ক্রিকেট ইতিহাসের নতুন মহাকাব্য
23 June 2015, Tuesday
রবিবার রাতে ঢাকার মিরপুর শেরেবাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে লেখা হলো ক্রিকেট ইতিহাসের এক নতুন মহাকাব্য, যার রচয়িতা কিনা সুদূর সাতক্ষীরা থেকে উঠে আসা এক ১৯ বছরের তরুণ মুস্তাফিজুর রহমান। মুস্তাফিজের এই অমর কীর্তির কথা ইতিমধ্যে জেনে গেছে উপমহাদেশের সব ক্রিকেটপ্রেমিক আর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ক্রিকেটপ্রেমী কোটি মানুষ। মুস্তাফিজের এই কাব্য রচনায় সহায়তা করেছেন পদ্মাপারের আর ১০ বাঙালি, মাশরাফি বিন মর্তুজার নেতৃত্বে। সেই রাতে মুস্তাফিজের বিধ্বংসী বোলিংয়ের কাছে সম্পূর্ণ পরাস্ত হয় সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভারতের ক্রিকেট সুপারস্টার মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বাধীন টিম ইন্ডিয়া। একটা সময় ছিল, যখন ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচ হলেই তা হয়ে উঠত হাই ভোল্টেজ ম্যাচ। এখন তেমনটি আর হয় না; কারণ পাকিস্তানের ক্রিকেটের এখন পড়ন্ত বেলা। জঙ্গি আক্রমণের ভয়ে সেই দেশে এখন আর অন্য কোনো দেশ খেলতে যায় না। বহু বছর পর গত মাসে খেলতে গিয়েছিল জিম্বাবুয়ে। লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে খেলা চলাকালে জঙ্গিরা আক্রমণ করলে বেশ কজন দর্শক ও জঙ্গি হতাহত হয়। জিম্বাবুয়েকে খেলতে হয়, কারণ দেশটির অর্থ প্রয়োজন। ভারতের কথা আলাদা। ভারতে ক্রিকেটকে ঘিরে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা প্রতিনিয়ত হাতবদল হয়। ভারত যখন কোথাও খেলে, তখনই বাজিকরদের রমরমা অবস্থা। তার ওপর এখন যোগ হয়েছে আইপিএল। ক্রিকেট বা কোনো খেলা যে বাজারি পণ্য হতে পারে, তা বিশ্বাস করা যেত না, যদি না আইপিএলের প্রচলন হতো। তার ওপর আছে আইসিসিতে ভারতের দাদাগিরি। এই দাদাগিরিতে সঙ্গে আছে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। তাদের বিবেচনায় অন্য টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলো এখানে ফালতু। তো সেই প্রতিবেশী দেশ ভারতের ক্রিকেট টিম বাংলাদেশে একটি টেস্ট ও তিনটি এক দিনের ম্যাচ খেলতে এলো। ভারতকে বাংলাদেশে খেলতে আনাটা তেমন একটা সহজ নয়, কারণ বাংলাদেশে এলে তাদের আয়-রোজগার তেমন একটা হয় না। টিভিতে বিজ্ঞাপনদাতারা বিজ্ঞাপন দিতে তেমন একটা উৎসাহ বোধ করে না। ভারতে ক্রিকেট খেলাকে ঘিরে বিজ্ঞাপন ব্যবসাটা মিলিয়ন ডলারের। ভারতের কাছে ক্রিকেট দল হিসেবে বাংলাদেশ গোনা-গুনতির বাইরে। তাদের অনেক ভাষ্যকার আর সিনেমা তারকা বলেন, বাংলাদেশ নিজেদের টাইগার দাবি করলেও বাস্তবে তারা বিড়াল বৈ আর কিছু নয়। সেই বিড়ালরা রবিবার ভারতকে উড়িয়ে দিয়ে সেই পুরনো বাক্যটাকে আরেকবার মনে করিয়ে দিল- প্রতিপক্ষকে কখনো দুর্বল ভাবতে নেই, হোক না সেটি বাংলাদেশ। এর আগে একমাত্র টেস্টটি বৃষ্টির কারণে ভণ্ডুল হয়ে যায়।
রবিবারের খেলা টিভিতে দেখতে দেখতে মনে পড়ে ১৯৮৩ সালে ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্টের কথা। সেটি ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের সোনলি যুগ। আজকের প্রজন্মের ক্রিকেটবোদ্ধাদের বোঝানো যাবে না কেমন ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যালকম মার্শাল, মাইকেল হোল্ডিং বা এন্ডি রবার্টসের ভয়ংকর বোলিং। ব্যাটিংয়ে ছিলেন গর্ডন গ্রিনিজ (পরবর্তীকালে বাংলাদেশের কোচ), ডেসমন্ড হেইন্স, ক্লাইভ লয়েড ও ভিভ রিচার্ডস। ভারতও কম যায় কিসে? সুনীল গাভাস্কার ও অংশুমান গায়কোয়াড় ওপেনিং করছেন। দলে ছিলেন দিলীপ ভেংসরকার, মহিন্দর অমরনাথ ও রবি শাস্ত্রী। কপিল দেব ও রজার বিনি বোলিংয়ের নিয়মিত সূচনা করেন। মহিন্দ্র সিং, শিবরাম যাদব ও রবি শাস্ত্রী ভালো স্পিন করেন। টিম ওয়েস্ট ইন্ডিজ স্পিন খেলতে অভ্যস্ত নয়। বলের গতি দেড় শ মাইল না হলে তাদের খেলা জমে না। ভারতের উইকেটরক্ষক তখন বিশ্বসেরা সৈয়দ কিরমানি। ব্যাটও করতেন ভালো। কলকাতার ইডেন গার্ডেনে ডিসেম্বরের ১০ তারিখ থেকে পাঁচ দিনের পঞ্চম টেস্ট শুরু হলো। দুনিয়ার সেরা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের অন্যতম ইডেন গার্ডেনস। গ্যালারিতে বসে খেলা দেখলে বোঝা যায়, ইডেনে খেলা দেখাটা কত আনন্দের হতে পারে। প্রথম ইনিংসে মার্শাল, রবার্টস আর হোল্ডিংয়ের ইডেন কাঁপানো বোলিংয়ে কোনো রকমে কাতরাতে কাতরাতে ভারত ২৪১ রান করল। ক্রিকেট ইতিহাসের নতুন মহাকাব্য তিন ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোলারের তিনটি করে উইকেট। বাকিটা নিয়েছিলেন উইন্সটন ডেভিস। গাভাস্কার খেলেছিলেন এক বল। প্রথম বলে শূন্য রানে যখন ড্রেসিংরুমে ফিরে গেলেন, তখনো ধারাভাষ্যকাররা খেলার ধারাবর্ণনা শুরুই করতে পারেননি। উত্তরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩৭৭। ভদ্রলোক ক্রিকেটার বলে সবার কাছে পরিচিত ক্লাইভ লয়েড ১৬১ রান করে নট আউট। এন্ডি রবার্টস শেষে এসে ৬৮ রান। কপিল দেব ৩৫ ওভারে ৪ উইকেট তুলে নিয়ে আবারও জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি কেন বিশ্বসেরাদের কাতারে। ভারতের দ্বিতীয় ইনিংস তো দিলীপ কুমার-নার্গিসের ট্র্যাজেডিনির্ভর সিনেমাকেও হার মানায়। ম্যালকম মার্শাল একাই একজন গ্ল্যাডিয়েটরের মতো ক্রিকেট বলকে তলোয়ার বানিয়ে ১৫ ওভার বল করে ৩৭ রান দিয়ে ৬ উইকেট নিয়ে চতুর্থ দিনের বেশ খানিকটা বাকি থাকতেই দর্শকদের ইডেনের খানিক দূরে মেট্রো সিনেমায় ইভনিং শোর টিকিটের লাইন ধরতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। মাইকেল হোল্ডিং ৯ ওভারে ২৯ রান দিয়ে ৩ উইকেট। বাকিটা এন্ডি রবার্টসের। ৯০ রানে ভারত অল আউট। তখনো সীমিত ওভারের ক্রিকেট খেলা চালু হয়নি। ভারত কোনোমতে ৩০ ওভার খেলতে পেরেছিল। কলকাতা থেকে প্রকাশিত স্পোর্টস ওয়ার্ল্ড পরের সপ্তাহে প্রচ্ছদ কাহিনী করেছিল Marshall The Hangman শিরোনামে। মার্শালকে একজন নির্দয় জল্লাদের সঙ্গে তুলনা করেছিল স্পোর্টস ওয়ার্ল্ড। না, আমরা ১৯ বছর বয়সী এই বাংলার এক অখ্যাত গ্রাম তেঁতুলিয়া থেকে উঠে আসা তরুণ মুস্তাফিজকে কোনো জল্লাদের সঙ্গে তুলনা করতে চাই না। তবে রবিবার মুস্তাফিজের ভূমিকা ১৯৮৩ সালের কলকাতার ইডেনের মার্শালের ভূমিকার চেয়ে কম কিসে? এই তো তিন দিন আগে ভারতের সঙ্গেই প্রথম এক দিনের ম্যাচে মুস্তাফিজ একাই তাঁর প্রথম আন্তর্জাতিক ওয়ানডেতে পাঁচ উইকেট নিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সেই ম্যাচে ভারত হেরেছিল ৭৯ রানে। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা ওই খেলার প্রতিবেদনে লিখেছিল, 'মিরপুর শেরেবাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে পদ্মাপারের ১১ জন সবাই এদিন শেরেবাংলা, বাংলার বাঘ। বাঘ এখন শিকার করতে শিখেছে।' মুস্তাফিজ প্রথম দুটি এক দিনের ম্যাচে মোট ১১ উইকেট নিয়ে এখন বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী। এই রেকর্ড থাকবে অনেক দিন মনে হয়।
স্রেফ বাজে আম্পায়ারিং আর ভারতের অখেলোয়াড়োচিত আচরণের কারণে অস্ট্রেলিয়ায় চার মাস আগে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ভারত-বাংলাদেশ খেলার ঘটনাপ্রবাহ ক্রিকেট ইতিহাসে একটি কালো দাগ হয়ে থাকবে বহুদিন। সেই বর্ণনা বহুবার লেখা হয়েছে। আইসিসির নিয়ম ভেঙে সংস্থার প্রেসিডেন্ট মোস্তফা কামালকে ট্রফি প্রদান অনুষ্ঠানে না ডাকা ছিল ক্রিকেট ইতিহাসের আরেকটি ন্যক্কারজনক ঘটনা। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই পত্রিকায় একটি কলাম লিখেছিলাম 'ক্রিকেট একসময় ভদ্রলোকের খেলা ছিল' শিরোনামে। কিন্তু যখন থেকে এই ভদ্রলোকের খেলায় করপোরেট অর্থ প্রবেশ করতে শুরু করেছে, তখন থেকে আর খেলাটি ভদ্রলোকের থাকেনি। টিম ইন্ডিয়ার বেলায় তা একটু বেশি সত্য। প্রথম ওয়ানডেতে ভারত অধিনায়ক ধোনি ক্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা লিকলিকে শরীরের মুস্তাফিজকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে চোট পেয়ে মুস্তাফিজ কিছু সময়ের জন্য সাজঘরে ফিরে গিয়েছিলেন। ম্যাচ রেফারি আর আম্পায়াররা ঘটনার প্রতিবেদনে উল্লেখ করলেন, ঘটনার জন্য দায়ী ধোনি। তাঁকে দণ্ড দিতে হবে। ভারতের টিম ম্যানেজমেন্ট ও ধোনি মানতে নারাজ। বলল, মুস্তাফিজকেও যদি দণ্ডিত করা না হয় তাহলে তারা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইসিসিতে আপিল করবে। আর আইসিসি তো ভারতের আজ্ঞাবহ সংস্থায় পরিণত হয়েছে অনেক আগেই। এসব সংবাদ ভারতের পত্রপত্রিকার। বাংলাদেশ মুস্তাফিজের দণ্ড মেনে নিল। এটি বাঙালির ঔদার্যের পরিচয়। রবিবারের খেলা শেষে বাংলাদেশের দলনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা মুস্তাফিজকে নিয়ে ভারতের ড্রেসিংরুমে গিয়েছিলেন। ধোনির কাছে চাইলেন মুস্তাফিজের জন্য তাঁর একটা ব্যাট। ধোনি ব্যাট দিয়েছেন কি না জানা যায়নি। আসলে মাশরাফি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে গিয়েছিলেন। ক্রিকেট তো আসলেই একটি ভদ্রলোকের খেলা। রবিবারের বড় পাওয়া, বাংলাদেশ এখন ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলার নিশ্চয়তা পেল।
রবিবারের ক্রিকেট মহাকাব্য রচনার নেতৃত্বে ছিলেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। দুই হাঁটুতে সাতবার অপারেশন। আবার কোনো প্রকারের বড় আঘাত লাগলে পঙ্গু হওয়ার আশঙ্কা। খেলার আগে জানিয়ে দিলেন, 'আগে তো খেলে নিই, তারপর ওটা নিয়ে ভাবা যাবে।' বিশ্বকাপের আগে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মাশরাফি জানালেন, একাত্তরে যদি যুদ্ধের ময়দানে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা আহত হয়ে যুদ্ধ করতে পারেন, তাহলে হাঁটুতে আঘাত নিয়ে কেন তিনি খেলতে পারবেন না? বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন যে! সাতক্ষীরা থেকে উঠে আসা মুস্তাফিজ এখনো নাগরিক জীবনের সঙ্গে সম্পূর্ণ পরিচিত হয়ে উঠতে পারেননি, যা তাঁর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখলেই বোঝা যায়। বাংলা বলেন গ্রামের সাদাসিধে একজন তরুণের মতো। প্রমিত বাংলা ভাষার পুঁজি এখনো তেমন সমৃদ্ধ নয়। খেলা শেষে টিভি ক্যামেরার সামনে শামীম চৌধুরী তাঁকে প্রশ্ন করলেন, 'সাতক্ষীরার দূর গ্রাম থেকে ঢাকা এসে এমন একটা খেলা উপহার দেওয়ায় তাঁর অনুভূতি কী?' মুস্তাফিজ একটু সলজ্জ হাসি দিয়ে বললেন, তাঁর সেজ ভাই তাঁকে সাহায্য করেছেন। কজনের এমন বড় ভাই আছে? খেলার রেশ না ফুরাতেই শুরু হয়ে গেছে খেলার বাইরের একটি কথিত ঘটনা নিয়ে তোলপাড়। সুধীর গৌতম ভারত থেকে এসেছেন বাংলাদেশে খেলা দেখতে। কলকাতার এবিপি টিভি চ্যানেলকে নাকি তিনি জানিয়েছেন, খেলা শেষে স্টেডিয়ামের বাইরে বের হলে তাঁকে কারা নাজেহাল করে। পরে জানা গেল, এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। বিষয়টা স্রেফ বানোয়াট, না হয় অতিরঞ্জিত। ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে কিছু মানুষ সদা উদ্গ্রীব থাকে। তবে ঘটনা যদি সত্য হয়ে থাকে, তা অত্যন্ত গর্হিত, দুঃখজনক ও নিন্দনীয়। ক্রিকেট আবার ভদ্রলোকের খেলা হয়ে উঠুক। রবিবার রচিত মহাকাব্য ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকুক। সব শেষে বড় প্রশ্ন, ভারত কবে বাংলাদেশকে তাদের মাটিতে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলতে আমন্ত্রণ জানাবে?
লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন