চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে বসে ছিলাম ঢাকা ফিরব বলে। ঘোষণা দেওয়া হলো, বিমান ছাড়তে আধ ঘণ্টা দেরি হবে। বিমান দেরিতে ছাড়া কোনো কোনো এয়ারলাইনসের জন্য তেমন কোনো নতুন ব্যাপার নয়। হঠাৎ এক ব্যক্তি নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, তিনি টিভিতে আমার টক শো দেখেন। পরিচিত হতে এসেছেন। দেশের সার্বিক অবস্থায় ভদ্রলোক বেশ বিরক্ত। তাঁর কন্যাটি এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। আজ জানা গেল, সেই পরীক্ষা বানচাল করার জন্য ২০ দলীয় জোট দেশে আবার ৭২ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছে। শিক্ষামন্ত্রী থেকে শুরু করে অনেক অভিভাবক বেগম জিয়ার কাছে আকুতি জানিয়ে বলেছেন, পরীক্ষার সময় যেন কোনো ধরনের হরতাল বা অবরোধ দেওয়া না হয়। কে শোনে কার কথা। ২০ দলীয় জোটের অন্যতম নেতা কর্নেল (অব.) অলি তো বলেই দিয়েছেন, পরীক্ষা পরে নেওয়া যাবে, তার আগে শেখ হাসিনাকে বিদায় করতে হবে (তাঁর ভাষায় গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করতে হবে, ৭১ টিভি)। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন বিবিসি সংলাপে বলেছেন, 'কিসের পরীক্ষা, কিসের কী'? মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান বেশ উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলেছেন, পরীক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই। আগে বর্তমান সরকারকে বিদায় করতে হবে (এটিএন নিউজ)। মেজর আখতার বিএনপিতে আছেন কি নেই, তা সঠিক জানি না। তবে তিনি সুযোগ পেলেই বেগম জিয়া আর বিএনপির পক্ষে গুলি ছোড়েন। বিমানবন্দরে পরিচয় হওয়া সেই ভদ্রলোক আমাকে কিছুটা অবাক করে দিয়ে বললেন, তিনি একজন বোমাবাজ হতে চান। হয়তো বলতে চেয়েছেন পেট্রলবোমার বোমারু। জানতে চাই হঠাৎ তাঁর এই ভীমরতি কেন? তাঁর সোজাসাপ্টা উত্তর, তিনি পেট্রলবোমারু হয়ে যাঁরা পেট্রলবোমা মারার হুকুম দেন, তাঁদের লক্ষ করে বোমা মারতে চান। ভদ্রলোকের মতে, পেট্রলবোমার আঘাতে ২০ দলীয় জোটের কাউকে তো আক্রান্ত হতে দেখলাম না। দু-চারজন দগ্ধ হলে তখন তাঁরা বুঝতেন পেট্রলবোমায় যাঁরা আহত হয়েছেন, তাঁরা কী যন্ত্রণায় আছেন। হঠাৎ ভদ্রলোক আমাকে কিছুটা অপ্রস্তুত করে দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। পিঠে হাত দিয়ে তাঁর দিকে তাকাতেই তাঁর মুখেই জানা গেল, তাঁর ছোট ভাই যে কিনা ঢাকায় একটি ছোটখাটো চাকরি করে কয়দিন আগে পাবলিক বাসে বাসায় ফেরার সময় পেট্রলবোমার আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটে কাতরাচ্ছেন। বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এতক্ষণে বুঝতে পারি ভদ্রলোক কেন বোমাবাজ হতে চান। তাঁকে সান্ত্বনা জানানোর কোনো ভাষা খুঁজে পাই না। আমি হলফ করে বলতে পারি, বর্তমানে বাংলাদেশে আরো অনেকেরই তাঁর মতো আগ্রহ সৃষ্টি হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। এই আগ্রহ থেকে দেশে আরো বড় ধরনের কোনো অঘটনও ঘটে যেতে পারে। এয়ারলাইনসের স্টাফ বিমান ছাড়ার সময়ের ঘোষণা দিলেন।
'আমি একজন বোমাবাজ হতে চাই'!
ঢাকায় অবতরণ করার পর আমার ড্রাইভার জানাল, পেট্রলবোমা মেরে সেদিনও শাহবাগের মোড়ে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা অনেক মানুষকে হতাহত করেছে। তাকে বলি জানালার কাচটা তুলে দিতে। পেট্রলবোমাকে বলা হয় গরিবের গ্রেনেড, আসল নাম মলোটভ ককটেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফিনল্যান্ডের অধিবাসীরা উদ্ভাবন করেছিল। নামকরণ তৎকালীন সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভাইচেসলেভ মলোটভের নামে। কারণ যিনি ১৯৩৯ সালে জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিভেনট্রপের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন যে এক দেশ অন্য দেশকে আক্রমণ করবে না, কিন্তু তৃতীয় কোনো দেশ আক্রমণে বাধা থাকবে না। ১৯৩৯ সালের নভেম্বর মাসে সোভিয়েতরা ফিনল্যান্ড আক্রমণ করলে ফিনিশরা সেই আক্রমণ প্রতিহত করেছিল এই মলোটভ ককটেল দিয়ে। সেটি এখন বাংলাদেশে ব্যবহার করা হচ্ছে বেগম জিয়ার নির্দেশে নিরীহ মানুষকে হত্যা করার জন্য। আর এসবের মধ্যে আমাদের দেশের কিছু পরগাছা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আর একদল সুশীল তারস্বরে চিৎকার করছেন- এ মুহূর্তে আলোচনা চাই, তা না হলে এই সংঘাত চলতেই থাকবে। কেউ কিন্তু বলেন না- বন্ধ করুন এসব প্রাণঘাতী পেট্রলবোমা সন্ত্রাস। তারপর আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করুন। সমস্যা তো এখানে একটাই। যেকোনো মূল্যে বিএনপিকে ক্ষমতায় যেতে হবে আর জামায়াতের যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করে দিতে হবে। বেগম জিয়া আর তারেক রহমান জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা থেকে মুক্তি চান। বিএনপি ঘরানার বেশ বড় একজন বর্ষীয়ান সাংবাদিক সেদিন ৭১ টিভিতে বেশ জোরালোভাবে বললেন, এসব নরহত্যা ২০ দলের আন্দোলনেরই অংশ। এটি সমষ্টিগত ক্ষতি (Collateral Damage)। কারণ সরকার হত্যাকারীদের দাবি মেনে নিচ্ছে না। নিউ ইয়র্কে বেগম জিয়ার একজন বড় উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুক দলীয় নেতা-কর্মীদের বললেন, এখন কতজন মানুষ মারা গেল অথবা অর্থনীতির কত ক্ষতি হলো, তা দেখার সময় নেই। কোনো সুশীলকে তো এসবের নিন্দা জানাতে শুনলাম না। এঁদের কেউ কি গেছেন কোনো একটা বার্ন ইউনিটে?
শুক্রবার দিবাগত রাতে বেগম জিয়ার গুলশানের অফিস কাম রেসিডেন্সের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। কেব্ল্, টেলিফোন সংযোগ ও ইন্টারনেট সংযোগ থেকেও তিনি বঞ্চিত। তবে রাতে বিদ্যুৎ সংযোগ পুনঃস্থাপন করা হয়েছে। সরকারের এমন ব্যবস্থা অবশ্যই অনুমোদনযোগ্য নয়। সুশীল আর তামাদি রাজনীতিবিদদের অনেকেই এই পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছেন। ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী এ ঘটনায় ব্যথিত হয়ে বলেছেন, বিদ্যুৎ লাইন কাটা রাজনৈতিক কলঙ্ক, জঘন্য ও নিকৃষ্ট কাজ। পাঠকদের একটু পেছনে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাই। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতনের পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের একটি যৌথ বিজয় মিছিল বের হয়েছিল। নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন। তিনি দেশের উপাচার্যদের মধ্যে সিনেটে সর্বাধিক ৭২ ভোট পেয়ে তখন নির্বাচিত হয়েছিলেন। মিছিল শেষে এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে তিনি বলেন, 'একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা নব্বইয়ে বিপ্লবী সেজেছে। তাদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে।' এতে ক্ষিপ্ত হলো ক্যাম্পাস দখলকারী ছাত্রশিবির। হামলা হলো ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর। সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়ল বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বেগম জিয়া সরকার গঠন করলেন। সবাই, এমনকি ছাত্রদল পর্যন্ত আশা করেছিল, পরিস্থিতির উন্নতি হবে। হলো উল্টো। উপাচার্যের বাসভবনকে সাবজেল ঘোষণা করে তাঁকে সেখানে ১২ দিন সপরিবারে বন্দি করে রাখল ছাত্রশিবিরের দুর্বৃত্তরা। তাদের দাবি, উপাচার্যকে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। বিচ্ছিন্ন করা হলো তাঁর বাসভবনের বিদ্যুৎ, টেলিফোন, গ্যাস আর পানি সরবরাহ। বন্ধ করা হলো বাইরে থেকে খাবার সরবরাহ। উপাচার্যের একমাত্র সন্তান উমর বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যাবে উচ্চশিক্ষার্থে। উপাচার্যের অফিস স্টাফ থেকে উমরের কাগজপত্র ছিনিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করা হলো। বাসভবনের সামনে বাঁধা হলো মাইক। দিনরাত উপাচার্যকে উদ্দেশ করে গালাগাল চলতে লাগল। এমন নরক গুলজার এই বাংলাদেশে আর কখনো দেখা যায়নি। একপর্যায়ে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ডা. বদরুদ্দোজা এলেন ক্যাম্পাসে। সঙ্গে উপাচার্যের এককালের ছাত্র বেগম জিয়ার কাছের মানুষ, বিএনপি নেতা মীর মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন। শিবিরের সন্ত্রাসীরা ফুল দিয়ে বরণ করে নিল শিক্ষামন্ত্রী আর তাঁর সঙ্গীকে। উপাচার্যের অন্ধকার, অনেকটা ভৌতিক বাসভবনে শিক্ষামন্ত্রী প্রবেশ করলে তাঁকে মোমবাতির আলোতে স্বাগত জানান স্বয়ং উপাচার্য। শিক্ষামন্ত্রী আবদার করেন, ছাত্রশিবিরের দাবি মেনে নিয়ে তাঁকে পদত্যাগ করতে হবে। উপাচার্য শিবিরের দাবির কাছে মাথানত করতে অস্বীকার করলেন। উপাচার্যের স্ত্রী, যিনি নিজেও বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক, কেরোসিনের স্টোভে দুই কাপ চা বানিয়ে সঙ্গে দুটি বেঙ্গল বিস্কুট দিয়ে মন্ত্রী মহোদয় ও তাঁর সঙ্গীকে আপ্যায়ন করেন। ডা. চৌধুরী ঢাকায় ফিরে সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন, উপাচার্য তো বেশ খোশমেজাজেই আছেন, তাঁদের চা দিয়ে আপ্যায়ন করেছেন। সেবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিরোধী দল সংসদ থেকে ওয়াক আউট করেছিল। বলতে ইচ্ছা করছে, ভণ্ডদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। তা না বলে বলছি, নষ্টদের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
ড. কামাল হোসেন, যাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হয়েছিল, তিনি বঙ্গবন্ধুর আলোয় আলোকিত। নিজে নির্বাচন করলে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। বেগম জিয়ার সঙ্গে সরকারের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, 'এটি গণতন্ত্র নয়।' আরেকটু আগ বাড়িয়ে বলতে পারতেন, পেট্রলবোমা মেরে নিরীহ মানুষ মারাটাই আসল গণতন্ত্র। অথবা মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় হরতাল দেওয়াটাই বিশ্বমানের গণতন্ত্র। ড. এমাজউদ্দীন আহমদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, মধ্যরাতে বেগম জিয়ার জন্মদিনের কেক কাটেন, বলেছেন, বেগম জিয়ার প্রাণনাশের চেষ্টা করা হচ্ছে। হয়তো সত্য কথাই বলেছেন। তবে তা সরকারি দল করছে তা মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ তেমনটি হলে ষোলো আনাই তাদের ক্ষতি। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য পাকিস্তানে আসিফ আলী জারদারি তালেবানের সহায়তায় তাঁর স্ত্রী বেনজির ভুট্টোকে হত্যা করেছিলেন। মোগল বাদশাহ আওরঙ্গজেব সিংহাসন দখল করতে তাঁর ভাইদের হত্যা করে পিতা সম্রাট শাহজাহানকে আগ্রার দুর্গে আট বছর বন্দি করে রেখেছিলেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক পররাষ্ট্রসচিব রিয়াজ রহমান কয়দিন আগে কার গুলিতে বেগম জিয়ার অফিসের কাছে গুলিবিদ্ধ হলেন? সবাই কেমন জানি চুপচাপ। এমনকি তাঁর পরিবারের সদস্যরাও। ক্ষমতার মোহ খুবই ভয়ংকর। বেগম জিয়ার নিরাপত্তা জোরদার করা অত্যন্ত জরুরি। আর দু-একজন পরিত্যক্ত রাজনীতিবিদ তো নতুন সার্কাস পার্টি খুলে আমরণ অনশনের নাম করে মতিঝিলে শতরঞ্জি বিছিয়ে শিমের বিচি দিয়ে রান্না করা কই মাছের ঝোল খেয়ে বিনা পয়সায় মানুষকে বিনোদন উপহার দিচ্ছেন। বাহ বেশ! চারদিকে নানা কিসিমের ভণ্ডামি দেখে সত্যি সত্যি আমারও বিমানবন্দরে দেখা হওয়া সেই ভদ্রলোকের মতো ইচ্ছা করে বোমাবাজ হতে। দুর্ভাগ্য, সেই বয়স আর সুযোগ আমার এখন নেই। আল্লাহ সবাইকে সুপথে আনুন।
লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন