যে মাতৃভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন বাংলার দুরন্ত দামাল সন্তানদের, সেই বাংলা ভাষার কী দুরবস্থা আজকের এই বাংলাদেশে? ভাবলে মাথা হেঁট হয়ে আসে। লজ্জায় মুখ ঢাকতে হয়। শুনলে কানে আঙুল দিতে হয়। এ দুর্দশা কিন্তু মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে অনেক বেড়েছে। কেউ কিছু বলছিও না, গুমরে মরছি কেবল। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ৬৩ বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো তাপ-উত্তাপ লক্ষ করছি না। কারো মধ্যেই নয়, ভাষাসংগ্রামীরা বার্ধক্যে ভুগছেন অধিকাংশই, মৃত্যু হয়েছে বহুজনের। ভেবেছিলাম বায়ান্নর রক্তাক্ত ফেব্রুয়ারি তো তরুণদেরই সৃষ্টি, প্রাণও দিয়েছেন তাঁরাই; হয়তো এখনকার তরুণরা নতুন কোনো ঢেউ তুলবেন মাতৃভাষার পক্ষে। কিন্তু কেবলই হতাশ হচ্ছি।
লিখতে, বলতে বলতে হদ্দ হয়ে গেলাম, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করুন। এটাই তো বায়ান্নর অন্যতম স্লোগান ছিল, শহীদদের স্লোগান, ভাষাসৈনিক-ভাষাসংগ্রামীদের স্লোগান ৬৩ বছর আগে। আজ বাংলাদেশ পুনরুদ্ধার হয়েছে ৪৪ বছর হলো, লাখো শহীদের রক্তধোয়া এই স্বাধীনতার পর আমরা তো স্বশাসিত দেশ, তবে কেন আজও সেই পুরনো স্লোগান তুলতে হয়? এ কি জাতীয় লজ্জা নয়? আজও কেন অফিস-আদালত, দোকানপাট, রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কেন সর্বত্র বাংলা চোখে পড়ে না? সরকারি দপ্তরে বাংলা কি সর্বত্র প্রচলিত হয়েছে? মাঝেমধ্যে যে বাংলা ব্যবহার করা হয়, তা আবার দুর্বোধ্য। অনেকে বোঝেন না বলে ইংরেজিতে ফাইল চালাচালি বা চিঠি লেখালেখি করে থাকেন। আদালতে মামলা উপস্থাপন ও নিষ্পত্তিতে রায় সবাই বাংলা লেখেন কি না জানি না। ভাষা আন্দোলনের নেতা গাজীউল হক পরবর্তী সময়ে অ্যাডভোকেট হয়ে হাইকোর্টে যোগ দেন। তিনি মামলার নথি ও রায় যেন বাংলায় লেখা হয়, তার জন্য চেষ্টাও করেছিলেন। 'একুশে চেতনা পরিষদ' গঠিত হয়েছিল সত্তরের শেষপ্রান্তে এবং গাজী ভাই ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। সেই থেকে আজও আমরা একুশে চেতনা পরিষদের উদ্যোগে ভাষাসংগ্রামী সমাবেশ প্রতিবছরই করি; কিন্তু আজও গাজীউল হকের প্রয়াণে আহমদ রফিকের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সমাবেশেও প্রতিবছর ভাষাসংগ্রামীদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে হচ্ছে। কিন্তু কেন?
প্রবাসী দুই তরুণ সালাম ও রফিকের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ, তাঁরা ২১ ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' করার জন্য জাতিসংঘের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন। এ প্রস্তাবনা দেশের সরকারকে করতে হয়। না হলে বিশ্ব সংস্থা একে বিবেচনা করে না। তখন ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা, তিনি উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন এবং জাতিসংঘ বিষয়টি বিবেচনা করে একুশেকে সেই মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। আমরা কৃতজ্ঞ যে আজ প্রায় ২০০টি রাষ্ট্র একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সগৌরবে পালন করছে। অথচ সেই সরকারই পর পর দুই মেয়াদে একনাগাড়ে দেশ শাসন করছে, তারাও সর্বস্তরে বাংলাকে চালু করতে পারেনি। নির্বাহী নির্দেশেই তো সবাইকে ব্যবহারিক প্রধান ভাষা হিসেবে বাংলা চালু করতে বাধ্য করতে পারে। এত বছর একনাগাড়ে থেকেও কেন এই নির্দেশ দিচ্ছে না?
সরকারের কাছে আমরা দাবি করব, যা কিছু অপূর্ণ-অন্যায়, সেগুলো পূরণের জন্য সংশোধনের লক্ষ্যে। কিন্তু সেই সঙ্গে আমাদের, অর্থাৎ জনগণেরও দায়িত্ব আছে, সে কথা ভুলে নিশ্চিন্ত মনে বসে থাকলে বহু অর্জন যেমন সুরক্ষার অভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে, তেমনি জাতীয় অধিকার আদায়ে কর্তব্য পালনেও ব্যর্থ হব। সে কারণে ব্যক্তি বা বেসরকারি সাহিত্য-সংস্কৃতি সংগঠনগুলোকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে এবং নিজেদের যেমন এ বিষয়ে পালনীয় কর্তব্য করতে হবে, সেই সঙ্গে দেশ পরিচালনাকারী রাজনৈতিক শক্তিকেও সচেতন করতে হবে, না হলে নিজ অধিকার হারাতে হবে, যাতে করে জাতি হিসেবে নিজ গর্ব-গৌরব হারাতে হবে, অস্তিত্ব সংকট দেখা দেবে।
যে ভাষায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, যে ভাষায় কবিতা লিখে তিনি বিশ্বজয় করেছিলেন অনেক আগেই, সেই সে গরবিণী ভাষায়ই রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, নজরুল, জগদীশচন্দ্র, সত্যেন বোস, কুদরাত-এ-খুদা, জসীমউদ্দীন, কায়কোবাদ, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, কাজী মোতাহের হোসেন, সুকান্ত, সোমেন চন্দ, সত্যেন সেন, রনেশ দাশগুপ্ত, ফররুখ আহমদ, শামসুর রাহমানদের মতন বঙ্গসন্তান, সেই সে সংগ্রামী-সাহসী গুণীজনের উত্তরাধিকারী সালাম-বরকত, রফিক-জব্বার, শফিউর, অহিউল্লাহ দিচ্ছেন ডাক গৌরবের উত্তরাধিকারকে ধারণ করতে। সেই বাংলাদেশের, বাংলা ভাষার জন্মসন্তান আমরা কেন আজ দ্বাদশ শতকের কবি আব্দুল হাকিমের ক্ষুব্ধ উচ্চারণ-'যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি'র মতো চূড়ান্ত অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি এবং রক্তার্জিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আজও ওই প্রশ্নেরই মুখোমুখি হচ্ছি?
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন