নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের ছক
05 September 2018, Wednesday
আগামী নির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতিতে নানামুখী মেরুকরণ চলছে। তফসিল ঘোষণার আগেই নির্বাচনের কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দিয়েছে, ডিসেম্বরের শেষ দিকে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু নির্বাচনটি কেমন হবে, তা এখন বড় প্রশ্ন। নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন না অংশগ্রহণমূলক ও অবাধ নির্বাচন? ক্ষমতাসীন দলের দিক থেকে স্পষ্ট বার্তা দেয়া হয়েছে- বর্তমান সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ সংবিধানের বিদ্যমান ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। তা হলে পদে বহাল থেকেই এমপিরা নির্বাচনে লড়বেন। এমন হলে প্রশাসন, পুলিশ ক্ষমতাসীন দলের এমপিদের বিজয়ী করতে মরিয়া হয়ে মাঠে সক্রিয় থাকবে। নির্বাহী বিভাগ পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনের আগে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে; নির্বাচনী এজেন্ট পাওয়া তো দূরের কথা। ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচনে প্রশাসনের ভূমিকার রূপ বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দেখা গেছে। সুষ্ঠুভাবে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থতার কারণে নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে মানুষের আস্থা হারিয়েছে। এখন ইভিএম নিয়ে কমিশনের অতি আগ্রহ এবং প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর অবস্থানের পরিবর্তন প্রমাণ করে, ক্ষমতাসীন দলের ইচ্ছার বাইরে নির্বাচন কমিশনের যাওয়ার শক্তি নেই।
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যখন আন্দোলনের জন্য জোট-মহাজোট গঠনের চেষ্টায় ব্যস্ত, তখন ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। এমন খবর এসেছে, আগামী মাসের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হতে পারে। ছোট মন্ত্রিসভায় ক্ষমতাসীন জোটের শরিকদের রাখা হবে। আর এর নাম দেয়া হবে নির্বাচনকালীন সরকার। বাংলাদেশের রাজনীতির বাস্তবতায় এ কথা বলা যায়- প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা ছোট হলো না বড় হলো তাতে ক্ষমতার রাজনীতির প্রভাবে খুব বেশি হেরফের হবে না। এতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার মতো কোনো আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হবে না।
বিরোধী দলগুলো এখন আর জোরালোভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করছে না। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মূলত দু’টি দাবি করে আসছে- নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেয়া আর নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা যতটা সম্ভব খর্ব করা বা ভারসাম্য আনা। বিএনপি নেতা ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সরকারের মেয়াদ পূর্তির ৯০ দিন আগে সংসদ ভেঙে না দিলে, সরকারের মেয়াদপূর্তির এক দিন আগেও সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনের কথাও বলেছেন। তাতে এপ্রিল মাসের মধ্যে নির্বাচন করা যায়। কিন্তু সে সময়ের সরকারের রূপ হবে তাও একটি বড় প্রশ্ন। আসলে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন বনাম অবাধ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লড়াই শুরু হতে যাচ্ছে। এই লড়াই শেষ পর্যন্ত নো ইলেকশনের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি করে কি না তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।
২.
বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের ইতিহাস নতুন নয়। কিন্তু নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের পরিণতি ভালো হয়নি। দেশে গণতন্ত্র স্থিতিশীল রূপ পায়নি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকার প্রচেষ্টার কারণে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচন ছিল পেশিশক্তি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন। ক্ষমতাসীন দল প্রবল প্রতাপে জাসদের প্রার্থীদের ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। সোয়া ৬ শতাংশ ভোট পেয়ে দলটির কপালে জুটেছিল মাত্র একটি আসন। এরপর জিয়াউর রহমানের সরকারের আমলে ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে বহু রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি জমকালো পার্লামেন্ট দেখা গিয়েছিল। এই পার্লামেন্টে আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ, ছোট ছোট বামপন্থী দল, ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগসহ সবার অংশগ্রহণ ছিল। বিএনপিকে ক্যান্টনমেন্টের দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতারা একধরনের অবজ্ঞার চোখে দেখতে চায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- বহুদলীয় পার্লামেন্টের চেহারা এ দেশের মানুষ সামরিক বাহিনীর উদরে জন্ম হওয়া দলের কাছ থেকেই দেখেছে। অংশগ্রহণমূলক হলেও এ সংসদ নির্বাচনও নিয়ন্ত্রিত ছিল। কিন্তু ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শক্তিশালী বিরোধী দলের অস্তিত্ব দেখা গেছে। জিয়াউর রহমানের রাজনীতির বড় সফলতা এখানেই।
জিয়াউর রহমানের রাজনীতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অনুসরণের চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু ’৮৬-এর সংসদ ’৭৯-এর মতো হতে পারেনি। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী অংশ নিলেও বিএনপি অংশ নেয়নি। বিএনপি দীর্ঘ সময় এককভাবে এরশাদবিরোধী আন্দোলন করে গেছে। কিন্তু ওই সংসদের মেয়াদপূর্তির আগে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর সদস্যরা পদত্যাগ করলে এরশাদবিরোধী আন্দোলন পূর্ণতা পায়। এরশাদের পতনের পর টেকসই সংসদীয় গণতন্ত্রের যে আশা জনগণ দেখেছিল তা বাস্তবে রূপ পায়নি। যদিও ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের মানুষ প্রথম প্রকৃত অর্থে ভোটের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি সংসদে পাঠাতে পেরেছে। কিন্তু ওই সংসদের মেয়াদপূর্তির আগেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী একযোগে রাজপথে নেমেছিল। মাগুরার উপনির্বাচনে কারচুপির অভিযোগকে করা হয়েছিল ওই আন্দোলনের ভিত্তি। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা এখনো খই ফোটান। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি এই সংসদেই পাস হয়েছিল। আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছিল।
২০০১ সালে আবার বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় আসার মধ্য দিয়ে দ্বিদলীয় টেকসই নির্বাচনব্যবস্থার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। ২০০৬ সালে বিএনপির আস্থাহীনতার রাজনৈতিক কৌশল আর আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠার আন্দোলন সে সম্ভাবনা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকারের অধীনে নির্বাচন ছিল একটি ম্যানেজড নির্বাচন। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি আর তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ তাদের বইয়ে ওই ম্যানেজ এবং কন্ট্রোল নির্বাচনের ইঙ্গিতপূর্ণ বিবরণ দিয়েছেন। বিদেশী শক্তির সমর্থন থাকলে বিরোধী দলকে উপেক্ষা করে কিভাবে ক্ষমতায় থাকা যায় ২০০৮ সালে বিজয়ী হওয়া আওয়ামী লীগ তা ভালোভাবে উপলব্ধি করেছিল। বিচারপতি খায়রুল হক কলমের এক খোঁচায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করেছেন। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনের গোপন মেকানিজম প্রকাশ্য হয়ে ওঠে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সুজাতা সিংয়ের ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে। এর নেপথ্যে কাহিনী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সিএমএইচে যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিলেন। ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী সংসদ সদস্য নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার পাঁচ বছর পার করে দিয়েছে। বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়া আরেকটি নির্বাচনের স্বপ্ন আওয়ামী লীগ দেখতেই পারে। ফলে আওয়ামী লীগের প্রধান কৌশল হবে- বিএনপি যাতে নির্বাচন বর্জন করে সে দিকে দলটিকে ঠেলে দেয়া অথবা একেবারেই দুর্বলভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া। নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের ছক কষে সামনে এগোচ্ছে ক্ষমতাসীন দল। বিএনপিসহ অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন বর্জনের মতো অবস্থায় নেই। ফলে এবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগকে নিতেই হবে।
৩.
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দুর্বল করার ক্ষমতাসীনদের সব কৌশল সবসময় কার্যকর হয় না। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির নেতৃত্বে রাজনৈতিক জোট যে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তা স্পষ্ট। বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন সহিংসতা ছাড়া হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের আন্দোলন অহিংস ছিল না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে যেমন বহু লোকের প্রাণহানি হয়েছে। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত আন্দোলনে বহু লোকের প্রাণহানি হয়েছিল। যদিও সে সময় গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো ঘটনা ছিল না বললেই চলে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাও ছিল জামায়াতের। এখন জামায়াত হয়ে গেছে আওয়ামী লীগের কাছে অচ্ছুত দল। কিন্তু ভোটের ফ্যাক্টর নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও জামায়াতকে ভোটের রাজনীতিতে টিকিয়ে রেখেছে। নিবন্ধন ও প্রতীক হারানোর পরও বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতের যতটুকু গুরুত্ব তা আগামী নির্বাচনেও বড় ধরনের হেরফের হবে না। কয়েক দিন আগে জাতীয় পার্টির নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ বিএনপির সাথে আসন ভাগাভাগির দরকষাকষিতে ব্যস্ত যুক্তফ্রন্টের নেতাদের প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন- অনেক ইউনিয়নে জামায়াতের যে ভোট আছে, এই দলগুলোর তাও নেই। তবে রাজনীতিতে ভোটের হিসাব শেষ নয়। রাজনৈতিক আন্দোলনে ব্যক্তিও অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তবে ব্যক্তিনির্ভর এমন দলকে আওয়ামী লীগ যতটা ব্যবহার করতে পারে, বিএনপি কতটা পারবে তা নিয়ে সংশয় আছে। ড. কামাল হোসেন আক্ষেপ করে বলেছেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে অনেক ত্যাগ স্বীকার করার পরও কোনো প্রতিদান পাননি। এমনকি নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার নিশ্চয়তাও তারা পাননি।
বিএনপি ২০ দলীয় জোটের বাইরে ছোট রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ঐক্যপ্রক্রিয়া শুরু করেছে। তা কতটা সফল হবে তা বলার সময় এখনো আসেনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ড. কামাল হোসেন, কর্নেল অলি আহমদ এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মিলে মহাজোট গঠন করা হয়েছিল। বিএনপি ২০ দলীয় জোট অটুট রেখে যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে চাইছে। জিরো প্লাস জিরো তত্ত্ব বাদ দিলেও এমন জোট বিএনপির নেতাকর্মীদের আত্মবিশ্বাস বাড়াবে। ক্ষমতাসীন দল মুখে এমন জোট গঠনের প্রচেষ্টা আমলে না নিলেও একধরনের দুশ্চিন্তা যে আছে তা বোঝা কঠিন নয়। নেপাল থেকে ফিরে প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনেও কোনো ধরনের সমঝোতার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। যদিও রাজনীতিবিদদের জনসমক্ষে দেয়া বক্তব্য শেষ কথা নয়, পর্দার অন্তরালে নানা আলোচনা চলে। মানুষ আশাবাদী হতে চায়, রাজনীতিবিদেরা মুখে যা-ই বলুক অন্তত ভোটের অধিকার যাতে তারা প্রয়োগ করতে পারেন।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন