আপনাকে অভিবাদন, স্যার
13 November 2014, Thursday
বয়সের আগে চলে গেলেন অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, এ কথা বলা যাবে না। কিন্তু একটি মহিরুহ তার ছায়া দেওয়া বন্ধ করে দিলে, হারিয়ে গেলে, শূন্যতাটা বড় হয়ে দেখা দেয়। অধ্যাপক সিদ্দিকী ছিলেন ছায়া দিয়ে যাওয়া এক মহিরুহ। আমাদের সাহিত্য, শিল্প আর সৃজনশীলতার অঞ্চলটাতে, আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক নানা আন্দোলনে তিনি যে শুধু প্রবলভাবে ছিলেন, তা নয়, তিনি সুরক্ষাও দিয়েছেন আমাদের অর্জনের সম্পদগুলোকে, অর্জনপ্রত্যাশী পরিশ্রমীদের।
৮৬ বছরের সমৃদ্ধ জীবনের দীর্ঘ একটা সময় তিনি কাটিয়েছেন শিক্ষকতায়। নিজেকে নিয়োজিত করেছেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞানের স্পৃহা আর সাহিত্যের রুচি তৈরিতে। নিজে ব্যাপৃত থেকেছেন জ্ঞানসাধনায়। ভেবেছেন শিক্ষা নিয়ে। লিখেছেন উচ্চশিক্ষার সমস্যা ও সম্ভাবনা বিষয়ে। আর যখনই সময় ও সুযোগ পেয়েছেন, গড়ে তুলেছেন সমমনাদের নিয়ে সাহিত্য-সংস্কৃতির মোর্চা—তা হোক রাজশাহী থেকে প্রকাশিত পূর্বমেঘ অথবা অনেক পরে ঢাকা থেকে বের হওয়া দীপঙ্করকে ঘিরে। সাহিত্য পত্রিকার কাজ শুধু সাহিত্য প্রকাশ নয়, বরং সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত সব বিষয় তদন্ত করা, পুনঃকল্পনা করা, সময়কে ধরা, সময়ের নানান দাবিকে বোঝার চেষ্টা করা। পূর্বমেঘ -এ লেখা দেওয়ার সাহস আমার হয়নি, দীপঙ্কর -এ লিখেছি তিনি লিখতে বলায়। তাঁর কথা শুনে বুঝতে পেরেছি, তাঁর পছন্দ তেমন লেখা, যার পেছনে চিন্তার সক্রিয়তা থাকে, সমাজ পরিবর্তনের প্রত্যয় থাকে। কত শিক্ষার্থী, তরুণ লেখক ও সংস্কৃতিকর্মীকে তিনি উদ্বুদ্ধ করেছেন, তাঁদের মনোজগৎ তৈরি করে দিয়েছেন, তার হিসাব নেওয়াটা কঠিন।
অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী কখনো আমার শিক্ষক ছিলেন না, কিন্তু সারা জীবন তাঁকে শিক্ষক মেনেছি। শ্রেণিকক্ষে তাঁর কাছে পড়িনি, কিন্তু তাঁর সঙ্গে সব সাক্ষাতে, সময় কাটানোতে, পাঠ গ্রহণ করেছি নানান বিষয়ে। কত যে তিনি জানতেন! তাঁর বন্ধু প্রয়াত সাংবাদিক এস এম আলী আমাকে বলেছিলেন, অধ্যাপক সিদ্দিকী হচ্ছেন পশ্চিমের নবজাগরণকালের আরাধ্য ‘সম্পূর্ণ মানুষ’।
তাঁকে জানতাম প্রথমত কবি হিসেবে, এবং তাঁর কবিতার নিমগ্ন রোমান্টিকতা এবং কোলাহলহীন আধুনিকতা আমাকে বিস্মিত করত; তাঁর আত্মসচেতনতা, স্থানীয় ও বিশ্বচিন্তার মেলবন্ধন চমৎকৃত করত। এরপর তাঁকে জেনেছি একজন সম্পাদক হিসেবে। সে ভূমিকায় তিনি ছিলেন একজন সহনশীল পথপ্রদর্শক। শিক্ষক হিসেবে তাঁর সুকৃতি শুনেছি, বক্তৃতা শুনেছি। তাঁর বৈদগ্ধ্য আমাকে মুগ্ধ করত। তাঁর শেকস্পিয়ারের সনেট আর মিল্টনের অ্যারোপেজিটিকা বা স্যামসন অ্যাগোনিস্টিস -এর অনুবাদ পড়েছি, উপকৃত হয়েছি। অনুবাদে ও অনুবাদতত্ত্বে তাঁর দখল আলাদা করে বলার মতো। শিক্ষা নিয়ে তাঁর অনেক ভাবনার সহযাত্রী হয়েছি।
যতবার তাঁকে দেখেছি, বুঝেছি, তাঁকে বিশিষ্ট করেছে তাঁর ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ, দার্ঢ্য ও পাণ্ডিত্য। তাঁর চিত্তের প্রসন্নতা, তাঁর উন্নত রুচি, তাঁর সততা, সুনীতির প্রতি তাঁর বিশ্বস্ততা, তাঁকে যেকোনো ভিড়ের মাথায় তুলে ধরত। কিছুদিন বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা-বিষয়ক তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন, কিন্তু সময়ের স্বল্পতা আমাদের শিক্ষায় তাঁর স্বাক্ষরটি এঁকে দেওয়ার সুযোগ দেয়নি।
কিন্তু অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী তাঁর স্বাক্ষর রেখে গেছেন আমাদের সৃজনশীল, সৃষ্টিশীল ও সক্রিয়তার অঞ্চলগুলোয়। তাঁর শূন্যতা, হারিয়ে যাওয়া কোনো মহিরুহের মতো, আমাদের জীবনে একটা সত্য হয়ে দাঁড়াল। তবে তিনি আমাদের সঙ্গেই আছেন, থাকবেন।
আপনাকে অভিবাদন, স্যার।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন