বাংলাদেশে আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রভাবশালী দেশগুলোর ভূমিকা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলছে। এই আলোচনার সূত্রপাত করেছে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী উভয় দলই। আগামী নির্বাচনে কোন দল ক্ষমতায় আসবে তার নির্ণায়ক যেন হয়ে উঠেছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাম্প্রতিক ভারত সফরের পর এমন ধারণা হচ্ছে যে, রাজনৈতিক দলগুলো দেশের জনগণের ওপর আস্থার চেয়ে ভারতের আস্থা অর্জনের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের আগে ভারতের তদানীন্তন পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং ঢাকায় এসে যেভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈঠক করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রত্যক্ষ অবস্থান নিয়েছিলেন, তাতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের হস্তক্ষেপের বিষয় প্রকাশ্যে চলে আসে। এ সময় জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। সুজাতা সিং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সাথে সাক্ষাৎ করে নির্বাচনে যাওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। এরশাদ নিজেই তা জানিয়ে দিয়েছেন। এরপর এরশাদকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে কথিত চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় এবং হাসপাতাল থেকে তিনি সংসদ ভবনে যান সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করার জন্য। এর পর থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে ভারতের ভ্রুণে জন্ম নেয়া অদ্ভুত এক গণতান্ত্রিক সরকার। সেখানে জাতীয় পার্টি একই সাথে ক্ষমতার অংশীদার এবং সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের দিন যতই এগিয়ে আসছে, নানা পর্যায়ে ভারতের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল গত মাসে দিল্লি সফর করেছেন। বিএনপি নেতারা নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য ভারতের সহায়তা কামনা করেন। বিএনপির সাথে ভারতের অতীত ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কের নানা দিক নিয়ে আলোচনা হয় বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। এই সফরের পর বিএনপি নেতারা এমন ধারণা দেন যে, ভারত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচনের ব্যাপারে এবার আগ্রহী নয় এবং নির্বাচনে আগের মতো হস্তক্ষেপ করবে না। এর পর থেকে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। সম্প্রতি দিল্লি সফর করেছেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। বিএনপি নেতারা ভারতের যেসব থিংকট্যাংকের সাথে আলোচনা করেছেন, তিনিও সেখানে বক্তব্য রাখেন। এসব আলোচনায় বিএনপিকে তিনি ‘পাকিস্তানপন্থী’ দল হিসেবে উল্লেখ করেন এবং ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে অতীতে দলটি কাজ করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে বলে অভিমত প্রকাশ করেন। তিনি মনে করেন না যে, এ রকম একটি দলকে ভারত সমর্থন করবে।
বিএনপি সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নেতা এমন পর্যবেক্ষণ দেবেন, তা অস্বাভাবিক কিছু নয়; যদিও নিজের দেশের একটি রাজনৈতিক দল সম্পর্কে অন্য দেশে গিয়ে এ ধরনের বক্তব্য রাখা মোটেই শোভন হতে পারে না। কিন্তু এর বাইরে তিনি এমন কিছু বক্তব্য রেখেছেন যা শুধু বিস্ময়কর নয়, প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানের সাথে সম্পূর্ণ অসঙ্গতিপূর্ণ। তিস্তা নদীর পানি নিয়ে ভারতের সাথে চুক্তি হওয়া না হওয়ার বিষয়টি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য ‘কোনো সমস্যা হবে না’ বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। ৭ জুলাই দুপুরে দিল্লির গবেষণা প্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনে মতবিনিময় সভায় তিনি এমন মন্তব্য করেন। এ ব্যাপারে ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকা বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
(দ্য হিন্দুর শিরোনাম Teesta water no longer a hurdle in India-Bangladesh ties, says Sheikh Hasina’s advisor).
এইচ টি ইমাম বলেন, ‘এবারের নির্বাচনে বিরোধীরা নিশ্চয়ই বলার চেষ্টা করবে শেখ হাসিনার সরকার তো তিস্তা চুক্তিও করাতে পারল না, ভারত কিছুই দিলো না ইত্যাদি। আমরা কিন্তু পরিষ্কার বলতে চাই, তিস্তা এখন আর তেমন কোনো বড় সমস্যা নয়।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী একটা কথা খুব বলেন, আমরা হলাম নদীর ভাটির দেশ। পানি এখানে ঠিকই আসবে, আসতে বাধ্য। একটা নদীকে কেউ মুছে দিতে পারবে না। আর তাই আজ হোক, কাল হোক, পানির ভাগাভাগি নিয়েও চুক্তি ঠিকই হবে।’ রীতিমতো আত্মবিশ্বাসের সুরে এইচ টি ইমাম বলেছেন, ‘ফলে তিস্তা নিয়ে বিরোধীদের যা খুশি বলতে দিন, ওতে নির্বাচনে আমাদের কোনো সমস্যা হবে না।’
এ বক্তব্য থেকে অনুমান করা যায়, বাংলাদেশ সরকারের কাছে এখন আর তিস্তার পানি বণ্টনের দাবি গুরুত্ব পাচ্ছে না। অথচ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আলোচনায় তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যুটি সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে বলে বিভিন্ন সময় দাবি করা হয়েছে। নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সর্বশেষ এই অবস্থানে সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কারণ, এত দিন বলা হচ্ছিল- মমতার কারণে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। এখন বাংলাদেশ সরকার আর এ নিয়ে আগ্রহী নয়, এমন ধারণাই প্রতিষ্ঠিত হবে। ভারতের সমর্থন পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের কাছে আত্মমর্যাদা ও জাতীয় স্বার্থের দিক কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে, এমন বক্তব্য থেকে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
আমরা যদি ধরেও নেই যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ এখন বাইরের শক্তির হাতে চলে গেছে, তাহলে সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা একমাত্র ভারতের হাতে আছে, এমন নয়। কারণ, একটি দেশের সাথে অপর দেশের সম্পর্ক ও প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে সে দেশটির স্বার্থ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে ভারত ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং চীনেরও স্বার্থ আছে। বাংলাদেশে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের আগের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে- এ ক্ষেত্রে চীনের অবস্থান কী? ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য চীন এই নির্বাচনকে সমর্থন দিয়েছিল। নির্বাচনের ছয় মাসের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফরে গিয়েছিলেন। তখন চীনের সাথে বড় বড় কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের বিষয়ও ছিল, যদিও পরে এ নিয়ে আর অগ্রগতি হয়নি।
এ মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে চীনের ভূমিকা অনেক বেশি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। ভারত অনেকটা কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে। নেপাল ও মালদ্বীপের সাথে অর্থনৈতিক সহযোগিতার পাশাপাশি প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত সম্পর্ক জোরদার করেছে চীন। এ দুই দেশে ভারতের অপছন্দের রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আছে। শ্রীলঙ্কায়ও চীনের ভূমিকা নিয়ে ভারতের রয়েছে অস্বস্তি।
সম্প্রতি ভারতের সংবাদপত্র হিন্দুস্তান টাইমসের এক খবরে বলা হয়েছে, প্রতিবেশী দেশগুলোয় নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতদের সাথে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বৈঠক করেছেন। সেখানে এসব দেশে চীনের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হয়। এই বৈঠকে ছিলেন পাকিস্তানে নিযুক্ত অজয় বিসারিয়া, আফগানিস্তানের বিনয় কুমার, নেপালের মানজীব সিং, বাংলাদেশের হর্ষবর্ধন শ্রীংলা, শ্রীলঙ্কার তারানজিৎ সাধু, মালদ্বীপের অখিলেশ মিশ্র এবং ভুটানের জয়দীপ সরকার।
(হিন্দুস্তান টাইমসের খবরের শিরোনাম- India will adopt a three-pronged strategy to check China influence).
বৈঠকের আলোচনা সম্পর্কে জানেন এমন চারজন কূটনীতিক হিন্দুস্তান টাইমসকে জানিয়েছেনÑ প্রতিবেশী দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকের শুরুতে সুষমা জানতে চান, তাদের দেশগুলোতে চীন কী করছে? চীনের ভূমিকার কথা তুলে ধরেন এই কূটনীতিকেরা। বৈঠকে যা উঠে এসেছে তা হলো, পাকিস্তানে চীনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বেড়েই চলেছে। আফগানিস্তানে চীন কৌশলগত অংশীদার হতে পারেনি। সেখানে তাদের অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন সহযোগিতা ছিল ন্যূনতম। তবে দেশটিতে এখনো সুযোগ রয়েছে চীনের। নেপালে বেড়েছে চীনের অংশগ্রহণ। নেপালি প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক চীন সফরে নতুন কিছু ঘটেনি, কিন্তু পুরনো চুক্তিগুলো বহাল রয়েছে। বাংলাদেশে চীন বড় ধরনের অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ঢাকায় অনেকেই শ্রীলঙ্কার মতো চীনা ঋণের ফাঁদে পড়ার বিষয়ে উদ্বিগ্ন। শ্রীলঙ্কা সরকার রাজনৈতিকভাবে ভারতের বন্ধু হলেও চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আগের মতোই রয়েছে। মালদ্বীপের ব্যাপারে বৈঠকে তুলে ধরা হয়, কিভাবে ভারতীয় প্রভাব খর্ব করতে দেশটি উদ্যোগ নিয়েছে। জানানো হয়, এতে চীন ব্যাপক সুবিধা পেয়েছে। বিমানবন্দর, দ্বীপ, সেতু ও বন্দরে চীন ইতোমধ্যে বিনিয়োগ করেছে বা এটা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
বেইজিংয়ের আধিপত্য তৈরির উচ্চাকাক্সক্ষার কথা তুলে ধরে এক রাষ্ট্রদূত উল্লেখ করেছেন, চীন রক্ষণাত্মক অবস্থান ছেড়ে দিয়েছে এবং ‘প্যাক্স সিনিকা’র দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভারতের এটা চিহ্নিত করা এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
হিন্দুস্তান টাইমসের এই খবরে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবেলায় তিনটি কৌশল নিয়েছে ভারত। এই কৌশলগুলো হচ্ছে- বেইজিংয়ের গতিপ্রকৃতি সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ, নিজেদের প্রকল্প ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন এবং চীনের সঙ্গে লেনদেনের ফলাফল সম্পর্কে প্রতিবেশী দেশগুলোকে পরামর্শ দেয়া। প্রতিবেশী দেশগুলোয় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতদের বৈঠকে এই পরামর্শ দেয়া হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোয় চীনের প্রভাব শুধু বাড়ছে না, দেশটির আগের নীতির পরিবর্তন হয়েছে।
একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের স্থায়ী যেমন কোনো বন্ধু থাকে না, তেমনি নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য সব দেশ সব সময় তার শত্রু থাকে না। যেমন- ভারতের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রতার বন্ধন শিথিল হতে চলছে। বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ হয়ে উঠেছে স্পষ্ট। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ক্ষেত্রে ভারতের নীতির ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী।
আবার ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোয় চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব শুধু বাড়ছে না, চীন রাজনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক বাড়ানোর দিকেও গুরুত্ব দিয়েছে। দেশটির রক্ষণাত্মক নীতিতে পরিবর্তন আসছে বলে ভারতীয় কূটনীতিক যে বক্তব্য তুলে ধরেছেন, তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়তে পারে। ফলে এ দেশে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় শুধু ভারতই একমাত্র খেলোয়াড় নয়, এ দিকটি রাজনৈতিক দলগুলোর বিবেচনায় নেয়া উচিত। ‘কাছা খোলা’ নীতি না নিয়ে আত্মমর্যাদা ও জাতীয় স্বার্থের প্রতি গুরুত্ব না দিতে পারলে, কোনো দলকে কোনো দেশ স্থায়ী বন্ধু হিসেবে দেখবে না; বরং জনগণের শক্তির ওপরই তাদের নির্ভর করা উচিত।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন