সব ঠিকঠাক থাকলে আর ২৪ ঘণ্টা পর ঢাকার দুটি আর চট্টগ্রামের একটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শুরু হবে। এই নির্বাচন ঘিরে চারদিকে সাজ সাজ রব। প্রার্থীরা এই কদিন ছুটেছেন এ-মহল্লা থেকে ও-মহল্লায়। তঁাঁদের পরিবারের সদস্যরাও বাড়িতে বসে ছিলেন না। প্রচারণায় তাঁরাও শামিল হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের বেশ কিছু কেন্দ্রীয় নেতাও ছুটে গিয়েছিলেন তাঁদের প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণায়। আবার ব্যতিক্রমও ছিল। অভিযোগ আছে, কোনো কোনো কেন্দ্রীয় নেতাকে মাঠে দেখা যায়নি। দু-একজন নেতার বিরুদ্ধে এ অভিযোগও আছে যে তাঁরা প্রচারণায় গিয়েছিলেন ঠিক, কিন্তু কৌশলে প্রতিপক্ষের জন্য প্রচারণা করেছেন। রাত পোহালেই নির্বাচনী মহোৎসব
তাঁদের মধ্যে দু-একজন প্রধানমন্ত্রীর একান্ত আস্থাভাজন আছেন বলেও শুনেছি। তা সত্যি হলে এটি হবে খুবই দূঃখজনক। তাঁরা আরো বলেছেন, আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী যদি পরাজিত হন, তাহলে তাঁরাই প্রধানত এর জন্য দায়ী হবেন। বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নেমে পড়েছিলেন দলের খোদ চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কয়েক দিন আগেও তাঁর হুকুমে দেশে পেট্রলবোমা-সন্ত্রাস চলছিল। এই সন্ত্রাসে প্রাণ গেছে কমপক্ষে দেড় শ নিরীহ মানুষের। চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়েছেন আরো কয়েক শ। তার পরও খালেদা জিয়া বেশ ফুরফুরে মেজাজে মাঠে নেমে পড়েন। এটি বাংলাদেশ বলে সম্ভব। মানুষ হত্যা করে পার পাওয়ার একটি সংস্কৃতি সেই যে ১৯৭৫ সালে চালু হয়েছিল, তা এখনো চালু আছে। বেগম জিয়া সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে এখন যা করতে পারছেন, তার চেয়ে আর ভালো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আশা করা উচিত নয়। এই তিন সিটি করপোরেশনে প্রায় ৬০ লাখ ৩০ হাজার ভোটার তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে তিনজন মেয়র, ১৩৪ জন পুরুষ আর ৪৫ জন নারী কাউন্সিলর আগামী পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচন করবেন। ভোটারদের প্রায় অর্ধেক নারী এবং তাঁরাই অনেকাংশে এই নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করবেন। প্রার্থীরা এই সহজ হিসাবটুকু মনে রাখলে ভালো করবেন।
বিএনপি নেতৃতাধীন ২০ দলীয় জোট ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করেছিল এই বলে যে শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না এবং নির্বাচন কমিশনও তাঁর আজ্ঞাবহ। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, এর পরপরই তারা অন্য পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়েছে এবং সব কটিতে বিজয়ী হয়েছে। তার পরও পেট্রলবোমা-সন্ত্রাস। আবার সেই সন্ত্রাসে বিরতি দিয়ে এই তিনটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে এবং ভালো করার স্বপ্নও দেখছে। তবে ভালো না করলে আবার তারা পেট্রলবোমা-সন্ত্রাসে ফিরে যেতে পারে। তার জন্য দেশের মানুষ কিছুটা হলেও শঙ্কিত। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হওয়ার পর থেকে বিএনপি ঘরানার রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, স্বঘোষিত নির্বাচন বিশ্লেষকের বদৌলতে চারদিকে একটি কথা বেশ চাউর হয়ে গেল- লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, মানে সবার জন্য সমান সুযোগ। অত্যন্ত ভালো কথা, কারো দ্বিমত করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু যেসব প্রার্থীর বিরুদ্ধে হুলিয়া আছে, তাঁরা প্রচার-প্রচারণার জন্য জনসমক্ষে আসতে পারবেন না। বিএনপির দাবি, তাঁদের জামিন দিতে হবে। এটি তো আইনের ব্যাপার। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেই একজন অভিযুক্তকে জামিন দিতে হবে, তা আইনে লেখা নেই। কেউ কেউ আবার আদালতে গিয়ে জামিনও নিয়েছেন। চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের এমপি, গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী তাঁর নিজস্ব হোটেলে বসে তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে বৈঠক করলেন। রাত পোহালেই নির্বাচনী মহোৎসব
নানা বিষয়ের সঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কৌশল নিয়েও আলোচনা হলো। প্রতিবাদে বিএনপি বলল, এতে আচরণবিধি লঙ্ঘিত হয়েছে। এটি প্রকাশ্য কোনো সভা-সমাবেশ ছিল না। তার পরও তাতে কিভাবে আচরণবিধি লঙ্ঘিত হয় তা পরিষ্কার নয়। নির্বাচনবিধিতে আছে, কোনো গাড়িবহর নিয়ে কেউ কোনো প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় যেতে পারবেন না অথবা রাস্তা বন্ধ করেও কেউ সভা করতে পারবেন না। বেগম জিয়া প্রায় ৫০টি গাড়ি, ২০০টি মোটরসাইকেল আর নিজস্ব সশস্ত্র নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নিয়ে তাঁর দল সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে ভোট চাইতে রাস্তায় নেমে পড়লেন, রাস্তা বন্ধ করলেন। কেউ কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করল না। অবশ্য শনিবার দুজন রিটার্নিং অফিসার বেগম জিয়াকে সতর্ক করে চিঠি দিয়েছেন। তাঁর গাড়িবহরে হামলা হলো। কোনো কোনো মিডিয়া বলছে, এটি সরকারি দলের কর্মীদের কাজ। আবার অন্যরা বলছে, বেগম জিয়াকে কালো পতাকা দেখানোর সময় তাঁর নিরাপত্তাকর্মীরা সমবেত জনগণের দিকে তেড়ে গেলে ঘটনার সূত্রপাত হয়। তবে নিশ্চয় এটি কোনো ভালো কাজ হয়নি এবং এর ফলে বেগম জিয়া কিছুটা হলেও সহানুভূতি আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন, যা তিনি চাইছিলেন। কিন্তু যাঁরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন, তাঁদের দিক থেকে তেমন কোনো হাঙ্গামার খবর পাওয়া যায়নি। দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতেই পারে। মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস তো মির্জা আব্বাসের প্রতিদ্বন্দ্বী সাঈদ খোকনের বাড়িতে গিয়ে নারীদের দোয়া নিলেন, নাশতা করলেন, নামাজ পড়লেন, কিছু সময় বিশ্রাম নিলেন, তারপর আবার বেরিয়ে পড়লেন। এটি একটি ভালো উদাহরণ। সমস্যা হলো যখন বেগম জিয়া বের হলেন তখন।
বিএনপির আবার দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর তেমন আস্থা নেই। নির্বাচন হচ্ছে দেশের মাত্র দুটি মহানগরীতে। নির্বাচনের দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আনসার, পুলিশ, কোস্টগার্ড, র্যাব আর বিজিবির কোনো কমতি নেই। তেমন আশ্বাস এসব বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা এর আগে দিয়েছেন। তাতে বিএনপি নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না। তাদের সেনাবাহিনী চাই। এর আগে ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে যখন সেনাবাহিনী মোতায়ন করা সত্ত্বেও বিএনপি হেরে গেল, তখন তারা শোরগোল তুলল, নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে এবং তাতে সেনাবাহিনীর হাতও ছিল। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনেও একই অবস্থা। বিএনপি যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বিতর্কিত করেছে, ঠিক একইভাবে সেনাবাহিনীকেও বিতর্কিত করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে তাদের একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা আছে বলে অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক মনে করেন। তার পরও নির্বাচন কমিশন বলল, ২৬ তারিখ থেকে সেনাবাহিনী রিজার্ভ ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সেনানিবাসের অভ্যন্তরে অবস্থান করবে। রিটার্নিং অফিসার প্রয়োজন মনে করলে যেকোনো মুহূর্তে তাদের ডাকতে পারেন। ঢাকার ভেতরে কুর্মিটোলা ও পোস্তগোলায় দুটি সেনানিবাস আছে। অদূরে সাভারেও একটি। চট্টগ্রামের নতুনপাড়া সেনানিবাস তো একেবারে মহানগর এলাকায়। বিএনপি মানতে নারাজ। পরে তারা আরো দাবি করল, সেনাবাহিনী দিলেই হবে না, তাদের বিচারিক ক্ষমতাও দিতে হবে। সেনাবাহিনীর বিচারিক ক্ষমতা এরশাদের সময় ছিল। তার পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে তিন জোট মিলে তা প্রত্যাহার করতে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বাধ্য করেছে। সুতরাং এখন তো সেটি আবার ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এই কথাটি বিএনপির না জানার কথা নয়; কারণ তারাও সেই সিদ্ধান্তের একটি পার্টি। ঘটনা এখানেই থেমে থাকল না। বিএনপির প্রতিনিধিরা ছুটলেন নির্বাচন কমিশনে। দাবি তুললেন, অপরাধ যা-ই হোক, আগামী সাত দিন বিএনপি সমর্থিত কোনো প্রার্থীকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। রাজধানীর অধিকাংশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) অন্যত্র বদলি করে দিতে হবে। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের দলীয়ভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের সরিয়ে দিতে হবে। পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র চিহ্নিত করার জন্য সব প্রার্থীর পরামর্শ নিতে হবে। বলতে বাকি রেখেছেন, ভোটগ্রহণ শেষে আমাদের প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করতে হবে। মামাবাড়ির আবদার আর কাকে বলে?
আসলে বেশ অনেক দিন পর এই দুটি মহানগরের মানুষ একটি উৎসবমুখর পরিবেশে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন করছে। গুটিকয় সন্ত্রাসী ছাড়া সবাই একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন প্রত্যাশা করে। এই নির্বাচন কোনো সরকার পতনের নির্বাচন নয়, যদিও বিএনপি ঘরানার অনেক বুদ্ধিজীবী মনে করেন, এটি একটি রেফারেন্ডাম। বিএনপির নতুন নেতা অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ঘোষণা করেছেন, এই নির্বাচনে সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থীর পরাজয় হলে সরকার তিন মাসের মধ্যে একটি মধ্যবর্তী জাতীয় নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে। তিনি রাজনীতিবিজ্ঞানের একজন পণ্ডিত ব্যক্তি। এমন অদ্ভুত কথা তিনি কেন বলেন তা বোধগম্য নয়। ঢাকায় হানিফ ও চট্টগ্রামে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী যখন ১৯৯৪ সালে প্রথমবার মেয়র নির্বাচিত হন, তখন বিএনপি ক্ষমতায়। তৃতীয়বার যখন মহিউদ্দিন চৌধুরী নির্বাচিত হন, তখনো বিএনপি ক্ষমতায়। তখন কিন্তু কেউ মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি তোলেননি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা বিএনপির রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, যা ছিল তাদের জন্য অনেকটা আত্মঘাতী। মানুষ আশা করে, ২৮ তারিখের নির্বাচনে ফলাফল যা-ই হোক, সব পক্ষ তা মেনে নেবে এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করবে।
লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন