থেকেই আমার চিন্তাভাবনার কেন্দ্রীয় বিষয়। কিন্তু এ দুইয়ের গণ্ডগোল থেকে মুক্ত থাকার জন্যই আমি জাতিবাদী বাঙালিত্ব কিংবা জাতিবাদী মুসলমান এ দুই ধরনের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ঘোর বিরোধী। জাতিবাদ আর ইসলাম দুটো ভিন্ন বিষয়। কিন্তু জাতিবাদের প্রশ্ন পরিচ্ছন্ন না হলে ইসলাম নিয়ে কোনো সারগর্ভ আলোচনা সম্ভব কিনা আমি সন্দিহান। বাইনারি চিন্তার খাসিলত বাদ দেয়ার অর্থ হচ্ছে, অন্যান্য ধর্মের বিরুদ্ধে ইসলামকে দাঁড় করিয়ে ইসলামের মহিমা কীর্তনও আমি আমার কর্তব্য বলে মনে করি না। আমার দাবি অতটুকুই যে, ঐতিহাসিকভাবে ইসলামের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা আছে, যা পরিচ্ছন্নভাবে বোঝা এবং এখনকার বিশ্ববাস্তবতায় তার উপযোগিতা বিচার খুবই জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। বাইনারি চিন্তার খাসিলত ত্যাগ না করলে তার ধারেকাছে পৌঁছানো অসম্ভব।
‘পশ্চিম’ বা ‘পাশ্চাত্য’ সম্পর্কে আগাম অনুমান বা চিরায়ত বদ্ধ ধারণা পুষে রাখা মুশকিলের, সেটা আজকাল অনেকেই বলছেন। ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী চিন্তার ধরন বা কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসার জন্যই সেটা দরকার। তবে আফ্রিকা, এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা থেকে যেসব লেখক, ভাবুক, চিন্তাশীল এ বিষয়ে লেখালিখি করছেন, তাদের লেখালেখি সম্পর্কে বাংলাদেশের লেখক, ভাবুক, কবি, সংস্কৃতিবানদের খবর রাখা বিশেষভাবে উচিত বলে আমি মনে করি। কিন্তু সবাই নয়। ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাচেতনার বিরুদ্ধে এসব দেশে লড়াইয়ের প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের লড়াই-সংগ্রামের মিল আছে। তারা এমন সব প্রশ্ন তুলতে সক্ষম, যা পাশ্চাত্যের লেখকদের পক্ষে তোলা ঐতিহাসিক কারণে সম্ভব নয়।
একইভাবে ‘ইসলাম’ সম্পর্কে বদ্ধমূল ধারণা পুষে রাখা চরম মুশকিলের। অনেক উদার চিন্তার মানুষও এ অসুখে ভোগেন। তারা প্রকাশ্য ইসলাম বিদ্বেষের নিন্দা করেন বটে; কিন্তু প্রাচীন ও বদ্ধমূল চিন্তাচেতনা থেকে তারা কিছুতেই মুক্ত হতে পারেন না। যেমন তারা বলবেন, ইসলামবিদ্বেষ খারাপ ঠিক আছে; কিন্তু সমকামিতা কিংবা নারীর অধিকারের দিক থেকে দেখলে পাশ্চাত্য সভ্যতা ইসলামের চেয়ে উন্নত। ইসলাম সমকামিতাকে সহ্য করে না, নারীদের বোরখার মধ্যে বন্ধ করে রাখে- এ বদ্ধমূল অনুমান দিয়ে তারা সারা রাত রামায়ণ পড়ে সকালে সীতার বাপের নাম জিজ্ঞাসা করতে থাকেন। বাইনারি চিন্তার খাসিলত ত্যাগ করা খুব সহজ নয়।
তবে ইসলাম বিদ্বেষের রূপ কী হতে পারে তার একটি প্রমাণ পেলাম সাম্প্রতিক তথাকথিত লিটারারি ফেস্টিভ্যালে। ফেস্টিভ্যালওয়ালারা একজন নোবেল লরেটকে আমন্ত্রণ করে এনেছেন। তিনি বয়স্ক মানুষ, বাংলাদেশ মেহমানদারিতে কোনো আপত্তি করে না। কিন্তু যখন ফেস্টিভ্যালের আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে একজন চরম ইসলামবিদ্বেষীকে নিয়ে আসা হয় তখন তা মেনে নেয়া খুবই কঠিন বটে।
ভিএস নাইপল সম্পর্কে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ খুব একটা জানে না। সেটা ভালোই হয়েছে। নীরবে নাইপল বাংলাদেশে এসে ঘুরে গিয়েছেন। কিন্তু একজন ক্ষুদ্র লেখক হিসেবে লিটারারি ফেস্টিভ্যালের আয়োজকদের জিজ্ঞাসা করা আমি কর্তব্য মনে করি, আপনারা কী বুঝে নাইপলের মতো চরম ইসলামবিদ্বেষীকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ করে আনলেন? নাইপল সম্পর্কে আমি আজ কিছুই বলছি না। শুধু ঢাকা লিটারারি ফেস্টিভ্যালের ওপর ‘প্রথম আলো’র গদগদ রিপোর্টই না হয় পড়ি। একজন লেখক ভিনদেশে ও ভিন্ন ভাষায় বড় লেখক হতেই পারেন; কিন্তু এ লোকটির চরম ইসলামবিদ্বেষ পৃথিবীব্যাপী কুখ্যাত। ব্যক্তি হিসেবে কিংবা সাহিত্যিক হিসেবে তার বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। তিনি যা খুশি লিখুন। কিন্তু ঢাকা লিটারারি ফেস্টিভ্যাল তাকে ডেকে এনেছে তাদের উৎসবের অলংকার হিসেবে। প্রশ্ন হল, তাহলে তসলিমা নাসরিন কী অন্যায় করেছে? তাকে আনলেন না কেন? তসলিমা এ দেশের মেয়ে, সে বাংলা ভাষায় লেখে। কবি। মোটেও খারাপ কবিতা লেখে না। তার তো বাংলাদেশে আসার ও ফেস্টিভ্যালে যোগদানের পূর্ণ অধিকার আছে। বহু ফালতু লেখককে দেখেছি আপনাদের উৎসবে। তাহলে?
নাইপল সম্পর্কে প্রথম আলো একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তারাও নাইপলের ইসলামবিদ্বেষ সম্পর্কে চুপ থাকতে পারল না। নাইপল তার স্বরে বলে থাকেন, ‘যেসব দেশে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে, সেসব দেশের মানুষের বুদ্ধিনাশ ঘটেছে।’ এ দেশ নাইপলের চোখে ধর্মান্তরিত মানুষদের দেশ, যারা হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে। এদের বুদ্ধিনাশ হয়েছে বলেই তারা হিন্দু না থেকে মুসলমান হয়েছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে এ হচ্ছে নাইপলের ধারণা, যা ধর্মান্তকরণ সম্পর্কে তার অনুমানের পরিণতি। প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকেই উদ্ধৃতি দিলাম। দেখুন, ‘ঢাকায় ভি এস নাইপল’ (২৫ নভেম্বর ২০১৬)।
বুঝি না, যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ‘বুদ্ধিনাশ’ হয়েছে সেই দেশে তিনি এলেন কেন? ঢাকা লিটারারি ফেস্টিভ্যালের আমি বিরোধী নই; কিন্তু এ ধরনের ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষীদের আমন্ত্রণ করে এনে সাহিত্যের নামে তারা রাজনীতি করছেন, চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন ভূমিকা পালন করেছেন। ভিএস নাইপলকে বাংলাদেশে এনে তাদের ফেস্টিভ্যালের ভাবমূর্তির মারাত্মক ক্ষতি যেমন করেছেন; তেমনি সাহিত্য ও রাজনীতির সম্পর্ক সম্বন্ধে তাদের চরম অজ্ঞতাও প্রকাশ করলেন।
প্রশ্ন উঠেছে, খামাখা ইসলামবিদ্বেষী লোক এনে ঢাকা লিটারারি ফেস্টিভ্যাল বাংলাদেশের সাহিত্যমোদী ও জনগণকে কী মেসেজ দিতে চায়? শেষমেশ নিজেদের সাম্প্রদায়িক ও ইসলামবিদ্বেষী কুৎসিত চেহারাটা উন্মুক্ত করা ছাড়া? বুঝুন কারবার! একটি আন্তর্জাতিক ফেস্টিভ্যালের গুরুত্ব আয়োজকরা তাদের অজ্ঞতা ও অবিবেচনার জন্য দেশের জনগণের বিপরীতে দাঁড় করাল। এলিট শ্রেণীর গণবিচ্ছিন্নতা ও তাদের মনে পুষে রাখা বর্ণবাদ এভাবে নোংরা ময়লার মতোই গলগল বেরিয়ে পড়ে। কারণ নাইপলের লেখা বর্ণবাদী, ইসলামের প্রতি তার ঘৃণা কুৎসিত। তার দাবি, ‘ইসলামে ধর্মান্তরিত মানুষের দেশগুলোতে নিউরোসিস ও নিহিলিজমের উপাদান আছে।’
ভিএস নাইপল খোদ ভারতেও বিতর্কিত। দুনিয়ায় কি আর কোনো নোবেল লরেট ছিল না? ভিএস নাইপলকেই আনতে হবে? ঢাকা লিটারারি ফেস্টিভ্যাল সাহিত্য ফেস্টিভ্যালের কথা বললেও শেষাবধি হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রচারক ছাড়া অধিক কিছু হতে পারল না। আফসোস। প্রথম আলো এত কিছু জানার পরও গদগদ। লিখছে : ‘এমন বড় মাপের একজন কথাশিল্পীকে আমরা অবশেষে এ শহরে পেলাম। ধন্যবাদ ঢাকা লিট ফেস্টের আয়োজকদেরও।’ মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন!
নাইপলের ইসলামবিদ্বেষ কী পরিমাণ তীব্র সেটা তসলিমা নাসরিনের বক্তব্য থেকে বুঝুন। ‘Naipaul is definitely Muslim hater’- ইন্ডিয়া টুডে’তে তসলিমার বক্তব্য। লিটারারি ফেস্টিভ্যালওয়ালারা আপনারা তসলিমাকেও শরমে ফেলে দিলেন!
বাংলাদেশে যখন আমি ইসলামবিদ্বেষীদের সম্পর্কে বলি, তখন এলিটদের গণমাধ্যম, সাহিত্যচর্চা, সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা, মনে পুষে রাখা বর্ণবাদ ইত্যাদির কথা মনে রেখেও বলি। এরা ইসলামের বিরুদ্ধে ক্রুসেডে যোগ দিয়েছেন বলে নয়। কিংবা কথায় কথায় অন্যদের মতো এরা ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্বেষী বা কটু বাক্যও বলেন না। এরা ভদ্রলোক। এটা তাদের বাইরের পোশাক। অন্তরে বর্ণবাদী। যে লোকটি তাদের বাপ-দাদা সম্পর্কে বাজে কথা বলে গেল তার সঙ্গেই এদের কোলাকুলি। এ ধরনের একজন ইসলামবিদ্বেষীকে তাদের ফেস্টিভ্যাল অলংকৃত করার জন্য আনা এবং তিনি এসেছেন বলে অপরিসীম কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে যাওয়ার মধ্যে যে হীনমন্য মানসিকতা তা ধরিয়ে দেয়া আমার কাজ বলে মনে করি।
ভিএস নাইপল? না, তার সম্পর্কে আমার কোনো অভিযোগ নেই। তিনি ইসলামের বিরুদ্ধে ক্রুসেডের একজন সৈনিক মাত্র। তার সঙ্গে মোকাবেলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে নয়, রাজনীতির মধ্য দিয়েই অনিবার্যভাবে ঘটবে। আমরা কেউই বাস্তব ইতিহাসের বাইরে নই।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন