জমজমাট নাটক 'সালাহ উদ্দিন দ্য গ্রেট'
15 May 2015, Friday
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদের প্রায় দীর্ঘ দুই মাস আগে হঠাৎ অন্তর্ধান, পরবর্তীকালে তাঁকে ঘিরে অনেক নাটকীয়তা, স্বাভাবিকভাবে তাঁর স্ত্রীর উদ্বিগ্নচিত্তে দৌড়ঝাঁপের অভিনয়, তাঁর দলের পক্ষ থেকে সালাহ উদ্দিনের অন্তর্ধান নিয়ে সরকারকে দোষারোপ করে নানা বক্তব্য-বিবৃতি, পাল্টা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিভিন্ন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার সালাহ উদ্দিনের অন্তর্ধানে তাঁদের কোনো রকম জড়িত থাকার ব্যাপারে স্পষ্ট ভাষায় অস্বীকার, সর্বশেষ গত মঙ্গলবার হঠাৎ করে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলংয়ে তাঁর আবির্ভাব ও স্থানীয় পুলিশের হাতে আটক, সব কিছু মিলিয়ে একেবারে জমজমাট নাটক। নাটকের নাম হতে পারে 'সালাহ উদ্দিন দ্য গ্রেট'। একেবারে ফাটাফাটি। নাটকের বাড়তি আকর্ষণ হচ্ছে আটকের সময় তিনি বেশ পরিপাটি ছিলেন। মুখে সামান্য দাড়ি ছিল, যা বড়জোর এক দিন পুরনো হতে পারে। পায়ে ছিল জুতা। গায়ে একটি বাহারি শাল, চোখের দামি চশমাটাও ঠিক ছিল। ১৩ মের আসাম বার্তা সংবাদ দিচ্ছে আটকের সময় সালাহ উদ্দিনের পকেটে ৫৭ হাজার ভারতীয় রুপি পাওয়া যায়। তাঁর কথাবার্তায় তেমন কোনো অসংলগ্নতা ছিল না। পুলিশের কাছে দাবি করেছেন, তিনি একসময় বাংলাদেশের মন্ত্রী ছিলেন। তা শুনে পুলিশ মনে করল বুঝি ভদ্রলোক অপ্রকৃতিস্থ। মাথা খারাপ হলে মানুষ নিজেকে রাজা-উজির মনে করে। মন্ত্রী তো কোন ছার। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো স্থানীয় একটি মানসিক হাসপাতালে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানিয়ে দিল, না, ভদ্রলোকের মাথায় কোনো গণ্ডগোল নেই। গায়ে কোনো আঘাতের চিহ্নও নেই। তাদের ধারণা আরো বদ্ধমূল হলো যখন তিনি তাঁর স্ত্রী হাসিনা আহমেদের টেলিফোন নম্বরটি বলতে পেরেছেন এবং তাঁকে বাংলাদেশে ফোন করে বলেছেন তিনি ভালো আছেন এবং সুস্থ আছেন। এমন লোকের মাথায় গণ্ডগোল থাকার কোনো কারণ থাকতে পারে না। তিনি বর্তমানে একটি সিভিল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। স্বামীর সঙ্গে কথা বলে সালাহ উদ্দিনের স্ত্রী ছুটে যান বেগম জিয়ার বাসভবনে। সেখানে নাকি বেগম জিয়ার ব্যক্তিগত স্টাফ অ্যাডভোকেট শিমুল বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর বেশ বচসা হয়। কারণ হাসিনা আহমেদ শিমুল বিশ্বাসকে বলেছেন তাঁর স্বামী তাঁদের নির্দেশেই দেশ ত্যাগ করেছিলেন। বিএনপির অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতা আড়ালে-আবডালে বলে বেড়ান বর্তমানে বিএনপি চালান শিমুল বিশ্বাস, লন্ডনে পলাতক তারেক রহমানের নির্দেশে।
সালাহ উদ্দিন আহমেদের সংবাদ পড়তে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা জিমি হফ্ফার কথা মনে পড়ল। জিমি হফ্ফাকে এই দেশের মানুষের তেমন একটা চেনার কথা নয়। হফ্ফা পঞ্চাশের দশক থেকে শ্রমিক নেতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কুখ্যাতি অর্জন করেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি এসে হফ্ফা যুক্তরাষ্ট্রের আনুমানিক ১৫ লাখ শ্রমিকের নেতা বনে যান। তাঁর বিরুদ্ধে ফেডারেল আইন ভঙ্গ করার দায়ে অনেক মামলা হয়। ১৯৬৭ সালে হফ্ফা গ্রেপ্তার হন এবং আদালত তাঁকে ১৩ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। হফ্ফা আর শ্রমিক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হবেন না- এই শর্তে নিক্সন তাঁর দণ্ড মওকুফ করেন। কিন্তু হফ্ফার তা পছন্দ হলো না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে ইউনিয়ন নেতারা খুবই ক্ষমতাশালী হয়ে থাকেন এবং বেআইনিভাবে বিশাল অর্থ-বিত্তের মালিক বনে যান। সেই দেশে দ্রুত কোটিপতি হওয়ার সহজ উপায় হচ্ছে শ্রমিক নেতা হওয়া। সেই জিমি হফ্ফাকে ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে ডেট্রোয়েটের একটি কফি শপের সামনে শেষবারের মতো দেখা গিয়েছিল। এর পর থেকে হফ্ফা নিখোঁজ। বাংলাদেশের রাজনীতির ভাষায় গুম। এখনো তাঁর কোনো খোঁজ নেই। অন্যদিকে বাংলাদেশে শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের নিহত হওয়াকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের সে কী দৌড়ঝাঁপ! কে হফ্ফাকে গুম করল আজতক তা রহস্যাবৃত। একসময় হফ্ফার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত অপরাধী সংগঠন মাফিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। ধারণা করা হয়, তাদের সঙ্গে লেনদেনের মতপার্থক্য হওয়াতে মাফিয়াই তাঁকে গুম করতে পারে।
জমজমাট নাটক 'সালাহ উদ্দিন দ্য গ্রেট'
সালাহ উদ্দিন ও তাঁর পরিবারের ভাগ্য ভালো তাঁকে হফ্ফার ভাগ্য বরণ করতে হয়নি। প্রায় দুই মাস রহস্যজনকভাবে নিরুদ্দেশ থাকার পর তিনি সশরীরে আবির্ভূত হয়েছেন, তা-ও আবার ভিনদেশে, কোনো বৈধ কাগজপত্র ছাড়া। বেগম জিয়া প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সময় সালাহ উদ্দিন তাঁর এপিএস ছিলেন। দক্ষিণ চট্টগ্রামের চকরিয়ায় তাঁর বাড়ি। স্থানীয় লোকজন তাঁকে গরম মিয়া বলে চেনে। অনেকে চেনে এপিএস সালাহ উদ্দিন হিসেবে। ছাত্র হিসেবে মেধাবী ছিলেন। পরবর্তীকালে রাজনীতিতে এসে তিনি বেগম জিয়ার কেবিনেটে যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন। তখন থেকে তাঁর অধঃপতন শুরু। স্ত্রী হাসিনা আহমেদও সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের বর্ষপূর্তির পর বিএনপি-জামায়াত মিলে দেশে যে প্রাণহরণকারী পেট্রলবোমা সংস্কৃতির আমদানি করল প্রথমে তাঁর হুকুমদাতা ছিলেন রিজভী আহমেদ। তিনি গ্রেপ্তার হলে পরে একেবারে বিন লাদেন কায়দায় গোপন আস্তানা থেকে প্রথমে ভিডিও টেপ, পরে বিবৃতির মাধ্যমে এ কাজটি চালিয়ে যেতেন সালাহ উদ্দিন আহমেদ। এখন শোনা যাচ্ছে শেষের দিকে তাঁর সই কাটপিস করে বিবৃতি পাঠানো হতো। তিনি আগেই দেশ ত্যাগ করেছিলেন। এই পেট্রলবোমার আঘাতে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় এক শ নিরীহ মানুষ আর শরীর ঝলসে গিয়ে হাসপাতালগুলোর বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়েছে আরো শ দুয়েক। বাদ যায়নি দুই বছরের মাসুম বাচ্চা অথবা অন্তঃসত্ত্বা নারীও। পরে জানা গেল, সালাহ উদ্দিন এই মানুষ হত্যার নির্দেশ দিচ্ছিলেন উত্তরার এক বাসা থেকে। সেই বাসা দক্ষিণ চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ীর দ্বিতীয় স্ত্রীর। এরপর একদিন তাঁর স্ত্রী হাসিনা আহমেদ সাংবাদিকদের জানালেন ২৪ ঘণ্টা আগে তাঁর স্বামী নিখোঁজ হয়েছেন। এই দীর্ঘ ২৪ ঘণ্টা তিনি কেন নীরব ছিলেন সেই প্রশ্ন তো উঠতেই পারে।
হাসিনা আহমেদ তাঁর স্বামীর নিখোঁজ হওয়ার সংবাদটি জানিয়ে চারদিকে বেশ হইচই ফেলে দিলেন। নানাজনের নানা মত আর তথ্য। কেউ বললেন বেগম জিয়া পেট্রলবোমা-সন্ত্রাস পরিচালনার জন্য তাঁর অফিস-কাম-রেসিডেন্সে যে কমান্ড পোস্ট খুলেছেন সেখানে সালাহ উদ্দিন আশ্রয় নিয়েছেন। বিএনপি জানিয়ে দিল সালাহ উদ্দিনকে সরকারের বিশেষ বাহিনী গুম করেছে। দু-একজন সুনির্দিষ্টভাবে বললেন র্যাবই সালাহ উদ্দিনকে আটকে রেখেছে। মাঠ গরম করতে নেমে গেল কিছু মানবাধিকার নামধারী সংস্থা, যেমন 'অধিকার'। তারা বলল, সালাহ উদ্দিনের গুম হওয়া কোনো অবস্থাতে মেনে নেওয়া যাবে না। যখন দেশে পেট্রলবোমা-সন্ত্রাস চলছিল তখন কিন্তু এরা চুপচাপ। সরকার সাফ জানিয়ে দিল তাদের কাছে সালাহ উদ্দিন নামের কেউ আটক নেই। সালাহ উদ্দিনবিষয়ক আলোচনা যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই ভারতের মেঘালয়ে তাঁর আচমকা আবির্ভাব বেশ নাটকীয়ই বটে।
সালাহ উদ্দিন মেঘালয়ের শিলং শহরে আটক হওয়ার পর বললেন তাঁকে কারা সেখানে নিয়ে গেছে তা তিনি জানেন না। জানালেন যারা তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল তারা সব সময় তাঁর চোখ বেঁধে রেখেছিল, যার কারণে তিনি তাদের কাউকে চিনতে পারেননি। তাঁকে একটি লাল মারুতি গাড়ি থেকে কেউ একজন নামিয়ে দিয়ে গেছে। চোখ বাঁধা থাকলে তিনি শেভ করলেন কিভাবে? গাড়ির রঙের বর্ণনাও বা কিভাবে এলো? চশমাটাও বা কোত্থেকে জোগাড় হলো? চকচকে পালিশ করা জুতা জোড়া অথবা বাহারি শাল? তাঁর চেহারার জেল্লাও খুব একটা কমেনি। কেউ কেউ বলছেন তিনি আসলে তাঁর সহযোগীদের মাধ্যমে প্রথমে আসামে যান। সেখানে তিনি বেগম জিয়ার একসময়ের রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর সহায়তা চান। কিন্তু হারিছ চৌধুরী তাঁকে কোনো ধরনের সহায়তা করতে অস্বীকার করেন। এরপর তিনি সেখান থেকে নেপাল হয়ে চীন যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু সাম্প্রতিককালে নেপালের ভয়াবহ ভূমিকম্প তাঁর সব পরিকল্পনা ভেস্তে দেয়। যাদের সঙ্গে তিনি ভারতে ও পরে নেপাল প্রবেশ করেছিলেন তারাও তাঁকে পরিত্যাগ করে উধাও হয়ে যায়। এরপর তিনি আবার নেপাল থেকে ভারতে প্রবেশ করেন। তারপর পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার। তাঁর পরিবার বলছে, তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। তা সহজ নাও হতে পারে। তিনি বিনা পাসপোর্টে ভারতে প্রবেশ করেছেন। সেই দেশের আইনে তিনি একজন অনুপ্রবেশকারী। সে জন্য মেঘালয়ের আদালতে তাঁর বিচার হওয়ার কথা। বিচার শেষে তাঁর কারাদণ্ড হলে তা ভোগ করার পর বাংলাদেশে তাঁকে ফেরত দেওয়া হবে। তারপর নিরীহ মানুষ হত্যার নির্দেশদানের দায়ে এই দেশের আদালতে তাঁর বিচার হবে। এসবের অর্থ হচ্ছে, সালাহ উদ্দিন আহমেদ ওরফে গরম মিয়ার গরমকাল দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অন্যদিকে তাঁর নামে ইন্টারপোলে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। বেশি চালাকি করতে গিয়ে ফেঁসে গেলেন সালাহ উদ্দিন।
ইলিয়াস আলী আর চৌধুরী আলম নামের আরো দুজন বিএনপি নেতা দীর্ঘদিন ধরে সালাহ উদ্দিন কায়দায় নিখোঁজ। এক-এগারোর পর থেকে কোনো খবর নেই হারিছ চৌধুরীর। কেউ অবশ্য তাঁর কোনো খোঁজ নেয় না। এক অদ্ভুত দল বিএনপি। ভবিষ্যতে এই তিনজন যদি হঠাৎ সালাহ উদ্দিন স্টাইলে আবির্ভূত হন তখন কী হবে তা ভাবনার বিষয়। আর এত দিন বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী আর সাংবাদিকরা গলা ফাটিয়ে টিভির পর্দা কাঁপানোর চেষ্টা করতেন তাঁরাই বা এখন কী বলবেন? অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ এই ব্যাপারে কী বলেন তা জানার ইচ্ছা রইল। তিনি তো আবার আগামী দিনে বিএনপি ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্রপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। তবে সব কথার শেষ কথা হচ্ছে, সব জল্পনা-কল্পনা ও দোষারোপের অবসান ঘটিয়ে সালাহ উদ্দিনকে জীবিত ও অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে সালাহ উদ্দিন উপাখ্যানে বিএনপির বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে গেল।
লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক
পাঠক মন্তব্য
dalal ....
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন