কিছু দিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, তার সরকার ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পুরনো সব স্থাপনা ভেঙে অত্যাধুনিক ও বিশ্বমানের বহুতল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ভবন নির্মাণ করবে। নিঃসন্দেহে এটা সাধুবাদ পাওয়ার মতো একটি পরিকল্পনা। রাজধানী ঢাকার ক্রমবর্ধমান লোকসংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল খুবই অপ্রতুল। আরও অনেক আগেই এরকম পরিকল্পনা নেওয়া উচিত ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় একই নিঃশ্বাসে বলেছেন— ‘এখনই ঐতিহ্যবাদীরা হৈচৈ শুরু করে দেবে। যতই লিখুন, যতই টকশো করুন আমার যা করার তা আমি করবই।’
প্রধানমন্ত্রীর এ কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও একই সঙ্গে দুঃখজনক। গুরুত্বপূর্ণ এ জন্য যে, তিনি নাগরিক সমাজের সমালোচনাকে কী চোখে দেখেন, তা প্রকারান্তরে জানিয়ে দিয়েছেন। দুঃখজনক এ জন্য যে, তার গণতান্ত্রিক সরকার নাগরিক সমাজের সমালোচনায় কর্ণপাত করতে চায় না। তিনি বা তার সরকার শুধু তার দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সিদ্ধান্ত নেন বা নেবেন, যা গণতন্ত্রের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যা একান্ত স্বৈরাচারী বা একনায়কসুলভ। যা প্রত্যাশিত নয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা তার সরকারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেগম খালেদা জিয়া ও তার দল বিএনপির সঙ্গে। যে দল নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সরকারকে পরাজিত করে ক্ষমতায় যেতে আগ্রহী। বর্তমান সরকারের যে কোনো কাজের সমালোচনা বিএনপি করে থাকে। যুক্তি দিয়ে হোক যুক্তি ছাড়াই হোক। বিএনপির কাজই হলো সরকারের নানা কাজের সমালোচনা করা। এটা আমাদের দূষিত রাজনীতির একটা লক্ষণ। বাংলাদেশে প্রধান বিরোধী দল কখনো সরকারের ভালো কাজের প্রশংসা করে না। তারা শুধু সরকারের খারাপই দেখে। এটা সব আমলেই দেখা গেছে।
বিরোধী দল বা বিএনপির ব্যাপারে সরকারপ্রধান এরকম মন্তব্য করলে তা যুক্তিযুক্ত হতো। কারণ বিএনপি তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু সরকারপ্রধান যদি দেশের বুদ্ধিজীবী, বিশেষজ্ঞ তথা নির্দল নাগরিক সমাজের প্রতিও একই মনোভাব পোষণ করেন তাহলে দেশে কোনো ইস্যুতে গঠনমূলক আলোচনা বা সুষ্ঠু তর্কবিতর্ক আর থাকবে না। আলোচনা ও তর্কবিতর্ক না থাকলে গণতন্ত্র থাকবে কী করে?
আমরা এমন এক জাতীয় সংসদ ‘নির্বাচন’ করেছি যেখানে বিরোধী দল বা বিরোধী দলের নেতা সরকারের প্রশংসায় সর্বদা পঞ্চমুখ। প্রশংসনীয় কাজের প্রশংসা করা ভালো। কিন্তু বিরোধী দল যখন সংসদে সরকারের প্রশংসায় প্রতিযোগিতায় নামে তখন তা আর সংসদ থাকে না।
আমাদের সৌভাগ্য বর্তমানে বাংলাদেশে টেলিভিশনে টকশো, সংবাদপত্রের কলাম ও মুক্ত সাংবাদিকতার মাধ্যমে সরকারের কিছুটা সমালোচনা করা হয়। এটুকু না থাকলে দেশে গণতন্ত্র চর্চার লেশমাত্র থাকত না, যা বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তির জন্য সহায়ক হবে না। নাগরিক সমাজের বিভিন্ন ফোরাম মানববন্ধন, সেমিনার, পথসভা, সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলন, স্মারকলিপি প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে নাগরিকদের মতামত ও প্রতিবাদ অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে সরকারের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। লক্ষ্য করবেন, নির্দল নাগরিক সমাজের কোনো কর্মসূচির ফলে শহরের রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয় না, ট্রাফিক জ্যাম বৃদ্ধি হয় না, পথচারীদের ভোগান্তির কারণ হয় না। অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ সব কর্মসূচি। এসব কর্মসূচির একটাই লক্ষ্য থাকে, তা হলো, তাদের (নাগরিক সমাজের) সমালোচনা বা বক্তব্য যেন সরকারের নীতিনির্ধারকদের কানে পৌঁছায়। নাগরিক সমাজের বক্তব্যে যদি কোনো যুক্তি থাকে তাহলে সরকার তা বিবেচনা করবে। এটুকুই শুধু আশা। যেহেতু আমাদের দেশে গণতন্ত্রের চর্চা রয়েছে সেহেতু নাগরিক সমাজ আশা করে সরকার তাদের যে কোনো নীতি বা সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সমালোচকদের মতামত ও যুক্তি শুনবে। নাগরিক সমাজ, বিশেষজ্ঞ বা বুদ্ধিজীবী কেউ-ই মেঠো বক্তৃতা বা যুক্তিহীন গলাবাজি করেন না। তারা কোনো জনসভাও করেন না। তারা সংবাদপত্রে লেখালেখি, টিভি টকশো বা সেমিনারের মাধ্যমে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। সরকারের প্রতিনিধিরা বা সমর্থকরা নাগরিক সমাজের বক্তব্য যুক্তিসহকারে খণ্ডন করতে পারেন। টকশোতে অনেক সময় তা করাও হচ্ছে। এটাই গণতন্ত্র চর্চা। যুক্তিহীন বা তথ্যহীন সমালোচনা কোনো সমালোচনা নয়। এখন প্রধানমন্ত্রী যদি বলেন, ‘আপনারা যাই লিখুন বা টকশোতে সমালোচনা করুন না কেন আমার যা করার তা আমি করবই’— তা শুনে গণতন্ত্রমনা ব্যক্তিমাত্রই উদ্বিগ্ন হবেন। কারণ এটা গণতন্ত্রের ভাষা নয়। কোনো প্রধানমন্ত্রী শুধু ক্ষমতাসীন দলের প্রধানমন্ত্রী নন। তিনি দেশের সব মানুষের প্রধানমন্ত্রী। কাজেই তার দলের বাইরে অন্য দলের বা নির্দল নাগরিকদের মতামতও তাকে শুনতে হবে। সেই সমালোচনায় ও বক্তব্যে যদি যুক্তি থাকে তাহলে প্রধানমন্ত্রী তথা সরকার তার অবস্থান পরিবর্তন করবেন। এটা গণতান্ত্রিক সমাজের প্রত্যাশা।
নাগরিক সমাজ, বিশেষজ্ঞ বা বুদ্ধিজীবীরা ক্ষমতা দখলের জন্য বা সরকারকে বিতাড়নের জন্য কোনো কাজ করেন না। সেরকম কোনো লক্ষ্য নাগরিক সমাজের নেই। যদি থাকত, তাহলে তারা বড় দু-তিনটি দলের যে কোনো একটির সদস্য হতে পারতেন। পর্যায়ক্রমে নেতা, এমপি, মন্ত্রীও হতে পারতেন। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে কোনো বিশেষ যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না। কাজেই নাগরিক সমাজকে এ অপবাদ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা তাদের বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের তাগিদে ও দেশপ্রেমের তাগিদে সরকারের কোনো প্রকল্প বা সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। অন্য কোনো স্বার্থ এর পেছনে কাজ করে না।
আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে প্রায়শ একটা কথা বলতে শোনা যায়। তা হলো : ‘নাগরিক সমাজের নেতারা গাড়িতে পতাকা লাগানোর খায়েশে সরকারের সমালোচনা করেন। উপদেষ্টা হওয়ার জন্য নির্দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার চান।’ (হুবহু উদ্ধৃতি নয়) এ ধরনের ঢালাও মন্তব্য করা ঠিক নয়। নাগরিক সমাজের কোনো কোনো নেতা হয়তো ‘উপদেষ্টা’ হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু উপদেষ্টা হওয়ার জন্যই তিনি সরকারের সমালোচনা করেন, এমন দাবি হাস্যকর। তা ছাড়া এ ধরনের উপদেষ্টার পদ তো মাত্র তিন মাসের জন্য। ওই সময়ে তারা কোনো বড় নীতিগত সিদ্ধান্তও নিতে পারেন না। মন্ত্রণালয়ের রুটিন কাজই তাদেরকে করতে হয়। তিন মাসের উপদেষ্টা হওয়ার জন্য তারা তিন দশক ধরে সংগ্রাম করছেন? উপদেষ্টা পরিষদে বড়জোর ৩০ জন সদস্য যোগ দিতে পারবেন। আন্দোলন তো করছেন ৩০ হাজার। অন্যদের উদ্দেশ্য কী?
প্রধানমন্ত্রী হয়তো বুঝতে পারছেন না, রাজনীতি, দল, এমপি, মন্ত্রিত্ব, প্রধানমন্ত্রিত্ব ইত্যাদির প্রতি যাদের কোনো রুচি নেই, আগ্রহ নেই, কেবল তারাই নাগরিকদের পক্ষে আন্দোলন করেন। অন্যান্য দেশেও একই চিত্র। দলের প্রতীক ও দলের সমর্থন ছাড়া মন্ত্রী, এমপি, প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হতে আর কোনো যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, অর্থনীতিবিদ, চিন্তক, প্রফেসর, ডাক্তার, প্রকৌশলী, স্থপতি ইত্যাদি হতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। দলের মনোনয়ন পেলেই বুদ্ধিজীবী বা চিন্তক হওয়া যায় না। পিতা বা স্বামীর পরিচয়েও বুদ্ধিজীবী বা চিন্তক হওয়া যায় না। নেতা হওয়া যায়। এই চিন্তক বা বুদ্ধিজীবীরাই নাগরিক সমাজের প্রাণ। তারা তাদের শিক্ষা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও মনীষা দিয়ে সরকারের কোনো কোনো কর্মসূচির গঠনমূলক সমালোচনা করেন। সব কর্মসূচির নয়।
আবার অন্য চিত্রও দেখা যায়। অনেক বড় মাপের পণ্ডিত বা চিন্তক ব্যক্তি রয়েছেন, যারা সরকারের কোনো কর্মসূচি বা নীতি সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করারও প্রয়োজন মনে করেন না। কেন মনে করেন না সেই জবাব তারাই দিতে পারবেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ভাষায় কথাটি বলেছেন, তা গণতন্ত্র সম্মত হয়নি। এটা তিনি পরে নিশ্চয় উপলব্ধি করেছেন। গণমাধ্যম বিভিন্ন জনের মতামত তুলে ধরে সরকারকে সহযোগিতা করে। গণমাধ্যমের সমালোচনা ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে হয় না। কোনো বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমালোচনার লক্ষ্য ক্ষমতা দখল হতেও পারে।
আমরা একই সঙ্গে যুক্তিহীন ও তথ্যহীন সমালোচনা না করার জন্য সবাইকে অনুরোধ করব। গলাবাজি ও গঠনমূলক সমালোচনা এক জিনিস নয়। নাগরিক সমাজ গলাবাজিতে বিশ্বাস করে না। আশা করব, নাগরিক সমাজের বিভিন্ন ফোরাম সরকারের কোনো প্রকল্প, কর্মসূচি বা সিদ্ধান্তের টেকনিক্যাল সমালোচনার আগে তা নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করবেন। গবেষণা ও তথ্য-উপাত্তের সমর্থন না থাকলে কোনো টেকনিক্যাল সমালোচনাই লাগসই হয় না। সরকারকে বুঝতে হবে গঠনমূলক সমালোচনা সরকারকে সহায়তাই করে। ভুল পথে যেতে সরকারকে নিবৃত্ত করে।
মিডিয়া ও মিডিয়া : আজকাল বিভিন্ন সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল নানা রকম অনুষ্ঠান, প্রতিযোগিতা ও ইভেন্টের আয়োজন করে থাকে। এসব অনুষ্ঠান আয়োজন করা মিডিয়ার কাজ কিনা তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু আমরা আজ সেই বিতর্কে যাচ্ছি না। আমরা দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, একটি পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল আয়োজিত অনুষ্ঠানের বা ইভেন্টের খবর অন্য পত্রিকা বা টিভিতে প্রচার হয় না। ব্যতিক্রম খুব কম। একই মালিকানা গোষ্ঠীর হলে হয়তো প্রকাশিত হয়। কিন্তু সচরাচর প্রকাশিত হয় না। এটা কি ঠিক কাজ হচ্ছে? আমরা এর পেছনে কোনো যুক্তি দেখি না। কোনো টিভি বা সংবাদপত্র একটা ইভেন্টের আয়োজক হতেই পারে। গণমাধ্যম দেখবে ইভেন্টটির সংবাদমূল্য রয়েছে কিনা। গণমাধ্যমের কাছে ‘সংবাদমূল্য’ ছাড়া অন্য কোনো কিছু বিবেচিত হতে পারে না। আয়োজক, প্রধান অতিথি, সভাপতি, অন্যান্য অতিথি কোনোটিই গণমাধ্যমের বিবেচনার বিষয় নয়। তবে পত্রিকা বা টিভিতে নিজস্ব সম্পাদকীয় নীতির কারণে খবরটি ছোট বা বড় করে প্রকাশিত হতে পারে। কিন্তু একেবারেই প্রকাশিত হবে না, তা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। সংবাদপত্র বা টিভি এরকম নেতিবাচক আচরণ করলে তার পাঠক ও দর্শক গোষ্ঠী একটি ইভেন্ট সম্পর্কে কিছুই জানতে পারে না। সরকার এরকম আচরণ করলে আমরা সরকারের সমালোচনা করি। কিন্তু সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ যখন একটি প্রকাশযোগ্য খবর প্রকাশে বা প্রচারে অনীহা দেখায় তখন সেই আচরণকে আমরা কী বলব?
আমাদের দেশের কয়েকটি সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল বছরে বেশ কয়েকটি বড় মাপের ইভেন্টের আয়োজন করে থাকে। এগুলোর সংবাদমূল্য যথেষ্ট। আশা করি বিভিন্ন পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বিবেচনা করে দেখবে।
বিদেশি মডেল : রাজধানী ঢাকার উত্তরায় বহুতল আবাসিক ভবন নিয়ে একটি টাউনশিপ গড়ে তোলা হচ্ছে। এর বিজ্ঞাপনে মডেল হয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেট তারকা সৌরভ গাঙ্গুলী। আমরা জানি বাংলাদেশে সৌরভ গাঙ্গুলীর ভক্তের সংখ্যা কম নয়। তিনি একজন বড় মাপের ক্রিকেট তারকা। কিন্তু বাংলাদেশের ফ্ল্যাট বাড়ির বিজ্ঞাপনে তার ছবি ব্যবহার বা ওই টাউনশিপে ফ্ল্যাট কেনার জন্য তার আবেদন কতটা যুক্তিযুক্ত হয়েছে সেই প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে। এ প্রকল্পের উদ্যোক্তারা বিষয়টি হয়তো একেবারেই ভাবেননি। আমাদের দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারকার সংখ্যা ভারতের মতো না হলেও একেবারে কম নয়। এমনকি ক্রিকেট জগতেও কয়েকজন ‘বড় তারকার’ খ্যাতি পেয়েছেন। আমাদের ধারণা, এই বিজ্ঞাপনটি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। মনে হয়েছে, এ দেশে বিজ্ঞাপনের মডেল হওয়ার মতো কোনো তারকা নেই। এ বিজ্ঞাপন দেখে যদি অন্য উদ্যোক্তারা অমিতাভ বচ্চন বা শাহরুখ খানকে মডেল করেন তাহলে অবাক হব না।
আমাদের প্রস্তাব : সৌরভের বিজ্ঞাপনটি গণমাধ্যম থেকে প্রত্যাহার করা হোক ও এ দেশি তারকাদের দিয়ে নতুন করে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হোক। অথবা অন্য কোনো স্ক্রিপ্টে নতুন করে বিজ্ঞাপনটি তৈরি করা যেতে পারে।
আগেও একবার কথাটি উঠেছিল, আজ আবার লিখছি। গণমাধ্যমে প্রচারের আগে (বিশেষ করে টিভি) স্ক্রিপ্ট বা নির্মিত বিজ্ঞাপন কোনো একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে অনুমোদন করানো উচিত। যদি তা করা না হয়, একটি অমানবিক, স্পর্শকাতর বা অনিচ্ছাকৃত ভুল বার্তার টিভি বিজ্ঞাপন কয়েক শতবার টিভিতে প্রচার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কয়েক কোটি দর্শক (শিশু দর্শকও) শত শতবার বিজ্ঞাপনটি দেখবেন ও প্রভাবিত হবেন। তা কি ঠিক কাজ হবে? তারচেয়ে একটু দেখিয়ে নিলে কি ভালো হয় না? সিনেমা নির্মাতারা কি তাদের ছবি প্রচারের আগে সেন্সর বোর্ডকে দেখাচ্ছে না? সিনেমার চেয়ে টিভি বিজ্ঞাপন অনেক বেশি প্রভাবশালী। তাহলে টিভি বিজ্ঞাপনের বেলায় এই উদারতা কেন?
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী : সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন আজ একটা বড় রীতি হয়ে উঠেছে। পাঁচ, দশ, পঁচিশ বছর নয় শুধু, প্রতি বছরই ব্যাপক জাঁকজমক করে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করা এখন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের স্ট্যাটাস সিম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এরকম হয় কিনা জানি না। তবে আমাদের প্রতিবেশী নানা দেশে এরকম কিছু হয় বলে শুনিনি। দেখিওনি।
আমাদের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো (দু-তিনটি ছাড়া) তেমন কোনো বড় মাপের প্রতিষ্ঠান এখনো হয়ে উঠতে পারেনি। আন্তর্জাতিক মানের প্রশ্ন না তোলাই ভালো হবে। একটি-দুটি দৈনিক পত্রিকা ছাড়া অন্য কোনো দৈনিকের প্রচার সংখ্যা দুই লাখও অতিক্রম করেনি। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোর দর্শক সম্পর্কে কোনো নির্ভরযোগ্য গবেষণা নেই। তবে সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের টিভি দর্শকদের একটি বড় অংশ ভারতীয় নানা টিভি চ্যানেল দেখতেই বেশি আগ্রহী। বাংলাদেশের টিভি অনুষ্ঠান তারা কমই দেখেন। একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের মতামত জরিপ করে আমি ব্যক্তিগতভাবে জানতে পেরেছি, তাদের দশ ভাগও বাংলাদেশের কোনো টিভি অনুষ্ঠান দেখেন না। হার্ড কপি সংবাদপত্র পড়েন না, কেউ কেউ অনলাইনে পড়েন।
এই যখন গণমাধ্যম পরিস্থিতি তখন প্রতি বছর জাঁকজমক করে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন একটু বেখাপ্পা নয় কি? এ ধরনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান পত্রিকার বা টিভির কর্মীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায়।
বাংলাদেশে গর্ব করার মতো বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যাদের রয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সম্মান। এরকম একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান ‘নোবেল শান্তি পুরস্কারেও’ সম্মানিত হয়েছে। এ ধরনের কোনো বড় মাপের প্রতিষ্ঠানকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বা এ ধরনের প্রচারধর্মী অনুষ্ঠান করতে দেখা যায় না।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনের খবর ও ছবি তাদের সংবাদপত্রে যেভাবে প্রকাশ হয়ে থাকে তাও কোনো আদর্শ সংবাদপত্রের জন্য উপযোগী নয়। আমাদের অনেক দৈনিক পত্রিকা যে এখনো সাবালকত্ব অর্জন করতে পারেনি এটা তারই প্রমাণ। সংবাদপত্র যে কোম্পানির ‘নিউজলেটার’ নয়, এটা অনেক সম্পাদক ও প্রকাশক বুঝতে পারেন না। সংবাদপত্রের এ ধরনের আত্মপ্রচার (তিন-চার পৃষ্ঠাজুড়ে ছবি) অনেক পাঠকের রুচিকে আহত করে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অর্থ আত্মপ্রচারের স্বাধীনতা নয়। বিভিন্ন মত প্রকাশের স্বাধীনতা।
প্রত্যেকটি গণমাধ্যম অবশ্যই তাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ঘরোয়াভাবে পালন করবে। কিন্তু তার প্রচারে পরিমিতি বোধ থাকা বাঞ্ছনীয়। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করার আগে নিজের গণমাধ্যমকে একটি উঁচু মাপের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা কি উচিত নয়?
নৈতিকতা : একটি টিভি চ্যানেলের একটি রিপোর্ট নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। টিভি রিপোর্টার জিপিএ ফাইভ পাওয়া কয়েকজন ছাত্রছাত্রী নিয়ে রিপোর্টটি প্রচার করেছেন। অভিযোগ : ‘টিভি রিপোর্টার ছাত্রছাত্রীদের নানা জ্ঞানের প্রশ্ন করে টিভির পর্দায় তাদেরকে হেয় করেছেন। কারণ ছাত্ররা বেশির ভাগ সাধারণ প্রশ্নেরও সঠিক জবাব দিতে পারেননি। জনসমক্ষে (পর্দায়) ছাত্রদের এভাবে হেয় করা উচিত হয়নি।’
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটা নিয়ে নানা সমালোচনা হয়েছে। রিপোর্টটির পক্ষে ও বিপক্ষে দুটি গ্রুপ দাঁড়িয়ে গেছে।
সাংবাদিকতার নৈতিকতার দিক থেকে প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। আবার রিপোর্টটির বিষয়ও যে গুরুত্বপূর্ণ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাহলে কীভাবে রিপোর্টার রিপোর্টটি প্রচার করবেন? এ ব্যাপারে একটা মীমাংসা হওয়া উচিত ছিল। তা হয়নি। শুধু সমালোচনা ও সমর্থনের মধ্যে সাংবাদিকতার নৈতিকতার বিষয়টি হারিয়ে গেল।
এ ব্যাপারে রেফারির ভূমিকা পালন করতে পারে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট। তাদের পত্রিকা ‘নিরীক্ষায়’ এটা কভার স্টোরি হতে পারে। প্রবীণ সাংবাদিক, বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক ও যোগ্য ব্যক্তিদের মতামত নিয়ে তারা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারত। এ বিষয়ে রিপোর্টিংয়ের সঠিক পদ্ধতি কী হতে পারত? এভাবে তরুণ রিপোর্টাররা ‘নিরীক্ষা’ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারতেন। একটা ঘটনা, প্রকাশিত প্রতিবেদনের বা প্রচারিত টিভি রিপোর্টের ভুলভ্রান্তি চিহ্নিত করে তার ‘শুদ্ধ রূপ’ প্রকাশ করতে পারলে ‘নিরীক্ষা’ তরুণ সাংবাদিকদের কাছে অনেক বেশি আদৃত হতো। ভালো প্রতিবেদনের পাশাপাশি দুর্বল প্রতিবেদনও দৃষ্টান্ত হিসেবে পুনঃপ্রকাশ করা উচিত। যাতে তরুণ সাংবাদিকরা সেরকম প্রতিবেদন আর না লেখেন। তবে দুর্বল প্রতিবেদনের সঙ্গে ওই পত্রিকার সম্পাদক ও রিপোর্টারের বক্তব্যও প্রকাশ করা উচিত। তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে।
আমাদের সংবাদপত্র, টিভি, বেতার ও চলচ্চিত্র নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা সমালোচনা ও পর্যালোচনা হয়। কিন্তু সমাধান তেমন পাওয়া যায় না। প্রেস ইনস্টিটিউটের গবেষণা, প্রকাশনা ও ‘নিরীক্ষা’ পত্রিকার মাধ্যমে সমাধানের পথনির্দেশ পাওয়া যেতে পারে। যদি প্রেস ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ আগ্রহী হয়। তথ্য মন্ত্রণালয় বা পিআইবি পরিচালনা বোর্ডের সদস্যরা এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারেন।
লেখক : মিডিয়া ও উন্নয়ন কর্মী
উৎসঃ বিডি-প্রতিদিন
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন