তাকে হারানোর ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়
29 September 2016, Thursday
জীবনের নিয়ম আসা- চলে যাওয়া। লন্ডন থেকে ফিরে এসে তিনি যখন ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি হলেন- তখন তিনি জানতেন তার সময় আর বেশি বাকি নেই। শেষ সময়েও তিনি সৃষ্টিশীল অনেক কাজের মধ্যে ডুবেছিলেন।
ছোটগল্প, কবিতা, গান- এসব রচনার মধ্যে পুরোটা সময় ব্যস্ত ছিলেন। সৈয়দ হকের কল্পনার নিমগ্নতা ও কাজের নিষ্ঠা জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অব্যাহত রাখার বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সৃষ্টিশীল কর্মীদের উচিত হবে সৈয়দ হকের জীবনের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। সাহিত্যের ক্ষেত্রে সৈয়দ হক পরম্পরার বিষয়টিকে সব সময় গুরুত্ব দিতেন। এই পরম্পরার বিষয়টিকে আমাদেরও গুরুত্ব দিতে হবে।
সৈয়দ শামসুল হকের চলে যাওয়াটা যথেষ্ট অপ্রত্যাশিত। যখন আমরা শুনলাম তার ক্যান্সার ধরা পড়েছে তখন কথাটা বিশ্বাস হয়নি। তার সঙ্গে সব সময় দেখা হতো। তাকে দেখে কখনোই মনে হয়নি তিনি এ জটিল রোগে আক্রান্ত। আমি যতদিন তাকে দেখেছি, কখনোই তাকে ক্লান্ত মনে হয়নি। আমার মনে হয়, তিনি প্রচণ্ড জীবনীশক্তির অধিকারী ছিলেন। তার কথাবার্তায় কখনোই আড়ষ্টতা প্রকাশ পায়নি। সহজ-সরলভাবে কথা বলতেন, স্পষ্ট ভাষায়। তার সঙ্গে কথা বলার, আড্ডা দেয়ার যেসব স্মৃতি রয়েছে- সেসব আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। তিনি ভাষাকে নিজের করায়ত্ত করেছিলেন। তিনি ক্রমাগত মানুষকে অনুপ্রেরণা দিতেন।
১৯৯২ সালে ভোরের কাগজের সাহিত্য পাতায় আমার একটি গল্প প্রকাশিত হলে তিনি আমাকে ফোন করে তার প্রতিক্রিয়া জানালেন। এভাবে অগ্রজদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেলে একটা পরম্পরা সৃষ্টি হয়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আবুল হোসেন, রশীদ করিম, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী- এদের তৈরি করা রাস্তা ধরে তিনি হেঁটেছেন।
সৈয়দ শামসুল হক অনুজদের ক্রমাগত অনুপ্রাণিত করেছেন সেই একই রাস্তার পথটা বহুদূর বিস্তৃত করতে। তার মহাপ্রয়াণে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হল। তিনি অনেক বড় সৃষ্টিশীল কাজ করে গেছেন। বাংলা সাহিত্যে তার বিচরণের ক্ষেত্র ছিল সর্বত্র। তিনি যেখানে হেঁটেছেন সেখানে অনেক মাইলফলক স্থাপন করেছেন। উপন্যাসে তিনি চিন্তার-কল্পনার বুদ্ধির বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন। উপন্যাসে ভাষার যে কুশলতা তিনি দেখিয়েছেন তার তুলনা আমি কম পাই, কবিতায় তিনি অপ্রতিরোধ্য।
সম্ভবত ১৯৭০ সালে যখন তার ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা’ বের হল। আমাদের মনে হল এ ধরনের একটা কাব্যগ্রন্থের জন্য আমরা অপেক্ষা করছিলাম। ওই সময় তার গল্পগ্রন্থগুলোর সঙ্গেও আমরা পরিচিত হই। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করি তখন তার কয়েকটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
তার কয়েকটি গ্রন্থ আমার সংগ্রহে ছিল। দুঃখের বিষয়, ১৯৭১ সালে সেসব হারিয়ে যায়। তার রচিত গল্প পড়ে অবাক হয়েছি- গল্প বলার এমন কুশলতা তিনি কী করে অর্জন করলেন। তার গল্প, উপন্যাস, কবিতার তিনটি বিষয় খুবই উদ্দীপ্ত করত। আমার মনে হয় আমাদের প্রজন্মের সবাই বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারতেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে চমৎকার একটা ঝকঝকে আধুনিকতার সূত্রপাত্র ঘটিয়েছেন- যে আধুনিকতা আমরা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর রচনায় পাই, রশীদ করিমের রচনায় পাই, আবুল হোসেন ও শামসুর রাহমানের রচনায় পাই।
সৈয়দ শামসুল হক বাংলা সাহিত্যে আধুনিকায় একটি পরিশীলিত রূপ দিয়েছিলেন- যেখানে বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে আবেগের একটা সংমিশ্রণ ঘটেছিল; প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের, মানুষের প্রতিদিনের সংগ্রামের জীবনযাপনের ছবি ঘনিষ্ঠতার ছবি ফুটে উঠেছিল। সে আধুনিকতা পশ্চিমা হলেও ওই আধুনিকতার সঙ্গে ততদিনে আমাদের পরিচয় হয়েছে। ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের কাছে আধুনিকতার মাপকাঠি এলিয়ট, অডেন, জেমস জয়েস, ভার্জিনিয়া উলফ- সেই আধুনিকতাকে সৈয়দ শামসুল হক গ্রহণ করে মাটি ও মানুষের সঙ্গে মিশিয়ে তার নিজস্ব একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছিলেন, যা বাঙালিয়ানার মাপকাঠিতেও উজ্জ্বল।
নিজস্ব একটি মৌলিক ভাষায় তিনি লিখতেন এবং যখন বলতেন সেই ভাষাটিই বলতেন। মাতৃভাষাকে যে এতখানি মর্যাদা দেয়া যায়, এতখানি মহিমা আরোপ করা যায়- এটা সৈয়দ হকের লেখা পড়লে এবং তার বক্তব্য শুনলে বিশেষভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার রচনায় বাংলা ভাষার ব্যবহার তাকে অমর করে রাখবে।
বাংলা ভাষাকে এত বুদ্ধিদীপ্তভাবে, এত সুন্দরভাবে কম কবি-সাহিত্যিকই ব্যবহার করতে পেরেছেন। জনজীবনের সঙ্গে তার গভীর সংশ্লিষ্টতা ছিল। তার জলেশ্বরীকেন্দ্রিক কিছু গল্প-উপন্যাসকে দক্ষিণ আমেরিকার লেখক গার্সিয়া মার্কেজের কিংবা ভারতের আর কে নারায়ণের লেখার সঙ্গে তুলনা করা যায়। শিল্পের সঙ্গে, প্রকরণের সঙ্গে তার বিষয়বস্তুর একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করার জন্য তার প্রতিটি কাজ মানোত্তীর্ণ। যা তিনি লিখেছেন তার মধ্যে মৌলিক কিছু থাকে, উৎকর্ষের বিষয় থাকে এবং সময় ও কালকে অতিক্রম করার একটা শক্তি থাকে।
এক সময় আমরা তার কাব্য নাটকের সন্ধান পেলাম, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘নুরুলদীনের সারা জীবন’ বা এসব কাজের মধ্য দিয়ে তিনি আরেক দিগন্ত উন্মোচিত করলেন। কবিতা ও গল্পের মতো তার নাটকেও বাংলাদেশের প্রকৃতি ও জনজীবনের ছবি জোরালোভাবে উঠে এসেছে। গীতিকার হিসেবেও সৈয়দ শামসুল হক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার হিসেবেও তিনি অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রেও সৈয়দ হক সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি ক্রমাগত যেমন শিখেছেন তেমনি সৃষ্টিকর্মের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন। তিনি সব সময় বহুমুখী সৃষ্টিকর্মের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন।
তার মহাপ্রয়াণে আমাদের যে ক্ষতি হল- এ ক্ষতি আমরা কখনও কাটিয়ে উঠতে পারব কিনা- জানি না। জীবনের নিয়ম আসা- চলে যাওয়া। লন্ডন থেকে ফিরে এসে তিনি যখন ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি হলেন- তখন তিনি জানতেন তার সময় আর বেশি বাকি নেই। শেষ সময়েও তিনি সৃষ্টিশীল অনেক কাজের মধ্যে ডুবেছিলেন। ছোটগল্প, কবিতা, গান- এসব রচনার মধ্যে পুরোটা সময় ব্যস্ত ছিলেন। সৈয়দ হকের কল্পনার নিমগ্নতা ও কাজের নিষ্ঠা জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অব্যাহত রাখার বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সৃষ্টিশীল কর্মীদের উচিত হবে সৈয়দ হকের জীবনের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। সাহিত্যের ক্ষেত্রে সৈয়দ হক পরম্পরার বিষয়টিকে সব সময় গুরুত্ব দিতেন। এই পরম্পরার বিষয়টিকে আমাদেরও গুরুত্ব দিতে হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন