'কালাম' মারা গেছেন। খবরটা বিদ্যুৎগতির চেয়ে দ্রুততায় পেঁৗছে গেল সবখানে। কারণ হতে পারে প্রযুক্তি উন্নয়নের যুগে যে কোনো সংবাদই তো তাৎক্ষণিক পেয়ে যাই। এটাই এখন স্বাভাবিক। প্রচারিত সংবাদে আনন্দিত অথবা ক্ষুব্ধ হই, আবার সামান্য শোক বা আনন্দ প্রকাশ করেই ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে যাই, মানব জীবনের স্বাভাবিক ও স্বতঃসিদ্ধ নিয়মানুসারে। কিন্তু একটি সংবাদ সবাইকে হতচকিত করে দিল। শিক্ষিত অভিজাত কিংবা বিজ্ঞান সম্পৃক্ত মানুষের মনে যেমন একটা দোলা লাগল তেমনি মধ্যবিত্ত শ্রেণিজাত মানবসন্তানরাও উদগ্রীব হলেন ঘটনার পরম্পরা জানতে। এ খবরের মৌল ব্যক্তিকে হয়তো দেখেনি কোনো দিন, নাম শুনেছেন বহুবার নিচু শ্রেণির মানুষ কারণ তিনি তো প্রতিবেশী ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। স্বভাবতই প্রত্যেক মানুষের অনুসন্ধান, জানার আগ্রহ এমন মহৎ প্রাণ সমৃদ্ধ জ্ঞানবৃদ্ধ মানুষটি কোথায় কী করে মৃত্যুবরণ করলেন। গণমাধ্যমগুলোর সবাই সংবাদ সংগ্রহে তৎপর হলেন, যোগাযোগ করতে শুরু করলেন ভারতীয় নিজস্ব প্রতিনিধিদের সঙ্গে। টেলিভিশন প্রযুক্তির সূত্র ধরে তার মৃত্যুসংবাদ সচিত্র প্রচার করতে শুরু করলেন।
শিক্ষক, শিক্ষানুরাগী মানুষ থেকে বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষার্থী থেকে গবেষক এবং সাংবাদিক বন্ধু সবাই উদগ্রীব যার খবর জানতে, তিনি ভারতের খ্যাতিমান বিজ্ঞানী এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম। যাকে ভারতে 'মিসাইলম্যান' বলেই আখ্যায়িত করা হয়েছে, তার ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ সফলতা এবং অব্যর্থ পরীক্ষা সাধনে পূর্ণতা অর্জন করায়। এই নিরন্তর পরীক্ষাও গবেষণার ক্ষেত্রে যে সাফল্যের স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন, তাতে ভারত যেমন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ক্ষেপণাস্ত্র সফলতার সম্মানীয় স্থানে পেঁৗছেছে, তেমনি এপিজের সুনাম, কৃতিত্ব, দক্ষতা, সফলতা তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে যথার্থ ক্ষেপণাস্ত্র মানব পরিচয়ে।
আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে তাকে সবচেয়ে বেশি 'শিক্ষক' হিসেবে দেখতে পাই। জীবনের শুরু থেকে সে প্রবল দারিদ্র্যের বিপরীত স্রোতে তাকে চলতে হয়েছে, তাকে তিনি অধ্যবসায় এবং জ্ঞান দিয়ে মোকাবেলা করেছেন। আর সেই অধীত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে জীবনকে জয় করেছেন। তাই তার চলা, সাধনা, ধৈর্য এবং মেধা তাকে সত্যিই 'মিসাইলম্যান'কে ছাড়িয়ে এক মহান শিক্ষকে পরিণত হয়েছিল। পড়ন্ত বয়সে ঘুরে ঘুরে দেশ থেকে দেশান্তরে তার শিক্ষা, সাধনা, অভিজ্ঞতা ও সাফল্যকে আলাপচারিতার মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছেন। আর তাই বোধহয়, 'শিক্ষক' সম্বোধনে আত্মমর্যাদাবোধ করতেন।
এপিজে ২০১৪ সালে ঢাকা এসেছিলেন। এখানে তিনি তরুণদের সমাবেশে বক্তৃতা করতে গিয়ে জ্ঞানগর্ভ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে কথা বলেননি, তিনি কী করে সফল হতে পারলেন, তার গল্প শুনিয়েছিলেন। আর যার কাছ থেকে এই শিক্ষা পেয়েছিলেন, তিনি নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন এবং শ্রদ্ধাভরে সেই প্রাথমিক শিক্ষক মহোদয়কে স্মরণ করলেন। ... কী প্রয়োজন ছিল? এখন তো তিনি তার জীবনের ৭৫ বছর আগের এক অখ্যাত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সেই অজ্ঞাত ব্যক্তিটিকে স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানাতে নাও পারতেন। কিন্তু না, তিনি তার সাফল্যের শিকড় যেখানে পোঁতা, যিনি তাকে স্বপ্ন দেখাকে তৈরি করেছিলেন, তাকে কখনই ভুলে যাননি, তাই তরুণদের সঙ্গে যখনই কথা বলেন, তখনই এপিজে 'তার স্বপ্ন তৈরির কারিগর'-এর কথা বলতেনই। কী অসাধারণ শ্রদ্ধাবোধ! কী অভূতপূর্ব দায়িত্ব পালনের দৃষ্টান্তই না তিনি রেখে গেলেন।
দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত জীবনের শুরুটা কিন্তু তার উত্থান রকেটের মতো। ওপরে উঠে এপিজে তার ছেলেবেলা ভুলে যাননি। ওটাকেই গর্বিত উত্তরাধিকার তৈরি করেছিলেন তিনি। ভারতের বিজ্ঞানের অগ্রগতির ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য যার হাত ধরে এসেছে, সেই আবুল পাকির জয়নুলাবেদিন আবদুল কালাম যাকে এপিজে বলে জানে গোটা বিশ্ব, তিনি জন্মেছিলেন ১৯৩১ সালে ১৫ অক্টোবর। ভারতবর্ষের মাদ্রাজে। ৮৪ বছর বয়সে ২০১৫ সালের ২৭ জুলাই ইহলোক ত্যাগ করে চলে গেলেন। দিনটিতে শিলং শহরের ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউ অব ম্যানেজমেন্টে 'বাসযোগ্য বিশ্ব' নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছিলেন। অকস্মাৎ ঢলে পড়লেন। তাকে তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে নেয়া হলো, চিকিৎসার চেষ্টাও কম করা হয়নি কিন্তু সবাইকে শোকে স্তব্ধ করে দিয়ে এ মায়াময় সংগ্রামের পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন।
খবরের কাগজ ফেরি করা সেই ছোট্ট ছেলেটি ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির পথিকৃৎ কারিগর-বিজ্ঞানী হিসেবে আবির্ভূত হয়ে নয় শুধু বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিলেন। দেশপ্রেম ও অধ্যবসায় এবং ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির সম্ভাবনা স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করে এপিজে রাষ্ট্রীয় সম্মান_ পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণ ও ভারতরত্ন উপাধি অর্জন করেছিলেন। অটল বিহারি বাজপেয়ির নেতৃত্বে ভারত সরকার তাকে বিজেপির মনোনয়নে রাষ্ট্রপতির আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল। পাঁচবছর সসম্মানে এই পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। তার মনোনয়নে অবশ্যই ভারতীয় কংগ্রেসেরও পূর্ণ সমর্থন ছিল।
তাই বলে তিনি বিজেপির রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, বিবেকসম্পন্ন কার্যক্রমের প্রতিই সহযোগিতা ও সমর্থন দিয়ে এসেছেন। মেয়াদ শেষে এপিজে আবদুল কালাম নানান আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে স্থানে স্থানে, সভা-সেমিনারে গিয়ে তার জ্ঞানগর্ভ বক্তব্যকে সাবলীল ভাষায় সংশ্লিষ্টজনদের সামনে তুলে ধরেছেন। নির্লোভ, নিরঅহংকারী এই ভারত সন্তান জীবনের নিম্নবিত্ত থেকে দারিদ্র্য জয় করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে জগৎ গড়ে তুলেছিলেন, তাকে তিনি সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করেছেন নিরন্তর। এই জ্ঞান পরিক্রমণে তিনি 'অভিজাত' শ্রেণিতে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু কী অদ্ভূত মানুষটির আচরণ কখনই তিনি তার অতীতকে ভুলে গিয়ে নিজেকে জাহির করার অযথা চেষ্টা করেননি। বয়োবৃদ্ধ জীবনে এপিজে নিজেকে একজন শিক্ষক বলতেই ভালোবাসতেন। সেই সম্মানটুকু প্রাপ্তিই ছিল তার সফলতার অর্জন। মানুষের ভালোবাসা তাকে বিপুল প্রাণে সমৃদ্ধ করেছেন।
এপিজের বাবা ছিলেন নৌকার মাঝি। দক্ষিণ ভারতের মাদ্রাজে রামনাথস্বামী জেলার রামেশ্বরমে তার বাস। তাই তিনি নৌকো নিয়ে বাবাকে দেখেছেন এ দ্বীপ থেকে অন্য একটি দ্বীপে নিত্য যাত্রী পারাপার করতে। এ শ্রম এবং বিপদসঙ্কুল পথের কাজে কতই বা আয় হতো বাবার, তা দিয়ে সংসার চালানো ছিল কঠিন। এই না দেখে আবদুল কালাম সংসারের ব্যয় নির্বাহে নিজেকে নিয়োগের চিন্তা করলেন এবং রেলস্টেশন থেকে খবরের কাগজের যেসব বান্ডিল চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দেয়া হতো, সেগুলো কুড়িয়ে শহরে পেঁৗছে দেয়ার কাজ করেছেন অনেক দিন। তাতেই বা কতটা সাহায্য হয় এই ভেবে এপিজে নতুন পথ খুঁজে বের করলেন। ভাবলেন বাবা যে নৌকা চালান তাকে যদি একটি নিজস্ব নৌকো তৈরি করে দেয়া যায়, তবে তো উপার্জনটা বেড়ে যাবে। মনোনিবেশ করলেন নৌকো তৈরি করার পদ্ধতি দেখে নিজে আকৃষ্ট হয়ে কাজটি করতে গিয়ে তাতে যন্ত্র সংযোজন করলেন। এই যে গতিবৃদ্ধি এবং বৃদ্ধির পদ্ধতি অনুশীলনের মাধ্যমে বিমান প্রযুক্তির ভাবনা পেয়ে বসেছিল। আর সেখান থেকে তিনি একদিন 'মিসাইলম্যান' হিসেবে পরিচিত করলেন সফল নির্মাণ ও ব্যবহারের মাধ্যমে। খ্যাতি এনে দিল বিশ্বময়। অধ্যাপক এপিজে আবদুল কালাম ক্ষেপণাস্ত্র বিজ্ঞানী হয়ে, ভারতকে অর্জন-সফলতার সুউচ্চ শিখরে নিয়ে তোলেন। ধন্যি ধন্যি পড়ে গেল দেশময়। খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল জগৎময়। তিনি সাধ্যকে সাধনার মাধ্যমে বহুল সম্ভাবনায় পরিণত করে স্বাপি্নক কালামের অভিযাত্রা পূর্ণ হলো।
জ্ঞানী এই মহান পুরুষ আবিষ্কার, ব্যবহার, পরীক্ষা আর তার সফলতায়ই ডুবে থাকেননি। তিনি তার জীবন সংগ্রামের পরতে পরতে সে লড়াই জারি রেখে নিজেকে সত্যিকার মানুষে রূপান্তরিত করেছিলেন, তারও ইতিহাস তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন গ্রন্থাগারে। তার বইগুলোর মধ্যে দুটির কথা উল্লেখ করতে চাই। একটি 'মাই জার্নি: ট্রান্স ফর্মিং ড্রিমস ইন টু অ্যাকশন'। সংকল্পবদ্ধ একটি জীবনসংগ্রামের জীবন্ত ইতিহাস। কী করে ধাপে ধাপে স্বপ্ন বাস্তবায়নের স্বর্ণদ্বারে পেঁৗছলেন, তারই ঘটনাবহুল মর্মস্পর্শী কাহিনী কাব্য এ গ্রন্থখানি।
তার রচিত 'উইং অব ফায়ার' জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থ। এর খ্যাতি কেবল তার জীবন ও কর্ম এবং সফলতা নিয়ে লেখার জন্যই নয়। এর ভাষার সাবলীলতা এবং রচনাশৈলীর গ্রহণযোগ্যতাই প্রমাণ করে, এ যে সাহিত্যসমৃদ্ধ বিজ্ঞানগ্রন্থ। অথবা জীবনচরিত। ছেলেবেলার দুরন্তপনা নয় জ্ঞানান্বেষণে 'তার আগ্রহ কিভাবে তাকে শিখরশীর্ষে স্থান করে দিয়েছে, তার অনুলিখন মিলবে নানান অধ্যায়ে। বৈমানিক হওয়ার শখ এবং হতে না পারার ব্যর্থতা তাকে যেন আরো দৃঢ়সংকল্প করে দিয়েছিল, সে কাহিনী এবং গ্রন্থের পাতায় পাতায়।
এপিজে আবদুল কালাম নিজেকে শিক্ষক পরিচয়ে পরিচিত হতেই ভালোবাসতেন। রাষ্ট্রপতি জীবনের আগে গবেষণা এবং তা ফলাফল বাস্তবায়নে প্রবল ব্যস্ততায় দিনকাল কাটিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে মাত্র পাঁচ বছর, তবুও কেটেছে রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা এবং অবসরে পড়াশোনার মধ্যদিয়ে। পদ ছাড়ার পর তিনি দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন তার অশীতিপর বয়সেও। এক সময় জ্ঞানের সাধনা করেছেন, পরে অধীত বিদ্যার উজ্জ্বল দ্যুতি ছড়িয়ে দিয়েছেন তরুণ প্রজন্মের মধ্যে।
এমন অসাধারণ কীর্তিমান মহান ব্যক্তিত্ব বোধ হয় শীলংয়ে বক্তৃতা করতে করতে ঢলে পড়লেন। তাকে সাততাড়াতাড়ি হাসপাতালে নেয়া হলো। কিন্তু তিনি চলে গেলেন তার এ প্রিয় বিশ্ব ছেড়ে। এপিজে চলে গেছেন বটে কিন্তু তার অবিস্মরণীয় কীর্তি থেকে গেল পরবর্তী প্রজন্মের অনুপ্রেরণা হয়ে। অনুকরণীয় এক মানবসন্তান দারিদ্র্যকে হয় জয় করে সাফল্যের স্বর্ণশীর্ষে কী করে হানা দিতে হয় তার এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে রইলেন। তাই তো দিলি্লতে এবং তার গ্রাম রামেশ্বরমে সমাহিত করার সময় কত যে মানুষের ঢল নেমেছিল। এই মানুষই সময়ের পরিক্রমায় পরবর্তী পুরুষদের কাছে কিংবদন্তির কথা বলবেন, গর্বের ও গৌরবের সাথে, এপিজে আবদুল কালাম চিরজীবী হোন।
কামাল লোহানী: সাংবাদিক ও কলাম লেখক। বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন