আপসহীন এক ভাষাসংগ্রামী
08 October 2015, Thursday
ভাষা মতিন প্রয়াত হয়েছেন আজ একবছর হয়ে গেল। ২০১৪ সালের ৮ অক্টোবর তিনি চলে গেলেন তাঁর মনের মানুষদের ছেড়ে। সুদীর্ঘ জীবনে যে রাজনৈতিক আদর্শকে ধারণ করেছিলেন, তা ছিল জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার, শ্রেণিশোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের। তিনি আব্দুল মতিন এই রাজনৈতিক আদর্শকে ধারণ করে নিজে শ্রেণি সম্পর্ক ত্যাগ করে সাধারণ মানুষের সাথে মিশে গিয়েছিলেন। আর সে কারণেই তিনি অবস্থাপন্ন পরিবারের সন্তান হয়েও নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিবেদন করেছিলেন দেশ ও দশের কল্যাণে। আর তাই আব্দুল মতিনের মতন উচ্চশিক্ষিত মানুষ আমৃত্যু সাধারণ জীবন-যাপন করে গেছেন। কৃষক শ্রেণিকে সংগঠিত করতে গিয়ে তাদেরই একজন হয়ে জনগণের জীবন পরিবর্তনের বাণী ছড়িয়ে গেছেন এবং নিরলস সংগ্রামে নিজেকে নিবেদন করেছেন।
প্রগতিশীল রাজনৈতিক দর্শন ও সংগ্রামে বিশ্বাসী এই তরুণ ছাত্রজীবনেই তাঁর মেধা ও প্রত্যয়ের পরিচয় রেখেছিলেন, বাঙালি জাতিসত্তার সবচেয়ে মৌলিক সংগ্রাম রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়ার মাধ্যমে। আব্দুল মতিনের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ লড়াই সংগ্রামের শুরু এই পথযাত্রার মাধ্যমে। দেশমাতৃকার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে পাকিস্তানি রাষ্ট্রের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নার মুখের ওপর প্রতিবাদ করতেও কুণ্ঠিত হননি। তিনি তাঁদেরই একজন, যিনি জিন্না সাহেবের Urdu and only Urdu shall be the state language of pakistan—এই একনায়কোচিত দম্ভোক্তির বিরোধিতা করেছিলেন। রেসকোর্স ময়দানে জিন্নার সংবর্ধনা সভায় উপস্থিত বিশাল সমাবেশের একপ্রান্ত থেকে গর্জে উঠেছিল যে কণ্ঠস্বর, তা-ই পরদিনই সোচ্চার হয়েছিল কার্জন হলের ছাত্রসভায়, সরাসরি। আর নাস্তানাবুদ মোহাম্মদ আলী জিন্নাকে বাধ্য হয়ে পেছন দরজা দিয়ে নিরাপত্তার নামে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। এইতো অগ্নিঝরা জীবনের সারথী আব্দুল মতিন। এ জীবনের সংগ্রামের শুরু ১৯৪৮ সালেই। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের ছাত্র। সেই যে প্রতিবাদ প্রতিরোধের সংগ্রাম দিয়ে শুরু তাঁর শেষ তাই একই আদর্শিক পথের অগ্রদূত হিসেবে।
আপসহীন এই সংগ্রামী মানুষটি কখনও অন্যায়ের সামনে মাথানত করেননি। আর করেননি বলেই তাঁকে পেরুতে হয়েছে জীবনের বহু ঘাত-প্রতিঘাত আর জেল-জুলুম। তাই জীবনকে তিনি মেহনতি মানুষের মুক্তি সংগ্রামের এক অকুতোভয় যোদ্ধা হিসেবেই আবির্ভূত করেছেন পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়েই। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী আন্দোলনে অংশ নেন, তাদের সমর্থনে সোচ্চার হলে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি নিশ্চুপ বসে থাকেননি। মনের মধ্যে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষা এবং তত্কালীন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বাংলার মানুষের ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন সহপাঠী সচেতন সংগ্রামী বন্ধুদের সাথে। ১৯৫০ সালের ১১ মার্চ ভাষা সংগ্রামকে অব্যাহত রাখার প্রয়োজনে ছাত্রনেতৃবৃন্দের এক সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সেই সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয় এবং আব্দুল মতিনকে সর্বসম্মতিক্রমে কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত করা হয়। এই ভাষা আন্দোলনকে শক্তিশালী ও বিস্তৃত করার উদ্দেশ্যে এই কমিটি নানা কর্মসূচির মাধ্যমে সংগ্রামের ধারাকে অব্যাহত রাখেন।
এমন সময় অতিবাহিত হতে থাকলে একসময় পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনকে কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে পদোন্নতি ঘটায় মুসলিম লীগ সরকার। কথা ছিল নাজিমুদ্দিন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারকে চাপ দেবেন। কিন্তু পদোন্নতির মোহে নাজিমুদ্দিন বেমালুম সেই সে প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গিয়ে উল্টো পথ ধরলেন নিজের গদিটাকে পোক্ত করার জন্য। তিনি ঢাকা এলেন ১৯৫২ সালে এবং ২৭ জানুয়ারি ঢাকা পল্টন ময়দানে এক জনসভায় জিন্না সাহেবের দম্ভোক্তিরই পুনরাবৃত্তি করে বললেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুই হবে। ছাত্রদের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভুলে নয়, পদ লোভে উন্মত্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন বিশ্বাসঘাতকতা করতে দ্বিধা করলেন না। কিন্তু এর যে ভয়াবহ পরিণতি হবে এবং একদিন না একদিন এই নিপীড়ক অপশক্তির পতন হতে পারে, একথা খাজা নাজিমুদ্দিন কিংবা কেন্দ্রের মুসলিম লিগ সরকারও ভাবতে পারেনি। এইখানে আব্দুল মতিন ও তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির প্রবল প্রতিরোধের সূচনা। পরিস্থিতির আকস্মিকতায় মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি করে গঠিত হলো সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। কাজী গোলাম মাহবুব হলেন সম্পাদক। আব্দুল মতিনও একজন সদস্য রইলেন।
আন্দোলনকে জোরদার করার প্রস্তুতি টের পেয়ে প্রাদেশিক প্রশাসন ঢাকা ও আশপাশে ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু অদম্য ছাত্র সমাজ এবং সংগ্রাম কমিটি প্রতিবাদে গর্জে উঠে। এদিকে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি ২০ তারিখে রাতে এক জরুরি বৈঠক ডাকেন। মওলানা ভাসানী তখন টাঙ্গাইলের সন্তোষে, তাই আবুল হাশেম সভাপতিত্ব করেন। ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে কিনা এনিয়ে সভায় ছাত্রদের সাথে মতবিরোধ দেখা দিলে সভা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত নেয় সর্বদলীয় কমিটি এবং ঘোষণা দেন ছাত্ররা ১৪৪ ধারা যদি ভাঙে, তাহলে সেই মুহূর্তেই এই কমিটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ... এই সভায় ছাত্র সংগ্রাম কমিটির প্রতিনিধি আব্দুল মতিনের ভূমিকা ছিল সাহসী এবং গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের পূর্ব সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়ে আব্দুল মতিন ও সহযোদ্ধা নেতৃবৃন্দ হলে চলে আসেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল প্রতিবাদ দিবস। বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান ফটকে কালো পতাকা উঠানো হয়। সকালেই ঐতিহাসিক আমতলায় শহরের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমবেত বিরাট সভায় গাজীউল হকের সভাপতিত্বে আব্দুল মতিন পূর্বাপর পরিস্থিতি বর্ণনা করে নিজেদের সিদ্ধান্ত, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার কথা জানিয়ে সকলের মত জানতে চান। উপস্থিত সকলেই একবাক্যে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মত দেন। আওয়ামী মুসলিম লিগের সাধারণ সম্পাদক টাঙ্গাইলের শামসুল হক না ভাঙার কথা বললে সকলে তা প্রত্যাখ্যান করেন। পরিস্থিতি তখন এতই অগ্নিগর্ভ ছিল। ছাত্রসভার সিদ্ধান্ত হলো আব্দুল মতিনের বক্তব্যের সুরে, দশজনের মিছিল বের হলো। অবস্থান নেয়া পুলিশ এক সময় গুলি চালাল ছাত্রদের ওপর। শহীদ হলেন সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বার, আরও অনেকে, তাদের লাশ সন্ধ্যার অন্ধকারে মিলিটারি গুম করে ফেলল। বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক আব্দুল মতিন পরদিন সকালে মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণে প্রতিবাদ সমাবেশ আহ্বান করেন। ... এ খবর বাতাসে কানে কানে ছড়িয়ে গেল গোটা পূর্ববাংলার গ্রামে-গঞ্জে। প্রতিবাদের ঝড় উঠল উত্তাল। জনতার গর্জনে কেঁপে উঠলো মুসলিম লিগ প্রশাসন। শুরু হলো গ্রেফতার। সরকারের চন্ডনীতি ছাত্রদের দমন করতে পারেনি। ২২, ২৩, ২৪ ফেব্রুয়ারি এ লড়াই সারা শহরে ব্যাপ্ত হয়ে গেলে ঢাকার আদি বাসিন্দা, যারা ছিলেন মুসলিম লীগের গোঁড়া সমর্থক তারাও এসে দাঁড়ালেন ছাত্রদের পাশে।
এমনিভাবে আহ্বায়ক আব্দুল মতিন গ্রেফতার হলেন এবং কারান্তরালে নিক্ষিপ্ত হলেন বহু ছাত্র যুব নেতা। রাজনীতিবিদ যারা মুসলিম লীগের এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে এবং ভাষা প্রশ্নে বাংলাকে সমর্থন দিয়েছিলেন তাঁরাও গ্রেফতার হলেন। কিন্তু যত দমন-পীড়নই হোক না কেন, এ লড়াই সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ায় লীগ সরকারের আক্রোশ নেমে এলো পূর্ববাংলার সকল মানুষের ওপর। সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিলেন সকল নেতা, ২১ ফেব্রুয়ারি হবে ‘শহীদ দিবস’। আর জাতির বৃহত্ এই জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলার লড়াই তুঙ্গে উঠলে, আব্দুল মতিন হয়ে গেলেন ‘ভাষা মতিন’। এই অভিধায় চিহ্নিত হলেন তিনি। তাই ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে বাংলার গণমুক্তির যে সূত্রপাত, সে এই ভাষা সংগ্রাম থেকেই উচ্চকিত হয়েছে। নেতৃত্বে অগ্রণীর ভূমিকা পালন করেছিলেন আপসহীন ছাত্রনেতা আব্দুল মতিন।
‘ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স’ বিভাগের মেধাবী ছাত্র আব্দুল মতিন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনীতি সচেতন হলেও কারাগারে প্রবীণ মার্কসবাদীদের সান্নিধ্য ও সাহচর্য তাঁকে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট করে। তিনি কৃষকশ্রেণির শোষণ অবসান ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাম রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করেন নিজেকে।
সেই যে বামপথে হাঁটা, তা থামেনি। নিরন্তর হেঁটে চলেছেন তিনি। মৃত্যুর আগেও তিনি কৃষক-শ্রমিক জনতার নবজীবন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ‘লালটুপি’ সমাবেশ করে দেশবাসীকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। দেশের মানুষ কি চান। সত্যি কথা বলতে কি, তিনি মার্কসবাদী ধ্যান-ধারণা থেকে দেশজ রাজনীতিকে বিশ্লেষণ করে একসময় সশস্ত্র বিপ্লবের পথে হেঁটেছেন। কিন্তু নানা দমন-পীড়নে তাঁকে কিন্তু জনগণের সার্বিক মুক্তির পথ থেকে সরানো সম্ভব হয়নি। তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন সত্যিকার কমিউনিস্ট হিসেবে সঠিক পথে থেকে দেশের মানুষের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে পৌঁছতে। দল করেছেন কমিউনিস্ট আদর্শের নীতি-নৈতিকতা মেনে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন একাত্তরে। কিন্তু নিজস্বতা বিসর্জন দেননি। তার জন্য তাকে সর্বস্ব ত্যাগের স্বীকারে পরিণতও হতে হয়েছে। তবু তিনি অন্যায়ের কাছে কোনদিন মাথা নত করেননি। মানুষের আদত মুক্তির দিশায় সকলকে তাই আহ্বান করেছেন। প্রগতিশীল ছাত্র সংগ্রাম থেকে, ভাষা আন্দোলন থেকে অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি-রাজনীতির পতাকাকে ঊর্ধ্বে ধরার জন্য যে বৈপ্লবিক চেতনা ধারণ করেছিলেন ভাষা সংগ্রামী আব্দুল মতিন, তাঁর সেই অধিনায়কোচিত নেতৃত্ব এবং অনন্য লড়াকু ভূমিকার জন্য তিনি ‘ভাষা মতিন’ হিসেবেই পরিচিত হয়ে থাকবেন।
লেখক :সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন