আজ থেকে ৪০ বছর আগে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর যখন ক্ষমতা দখল করলেন খোন্দকার মোশতাক গদিচ্যুত হওয়ার পর কর্নেল (অব) তাহেরকে হত্যা করে; তখন রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য পাকিস্তানি সামরিক জান্তার মতন দেশের জনপ্রিয় খ্যাতিমান ব্যক্তিদের নিয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেছিলেন মন্ত্রিসভার পরিবর্তে। তাতে আমাদের সবার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক আবুল ফজলকে শিক্ষা-সংস্কৃতি বিষয়ের উপদেষ্টা হিসেবে থাকতে বাধ্য করেছিলেন। তারই পরামর্শে একুশে পদক প্রদান প্রথা চালু করা হয়েছিল। এই পদক প্রস্তাবনার দ্বিতীয় বৈঠকে আমি রাজশাহীর দৈনিক বার্তার সম্পাদক হিসেবে আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। কিন্তু খুব একটা সুখকর ছিল না সে বৈঠক। তাতেই প্রচলন করা হয়েছিল একুশে পদক নামের সম্মাননা। যখন প্রথমবার যাদের পদক দেওয়ার জন্য তালিকা তৈরি হলো তাতে শহীদ আলতাফ মাহমুদের নাম না দেখে প্রতিবাদ করে শ্রদ্ধেয় আবুল ফজল স্যারকে গলাটা উঁচিয়েই বললাম, একুশের নামে যদি পদক প্রবর্তিত হয় তবে প্রথমবারেই প্রাপকদের মধ্যে শহীদ আলতাফ মাহমুদের নাম থাকা উচিত। যাদের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে, আমি মনে করি আলতাফ মাহমুদের অবদান তাদের চেয়ে অনেক বেশি। আমি কিছুটা উত্তেজিত ছিলাম। তাই স্যার আমাকে শান্ত করার জন্য কাছে ডেকে নিয়ে পাশে বসালেন। বললেন, এবার না পেলেও আগামীবার পাবে।
সেই যে পদক প্রকাশ শুরু হয়েছে, এখনো চলছে কিন্তু এ চলার মধ্যে পছন্দ-অপছন্দ আছে, গুণপনা কিংবা অবদান অথবা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ভূমিকা বিচার কতটা হয় বা হচ্ছে, তার খতিয়ান কে নেবে। বিএনপি, জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ যখন যে ক্ষমতায় থাকে, তারা তখন তাদের ঘরানার পছন্দের মানুুষদেরই পদক বিতরণ করে থাকেন। এই পদক প্রদানের কোনো মাপ বা মাত্রা কোন সময়ই থাকে না। ব্রিটিশ আমল থেকে যাদের অবদান তাদের সঙ্গে আবার চলমান প্রজন্মের ব্যক্তিকেও এই পদক দিয়ে দিচ্ছেন। বিচারের মাপকাঠি থাকে না অনেক ক্ষেত্রে। ’৬০-৬৫ বছরেও অনেকে এই পদক পাননি। অথচ তারা অনেকে বেঁচে আছেন এখনো। যারা মারা গেছেন তাদের কেউ কেউও একুশে পদক পাননি। তাদের মধ্যে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা রয়েছেন। তাহলে যারা পাচ্ছেন তাদের সবার অবদান কি তাদের চেয়ে বেশি? যদি তাই হবে তবে আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু যদি তা না হয়, তাহলে কি মনে করব, এগুলো রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া হচ্ছে? কেন এমন হবে? যদি সত্যিই রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বা সংবর্ধনা হয়ে থাকে তাহলে তো তার মাপকাঠি থাকা উচিত।
আমি যতদূর জানি তা থেকেই বলতে পারি, নব্বইয়ের দশকে শিল্পকলা একাডেমি থেকে সাংবাদিকতায় মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী বয়োজ্যেষ্ঠ সাহসী রিপোর্টার আতাউস সামাদের নাম সাংবাদিকতায় পুরস্কৃত হওয়ার জন্য পাঠানো হয়েছিল। দেখা গেল ঘোষণার সময় তার থেকে বয়োকনিষ্ঠ এবং স্বল্প অভিজ্ঞতা, তবে রাজনৈতিক বিবেচনায় ঘরানার লোক হিসেবে আরেকজনের নাম জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আবার ২০১০ সালে এক অনুষ্ঠান উপস্থাপকের নাম শিল্পকলা থেকে পাঠানো হলো কিন্তু তিনি শিল্পকলা একাডেমিকে তোয়াক্কা না করে মন্ত্রণালয়ে বসেই তার নাম তালিকাভুক্ত শুধু করলেনই না, শেষ পর্যন্ত তিনি একুশে পদক পেয়েও গেলেন। তিনি বর্তমান সরকারের সমর্থকও নন। তবু দেখলাম, ভদ্রলোক একুশে পদক পেয়ে গেছেন।... ‘একুশে পদক’ প্রচলনের পর থেকেই জাতপাত বিবেচনা করেই পদক দেওয়া হচ্ছে। না হলে ভাষা সংগ্রামের সরাসরি সৈনিকদের কেন আজও দেওয়া হয়নি অনেককেই।
আমি এবার পূর্ববাংলার ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা মোহাম্মদ সুলতানের নাম প্রস্তাব করেছিলাম। কারণ এই ছাত্রনেতা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের গোড়া থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জিন্নাহর বৈমাত্রীয় বক্তব্যের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের শীর্ষে যে সাতজন ছাত্র প্রতিবাদী কালো পতাকা উত্তোলন করেছিলেন, মোহাম্মদ সুলতান তাদের নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নেতা ছিলেন তো বটেই তার পরও তিনি তখন দুঃসাহসের সঙ্গে একটি প্রকাশনা সংস্থা পুঁথিপত্র প্রকাশনী প্রতিষ্ঠা করে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামে ভাষা সংগ্রামের একটি প্রামাণ্য দলিলগ্রন্থ প্রকাশ করেন ১৯৫৩ সালে। প্রবন্ধ, কবিতা, গান-গল্পসহ যে প্রামাণ্য দলিলপত্র প্রকাশ করেছিলেন ছাত্রনেতা হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় তার প্রকাশকও ছিলেন মোহাম্মদ সুলতান। ১৯৫২ সালের শেষে প্রগতিশীল চিন্তা ও আন্দোলনের ঐতিহ্য এবং বাংলার মানুষের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ফসল হিসেবে তখন অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। মোহাম্মদ সুলতান আজও একুশে পদক পাননি। পাননি তুখোড় যুবনেতা মোহাম্মদ ইমাদুল্লাহ, যিনি মুসলিম লীগ সরকারের গুলিবর্ষণে ছাত্র হত্যার গায়েবানা জানাজার পর মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে জমায়েত জনতার উদ্দেশে বক্তব্যে মুসলিম লীগ নেতা খুনি নূরুল আমিনের মুখোশ উন্মোচন করেছিলেন। ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে লীগ-শাহীকে পরাজিত করার লড়াইয়ে নিরন্তন দিনরাত্রি জেলা থেকে জেলায় ঘুরে মানুষকে সংঘবদ্ধ ও সচেতন করে বলেছিলেন সেই ইমাদুল্লাহও পাননি। পাননি তখনকার আন্দোলনের সক্রিয় নিরবধি মোহাম্মদ তোয়াহা, মোহাম্মদ ইমাদুল্লাহ রাজশাহীর ভাষা আন্দোলনের পুরোধা নেতৃবৃন্দÑ ডা. গাফফার, গোলাম আরিফ টিপু প্রমুখ। পাননি ছাত্রনেতা সাংবাদিক এবং পরে অধ্যাপক বদরুল হাসান। আন্দোলনে তো বটেই তার পরও জীবনভর সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিকধারার প্রথম আবৃত্তিকার। ডাকসু ও একুশসহ প্রতিবাদী সব অনুষ্ঠানে বদরুল হাসানের ধারাভাষ্য রচনা ও পাঠ ছাড়া সম্পূর্ণ ও সম্পন্ন হতো না। চট্টগ্রামের আহমেদুর রহমান আহমদ, অচিন্ত্য চক্রবর্তী, হবিপ্রসন পালসহ বহু গুণীজন আজও পাননি একুশে পদক। ময়মনসিংহের খ্যাতিমান আইনজীবী আবদুল কুদ্দুস, অধ্যাপক ফুলে হোসেন সারাজীবন জনগণের সঙ্গে গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং সাংস্কৃতিক সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারাও পাননি। পাননি রংপুরের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ আফজাল হোসেন নুরুল ইসলাম প্রধান। এ ছাড়া কতজনের পক্ষ বলব?
রাষ্ট্র আজ পর্যন্ত এদের তালিকা করতে পারেনি। নির্দিষ্ট সংখ্যক ছাত্র, যুব ও জননেতাই জড়িত ছিলেন ভাষা আন্দোলনে অথচ আজ পর্যন্ত ৬৫ বছর হয়ে গেলেও কোনো সরকারই তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এ এক যন্ত্রণা এবং দুঃখজনক কাহিনি। জেলা প্রশাসনকে দায়িত্ব দিয়ে রাষ্ট্র যদি ক্ষমতাসীন সরকারের মাধ্যমে এই নাম সংগ্রহ করার উদ্যোগ গ্রহণ করত, তাহলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জীবিত নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে জেলায় জেলায় এবং কেন্দ্রীয়ভাবে এর একটি তালিকা তৈরি করা সম্ভব হতে পারত।
বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতাসীন, তারা এই ঐতিহাসিক দায়িত্বটি পালন করতে পারেন। আমরা মুখে-বক্তৃতায় ১৯৫২ থেকে ’৭১, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধÑ বলে থাকি কিন্তু শেকড়ের কোনো সন্ধান আজ পর্যন্ত করিনি। পাবনার আবদুর রব, লুৎফর রহমান, আমজাদ হোসেন, জয়নাল আবেদিন, রণেশ মৈত্র, আবদুল মবীন যারা সক্রিয় ছিলেন। বগুড়ার ছিলেন মোখলেসুর রহমান, সত্য ভট্টাচার্য, দুর্গাদাস মুখার্জি, মাজহারুল ইসলাম প্রমুখ। সিলেট, কুমিল্লা, দিনাজপুর অর্থাৎ পূর্ববঙ্গের তৎকালীন ১৭টি জেলার সচেতন প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মী-সংগঠক মাতৃভাষা মর্যাদার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে শামিল ছিলেন। প্রতিবছর একুশে পদক বিতরণ করা হচ্ছে দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি তথা ভাষা সংগ্রামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বন্ধুজনকে। আমরা রাষ্ট্রের কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু মাঝে মধ্যে যে অপাত্রেও দান করা হচ্ছে না, তা হলফ করে বলা যাবে না। তাই এযাবৎ যারা পেয়েছেন তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রের অবদান খাটো করে কেউ দেখছেন না। তবুও গুণীজন, মহান, ত্যাগী, নির্যাতিত বহু ভাষা সংগ্রামী আজ পর্যন্ত এই পদকে ভূষিত হননি। নিশ্চিত করেই বলা যায়, যদি তাই হয় তাহলে কি প্রশ্ন ওঠে না কেন এই পুরোধা ব্যক্তি সংগ্রামের নেতৃস্থানীয় অনেককেই বাদ দিয়ে এই রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে? ভাষা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী প্রথম সারির সক্রিয় নেতারা বেশ কজন আজও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের রক্তক্ষয়ী মুক্তি সড়ক সৃষ্টি করেও এই সম্মান থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। এরাই তো ঢাকা ও ঢাকার বাইরে জেলায় জেলায় অকুতোভয় বাঙালি এমনকি আদিবাসী রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাদের সম্মান না করে আমরা কি অবমাননাই করছি না? সত্যিকার ভাষা সংগ্রামীদের সম্মান করা রাষ্ট্রের কর্তব্য এবং তা প্রশাসনিক উদ্যোগেই করতে হবে।
কামাল লোহানী, সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন