আমরা চলেছি কোথায়? এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের কেন এত হয়রানি করা হচ্ছে? এমনকি পুলিশ তাদের জিডি পর্যন্ত নিচ্ছে না, কোন দায়িত্ববোধে? নাকি প্রতাপের ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে অভিযোগকারীর সত্য বলার সাহসকে হত্যা করতে চাইছে সংশ্লিষ্টরা? মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সত্য কথা বলা, দেশপ্রেম দেখানোটাও কি তবে এখন 'নিষিদ্ধ' হতে চলেছে? মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কি একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে? আমরা লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে নিজ মাতৃভূমিকে পাকিস্তানি দখলদার শোসকদের নিপীড়ন নির্যাতন, শোষণ-বঞ্চনার হাত থেকে দেশকে উদ্ধার করেছিলাম গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ এক সমাজতান্ত্রিক সোনার বাংলা গড়ে তুলতে। কিন্তু আজ কেন এমন হলো? একি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভুলুণ্ঠিত করার কোনো অপপ্রয়াস? আমরা কি ক্রমেই সে পথে যাচ্ছি, যে পথে হাঁটলে 'শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যে' প্রবেশ করতে হবে।'
স্বদেশে যে অস্থির পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করছি প্রতিদিন শিশু-কিশোরী ধর্ষণ, নানা বয়সী হত্যা, উচ্ছেদ বিতাড়ন, হুমকি-ধমকি, মামলা-হামলা ইত্যাকার পৈশাচিক কর্মকা-ে কান ঝালাপালা, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। সবই সেই পাকিস্তানি ভূত শত্রুসম্পত্তির দখলদারি আর ভূমিগ্রাসের অপ্রিয় ঘটনাবলি ছাড়াতে বিশেষ করে হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর নানা নির্যাতন-অপহরণ, হত্যা-ধর্ষণের কাহিনী নিরন্তর ঘটতে ঘটতে ৩৪ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে জনসংখ্যা বিশেষ সম্প্রদায়। মন্দির, বসতি, ব্যবসা, সম্পত্তি ধ্বংস তো নিত্যকার ঘটনায় পরিণত হয়ে গেছে।
অর্পিত সম্পত্তিবিষয়ক আন্দোলনে আমরা যারা জড়িত দীর্ঘকাল থেকে তারা এই দেশের নাগরিক হিসেবে লজ্জিত, কুঞ্চিত ওইসব ঘটনার জন্য। তবু নানা হেনস্তা হয়রানি হচ্ছে আজও লড়তে হচ্ছে কারণ ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু অর্পিত সম্পত্তির তালিকা তৈরি শেষ করে দিয়েছিলেন, তাকে অমান্য করে আজও চলছে ভূমিগ্রাস। সরকারের আমলারা তো আছেই এর সাথে জড়িত এখন যে ক্ষমতায় থাকে সেই দলীয় চেলাচামু-া নয়_ শুধু এমপি, মন্ত্রী, রাজনৈতিক দলীয় নেতারাও এই অপকর্মে জড়িত থাকেন। নানা অপকৌশল খাটিয়ে এসব জমি-সম্পত্তি, দালান-কোঠা দখল করে নিচ্ছে, কে ঠেকাবে।
অনেক দিনের লড়াই। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় জেনারেল আইয়ুব খান কর্তৃক 'শত্রু' সম্পত্তি নামে চিহ্নিত জমিজিরেত বাংলাদেশ হওয়ার পর দখল বেপরোয়াভাবে শুরু হয়েছিল। অর্ধ শতাব্দী ধরে চলছে এই মহোৎসব। পাকিস্তানি সামরিক শাসকচক্রের এই আগ্রাসী নীতি ও বিবর্তনমূলক আচরণ আজও কেন বহাল থাকবে, ধর্ম নিরপেক্ষতার সস্নোগান দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ লড়ে যে দেশের জন্ম, তার শাসকচক্র আচরণ কেন এমন হবে? তবু আমরা ৪৪ বছর পার করে এসে 'শত্রু সম্পত্তিকে' 'অর্পিত সম্পত্তি' নাম দিয়ে সুরাহা তো করতে পারিইনি উল্টো হিন্দু জনগোষ্ঠীকে দেশত্যাগে বাধ্য করার ভূমিদস্যু ও সাম্প্রদায়িক আচরণ করতে দ্বিধাবোধ করছি না। ধর্মনিরপেক্ষতার দেশে অমুসলিম জনগোষ্ঠীকে এত হয়রানি, দমন-পীড়ন, ভয়ভীতির মধ্যে কেন বাস করতে হবে? কেনইবা প্রশাসন সরকার এদের বিমাতাসুলভ হিংসাত্মক নজরের শিকারে পরিণত হতে হবে এবং এত বছর ধরে কেন কোনো সরকার ওই শত্রুসম্পত্তি কি অর্পিত সম্পত্তি তার একটা মীমাংসা করতে পারছে না। অথচ মহান মুক্তিযুদ্ধ চরাকালে প্রথম দিকেই প্রবাসী সরকার 'শত্রু সম্পত্তি' যার যার মালিকানায় ফিরিয়ে দেয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। সরকারি মুখপত্র সাপ্তাহিক 'জয়বাংলা' পত্রিকায় লেখা হয়েছিল সেই নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছিল সেই সিদ্ধান্ত। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেও ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত যে তালিকা প্রণীত হয়েছিল সেখানেই শেষ করে আর কোনো নতুন সম্পত্তিকে শত্রু বা অর্পিত সম্পত্তি বলে তালিকাভুক্ত করা যাবে না বলে নির্দেশ দিয়ে তালিকা করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তার নির্দেশকে ১৯৭৫ সালে তাকে সপরিবারে হত্যার পর মোশতাক নাটের গুরু হয়ে কিছু অবাধ্য এবং বিশ্বাসঘাতক সেনা অফিসারকে জড়ো করে ইতিহাসের মর্মান্তিক হত্যাকা- ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করল না শুধু, তার পরিবারের সব সদস্য এবং ঘনিষ্ঠ স্বজন ও রাজনৈতিক সহচরদের বেছে বেছে হত্যা করেও টিকতে পারল না। বীর মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার ও কে ফোর্সের অধিনায়ক জেনারেল খালেদ মোশারফ মোশতাক গংকে উৎখাত করে নিজে ক্ষমতা হাতে নিলেন বটে টিকতে পারলেন না। মাত্র চারদিন স্থায়ী হয়ে ছিল সেই ক্যু। কিন্তু একেও কর্নেল (অব.) তাহেরের সিপাহি জনতার অভ্যুত্থান নামে অভিহিত পাল্টা সেনা অভিযানে জেনারেল জিয়াকে ক্ষমতায় বসালেন তাহের। ক্ষমতালিপ্সু জেনারেল জিয়া সামরিক শাসনে দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে আপন স্বার্থ চরিতার্থ করার মতলবে তার ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে চাইলেন বলে কোনো আইন ছাড়াই যে জিয়াকে পূর্ববর্তী ক্যুতে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেছিলেন 'ত্রাতা' তাহের তাকেই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে নিজ ক্ষমতায়নকে নিরাপদ করলেন। তিনি ক্ষমতায় বসেই তার স্বপ্নসাধ পূরণের জন্য সেনাবাহিনীতেও গোপন হত্যা চালিয়ে নিজের পথ পরিষ্কার করতে ব্যস্ত ছিলেন। ফলে কর্নেল (অব.) তাহের যে সমাজতান্ত্রিক চিন্তা-ভাবনায় সেনাবাহিনীকে গণবাহিনীতে পরিণত করা, দেশের মঙ্গলকাজে নিবেদিত কর্মী হিসেবে যাদের কাজে লাগাতে চেষ্টা করছিলেন, তার পরিসমাপ্তি ঘটল। তাহেরের এই বিদ্রোহ ও গণবাহিনীর কর্মতৎপরতা কেবল সেনাবাহিনীর কিছুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল বলে জনগণের মধ্যে এর কোনো শেকড় ছিল না। আমার ধারণা, তাহেরের গণমানুষের কল্যাণচিন্তা প্রসূত অভ্যুত্থান জিয়াবাহিনীর দমন অভিযান ও সব সহযোগীর গ্রেপ্তারে স্তব্ধ হয়ে গেল। এখান থেকে আমরা যে শিক্ষা পেয়েছি, সে হলো, জনগণের মধ্যে ভিত্তি না থাকলে অথবা জনসাধারণকে এ ধরনের সশস্ত্র অভিযানে সম্পৃক্ত করতে না পারলে হঠাৎ কিছু একটা ঘটানো যায়; কিন্তু স্থায়ী করা যায় না, ব্যর্থ হতে হয়। তাহেরের উদ্যোগ তাই ব্যর্থ হয়ে গেল জিয়াবাহিনীর অনৈতিক ও অবৈধ অ্যাকশনে। গণবাহিনীও কর্নেল তাহের ছাড়া উঠে দাঁড়াতে পারল না। অথচ গণসমর্থন পেয়েছিল।
যা হোক শুরু হলো জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতালিপ্সা অভিযান। যা খুশি তাই করতে শুরু করলেন জিয়া। ১৯৭৩-এর দালাল আইনে যে যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল জিয়া তাদের সব খুনি হত্যা সহযোগী, ধর্ষক, লুটেরা ও অগি্নসংযোগকারীদের মুক্ত করে দিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধূলিস্যাৎ করে একাত্তরের খুনি জল্লাদ জামায়াত প্রধান গোলাম আজমকে পাকিস্তানি পাসপোর্টে বাংলাদেশে ঢোকার অনুমতি দিলেন। কিন্তু ১৯৮১ সালে মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের হাতে জেনারেল জিয়া মৃত্যুবরণ করতে তার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং একাত্তরে পাকিস্তানি সেনা তত্ত্বাবধানে বসবাসকারী সুন্দরী স্ত্রী খালেদা জিয়া প্রথমে দলপ্রধানের পদটি বিচারপতি সাত্তারের কাছ থেকে দখল করেন, মৃত ব্যক্তির প্রতি মানুষের মমতা অনুভূতির দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে। কিন্তু জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনে খালেদা জিয়া বাঁচার আকাঙ্ক্ষায় ঘর থেকে যখন বেরিয়ে পড়েছেন তখন নাচতে নেমে ঘোমটা দিয়ে কী হবে এমনই ভেবে যখন দেখলেন, এমনি ভূমিকায় তিনি একদিন ক্ষমতার শীর্ষ ব্যক্তি হতে পারবেন, তখন খালেদা অবরোধবাসিনী স্ত্রী ভূমিকা ত্যাগ করে রাষ্ট্রের শাসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে রাজপথে নামলেন। লোকে সহানুভূতির সাথে গ্রহণও করলেন। এই যেমন খালেদা জিয়া ছাড়লেন না, তেমনি সমর্থক জিয়াগোষ্ঠীও তাকে পেয়ে হাতে স্বর্গ পেল।
শুরু হলো স্বৈরাচারী জেনারেল এরশাদবিরোধী আন্দোলন। আন্দোলনে শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া দুজনের নেতৃত্বে ১৫ দল, ৭ দল এবং বামেদের ৫ দলীয় জোট জনগণের মনে সঞ্চিত ক্ষোভকে পুঁজি করে রাজনীতি ও ক্ষমতার লড়াই শুরু করল। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে দুই প্রধান জোট ও নেত্রীদ্বয়ের মেধার অগি্নপরীক্ষা হয়ে গেল। সাহসের সাথে স্বৈরাচারকে মোকাবেলার পাল্লা শুরু হয়ে গেল সবার অজান্তে অঘোষিতভাবে। সাধারণ মানুষ দুই নেত্রীকে পরখ করলেন এবং স্বৈরাচারের পতনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেন সাহসী খালেদা জিয়া। অথচ জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল এবং তুলনামূলক বেশি সময়ের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দল হওয়া সত্ত্বেও মানুষ খালেদা জিয়াকেই জিতিয়ে দিলেন। আওয়ামী লীগ জোট অনেকটা রিল্যাক্স ছিল যে তারাই জয়ী হবে। কিন্তু হলো উল্টো।
আওয়ামী লীগ এবং নবগঠিত বিএনপি এই দলের বয়স, অভিজ্ঞতা এবং আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ এসবেই আওয়ামী লীগ এগিয়ে ছিল। দল চরিত্রেও সমর্থক অনুসারীদের প্লাটফর্ম হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেই আদর্শ মেনেই পূর্ববর্ত িধারাকেই অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছিল। ক্ষমতায় থাকা এবং বাইরে অবস্থান গ্রহণে বাধ্য হওয়া অভিজ্ঞতার দিক থেকে যে কতটা ভিন্ন, তা এই নির্বাচনের মাধ্যমেই নিরূপিত হয়ে গেল। আমরা তার বহিঃপ্রকাশও দেখলাম। অথচ জনগণ কেন এই অরাজনৈতিক সামরিক বধূর চরিত্রকেই রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব দিলেন। আওয়ামী লীগ এক ও অভিন্ন চিন্তার লোকজনের দীর্ঘকালের দল। ১৯৪৯ সালে প্রতাপশালী মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে সংগঠিত বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। তখন অধিকাংশ সদস্যই দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে জনমতের প্রতিফলন ঘটিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেছিলেন। তবে নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মীরাও এই সংগঠনে থেকে তৎপরতা অব্যাহত রেখেছিলেন। গঠনের সাত বছর পর মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়ার প্রশ্নে দল বিভক্ত হয়ে গেল। ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী জাতীয়তাবাদী উগ্রশক্তির কাছে পরাজিত হলেন। পরিণতিতে মওলানা ভাসানী সারা পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতারা_ সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গাফফার খান, তার সহযোগী আবদুস সামাদ আচকজাই, পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক ওসমানী, জিয়ে সিন্ধের নেতা আবদুল মজিদ সিন্ধী, পিএম সৈয়দ, লাহোরের মাহমুদুল আলী কাসুরী এবং তাদের সহযোগী সমর্থকদের নিয়ে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন, যা ন্যাপ নামে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তিশালী ভিত্তিতে দাঁড় করিয়ে পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসন আত্মনিয়ন্ত্রণাধীকারের প্রশ্নে এবং ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক শক্তি আরো জোরদার করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তারা ১৪ দফা রাজনৈতিক দাবিও উত্থাপন করেছিল এবং দেশের সর্বত্র দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। কারণ রাজনীতিকে জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত করার এক অঙ্গীকারবদ্ধ দৃঢ় প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হলো। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতি ও দেশশাসন রাষ্ট্রক্ষমতায় অশনি সংকেত দেখা দিলে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটল। দেশের প্রধান সেনাপতি মেজর জেনারেল আইয়ুব খান সর্বময় ক্ষমতা নিজ হাতে তুলে নিলেন। দশ বছর পূর্ণ করল মানুষের সব অধিকার কেড়ে নিরন্তর শোষণ, বঞ্চনা, অবহেলা দেখিয়ে শাসন-শোষণ অব্যাহত রাখল। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করে সরকারি ফরমান জারি করে দেশশাসন করতে থাকলে অভ্যন্তরীণ ক্ষমতাদ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠলে, ইতোমধ্যে ফিল্ডমার্শাল হওয়া দোর্দ- প্রতাপশালী আইয়ুব খান তারই প্রধান সেনাপতির ক্ষমতার আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে জেনারেল ইয়াহিয়ার হাতে ক্ষমতা দিয়ে দিতে বাধ্য হলেন। পরে নির্বাসনে গেলেন, বিদেশে এক হোটেলে জনসংযোগ অফিসার হিসেবে 'পাকিস্তানের দুর্দ- প্রতাপশালী প্রেসিডেন্ট' দিনাতিপাত করতে করতে এক সময় মরেই গেলেন। হায়রে প্রতাপ। ক্ষমতাধর সর্বাধিনায়কের এই পরিণতি? এলেন জেনারেল ইয়াহিয়া। পূর্ব পাকিস্তানকে আড় চোখে দেখার সাথে যোগ হলো মদমত্ত-লাম্পট্য- এমনি যদি মানসিকতা থাকে, তাহলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা কী হতে পারে। তাতো আমরাই ভুক্তভোগী। অতি লোভে তাঁতি নষ্ট। সেটাই প্রমাণিত হলো। কপটতা আর দ্বিচারিতার সাথে স্বার্থোদ্ধারে পরনির্ভর হলে পরিণতি কী ভয়াবহ হতে পারে, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ তার জ্বলন্ত প্রমাণ। ভালো মানুষী দেখিয়ে সাধারণ নির্বাচন দিল দেশব্যাপী, তবে সামরিক শাসনের অবকাঠামো ভিন্নভাবে তৈরি হলো। মওলানা ভাসানীর অনুসারী ও সমমনা রাজনৈতিক ছোট এবং আঞ্চলিক দলগুলো অংশগ্রহণ নেবে না, ঘোষণা করে দিল। কিন্তু ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান নিজ উদ্যোগে রচিত ৬ দফাকেই হাতিয়ার করে সাময়িক রূপরেখায়ই অংশগ্রহণের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন এবং ঐতিহাসিক একক নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করলেন। কিন্তু পাকিস্তানে নিরন্তর শাসন করার মতলবিচক্র কায়েমি স্বার্থবাদী শোষক ক্ষমতাধরগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের এই মহান বিজয়কে গ্রহণ করল না কারণ তাহলে প্রশাসন যে বাঙালিদের হাতে চলে যাবে। চক্রান্ত জোরদার ও দ্রুততর হলো। তারপরের ইতিহাস বর্ণনা করার প্রয়োজন নেই।
মহান মুক্তিযুদ্ধ নয় মাস হলো। প্রাণ বিসর্জন দিলাম লাখো মানুষ। শরণার্থী জীবন কাটালেন কোটিজন। পাকিস্তানি হানাদারদের নির্মম নিপীড়ন-নির্যাতন হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ তো ছিলই সাথে জামায়াত ও ইসলামী ছাত্র সংঘ (এখন শিবির) ও তাদের সহযাত্রীরা আলবদর, রাজাকার বাহিনী গঠন করে যে জল্লাদ ও কসাইয়ের ভূমিকা পালন করেছে ইসলাম রক্ষার নামে, তাদের হাতেই অবরুদ্ধ শঙ্কিত জীবন কাটিয়েছেন প্রতি মুহূর্তে। সেই নিপীড়ক নির্দয় মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি জামায়াত-শিবির নরপশুরা জিয়া আর খালেদার প্রশয় পেয়ে আত্মপ্রকাশ করে ক্রমেই সংগঠিত শক্তি নিয়ে একাত্তরের হত্যা, খুন, গুম, লুট অগি্নসংযোগ চালিয়ে দেশবাসীকে ধর্মের দোহাই দিয়ে বিভ্রান্ত করতে কত না অপচেষ্টাই চালাচ্ছে। নানা নামে আত্মপ্রকাশ করছে এই জঙ্গিরা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তিকে তারা সইতে পারছে না। তাই অনবরত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবির সাথে বিএনপি অরাজকতা সৃষ্টি করে। বিশ্বের সামনে বাংলাদেশকে একটি 'পতিত জাতি' হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়, যা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু এদের যে নানামুখ সন্ত্রাসী জঙ্গিবাদী কর্মকা- ও তৎপরতা, সাময়িক হলেও জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে এবং জীবনটাকে সারাক্ষণ তটস্থ রাখার চেষ্টা চালায়, সে তো প্রায়ই জনগণ এবং সরকার প্রত্যক্ষ করছে। কিন্তু এদের প্রতিরোধের কৌশল জানা না থাকায়, তাদের কার্যক্রমকে ধরতে পারছে না। একেবারে যে পারছে না তাও কিন্তু নয়। পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনী বেশ কতগুলো অভিযোগে আড্ডা, গোপন অস্ত্রাগারে, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও খুঁজে বের করছে। কিন্তু জিরো টলারেন্স বলতে কি বোঝায়, তা জানি না, আমার জ্ঞান নেই। তবে আমি তো মানুষ। মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধি থেকেই তো এমন সব দুর্ধর্ষ বিধ্বংসী ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার জন্ম দিচ্ছে। কিন্তু এসব ফন্দি-ফিকির তো বেড়েই চলেছে। তাহলে নাগরিক হিসেবে আমার মনে প্রশ্ন উঠবে না? কেন এমন হচ্ছে?
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া সংবিধানকে সংশ্রফ সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করেছিল সেই সংবিধানকে জিয়া-এরশাদ কাটা-ছেঁড়াই শুধু করেনি, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতাবিরোধী সংশোধনী পাস করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই ধ্বংস কিংবা মস্নান করার চেষ্টা করেছিল। জনগণ মেনে নেয়নি। সামরিক শাসনের রক্তচক্ষুর কারণে নিশ্চুপ- চাপা ক্ষোভে দগ্ধ ছিলেন। কিন্তু সামরিক শাসনকালের অবসান ঘটে জিয়ার মৃত্যুর পর। এরপর জেনারেল দশ বছর স্বৈরতন্ত্র চালায়। জিয়া যে জামায়াতকে বৈধতা দিয়ে গেল গোলাম আজমকে বাংলাদেশে ঢুকতে দিয়ে, তারপর থেকেই যুদ্ধাপরাধী ধর্মান্ধ জামায়াতিদের অপকীর্তি-হিংস্র আচরণ দেশবাসীকে পুনরায় উদ্বিগ্ন করে তোলে। তারই ধারা অনুসরণ করে খালেদা জিয়া ৯৩ দিন স্বেচ্ছা অবরোধবাসিনী হয়ে পেট্রলবোমা ককটেলে যেভাবে মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করলেন, কি হবে তার?
বিরোধী দল প্রায় উচ্ছন্নেই গেছে। বিএনপি এখন সরকারি রোষানলে নিপীড়িত। জামায়াত তো হিংস্র সন্ত্রাসী তবু ওদের ওপর নির্ভর করেই জ্বালাও-পোড়াও, হত্যা-খুন চলছে।
এর মধ্যে গরম, প্রচ- গুমোট, অনেকটা রাজনৈতিক পরিবেশের মতন। না হলে বঙ্গবন্ধুকন্যা কেন '৭২-এর সংবিধান গ্রহণ করতে গিয়ে সংবিধানবিরোধী পঞ্চদশ সংশোধনীতে জিয়ার বিসমিল্লাহ..., এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে বহাল রাখার ব্যবস্থা নিলেন। বঙ্গবন্ধু তো ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার সস্নোগান দিয়ে। '৭২-এর সংবিধানের মূল স্তম্ভও একটি ওই ধর্মনিরপেক্ষতা। বুঝলাম না কেন এই সংশোধনীটিতে এ দুটো বিষয় বহাল রাখলেন। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বার বার উচ্চারণ করেছেন, দেশ মদিনা সনদ অনুযায়ী শাসিত হবে। কোরআন ও সুন্নাহর বাইরে কোনো আইন হবে না। মাননীয়া, এই কথা এই সংশোধনী কি মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক চক্রের ষড়যন্ত্র এবং হিংস্রতা বাড়িয়ে দেয়নি? এখন তাহলে জিরো টেলারেন্স ডিঙ্গিয়ে জঙ্গিরা নিত্যনতুন নামে আবির্ভূত এবং হিংস্রতা চালিয়ে যাচ্ছে কী করে?
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য কৃতজ্ঞতা অবশ্যই জানাব। কিন্তু এত ঢিমেতালে কেন চলছে? এত ছাড় কেন দেয়া হচ্ছে ওদের? ওরা ফাঁসির রায় ট্রাইব্যুনাল দিলে পর 'ভি' চিহ্ন দেখায় কোন ঔদ্ধত্যে? সাঈদীর রায় পাল্টে গেছে আপিলে গিয়ে। কি করে সম্ভব হলো_ বুঝতে পারি না। বাংলাদেশ অর্জিত হওয়ার পরও তার যে বিষোদগার মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে, তাতেই তো দেশদ্রোহী হিসেবে ওর ফাঁসি হওয়া উচিত ছিল। সেখানে ট্রাইব্যুনালে ফাঁসি বাতিল হয়ে যাবজ্জীবন হয়ে গেল, তাও সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে যা মত অনুসারে। শুনেছিলাম, সত্য কিনা জানি না, একজন তো 'খালাস' দেয়ার মতোই দিয়েছিলেন।... এর মধ্যে বজ্রজাতের মতন সরকারি সিদ্ধান্ত শুনলাম, ট্রাইব্যুনাল নাকি একটা হবে। এ কি কথা শুনি। এমনিতেই ঢিমে তেতালা, তার ওপর সংখ্যা কমিয়ে কি করতে চায় সরকার?
জীবনের দৈনন্দিন প্রয়োজন হলো খাওয়া, দাওয়া। দুটোই বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে যাচ্ছে। বাজারে আগুন লেগেছে, কী ভীষণ তেজ, পুড়িয়ে দিচ্ছে সবকিছু। এমনিতেই ব্যবসায়ী 'দেশসেবক'রা আমাদের কিভাবে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, তা ভাবলে অবাক লাগে। লাগামটা কোথায়? কার হাতে? যার হাতেই থাকুক, একে তো নিয়ন্ত্রণ করবে সরকার। কেন এই ব্যর্থতা। যার যা খুশি দাম হাঁকছে, মানুষ বাধ্য হয়ে কিনছে। সবকিছু ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে।
এর মধ্যে আবার ১৫ হাজার কোটি টাকার বেতন বাড়ল সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ২৬টি স্তরে। অন্যদেরও বাড়িয়েছে সরকার। তবে শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এমন বিমাতাসুলভ আচরণ কেন? মর্যাদার দিক থেকে তো এদেরই বেতন সবচেয়ে বেশি হওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শেষ পর্যন্ত আন্দোলনে যাচ্ছেন। কঠোর কর্মসূচি ঘোষণাও দিয়েছেন।
হায়রে নিষ্ঠুরতা! গ্যাসের দাম বাড়ছে, তেল মাথা বলে নাকি ভর্তুকি ও ধারে উঁচু দরে কিনে কম দরে দেশবাসীকে সেবা দেয়া হয়েছে বলে ৩৮ হাজার কোটি লাগবে_ সেই ঋণ শুধতে। ব্যবহারকারীদের ঘাড় শক্ত বলে মনে করে তাদের কাছ থেকে আদায় করতে উদ্যোগ সরকারের।
প্রশ্ন, অনেক রকম উঠে যাচ্ছে। দেশি ব্যাংকে যে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে যাচ্ছে, তার কী হলো? বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া অসংখ্য হাজার কোটি টাকার কতটুকু ফিরিয়ে এসেছেন? আর এই যে টাকার ব্যয় বাড়াচ্ছেন, তার কী হবে? কে দেবে এই টাকা? তাই বুঝি গৌরি সেনের ওপর চাপানো হচ্ছে?
বলতে বলতে অনেক বলে ফেললাম, আরো বলার সুযোগ আছে, এটা সমালোচনা নয়, একে স্বচ্ছ এবং বস্তুনিষ্ঠ মন্তব্য ধরে দেশের মানুষের মনে আজ যে প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে, তার সুরাহা করতে হবে। যাচ্ছি কোথায়?
কামাল লোহানী:সাংবাদিক ও কলাম লেখক। বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন