সুশীল সমাজের সংজ্ঞা তুলে দিতে হবে
10 July 2015, Friday
সুশীল সমাজের সংজ্ঞা তুলে দিতে হবে বলে মনে করেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, সুশীল-কুশীল সংজ্ঞা দিয়েই সমাজের বিভাজন তৈরি হয়। শিক্ষিতদের সুশীল বলা হয়, কিন্তু একজন কৃষকই সবচেয়ে বড় সুশীল। কারণ তিনিই তো সবচেয়ে সৃজনশীল কাজ করেন। নিজেকেও বিভ্রান্ত সুশীল সমাজের সদস্য বলে মনে করা এই খ্যাতিমান অধ্যাপক বলেন, বর্তমানে বুদ্ধিজীবীদের বস্তু ও স্বার্থ চিন্তা গ্রাস করেছে। তারা জাতীয় স্বার্থের বিপরীতে নিজের স্বার্থকে বড় করে দেখছেন। ফলে দেশ এক ক্রান্তিকাল পার করছে। কিন্তু নিশ্চয়ই একদিন এ পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, বিভক্তির দুটো কারণ- রাজনৈতিক ও স্বার্থ চিন্তা। প্রথমতম একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পর একটি দল স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেনি। পরে তাদেরই নিয়ে রাজনৈতিক চর্চা হলো। তারা শুধু স্বাধীনতার চেতনা গ্রহণ না করেই ক্ষান্ত হলো না, তারা এর বিরোধিতা করল। এখনো সেই ধারা বর্তমান। দ্বিতীয়ত, স্বার্থ চিন্তার কারণে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা আগে যেই আদর্শবাদিতার জায়গায় থাকতেন, এখন তার খুব কমই অবশিষ্ট আছে। তিনি বলেন, সংজ্ঞা অনুসারে সুশীল সমাজ বা সিভিল সোসাইটির সদস্যরা প্রথমত জাতির বিবেকের প্রতিনিধিত্ব করবেন। তাদের অবস্থান সব সময়ই থাকবে জনগণের পক্ষে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পক্ষে। তারা সব সময়ই জনমানুষের সুবিধার জন্য কাজ করবেন। রাষ্ট্র যদি কখনো অত্যাচার করে তাহলে সুশীল সমাজের সদস্যরা এর বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন। রাষ্ট্রের নীতি যদি দরিদ্র মানুষের বিপক্ষে যায় তাহলে এর বিরোধিতা করবেন। পৃথিবীর সব দেশেই বুদ্ধিজীবীরা মানুষের পক্ষে দাঁড়ান। যুক্তরাষ্ট্রের জন নোয়াম চমস্কি ইহুদি হওয়া সত্ত্বেও ইসরায়েল ইস্যুতে মার্কিন নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। প্যালেস্টাইনের খ্রিস্টান হওয়া সত্ত্বেও এডওয়ার্ড সাইদ মুসলিমদের পক্ষে দাঁড়িয়ে নিগৃহীত হয়েছেন। এরা হলেন সত্যিকার বুদ্ধিজীবী। বুদ্ধিজীবী মানে হলো বুদ্ধি দিয়ে জীবিকা অর্জন নয়, বুদ্ধির চর্চা করা এবং নিরন্তর চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধিকে মানুষের উপকারে কাজে লাগানো। সেখানে স্বার্থচিন্তা কোনোভাবেই আসবে না। একজন সত্যিকার বুদ্ধিজীবী পদ বা ক্ষমতার জন্য চিন্তা করবেন, তা কোনোভাবে কল্পনাই করা যায় না। তাহলে তিনি বুদ্ধিজীবী নন। কিন্তু আমাদের দেশে এর প্রচণ্ড অভাব দেখা যাচ্ছে। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের প্রধান লক্ষ্য হয়েছে উপাচার্য হয়ে গাড়িতে ফ্ল্যাগ লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আফ্রিকার দেশে রাষ্ট্রদূত হচ্ছেন।
কোথায় উপাচার্যের মর্যাদা আর কোথায় রাষ্ট্রদূতের মর্যাদা! আবার কেউ প্রতিমন্ত্রী হতে চান, কেউ উপমন্ত্রী হতে চান, কেউ সংসদ সদস্য হতে চান। তাহলে কোনো সংজ্ঞাতেই তাদের প্রকৃত বুদ্ধিজীবী বা সুশীল সমাজের প্রতিনিধি বলা যাবে না। কারণ সুশীল সমাজের প্রথম শর্তই হলো তারা স্বার্থের জন্য কাজ করবেন না। তারা বুদ্ধির রাস্তা বা যুক্তি-বিজ্ঞানের রাস্তায় কাজ করবেন। এখন যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে উপাচার্য বা ইউজিসির সদস্য করার কথা বলা হয় তাহলে লাইন লেগে যায়। স্বার্থের চিন্তা ও বস্তুর চিন্তা আমাদের গ্রাস করে ফেলেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, এক পক্ষের বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের অস্তিত্বের জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীতের বিরোধিতা করে পত্রিকায় লিখছেন। এটা কোনো সত্যিকারের বুদ্ধিজীবীর কাছে কল্পনাতীত। আবার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যারা আছেন তাদের সবাই যে সেই চিন্তা বিশ্বাস করেন বা করছেন, তা বলা যায় না। বেশির ভাগই লাভের এ কাজ করছেন। তবে বাংলাদেশেও যে কিছু মুষ্টিমেয় সত্যিকার বুদ্ধিজীবী আছেন তাদের জন্যই এ সমাজ টিকে আছে। যেমন- মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অনর্গল সংগ্রাম করে যাওয়া অধ্যাপক কবীর চৌধুরী তার নিজের বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামকে দিয়ে গেছেন। এখনো সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীদের মতো নিঃস্বার্থ মানুষ আছেন।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা একাত্তরের আগে পর্যন্ত গণমানুষের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। পাকিস্তান আমলে তারা রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। আহমদ শরীফ থেকে শুরু করে সুফিয়া কামালরা পর্যন্ত সবই ব্যক্তিস্বার্থের ঊধের্্ব উঠে শিক্ষার্থী ও জনমানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু বাহাত্তর সাল থেকেই উপাচার্য ও অন্যান্য পদের জন্য বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এক ধরনের চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে। এরপর দুই সামরিক শাসনে লোভের বাণিজ্য সুশীল সমাজের ব্যক্তিদের ঘিরে ফেলে। এরশাদ শাসনামলে দুর্নীতির বিস্তার ঘটল। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র এলো কিন্তু দুই দলের শাসন শুরু হলো। একদল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, আরেক দল মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ রাজনীতিকে সমর্থন দিল। এর মাধ্যমেই বুদ্ধিজীবিতা শেষ হয়ে গেল।
পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় জানতে চাইলে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, উত্তরণ অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু আমরা যদি বুদ্ধিজীবীদের অবজ্ঞা করতে শিখি। কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যতই নিজেদের উন্নয়ন ঘটাবেন, যখন সমাজ আরও গতিশীল হবে তখন আর বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রয়োজন হবে না। সমাজের মানুষ যত শিক্ষিত হবে, নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারবে, সমাজের বিভাজন যখন দূর হবে, তখন আর সুশীল সমাজের প্রয়োজন হবে না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন