বখাটেদের উৎপাত এবং মৌসুমীদের আত্মহনন
09 May 2017, Tuesday
বখাটেদের উৎপাতে এক সময় সমাজে বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। এ কারণে আমাদের সামনে রয়েছে অনেক মর্মন্তুদ ঘটনাবলী। তৃষারা তো এরই জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। এরপর বখাটেদের উৎপাত কিছুটা বন্ধ হলেও সম্প্রতি আবার তা ব্যাধি হিসেবে দেখা দিয়েছে। ৪ মে ২০১৭ তারিখ পত্রিকান্তরে প্রকাশ, বখাটেরা উত্ত্যক্ত করায় রাজধানীর হাজারীবাগে মৌসুমী আক্তার নামের ২০ বছরের নারী (পোশাক শ্রমিক) গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে পুলিশ চারজনকে গ্রেফতারও করেছে। পুলিশের তাৎক্ষণিক এমন তৎপরতার প্রশংসা করতে হয়। আমাদের স্মরণে আছে এর আগে এ বছরেরই গত ২৯ এপ্রিল গাজীপুরের শ্রীপুরে আট বছরের মেয়েকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন হযরত আলী নামের এক দিনমজুর। খুবই মর্মন্তুদ ঘটনা। অভিযোগ উঠেছে এলাকার এক বখাটে যুবক মেয়েটিকে উত্ত্যক্ত করত।
বাবা-মেয়ের আত্মহত্যার ঘটনাটি সমাজ দেহে ঝড় তোলে। এর রেশ কাটতে না কাটতেই আমাদের শুনতে হলো আরো একটি মর্মন্তুদ কাহিনী। গাজীপুরের হযরত আলী থানা-পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধির কাছে প্রতিকার না পেয়ে আত্মহত্যা করেন গণমাধ্যমে এমন সংবাদ প্রকাশিত-প্রচারিত হয়েছে। গাজীপুরের কার্যপুর গ্রামের বাসিন্দা হযরত আলীর কন্যাসহ আত্মহত্যার ঘটনাটি সমাজের জন্য চরম লজ্জার বিষয় এ নিয়ে দ্বিমত প্রকাশের কোনোই অবকাশ নেই। এই ঘটনার খলনায়কও চিহ্নিত এবং এ ব্যাপারে পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। হযরত আলী যে মেয়েটির সম্ভ্রম বাঁচাতে নিজে মেয়েকে নিয়ে আত্মহত্যা করেন সেই মেয়ে আয়েশা আক্তার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীর ছাত্রী ছিল তাও গণমাধ্যম মারফতই জেনেছি। আয়েশাকে নারী বলার অবকাশ নেই সে শিশু অবস্থায়ই বখাটের লোলুপ দৃষ্টির শিকার হয়।
বখাটেরা যতই শক্তিশালী হোক তারা নিশ্চয়ই আইনের ঊর্ধ্বে নয় কিংবা কোনোভাবেই ক্ষমার যোগ্য নয়। সভ্যতা-মানবতাবিরোধী এসব বখাটেদের উৎপাত বন্ধে ইতোমধ্যে সামাজিক আন্দোলন যতটা হয়েছে প্রশাসনিক কঠোর কার্যকর পদক্ষেপ ততটা নেয়া হয়নি এই সত্যও অস্বীকারের পথ নেই। যদি কঠোর দৃষ্টান্তযোগ্য দণ্ডের চিত্র আমাদের সামনে থাকত তাহলে বখাটেদের এত উন্মত্ততা পরিলক্ষিত হতো না। বখাটেরাও কারো না কারোর সন্তান। তাদের অভিভাবকরা যথাযথ দৃষ্টি সন্তানের প্রতি রাখেননি বিধায়ই ওরা বখাটে হয়েছে। এই বখাটেরা কীটসম। এদের সমূলে উৎপাটনের দায় প্রশাসনের। কিন্তু প্রশাসনের দায়িত্বশীলরা কিংবা সমাজপতিরা এমন অভিযোগ আমলে নেন না এ রকম দৃষ্টান্তেরও অভাব নেই। হযরত আলীর ঘটনাটি সে রকমই। এ রকম হযরত আলী ও আয়েশা আক্তারের সংখ্যা এই সমাজে কম নয়। তারা শক্তিমানদের ভয়ে তটস্থ এবং সমাজদেহে অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে চারপাশে।
রাজধানীর হাজারীবাগে যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটি ওইসব বীভৎস ঘটনারই ধারাবাহিক মর্মন্তুদ ঘটনা। শিশু-নারী নির্যাতনের বহুমুখী চিত্র আমাদের সামনে আছে। কিন্তু দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকার চিত্র ক’টি আছে? উত্তরটা নিশ্চয়ই প্রীতিকর নয়। প্রত্যেকটি অঘটনের যদি যথাযথ বিচার হতো, যদি সমাজবিরোধীদের দৃষ্টান্তযোগ্য দণ্ড হতো তাহলে বারবার এমন মর্মন্তুদ চিত্র প্রত্যক্ষ করতে হতো না। আইনের শাসন ও ন্যায় বিচারই অপরাধের একমাত্র প্রতিবিধান। আইনের শাসন ও ন্যায় বিচারের পথ যদি মসৃণ না হয়, যদি ক্ষমতাধরদের মুষ্ঠিবদ্ধ থাকে সবকিছু তাহলে সমাজ অন্ধকারে ক্রমেই ঢেকে যাবে এটিই তো সত্য। হযরত, মৌসুমী, আয়েশারা জীবন দিয়ে এই সমাজ ও প্রশাসনকে নানাবিধ ব্যর্থতা-অক্ষমতা তুলে ধরেছে কিন্তু এরপরও কি যাদের জাগার কথা, দায়িত্ব-কর্তব্য নিষ্ঠার সঙ্গে পালনের কথা তারা সেই কাজগুলো করেছেন? এর উত্তরও নয় প্রীতিকর।
আমরা নিশ্চয়ই ভুলিনি পিংকির কথাও। অনাকাক্সিক্ষত হলেও রাস্তাঘাটে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা বা ‘ইভটিজিং’ বরাবরই সব দেশে, সব সমাজে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের দেশের মতো প্রতিকার হীনতার চিত্র এতো উৎকট নয়। নগরজীবনে এই ‘ইভটিজিং’-এর আধিক্য বেশি পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে বখাটেদের উৎপাত আবার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সিমি, তিথি, রুমি, রুনা, রিনাসহ অনেকের নাম রয়েছে এই তালিকায় যারা বখাটেদের কারণে বাধ্য হয়ে গেছে নিয়েছে আত্মহত্যার পথ। অথচ এতসব মর্মন্তুদ ঘটনার পরও সমাজ চিত্র বদলালো না! জটিল বিষয় হলো এই বয়সের মেয়েরা থাকে খুব স্পর্শকাতর। তারা প্রতিকূলতা সহ্য করতে পারে না সহজে। আবার মোকাবিলাও করতে পারে না। তাই বাধ্য হয়ে বেছে নেয় জীবনের চূড়ান্ত সর্বনাশের পথ। এমন উচ্ছুল প্রাণের মেয়েরা যখন রাস্তায় কিংবা বাসা-বাড়ির আঙ্গিনায় বখাটের কাছ থেকে অনাকাক্সিক্ষত-অপ্রত্যাশিত কিছুর শিকার হয় তখন মনের ভারসাম্য বজায় রাখতে না পেয়ে মূল্যবান জীবন, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হিসাবটা ভুলে গিয়ে অকালে জীবনের চির সমাপ্তি টেনে দেয়ার মতো চরম দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাই ঘটিয়ে ফেলে।
উদ্বেগের বিষয় হলো, যে বখাটেদের কারণে এমন আত্মহননের ঘটনা ঘটছে তাদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের মাধ্যমে বিচারের সম্মুখীন করা যায় না। আবার যেখানে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে সেখানে ক্ষমতার দাপট আক্রান্তকারীকে পিছু হটতে বাধ্য করে। এ ধরনের উত্ত্যক্ত করার মানসিকতা পরিবর্তনে আরো জোরদার সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন। অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে সমাজে একটি পরিবর্তন আসছে। এই পরিবর্তনের ভেতর আমরা বেশ কিছু নেতিবাচক দিকও দেখতে পাই। পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি, পেশাগত শিক্ষা বিস্তারের কারণে পরিবার ও প্রতিষ্ঠান সর্বত্রই মূল্যবোধ শিক্ষার অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পুরো সংস্কৃতির জন্য, পুরো মূল্যবোধ শিক্ষার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ওপর ভর করতে হচ্ছে। যার কারণে এখন অল্প বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যে নৈতিক শিক্ষার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ কারণে অবক্ষয় তাদের গ্রাস করছে। নৈতিকতার মান নেমে যাচ্ছে এবং আচরণগত দুর্বলতা অধিক মাত্রায় বিস্তৃত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে বখাটেপনা কিংবা ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধানের পাশাপাশি একটি শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এ ব্যাপারে সরকার ও সমাজপতিদের এগিয়ে আসতে হবে।
ইভটিজিং নামক সামাজিক ব্যাধিতে আক্রান্ত এই সমাজ দীর্ঘদিন ধরে। এই রোগ থেকে মুক্তি মিলছে না। কোনোভাবেই দূর করা যাচ্ছে না এই সামাজিক ব্যাধির সংক্রমণ। বখাটেরা কত নির্মম ও নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে পারে তার অনেক উদাহরণ আছে। তাদের কারণে কত পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে খান খান হয়ে গেছে এর ইয়ত্তা নেই। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা বদলে ফেলার সময় এসেছে। সামাজিক মূল্যবোধগুলো নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে সমাজকে এই ব্যাধি থেকে মুক্ত করা যাবে না। দিনের পর দিন বেড়েই যাবে ইভটিজিং নামের যৌন হয়রানি। বখাটেদের পরিবারকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। এভাবে কোনো সমাজ চলতে পারে না। যারা রাষ্ট্রের শীর্ষ স্থানে আছেন তারা বিষয়টি দ্রুত ভেবে দেখবেন আশা করি।
একই সঙ্গে সমাজের সব স্তরে সুস্থ সংস্কৃতি-বিনোদন চর্চা বাড়াতে হবে। শুধু আইন প্রয়োগ করে এই সামাজিক ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি। সর্বত্র অশ্লীলতা, যৌন শিকার, কুরুচিপূর্ণ সাহিত্য, বিকৃত চলচ্চিত্র ও অপসংস্কৃতির আগ্রাসন রোধের প্রচেষ্টা জোরদার করাও জরুরি। আমাদের সব অর্জন নষ্টদের অধিকারে যেতে দেয়া যাবে না।
নারী-শিশুদের হয়রানি রোধে আদালতের নির্দেশনা আছে। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সমাজ এ ব্যাপারে অনেকটা নিষ্পৃহ। নির্যাতনের শিকার নারী-কিশোরী-যুবতীরা যেন আত্মহত্যার পথ বেছে না নিয়ে প্রতিবাদ করার সাহস দেখাতে পারে তার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতেই হবে।
লেখক: প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট ও সংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক
মানবকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন