বাংলাদেশের আলেম-ওলামাদের প্রতি আহ্বান থাকবে, তারা এদিকে মনোযোগ দেবেন যেন কোনোরকম সাম্প্রদায়িকতা প্রশ্রয় না পায়। বাংলাদেশে নিরাপত্তার বিশাল একটি দায় আলেম-ওলামাদের ভূমিকার ওপর নির্ভরশীল। দ্বিতীয়ত আহ্বান থাকবে বাংলাদেশের নারী প্রশ্ন নিয়ে যারা কাজ করছেন, বিশেষত নারী মুক্তির আন্দোলন-সংগ্রামকে সামাজিক-রাজনৈতিক ভিত্তি দিতে চাইছেন, তাদের প্রতি। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের রণনীতি হিসেবে নারীকে সবসময়ই ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বারুদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনা এবার গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার ধরনের মধ্যে বেশ বড়সড় পার্থক্য লক্ষ্য করেছি। আগে যেমন দেখা যেত খেয়ে না খেয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে ইসলামপন্থী বা মৌলবাদীদের ওপর দোষ চাপিয়ে দেয়া, তেমন দেখা যায়নি। মন্দির ভাংচুরের পেছনে জামায়াত-শিবির-হেফাজতিদের ‘কালো হাতের’ দাবি যতটা উঠবে ভেবেছিলাম ততটা ওঠেনি। ভাবছিলাম, সস্তা রাজনীতির দিন কি শেষ হয়ে এসেছে? কিন্তু অভিযুক্ত না করাও বাংলাদেশের জনগণের জন্য কম বিপদের নয়। ঘটনার কারণ ব্যাখ্যাকে কেন্দ্র করে যে নতুন বয়ান শক্তিশালী হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বোঝা এবং তার মোকাবেলার তর্ককে তা আরও গভীর গহ্বরে ঠেকিয়ে দেবে। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরিস্থিতির কারণে সেটা বাংলাদেশের জন্য আরও ভয়াবহ বিপদ তৈরি করবে। সে বিষয়েই আজকের লেখা।
ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোকে দোষারোপ করার সুবিধা আছে। এই অভিযোগের গল্পটা যেভাবে বলা হয় তাতে বাংলাদেশের জনগণ কিন্তু বেঁচে যায়। সেটা কেমন? ইসলামপন্থীরা বাংলাদেশকে একটি ধর্মরাষ্ট্র বানাতে চায়, কিন্তু বাংলাদেশ লড়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্য। বাংলাদেশের জনগণ ভালো, কিন্তু নষ্টের গোড়া ইসলামপন্থীরা। তারা ধর্মকে রাজনীতিতে ‘ব্যবহার’ করে। এটা তাদের করতে দেয়া উচিত নয়। সমাধান হচ্ছে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা। হিজবুত তাহরির নিষিদ্ধ হয়েছে, জামায়াত-শিবিরকেও নিষিদ্ধ করতে হবে। বাংলাদেশের জনগণকে ধর্মীয় রাজনীতির দোষ থেকে মুক্ত রাখতে হবে।
এই গল্প চেতনাবাদীদের রাজনীতি নামে খ্যাত। ইসলামপন্থীরা চেতনাবাদের দুশমন। তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াইয়ের রণনীতি হিসেবে এ বয়ান এই কিছুদিন আগেও প্রবলভাবে জারি ছিল। এই বয়ান খাটিয়ে শেখ হাসিনা বিএনপিকে মোটামুটি সাইজ করে ফেলেছেন। বিএনপিসহ বিশদলীয় জোটের অংশীদাররা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট বেঁধে প্রমাণ করেছে তাদের সবার আদর্শ এক। এরা পাকিস্তানবাদী, ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করে। শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে তার কথাবার্তা দিয়েও এই মহৎ সত্য বারবার হাজির করেছেন। এটা তার বিশাল সাফল্য।
তার সফলতার একটি কারণ হচ্ছে, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা এবং কূটনীতিকে নিজের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কাজে খাটানো। তিনি প্রমাণ করেছেন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের বিশ্বব্যাপী ময়দানে তিনি স্থানীয় সেনাপতি। শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তার পক্ষেই গিয়েছে। বলাবাহুল্য, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সাফল্য বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কিংবা অর্থনৈতিক অগ্রগতি বা সাফল্য কিনা সেটা ভিন্ন বিতর্ক। সেই তর্কে দৈনিক পত্রিকার উপসম্পাদকীয় কলামে প্রকাশ্যে প্রবেশের সুযোগ আমাদের মতো অধম লেখকদের জন্য খুবই সীমিত। আমরা পুরনো রাজনৈতিক বয়ানের পাশাপাশি নতুন রাজনৈতিক বয়ানের সম্ভাব্য শক্তিশালী আবির্ভাব নিয়েই এখানে কথা বলছি। নতুন বয়ান হচ্ছে, হিন্দুর মন্দির ভাঙা, বাড়িঘর লুট করা, তাদের মেয়েদের ধর্ষণ শুধু ইসলামপন্থীরা করছে না। ইসলামপন্থী রাজনীতির কারণেও ঘটছে না। ঘটনাস্থলে দাড়ি, টুপি, সাদা কোর্তা, সাদা পায়জামা পরা লোকজন পাওয়া যাচ্ছে না। যাদের পাওয়া যাচ্ছে তাদের অধিকাংশই প্যান্ট-শার্ট পরা। অনেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা, পাণ্ডা কিংবা সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। সমস্যাটা তাহলে কোথায়? আসলে সমস্যাটা, চেতনাবাদীদের মতে, খোদ ইসলাম ধর্মের মধ্যে। আওয়ামী লীগ করুক, কিংবা বিএনপি-জামায়াত, মুসলমান মানেই খতরনাক জাতি! সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দেশে সংখ্যালঘু হিন্দু বাঘের ঘরে ছাগলের ছানার মতো। কোনোমতেই নিরাপদ নয়।
চেতনাবাদী বয়ানের দাবি হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষ চেতনাবাদ কায়েমের জন্য লড়েছে। কিন্তু একাত্তরের মতো বাংলাদেশের জনগণকে পাকিস্তানের অধীনে আবার ফিরিয়ে নেয়ার জন্য লড়ছে ইসলামপন্থীরা। এরা পরাজিত শক্তি। একাত্তরে এদের নির্মূল করা যায়নি। কিন্তু এখন করতে হবে। ইসলামপন্থার মধ্যে কোনো ভেদবিচারের দরকার নাই।
হিন্দুদের মন্দির-বাড়িঘর ভাঙার জন্য ইসলামপন্থীদের ওপর দোষারোপ করার সুবিধা হচ্ছে অন্তত ঢালাওভাবে বাংলাদেশের জনগণকে এই বয়ানে দোষারোপ করা হয় না। দোষ মূলত জামায়াত-শিবিরের। সঙ্গদোষে অন্য ইসলামী দলগুলোও দোষী, বিশেষত যদি তারা চেতনাবাদী রাজনীতির বিরোধিতা করে। তবে ঢালাওভাবে মুসলমানদের দোষ দেয়া হয় না। তবে দোষারোপের একটি শক্তিশালী বয়ান সবসময়ই জারি ছিল। তার প্রকট প্রচার থাকলেও চেতনাবাদী রণনীতি ও রণকৌশলের প্রাধান্যই বেশি ছিল। বাংলাদেশের মানুষ সহনশীল, ধর্মনিরপেক্ষ। কিন্তু ইসলামপন্থীরা সমস্যা।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা নিরাপদ নয়; নিয়মিত তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়; তাদের পুড়িয়ে মারা হয়; তাদের মেয়েদের নিয়মিত ধর্ষণ করা হয়; এমনকি শিশুরাও বাদ যায় না। তসলিমা নাসরিন ‘লজ্জা’ দিয়ে যেদিন থেকে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ঢালাওভাবে লজ্জা দিতে শুরু করলেন সেদিন থেকেই মুসলমান হিসেবে সবাই যারপরনাই বিস্মিত ও লজ্জিত হয়ে উঠতে শুরু করলেন। ঢালাও দোষারোপের এই রাজনৈতিক বয়ান চেতনাবাদী বয়ান থেকে আলাদা। তাকে আলাদা করে বোঝার দরকার আছে।
দুই
বাংলাদেশ কি হিন্দুদের দেশ নয়? কিন্তু হিন্দুরা দলে দলে বাংলাদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে কেন? এই প্রচার তসলিমা সম্পর্কে বিজেপিকে দারুণ আগ্রহী করে তোলে। একটি মুসলমান মেয়ে মুসলমান ও ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে বলছে। তদুপরি তার রয়েছে সংখ্যালঘু হিন্দুর জন্য অকুণ্ঠ ভালোবাসা। বিজেপি তসলিমায় মুগ্ধ হয়েছিল। তারা ‘লজ্জা’ বইটি কপি করে প্রচারের ব্যবস্থা করে। মনে রাখা দরকার, ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থানের কালে এ ধরনের বইয়ের ভূমিকা আছে। ইসলাম মানেই বদ ব্যাপার এবং মুসলমান মানেই ভয়ংকর এক জাতি- এই বয়ান চেতনাবাদী বয়ানের সঙ্গে মিলেমিশে বড় হয়েছে; কিন্তু দুটো সে কারণে একই বয়ান নয়। বলাবাহুল্য, ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে তসলিমা নাসরিন মার্কা বয়ান বিজেপির খুবই পছন্দ হয়েছিল। মতাদর্শিকভাবে এই বর্ণবাদের বিশেষ তাৎপর্য হচ্ছে এটা নিজেকে নারীবাদ হিসেবে বা নারীমুক্তির তত্ত্ব হিসেবে হাজির করে।
চেতনাবাদী, বিশেষত আওয়ামীপন্থী চেতনাবাদ ইসলাম মানেই একটি বদ ধর্ম আর জাতি হিসেবে মুসলমান খারাপ- এই বয়ানে পুরোপুরি সায় দেয় না। সায় দিলে বাংলাদেশে তাদের রাজনীতির কোনো ভিত্তি আর অবশিষ্ট থাকে না। কিন্তু নাসরিনী বয়ান থেকে যতটুকু রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করা যায়, তা উসুল করে নিতে চেতনাবাদীদের কোনো আপত্তি নাই। এখানে তার পুরো মাত্রায় আগ্রহ আছে। দুইয়ের দোস্তিও এ দিক থেকে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
তো নাসরিনী বয়ানের সারকথা হচ্ছে, মুসলমান মানেই বদ জাতি, তারা যা কিছু করে তার সবই তাদের ধর্মগ্রন্থ কোরআনে আছে। ফলে এটা স্রেফ ইসলামপন্থা কিংবা রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের মুশকিল না। এটা মুসলমান চরিত্রের সমস্যা, তাদের খোদ ধর্মের মধ্যেই মুশকিল; ওদের শর্ষের মধ্যেই ভূত, ইত্যাদি।
তাহলে মুসলমানদের সঙ্গে বিজেপি জাতীয় হিন্দুত্ববাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রটা কী? সেটা হচ্ছে মুসলমানদের ইসলাম ত্যাগ করে আবার তাদের ঘরে ফিরে আসতে উৎসাহিত করা। ভারতে তাই মুসলমানদের গরুর চনা খাইয়ে আবার ‘স্বধর্মে’ ফিরিয়ে আনার আন্দোলনও চলছে। ইসলাম তো উপমহাদেশের জনগণের ধর্ম ছিল না। এটা আরবদের ধর্ম। উপমহাদেশের হিন্দুরা আরব সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের ভিক্টিম। ইসলামী সাম্রাজ্যবাদ থেকে উপমহাদেশের জনগণকে বাঁচাতে হলে উপমহাদেশ থেকে ইসলাম নির্মূল করতে হবে। চেতনাবাদী ও হিন্দুত্ববাদী ইসলাম বিদ্বেষের মধ্যে ফারাক আগের চেয়ে এখন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে। দিল্লিতে বিজেপির ক্ষমতারোহণ এবং ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রভাব ও ভূমিকার কারণে তা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের ঘটনাবলীকে উপমহাদেশ, বিশেষত ভারতের রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্নভাবে বিচার করার কোনো সুযোগ নাই।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হিন্দু মন্দির ভাঙা ও জনপদ হামলার খবর যেভাবে তথাকথিত সেক্যুলার গণমাধ্যমে এসেছে তা সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য এবার ইসলামপন্থীদের দোষী করার চেষ্টা একদমই হয়নি বলা যাবে না। শুরুতে হয়েছে বটে, কিন্তু দেখা গেছে শেষমেশ তাদের ‘দুর্বৃত্ত’ হিসেবেই শনাক্ত করা হয়েছে। এই দুর্বৃত্তরা এবার দারুণ কাণ্ড করেছে বটে। শহর ও শহরতলীর মসজিদ, মাদ্রাসায় ‘দুর্বৃত্তগণ’ তালা মেরে দেয়। তারপর কাবা শরিফের ও শিবের মূর্তি ছাপিয়ে কাবা শরিফ অবমাননা করা হয়েছে বলে মাদ্রাসার ছাত্রদের উত্তেজিত করার চেষ্টা করে। চেষ্টাটা খুব অভিনব কিছু নয়। কোনো এক হিন্দু যুবক ইন্টারনেটে বা তার ফেসবুকে এই ছবি দিয়েছে, এটা অতএব হিন্দুদের কাজ। এবারও পবিত্র কাবা শরিফের ছবি ব্যঙ্গ করে মহাদেবের মূর্তি বসিয়ে দেয়ার আসামিকেও যথারীতি পাওয়া গেল। সে রসরাজ দাস। তাকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে কড়া নিরাপত্তায় চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে তাকে হাজির করে ৬ দিনের রিমান্ড প্রার্থনা করেন। রসরাজ স্বীকার করেছে, এটা তার ফেসবুক হ্যাক করে কে কীভাবে করেছে সে জানে না। এ ঘটনার জন্য সে ক্ষমাও চেয়েছে। তারপরও আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।
ইসলামপন্থীদের দোষারোপ না করে ‘দুর্বৃত্ত’দের অভিযুক্ত করা রাজনীতির নতুন সিম্পটম। দুর্বৃত্তরা বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাতে চেষ্টা করছে, অনেক গণমাধ্যম সেটাই বলছে। নাসিরনগরের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মন্দির-বাড়িঘর দেখে জাসদের একটি প্রতিনিধি দলও সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছে, বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর জন্য একটি মহল অপচেষ্টা চালাচ্ছে। ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টার শিরোনাম করেছে : Planned attack 'to grab land'। অর্থাৎ কাজটা ইসলামপন্থীরা ধর্মের কারণে নয়, করেছে সংখ্যালঘুদের জমি দখলের জন্য (দেখুন, ৩ নভেম্বর ২০১৬)।
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর রাজনৈতিক বাস্তবতা কতটুকু দায়ী সেটা নিঃসন্দেহে গভীরভাবে ভেবে দেখার বিষয়। দুর্গাপূজা শান্তিপূর্ণভাবেই এ দেশের জনগণ পার করেছে। একরকম গণসতর্কতা ও গণনজরদারি জারি ছিল। সম্ভবত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও সতর্ক ছিল। সাম্প্রদায়িকতা আধুনিককালে সম্প্রদায়বোধ বা জাতিবোধের জমিন থেকে তৈরি হয়। ধর্ম যখন জাতিবাদী পরিচয়ের নির্ণায়ক হয়ে উঠতে চায় তখন তা সাম্প্রদায়িক রূপ পরিগ্রহণ করতেই পারে। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার জমিন দুর্বল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ দেশটির আবির্ভাব। সাম্প্রদায়িকতার জমিন আরও দুর্বল হতো যদি বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের ইসলামবিদ্বেষ প্রশমন করা যেত। পাশাপাশি ইসলামপন্থীরা ইসলামের আদর্শিক জায়গায় দাঁড়িয়ে জাতিবাদী চিন্তাচেতনার, বিশেষত মুসলমান জাতিবাদ পর্যালোচনা ও বিরোধিতা করতে আরও সক্ষম হয়ে উঠতেন। ফলে সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে সদাসতর্ক থাকা এবং প্রতিরোধের জন্য সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হওয়ার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন তো থাকতেই হবে।
চেতনাবাদী, বিশেষত আওয়ামীপন্থীদের জন্য ইসলামের বর্ণবাদী বয়ান, হিন্দুত্ববাদের যা উপজীব্য, মেনে নেয়া সহজ নয়। এই বয়ান সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করে। স্বাধীন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব যাপনের ন্যায্যতা এতে উবে যায়। তবে চেতনাবাদ ও হিন্দুত্ববাদের ফারাক সম্পর্কে আমরা সঠিক কিনা সেটা আগামী দিনগুলোতে ক্রমে আরও স্পষ্ট বুঝব।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের দুটো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতি কিছু আহ্বান রেখে শেষ করব। ইমান-আকিদার ধর্মতাত্ত্বিক ভিত্তি এবং ইসলামের বাস্তব ইতিহাস পর্যালোচনার কোনো বিকল্প নাই। বাংলাদেশের আলেম-ওলামাদের প্রতি আহ্বান থাকবে, তারা এদিকে মনোযোগ দেবেন যেন কোনোরকম সাম্প্রদায়িকতা প্রশ্রয় না পায়। বাংলাদেশে নিরাপত্তার বিশাল একটি দায় আলেম-ওলামাদের ভূমিকার ওপর নির্ভরশীল।
দ্বিতীয়ত আহ্বান থাকবে বাংলাদেশের নারী প্রশ্ন নিয়ে যারা কাজ করছেন, বিশেষত নারী মুক্তির আন্দোলন-সংগ্রামকে সামাজিক-রাজনৈতিক ভিত্তি দিতে চাইছেন, তাদের প্রতি। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের রণনীতি হিসেবে নারীকে সবসময়ই ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বারুদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ইসলাম প্রসঙ্গে সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী বয়ান পর্যালোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত নারীবাদের নামে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী বয়ান পুনর্লিখন এবং বাংলাদেশে নারীবাদের নামে তাকে সমানে আনার প্রচলিত চেষ্টা আরও বাড়বে বলেই আমার ধারণা। এই দিকে আশা করি, তারা সতর্ক নজর রাখবেন।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন