তৃতীয় ফর্মুলার ইঙ্গিত!
20 March 2015, Friday
১৩ মার্চ শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে এক অনুজপ্রতিম সাংবাদিক ফোন করে সেদিন বিকেলে দেওয়া বিএনপিপ্রধান বেগম জিয়ার সংবাদ সম্মেলন সম্পর্কে আমার মতামত জানতে চাইলেন। তখন আমি আমাদের চট্টগ্রামের বাড়িতে জ্বরে শয্যাশায়ী। সেই সাংবাদিক ভাইকে বলি, আমি তো সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য শুনিনি। সুতরাং তাঁর প্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া জানাতে একটু সময় লাগবে। আমি এমন এক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ সম্মেলন শুনিনি, এটা জেনে তিনি একটু অবাক হলেন। এমনিতে খেলা না হলে আমার টিভি দেখা হয় কম, তার ওপর বেগম জিয়াকে ইদানীং আমার কাছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাহুল্য (redundant) মনে হয়। আমার মতো অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলটি এখন অস্তাচলে স্রেফ বেগম জিয়া ও তাঁর গুণধর ছেলে তারেক রহমানের কারণে। অথচ যদি দলটি সত্যিকার অর্থে সুস্থ ধারায় জনমুখী রাজনীতি চর্চা করত, তাহলে তা হতো বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশ আর উন্নয়নের জন্য একটি ইতিবাচক দিক। কম্পিউটার অন করে জানার চেষ্টা করি বেগম জিয়া কী কী গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন তাঁর সংবাদ সম্মেলনে। অনলাইনে সংবাদ পড়ে বুঝলাম, এটি বেগম জিয়ার চিরাচরিত সংবাদ ব্রিফিং। কারণ এখানে উপস্থিত কয়েক ডজন সাংবাদিক অসম্ভব উৎসাহ নিয়ে গেলেও শুরুতেই তিনি বলে রেখেছেন, কোনো প্রশ্ন নেবেন না। উপস্থিত কোনো সাংবাদিক যদি প্রস্তাব করতেন এত কষ্ট করে তাঁদের এখানে ডেকে না এনে সংবাদ ব্রিফিংয়ের কপিটা তাঁর অফিস স্টাফ দিয়ে পাঠিয়ে দিলে তা তাঁরা ঠিকই প্রচার করতেন, যেমন তাঁরা এত দিন প্রচার করছিলেন সালাহ উদ্দিন নামের এক অদৃশ্য ব্যক্তির মানুষ পোড়ানোর নির্দেশাবলি। সেই সালাহ উদ্দিন এখন সত্যি সত্যি অদৃশ্য হয়ে গেছেন। আগে যে সত্যি সত্যি তিনি বাংলাদেশে দৃশ্যমান ছিলেন তার কোনো অকাট্য প্রমাণ নেই। তাঁর নির্দেশাবলির নিচে যে স্বাক্ষর থাকত তা ছিল কাটপেস্ট। কাউকে কাউকে বলতে শুনেছি অনেক বিএনপি নেতার মতো তিনি ভারতে অবস্থান করছেন, আবার কারো কারো মতে তিনি দুবাইতে। কেউ কেউ আবার এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, তাঁকে কানাডার ভ্যানকুবারে দেখা গেছে। মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। তবে সরকারের উচিত যথাসাধ্য চেষ্টা করে তাঁকে খুঁজে বের করে আইনের সামনাসামনি করা। তাঁর বিরুদ্ধে অনেক মামলা রয়েছে। সেদিন বেগম জিয়া উঠে যাওয়ার সময় একজন সাংবাদিক সাহস করে প্রশ্ন করলেন, 'এত মানুষ পুড়িয়ে আপনাদের অর্জন কী?' উঠতে উঠতে বেগম জিয়া বেশ সাবলীলভাবে বললেন, 'মানুষের সমর্থন অর্জন!' রাজনীতিতে মানুষ পুড়িয়ে মানুষের সমর্থন অর্জন করা যায় এই প্রথম জানলাম। সামান্যতম বিবেক আছে তেমন কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তির কাছ থেকে এমন কথা কখনো শোনা যাবে না। আসলে বেগম জিয়ার কাছে সম্ভবত কোনো সাংবাদিক বশীকরণ তাবিজ আছে। শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা পারলে তাঁর হাঁড়ির খবরও বের করেন। কখনো কখনো দেখা যায় কোনো কোনো সাংবাদিক শেখ হাসিনার সামনে বসে তাঁর মুখে মাইক ধরে আছেন। আর বেগম জিয়ার ক্ষেত্রে নিরাপদ দূরত্বে। সাংবাদিকরা আবার 'ব্লাডি সিভিলিয়ন' তো! তাঁরা কাছে কী করে ভিড়বেন?
অনেকের কাছেই দীর্ঘ ৫৩ দিন পর বেগম জিয়ার এই সংবাদ ব্রিফিংয়ের গুরুত্ব ছিল মূলত দু-একটি কারণে। তিনি ৫ জানুয়ারি থেকে এই দীর্ঘ সময় ধরে টানা হরতাল আর অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে মনে করছেন। মূল দাবি, বর্তমান সরকারকে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে আবার আরেকটি সংসদ নির্বাচন করতে হবে। দেশে অবরোধ বা হরতাল বলে তেমন কিছু নেই। আছে রাজনৈতিক কর্মসূচির আড়ালে পেট্রলবোমা মেরে আর ট্রেনের লাইন তুলে নিরীহ মানুষ মারার মচ্ছব। এ পর্যন্ত প্রায় ১৩০ জন মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়ে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। বিভিন্ন হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে শতাধিক মানুষ। বালক থেকে বৃদ্ধ কেউ বাদ যায়নি। সবাই মনে করেছিল বেগম জিয়া বুঝি নির্দেশ দেবেন, যেন আর কোনো পেট্রলবোমা ছোড়া না হয়। তিনি সব সময় বলে থাকেন, এই যে পেট্রলবোমা ছোড়া বা নাশকতার কাজ, তা করছে সরকারি দল। তিনি আবার এটিও সেদিন বললেন, আজ যদি সরকার তাঁদের দাবি মেনে নেয়, তাহলে কাল থেকে সব ধরনের অশান্তি দূর হয়ে যাবে। অশান্তি যদি সরকারই সৃষ্টি করে থাকে, তাহলে তাঁর দাবি মানলে কাল থেকে সরকারসৃষ্ট নাশকতা কিভাবে দূর হবে? আসলে বেগম জিয়া দেশের মানুষকে এত বোকা আর নাদান না ভাবলে ভালো করতেন। তৃতীয় ফর্মুলার ইঙ্গিত!
তিনি সোজাসুজি বলতে পারতেন, 'আমি নির্দেশ দিচ্ছি কাল থেকে সব ধরনের নাশকতা বন্ধ।' তখন দেখা যেত কারা এই জীবন হরণকারী নাশকতা করে। পেট্রলবোমা মারতে গিয়ে বা বানাতে গিয়ে যারা বমাল ধরা পড়ছে তারা তো প্রায় সবাই তাঁর দলের অথবা জামায়াত-শিবিরের। আর বেগম জিয়ার সংবাদ ব্রিফিংকে কেন্দ্র করে আশান্বিত হয়েছিলেন দেশের কয়েক কোটি অভিভাবক, কারণ তাঁদের ছেলেমেয়েরা ঠিকমতো বিদ্যালয়ে যেতে পারে না। ১৫ লাখ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সময়মতো পরীক্ষা দিতে পারেনি। সামনের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায়ও ১২ লাখ শিক্ষার্থী এমন একটি অচল অবস্থার মধ্যে পড়বে বলে মনে হচ্ছে। অথচ বেগম জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর কুয়ালালামপুরে মৃত্যু হলে তাঁর দুই মেয়ে বাবার মৃতদেহের সঙ্গে দেশে এসে দুই দিনের মাথায় কুয়ালালামপুরে ফেরত গেছে। কারণ তাদের পরীক্ষা। তাদের মা তাদের পরীক্ষা দিতে নিয়ে গিয়ে একজন উপযুক্ত মায়ের পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর শাশুড়ি বেগম জিয়া অন্যদিকে দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের বারোটা বাজাচ্ছেন। পুত্রবধূর মতো শাশুড়ির একটু কাণ্ডজ্ঞান থাকলে বেগম জিয়া ১৩ তারিখের বক্তৃতায় বলতে পারতেন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথাকথিত অবরোধ-হরতালের আওতামুক্ত। এসব চিন্তা করার মেধা ও বিচক্ষণতা বেগম জিয়ার কখনো ছিল তা মনে হয় না। তা যদি হতো সব সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও তাঁর দুই ছেলে এমন বরবাদ হয়ে যেত না।
আমার সেই সাংবাদিক বন্ধুটিকে ফোন করি। বলি, বেগম জিয়ার সংবাদ ব্রিফিংটা পড়লাম। তাতে তো নতুন কিছুই নেই। নতুন বোতলে পুরনো মদ। মদ পুরনো হলে নাকি তার মূল্য বাড়ে। কিন্তু বেগম জিয়ার এসব বাগাড়ম্বরসর্বস্ব পুরনো মদের কোনো মূল্য এখন জনগণের কাছে আছে বলে মনে করি না। বলি, বেগম জিয়ার কাছে অনেকবারের মতো আরো একবার সুযোগ এসেছিল নিজের সৃষ্ট তাঁর এই অচল অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার, যা তিনি নষ্ট করেছেন। রাজনীতিতে অপরিকল্পিত ও দায়িত্বজ্ঞানহীন জেদাজেদি কোনো সুফল বয়ে আনে না। তিনি আগামী নির্বাচন কিভাবে হতে পারে তার একটা রূপরেখা তুলে ধরতে পারতেন। বলতে পারতেন, নির্বাচন কমিশনকে কিভাবে আরো শক্তিশালী করা যায়। তিনি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করার কথা বলেছেন। বলেননি তার পরিবর্তে তিনি কি চান। তত্ত্বাবধায়ক সরকার তো হবে না, কারণ দেশের সর্বোচ্চ আদালত বলেই দিয়েছেন এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী। তাকে যদি ফিরিয়ে আনতে হয়, তাহলে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর ওপর হাত দিতে হবে। ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায়ের বিশ্লেষণে মহামান্য আদালত বেশ জোরের সঙ্গে বলেছেন, বাংলাদেশের সংবিধান ৩০ লাখ শহীদের রক্তে লিখিত সংবিধান। ব্যক্তিস্বার্থে এটির ওপর হাত দেওয়া উচিত নয়। পত্রিকা মারফত জেনেছি, বেগম জিয়ার সংবাদ ব্রিফিং সম্পর্কে দলের শীর্ষ পর্যায়ের কোনো নেতাই আগে থেকে জানতেন না বা তাঁদের জানানো হয়নি। তাঁরা টিভির স্ক্রলে দেখেছেন। ব্রিফিংয়ের বিষয়বস্তু এসেছিল লন্ডন থেকে। তারেক রহমানের আরেক কীর্তি। তার ওপর ভিত্তি করে ব্রিফিং তৈরি করেছেন বেশ কদিন ধরে ভেতরে থাকা দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও সেলিমা রহমান। বেগম জিয়ার কৃপাধন্য শফিক রেহমানের হাতও নাকি ছিল। হিটলার প্রসঙ্গ আসায় সাধারণ মানুষের তা-ই ধারণা।
পরদিন আরো জানা গেল, বেগম জিয়ার আগের দিনের বয়ানে দেশের মানুষ ও দলের নেতা-কর্মীরা চরম হতাশ হলেও দেশে দুজন স্বনামধন্য ব্যক্তি এই বয়ানে সম্ভবত বেগম জিয়ার কিছু নমনীয়তার ইঙ্গিত পেয়েছেন। তাঁদের একজন সাংবাদিক আর অন্যজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। দুজনই বেশ ওজনদার মানুষ। তাঁদের লেখা আর বক্তব্য আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনি অথবা পড়ি। একজন বলেছেন, বেগম জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বদলে 'সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সরকারের' কথা বলেছেন। বাহ চমৎকার! সেই সরকার কোত্থেকে আসবে তা বললে ভালো হতো না? তিনি নাকি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্যে গঠিত সংসদকে অবৈধ বলেননি। তাহলে সেই সরকারের পূর্ণ মেয়াদ পূরণ করতে অসুবিধা কোথায়? ১৯৯৬ সালের মতো করেই তাঁরা একটি গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে বর্তমান সরকারকে বিদায় করার মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে চান। মানুষ পুড়িয়ে চেষ্টা করেছিলেন। ব্যর্থ হয়েছেন। আসলে পেট্রলবোমা মেরে তো আর গণ-আন্দোলন হয় না, তা সাংবাদিক বন্ধুর চেয়ে আর ভালো কে জানবেন? বেগম জিয়া নাকি অবরোধ-হরতাল অনির্দিষ্টকাল চলুক তা চাননি। তিনি বাংলাদেশে স্বাধীনতার ৪৫তম বর্ষপূর্তি ঐক্যবদ্ধভাবে পালন করার খায়েশ প্রকাশ করেছেন। কোনো অসুবিধা তো দেখি না। ২১ ফেব্রুয়ারি বেগম জিয়া শহীদ মিনারে যাননি। তাতে কি খুব বেশি অসুবিধা হয়েছে? এবার জাতীয় স্মৃতিসৌধে নাই বা গেলেন। তিনি তো তাঁর মিত্রদের নিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশকে একাত্তর-পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে চেষ্টা করছেন। অধ্যাপক মহাশয় বলেছেন, বেগম জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি এড়িয়ে গেছেন। তৃতীয় কোনো ফর্মুলার দিকে যাওয়ার ইঙ্গিত নাকি আছে। তা-ই যদি হয়, তাহলে এর দাবিতে এত মানুষ হত্যা, তার কী হবে? আমার বোঝার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ, অনেক সহজ কথাও সহজে মাথায় ঢোকে না। তবে সার্বিক বিবেচনায় মনে হলো, বেগম জিয়ার সংবাদ ব্রিফিং না শুনে তেমন কিছু মিস করিনি।
লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন