গেল ২৪ মার্চ সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ৪ বছর পূর্ণ হলো। ২০১৩ সালে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ওই ঘটনার চার বছর পরও একদিকে চলছে মিছিল-সেøাগান আর অন্যদিকে ভেসে আসে কান্নার শব্দ। রানা প্লাজাধসের ঘটনায় নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনরা শ্রদ্ধা জানাতে এসে তাদের প্রিয়জনের ছবি বুকে নিয়ে কান্না করছিলেন সেদিনও। ঘুড়ে দাঁড়াতে পারেনি হতাহত গার্মেন্টকর্মীর পরিবারগুলো। এ ছাড়া বেঁচে থাকা অনেকেই শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়ে নানা কষ্টে দিনাতিপাত করছেন।
নিখোঁজ অনেকের লাশের সন্ধান না মেলায় স্বজনদের আহাজারি এখনো থামেনি। কেবল ঘরে থাকা ফ্রেমে বাঁধা ছবিই এখন স্বজনদের বেঁচে থাকার অবলম্বন। অথচ ভবনধসে নিহতদের পরিবারকে পুনর্বাসন, পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং আহতদের চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা দিলে অল্প সময়ের মধ্যে এসব পরিবার ঘুরে দাঁড়াতে পারত।
শ্রমিকদের প্রতি আমাদের এই যে বঞ্চনার ইতিহাস তাতে কেবল মনে হয়-
‘কলে কারখানাতে আর লাইনে অফিসেতে
মোরা খেটে মরি, না পাই খেতে
না পাই থাকার ঘর।
তাই খুন রাঙা লাল ঝাণ্ডা
শক্ত হাতে ধর।’
এ গানটি আমাদের দেশের শ্রমিক শ্রেণির বঞ্চনার ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে গীতিকার এমনিভাবে ও ভাষায় শ্রমজীবী মানুষের খেদ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। এ তো আমাদের কলে-কারখানায়, গায়ে-গতরে খেটে খাওয়া মানুষেরই কথা। দুঃখ হলো, আজও এ গান গাইতে হচ্ছে। এমনই সব নতুন নতুন দাবি-সেøাগান উঠছে শ্রমিকাঞ্চলে।
শতবর্ষেরও আগে আমেরিকা-ইউরোপের জুতা, বিস্কুট, রুটি তৈরির কারখানাগুলোর মানুষ কাজের সময় বেঁধে দেওয়ার দাবিতে প্রথম সোচ্চার হয়েছিল। একবার নয় বারবার, এক অঞ্চলে নয়, বহু এলাকার শ্রমিক কখনো বিচ্ছিন্নভাবে কিন্তু ক্রমেই সম্মহিত ও সংগঠিতভাবে গড়ে উঠতে থাকে শ্রমিক ঐক্য এবং তারা যৌথভাবে তাদের সিদ্ধান্ত ঠিক করতে শুরু করেন। এমনি প্রয়াসে শ্রমিক আন্দোলন যখন সংঘবদ্ধ হতে লাগল, মালিক নয়, কেবল তৎকালীন আমেরিকার স্থানীয় সরকারি সংস্থাও সজাগ-সতর্ক এবং মারমুখী হয়ে উঠেছিল। আর তাই শ্রমিকরা শ্রমঘণ্টা অর্থাৎ কাজের সময় বেঁধে দেওয়ার প্রধান দাবি উত্থাপন করেন। স্থানে স্থানে একই দাবি ওঠে। প্রতিবাদ সমাবেশ করেন শ্রমিকরা। সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী আর মালিকের গু-াবাহিনী একত্র হয়ে প্রতিবাদী শ্রমিক সমাবেশে হামলা চালায়। শহীদ হন অনেকে। আহত তো অবশ্যই। কিন্তু হত্যার প্রতিবাদে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে ধর্মঘটী শ্রমিক সমাবেশের কাজ বেশ শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল। শ্রমিকরাও ক্ষুব্ধ-উত্তেজিত ছিলেন। কিন্তু বিশৃঙ্খল ছিলেন না। শুরুর এই শ্রমিক আন্দোলনে ঐক্যরূপটি ছিল আদর্শ ও অনুকরণীয়। অথচ শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদী শ্রমিক জমায়েতে মালিকপক্ষ তাদের পোষা গু-াবাহিনী লেলিয়ে দিল। সরকারও বসে থাকল না, নিরাপত্তা বাহিনীকেও হুকুম দিল সাধারণ শ্রমিকদের এই সমাবেশে হামলা করতে।
প্রাণ বিসর্জন দিলেন শ্রমিক নেতারা এবং দমন-পীড়নের মাত্রাহীন হামলা জমায়েত তো ভেঙে দিলই, ওই হে মার্কেটে রক্তের প্লাবনে জন্ম নিল শ্রমিক অধিকার আদায়ের দিন পহেলা মে। নানা স্থানে বহুদিন লড়াই-সংগ্রাম হলেও সব দেশের প্রতিনিধিদের সম্মেলনে এদিনটিকেই নির্ধারণ করা হলো এবং ১ মে দুনিয়াজুড়ে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। সেই থেকে পৃথিবীর শ্রমিক শ্রেণি এদিনটিতে একত্র হয়ে গেয়ে ওঠেনÑ
‘ও দুনিয়ার মজদুর ভাইসব
আয় এক মিছিলে দাঁড়া
ওই নয়া জামানার ডাক এসেছে
এক সাথে দে সাড়া।’
সারা বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণির কণ্ঠে ধ্বনিত এই আহ্বান যে সংঘবদ্ধতা সৃষ্টি করেছিল সেদিন, আজও আমরা শুনতে পাই সেই সেøাগান ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও।’ দুনিয়ার দেশে দেশে তাই প্রতিধ্বনিত এই আওয়াজ প্রবল শক্তির বিপুল বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। কিন্তু ইঙ্গ-মার্কিন-ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধোন্মাদ চৈতন্যের আগ্রাসী চরিত্র এই আদর্শবাদী শ্রমিক শ্রেণির ঐক্যশক্তিকে কৌশলী চক্রান্তের মাধ্যমে সহিংস সংঘাতে পরিণত করে যে বিভাজন অথবা বিত্তবৈভবের খপ্পরে ফেলে দিয়েছিল, তাতে দুনিয়ার অনেক অঞ্চলের মতন আমরা বাংলার ক্ষুদ্র শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীও ওই ষড়যন্ত্রের শিকার হলাম এবং এ দেশের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ক্রমেই নিজ চরিত্র হারিয়ে দালাল-চাটুকারদের সংগঠনে পরিণত হতে শুরু করেছিল। ব্যতিক্রমী যারা কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শিক কাঠামো এবং নৈতিক চরিত্র ঠিক রেখে আদত শ্রমিক আন্দোলন ও ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন করতে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন, তারা নানা দমন-পীড়ন, গ্রেপ্তারি-হয়রানি, মামলা-হামলার শিকার হয়েছেন। ফলে সরকার সমর্থিত শিল্পপতিগোষ্ঠী শ্রমিক আন্দোলনকে গর্ব করার জন্য দালাল শ্রেণি ও সংগঠন তৈরি করেছে। সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হলো, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ক্ষমতার দাপটে শ্রমিক শ্রেণি যেমন শিল্পক্ষেত্রে অবহেলা-অবমাননা, নানা ধরনের দখল ও লুটপাটের শিকারে পরিণত হয়েছেন, এমন অবস্থা আগে কখনো ছিল না। তাই ট্রেড ইউনিয়ন যেমন নাজুক অবস্থায় পড়েছে, তেমনি ইউনিয়ন নেতাকর্মীদেরও নানা ধরনের বিপদ, সংঘাত, এমনকি প্রাণনাশের শিকারে পরিণত হতে হয়েছে। এমন নিবর্তনমূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে সরকার ও মালিকপক্ষ যেমন শিল্পের ওপর ‘আঘাত’ হানতেও দ্বিধা করেনি। সরকার নিজের শক্তিমত্ততা প্রমাণ করেছে আর মালিক তার আয়ের নতুন নতুন উৎসের সূচনা করায় এ ধরনের শিল্প থেকে হাত গুটিয়ে নেওয়া, কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে শ্রমজীবী সাধারণ গরিব মানুষকে কাবু করতে অপচেষ্টা চালিয়েছে বেধড়ক। কিন্তু সবক্ষেত্রে সফল হতে পারেনি, শ্রমিক শ্রেণির সংঘবদ্ধতা তাদের অপকর্ম ও অপকৌশলকে ফাঁস করে দেওয়ায় অবশেষে তারা কুকর্মের জন্য সরকারের করুণা থেকেও কেউ কেউ বঞ্চিত হয়েছে। সে ক্ষেত্রে শ্রমিকস্বার্থ সংরক্ষণে ট্রেড ইউনিয়ন যে ভূমিকা পালন করেছে, তা অবিস্মরণীয়। নেতারা যেমন সাহসের সঙ্গে দৃঢ়তা নিয়ে সংগ্রামে অবিচল থেকেছেন, তেমনি মালিকপক্ষের দালাল ও গু-াবাহিনীর নানা হামলা, সংঘাত, সংঘর্ষ সত্ত্বেও নিজেদের ঐক্য বজায় রাখতে পেরেছিলেন, প্রয়োজনে আদর্শনিষ্ঠ শ্রমিক নেতার প্রাণ বদলদান করেও সেই লড়াই দুনিয়ার কাছে দেশের মান উজ্জ্বল করেছে এবং শ্রমিক শ্রেণির ঐক্য ও তাদের আপসহীন লড়াই অভিনন্দিত হয়েছে দেশবাসীর কাছেও। এই সংগঠিত জনগোষ্ঠী তাই তো একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে নির্দ্বিধায় প্রাণোৎসর্গ করেছিল দেশমাতৃকার মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে। সেই দেশ মুক্ত হলো সেই ঔপনিবেশিক নিপীড়ক পাকিস্তানি দুঃশাসন থেকে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে। দেশ তো স্বাধীন হলো। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত মাতৃভূমিকে পুনর্গঠনে-নির্মাণে যে চৈতন্যনির্ভর কর্মপ্রয়াস গ্রহণ করা প্রয়োজন ছিল, তা হয়ে গেল একেবারেই একপেশে। ফলে ‘ফোকলা’ শিল্প, কল-কারখানাগুলো, যা ছিল সরকারের বা পাকিস্তানি মালিকদের, তারা পালিয়ে যাওয়ায় এর দায়িত্ব একাত্তর-উত্তর সরকার গ্রহণ করল এবং নিজ দলীয় লোকজনের মধ্যে বাছাই করে কিছু ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সেই যে শুরু অবক্ষয়ের, তার অবসান আজও ঘটেনি। শুধু কি তাই? না, তার চেয়েও ক্ষতি হয়েছে কল-কারখানা এবং শ্রমিক শ্রেণির সব সদস্যের। এর মধ্যে সমাজতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা নিয়ে শিল্পাঞ্চলগুলোকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল বটে কিন্তু টিকে থাকতে পারেনি। সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ঘটেছে শিল্পাঞ্চলে এই সংগঠন শক্তির। ট্রেড ইউনিয়ন হয়ে গেছে কুক্ষিগত। যদিও সংঘ নেতৃত্বকে উচ্ছেদ করে অনেক জায়গায় দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আবার কোথাও পুরনো ইউনিয়নের ঐক্যের বিরুদ্ধে ক্ষমতাদম্ভে নির্মম কয়েকটি সংগঠন শ্রমিকদের কল্যাণে কাজ করার নাম করে হিংসা, বিভেদ, বিদ্বেষ ইত্যাদি ছড়িয়ে ইউনিয়নকে কলুষিত করে ঐক্যে ফাটল ধরিয়েছে। ক্রমান্বয়ে এই পরিস্থিতি শিল্পসম্ভাবনার দেশ এই বাংলার কল-কারখানাগুলোকে নিঃশেষ করে ভিন্ন ধরনের ফায়দা লুটেছে। নানা সময় নানা রাজনৈতিক সরকার শ্রমিক শ্রেণিকে কব্জা করে কল-কারখানাকে করায়ত্ত করতে উঠেপড়ে লেগে গিয়েছিল। এখন প্রায় নিস্তব্ধ ট্রেড ইউনিয়ন। কল-কারখানা একে একে বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু শ্রমিক শ্রেণি তো আছে। তাদের পরিবারভুক্ত জনসংখ্যার যে বিপদ, তা থেকে উদ্ধারের কোনো পদক্ষেপ নেই কারো। খালেদা জিয়ার শিল্পমন্ত্রী জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী একে একে শিল্প-কারখানা বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং কোনো পাওনা পর্যন্ত বুঝিয়ে না দিয়ে গেটে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে গেছেন আকস্মিকভাবে। সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা অনাহারে দিন কাটাতে শুরু করেছেন। লঙ্গরখানা খোলা হয়েছিল, পুলিশ বাহিনী গিয়ে সে লঙ্গরখানা ভেঙে দিয়ে বন্ধ ঘোষণা করেছিল। কী নির্মম-নিষ্ঠুর কা-কারখানাই না ঘটেছিল! জামায়াত এমনই করবে। ওরা তো জনগণ, বিশেষ করে মজদুর-মজলুমদের সহ্য করতে পারে না। কারণ তারা সংঘবদ্ধ শক্তি। যে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস রাখে এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বর্তমান সরকার কয়েকটি মিল খুলে দিয়েছে। কিন্তু কী তার অবস্থা, কে জানে!
সবচেয়ে নিষ্ঠুর আর নির্মম উদাহরণ হলো আমাদের গার্মেন্ট শ্রমিক। তাদের ওপর যে স্টিমরোলার চলছে লোভাতুর মহাজন শিল্পপতিদের, তা কল্পনাও করা যায় না। ন্যূনতম বেতন নিয়ে ফ্যাসাদই না চলছে। এই সরকার বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু তা কি আদৌ গ্রহণযোগ্য কিংবা মনুষ্যোপযোগী? যখন রানা প্লাজার মতন নিদারুণ দুনিয়া কাঁপানো খবর পৌঁছায় বিশ্বের সর্বত্র, তখন সারা পৃথিবী উদ্বিগ্ন, কাতর, শোকাহত হয়, সহযোগিতার হাত বাড়ায়। কিন্তু কেন এমন হলো, কারা করল এমন দুর্যোগ সৃষ্টি, কারা দায়ী এই ভয়াবহ বীভৎসতম ঘটনার- যা গণহত্যার শামিল, সেসব কালপ্রিটের আজও বিচার হয়নি।
বাড়ির মালিক, শিল্পপতি, নির্মাণ পরীক্ষকÑ এমন নানাজনের কি কোনো খোঁজখবর করা হয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছে কি সবাই? নাকি ছাড়া পেয়ে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আমাদের নাকের ডগায় ঘুরে বেড়াচ্ছে? তাদের বিচারের প্রশ্নে কেন এত বিলম্ব, গাফিলতি? আবার ক্ষতিপূরণও সবাই পাননি। এমনকি নিখোঁজ স্বজনের সন্ধানও পাননি অনেকেই। কী হবে তাদের? আজ মে দিবসে এই তো প্রশ্ন সবার সামনে। মে দিবসের শপথ কি আমরা ভুলে যাচ্ছি ক্রমেই?
পৃথিবীর শ্রমিক শ্রেণি এদিনটিতে আবারও একত্র হয়ে গেয়ে ওঠেন-
‘ও দুনিয়ার মজদুর ভাইসব
আয় এক মিছিলে দাঁড়া
ওই নয়া জামানার ডাক এসেছে
এক সাথে দে সাড়া।’
কামাল লোহানী : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন