কিশোর-তরুণ সমাজের একাংশের অবক্ষয় চিত্র ভয়ঙ্কর
23 January 2017, Monday
আমাদের তরুণ সমাজের গৌরবদীপ্ত অধ্যায়ের বিস্তৃতি কম নয়। তারুণ্যের এই গৌরবদীপ্ত অধ্যায়ের ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব সমাজ ও রাষ্ট্রে কতটা আলো ছড়াতে পারে এর বহুবিধ দৃষ্টান্ত রয়েছে আমাদের সামনে। স্বাধীনতা অর্জনের উত্তর-পূর্ব সময়কালের খণ্ড খণ্ড চিত্র একত্রে করলে আমাদের তারুণ্যের যে অখণ্ড রূপ প্রকাশ পায় তা এত বেশি আশাজাগানিয়া যা বর্ণনাতীত বহু ক্ষেত্রেই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই তারুণ্যের একাংশ এখন ডুবে যাচ্ছে অবক্ষয়ের কাদাজলে। এর পশ্চাদ কারণ অনুসন্ধান করার আগে দৃঢ়ভাবে যে কথাটা উচ্চারণ করতে চাই তা হলো-এমনটি কোনোভাবেই আমাদের কাছে কাক্সিক্ষত নয়। আমাদের গৌরবদীপ্ত তারুণ্যের আলোর বিস্তৃতকরণ চাই। কারণ তারুণ্যের আলোই তো একটি দেশ ও সমাজকে করতে পারে ব্যাপক সমৃদ্ধ।
সম্প্রতি একাধিক পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে যে, রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে উচ্ছৃঙ্খল-বিপথগামী কিশোর-তরুণদের ভয়ে মানুষ তটস্থ। তাদের সিংহভাগ কেন, বলা শ্রেয় যে প্রায় সবাই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। রাজধানীতে রাত যত বাড়ে তাদের দাপটও পাল্লা দিয়ে ততই বাড়ে। রাস্তায় গাড়ি হাঁকিয়ে চলে তারা গাড়ির মিউজিক বক্সে উচ্চমাত্রা দিয়ে। তারা এপ্রান্ত থেকে ছুটে যায় ওপ্রান্তে। কী তাদের উদ্দেশ্য এর গভীরে না গিয়েও বলা যায়, ধনাঢ্য ঘরের এসব সন্তান এরই মাঝে খোঁজে আনন্দ! এমন চিত্র মোটেও স্বস্তিদায়ক নয় বরং বলা সঙ্গত যে, নৈতিক স্খলের এমন ভয়াবহ চিত্র বড় বেশি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা ভয়ঙ্কর সব অপরাধে জড়াচ্ছে এমন সংবাদ পত্রপত্রিকায় প্রায়ই প্রকাশিত হচ্ছে। চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা এখন বেছে নিচ্ছে বখে যাওয়া কিশোর-তরুণদের।
দেশে জঙ্গি-উগ্রবাদ-সন্ত্রাস দমনে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি এবং প্রশাসনের কঠোর নজরদারি ও অভিযানের পরও এই অপক্রিয়ার রাশ টেনে ধরা যাচ্ছে না। বিপথে যাচ্ছে তরুণরা এবং ইতোমধ্যে তাদের মাধ্যমে সংঘটিত কয়েকটি ঘটনা প্রশ্ন দাঁড় করিয়েছে-আমাদের তরুণদের একাংশকে টার্গেট করে কারা টেনে নিচ্ছে বিপথে? এ প্রশ্নের জবাব মোটেও জটিল নয়। জঙ্গিবাদ-উগ্রবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত এ দেশের গডফাদাররা এই তরুণদের টার্গেট করে এগোচ্ছে। তারা এখন আর দরিদ্র শ্রেণী কিংবা মাদ্রাসায়পড়–য়াদের দিকে হাত বাড়াচ্ছে না। তারা নজর দিয়েছে ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের দিকে এবং এই সন্তানদের অধিকাংশই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া। অর্থাৎ জাতি বিনাশের লক্ষ্যে তারা হাত দিয়েছে অত্যন্ত মজবুত একটি ক্ষেত্রে এবং আমাদের তারুণ্যের একাংশ তাদের টানে হেলে পড়ছে ধ্বংসাত্মক দিকে। এই চিত্র বড় বেশি ভয়ঙ্কর। এর জন্য সমাজ ও পরিবারের দায়-দায়িত্বের পাশাপাশি সরকারেরও কঠোর নজরদারি দরকার।
শুরু করেছি কিশোর-তরুণদের অবক্ষয় নিয়ে। আমাদের তরুণদের একাংশের ওপর পড়েছে মাদকের ভয়াবহ থাবাও। এক্ষেত্রেও দেখা যায় সচ্ছল পরিবারের সন্তানরাই বেশি ধাবিত হচ্ছে। মাদকের কিশোর-তরুণ সমাজের একাংশের অবক্ষয় চিত্র ভয়ঙ্করভয়াবহ আগ্রাসনে গোটা সমাজে দেখা দিয়েছে নানাবিধ শঙ্কা। আমরা ভুলে যাইনি ঐশীর কথা এবং ঐশীর ঘটনা ভয়াবহ দৃষ্টান্ত। এমন ঐশীর সংখ্যা এই সমাজে কত এ প্রশ্নটা জাগে। সম্প্রতি একটি দৈনিকে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মরণ নেশার টানে আক্রান্ত তরুণ-তরুণীর সংখ্যা ক্রম বাড়ছে। হাত বাড়ালেই মিলছে নানা রকমের মাদক। মাদকবিরোধী অভিযান এবং প্রচারণা জোরদার সত্ত্বেও এ সর্বনাশা কর্মকাণ্ডেরও রাশ টানা যাচ্ছে না। সময়ের সঙ্গে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন উপকরণ। ফুটপাত, বস্তি থেকে শুরু করে পাঁচ তারকা হোটেল, অভিজাত বাসাবাড়ি সর্বত্রই চলছে নেশার খেলা এই তথ্যচিত্র উপস্থাপিত হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। নেশাগ্রস্ত তরুণ-তরুণীরা এমন সব ঘটনা পরিবারে-সমাজে ঘটিয়ে চলেছে যার অনেক কিছুই প্রকাশ পাচ্ছে না। না পাক প্রকাশ কিন্তু তাতে কী। সমাজের মাঝে অবক্ষয়ের ছায়া যে ক্রম বিস্তৃত হচ্ছে নীরবে-নিভৃতে কিংবা প্রকাশ্যে তা তো এখন আর অস্পষ্ট নয়। গণমাধ্যমে এমন চিত্র প্রায়ই ফুটে উঠছে।
শুধু তরুণ-তরুণীরাই নয়, কিশোর-কিশোরীরাও যাচ্ছে বিপথে। সমাজ বিজ্ঞানীরা এই বিষয়টি নিয়ে নানা রকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিতরাও চিন্তিত। সমাজের মধ্যে অবক্ষয়ের ছায়ার ক্রম যে বিস্তর ঘটছে এর অশুভ পরিণতি আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে এই আশঙ্কা অমূলক নয়। আমাদের তরুণ-তরুণীদের বিরাট অংশের জাগরণ নিকট অতীতেও দেশ-বিদেশে ঝড় তুলেছিল। মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী কসাই কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে নতুনভাবে জেগে উঠেছিল এ দেশের তারুণ্য। এই জাগরণের ঢেউ দেশের সব জনপদে যেমন লেগেছিল তেমনি ছড়িয়ে পড়েছিল সীমানা ছাড়িয়েও। খুবই আশাপ্রদ চিত্র ফুটে উঠছিল ক্ষণে ক্ষণে। অনস্বীকার্য যে, ওই জাগরণ দেশে নতুন ধারার একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিল। এর ইতিবাচক প্রভাব সর্বব্যাপী এতটাই পরিলক্ষিত হয়েছিল যে এর ফলে আমাদের মনে আশার নতুন সঞ্চার ঘটিয়েছিল। তারুণ্যই বদলে দিতে পারে সব কিছু এমন ধারণা পুনর্বার হয়েছিল পুষ্ট। যে দেশের তারুণ্যের বড় অংশের এমন দৃষ্টান্তযোগ্য আরো উদাহরণ রয়েছে সে দেশের তারুণ্যের একাংশের সাম্প্রতিক অবক্ষয় চিত্র সঙ্গত প্রশ্ন দাঁড় করায়-এর পেছনে কি কোনো হীন চক্রান্ত কাজ করছে? সরকার ও প্রশাসনের দায়িত্বশীলদের এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে মনোনিবেশ করা জরুরি বলে মনে করি। কমনওয়েলথ ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স ২০১৬ এর গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে তরুণদের জীবন উজ্জ্বল নয়। এই বার্তাটিও দায়িত্বশীলদের আমলে নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
বায়ান্ন-ঊনসত্তর-একাত্তর পর্বে এবং স্বাধীন দেশে নব্বইয়ে আমাদের তারুণ্যের মুঠিবদ্ধ হাত, দৃঢ় দীপ্ত পায়ের পদচারণা, বুক চিতিয়ে দিয়ে অন্যায়-অনাচার-স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদে রাজপথে কাঁপন ধরানো আওয়াজ আমাদের অর্জনের খতিয়ান কতটা বিস্তৃত করেছে এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নতুন করে নিষ্প্রয়োজন। সেই তারুণ্যের উত্তরাধিকারী একাংশের মাঝে আজ এত অবক্ষয় কেন দেখা দিল? আমাদের সব অর্জনের বিসর্জন ঘটাতে কারা গভীর ষড়যন্ত্রে মেতেছে? এসব কিছুর জন্য হাত দিতে হবে উৎস মূলে। খুঁজে বের করতে হবে বিষের পাত্র, উপড়ে ফেলতে হবে বিষবৃক্ষ। এর জন্য দরকার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-গণতান্ত্রিক সব প্রক্রিয়া জোরদার করা। রাজনীতির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। দেশের মানুষের আশা পূরণ করার দায়িত্ব সরকারে যারা থাকেন তাদের। যারা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তাদের দায়বদ্ধতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করার জন্য বুদ্ধিজীবী সমাজেরও ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। সবাইকে স্ব স্ব অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে আমাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণের জরুরি প্রয়োজনে। অবক্ষয়ের যে চিত্র ক্রম উৎকট রূপ নিচ্ছে এর নিরসন ঘটাতে চালাতে হবে সম্মিলিত প্রয়াস এবং এক্ষেত্রে আর কোনো কালক্ষেপণ কাম্য নয়।
কিশোর-তরুণ সমাজের একাংশের মাঝে অবক্ষয়ের যে অপছায়া পড়েছে তা দূরীকরণ শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশের জন্য নতুন কর্মপরিকল্পনার পাশাপাশি দ্রুত বাস্তবায়নের সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষয়ে যাওয়া তারুণ্যের অংশকে আলোতে আনতে হবে। অন্ধকারের বিস্তার ঠেকাতে হবে। এক্ষেত্রে প্রত্যেক পরিবারকে অধিকতর সজাগ হওয়া জরুরি। পরিবারের সন্তান কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে এসব দেখভালের দায়-দায়িত্ব পরিবারের। আমাদের তারুণ্যের গৌরবদীপ্ত অধ্যায়গুলোর কথা স্মরণ করে এ কথাটাই স্পষ্ট করে বলতে চাই-অবক্ষয় মেনে নেয়া কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আমাদের ভবিষ্যৎ কর্ণধারদের রক্ষায় সর্বতো প্রয়াস জোরদার করতেই হবে। কাজের ক্ষেত্র বিস্তৃত করতে হবে। সবাইকে না পারা যাক অধিকাংশকে যাতে কাজে যুক্ত করা যায় এ প্রচেষ্টা করতে হবে জোরদার। হতাশা জš§ নেয় এমন সব কিছুর যবনিকাপাত ঘটানো জরুরি। অন্ধকার দূর করতে নানামুখী কর্মপরিকল্পনা নিয়ে দ্রুত এগোনো ছাড়া গত্যন্তর নেই।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
মানবকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন