বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেরই স্বাধীনতা অথবা জাতীয় দিবস আছে। বাংলাদেশে এসব দিবস তো আছেই, সঙ্গে আছে একটি বিজয় দিবস, যা অন্য কোনো দেশের আছে বলে জানা নেই। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা এবং তার একান্ত নিজস্ব। যেকোনো বিষয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনতে হলে পরিশ্রম, ত্যাগ স্বীকার আর দীর্ঘ প্রস্তুতি নিতে হয়। এসবের সঙ্গে বাংলাদেশের এই বিজয় ছিনিয়ে আনতে দেশের ৩০ লাখ মানুষকে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে, তিন লাখেরও বেশি মা-বোনকে নিজের ইজ্জত দিতে হয়েছে। এই বিজয়টা দেশের বিজয়, এই বিজয়টা দেশকে দখলদার পাকিস্তানি সেনা সদস্যদের হাত থেকে মুক্ত করার বিজয়, এই বিজয় দেশের তৎকালীন সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিজয়। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের মানুষ এই বিজয়ের ৪৪ বছর পূর্তি উদ্যাপন করবে। বিগত কয়েক বছরের মতো এবারও যখন দেশ এই বিজয় দিবস পন করবে তখন যে দলটির নেতৃত্বে দেশের মানুষ একাত্তরে দেশকে মুক্ত করতে যুদ্ধে গিয়েছিল, সেই দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায়। এই কয়েক বছর এটি অনেকটা বাংলাদেশের মানুষের বাড়তি পাওনা, কারণ ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে ছিল। ১৭ বছর এ দেশকে অনির্বাচিত সরকার শাসন করেছে (১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ ও ২০০৬ থেকে ২০০৮)। এই দীর্ঘ সময়ে নিয়মমাফিক স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস পালন করা হয়েছে ঠিক; কিন্তু তাতে এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিনের মূল অনুভূতি বা স্পিরিট উপস্থিত ছিল না।
অপরাজেয় বাংলাদেশ আমার অহংকার
প্রতিবছর বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবস সামনে রেখে বিভিন্ন ব্যক্তি, দল ও গোষ্ঠী হিসাব-নিকাশ করতে বসে যায় কেমন আছে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত বিধৌত আমাদের এই বাংলাদেশ? সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে এর বিচার-বিশ্লেষণ করে নিজেদের বক্তব্য উত্থাপন করেন। সরকারে যাঁরা থাকেন তাঁরা অনেক অর্জন দেখতে পাবেন। বিরোধী দলে যাঁরা থাকেন তাঁরা কমবেশি নিজেদের আমলের অর্জনগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করবেন, বলবেন ক্ষমতায় আরো কিছুদিন থাকতে পারলে এই অর্জনটুকু আরো একটু বেশি হতো। ক্ষমতাসীন আর ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলের বাইরে আরো কিছু দল আছে, যাদের আমি নাম দিয়েছি সুজন সখি পার্টি। তারা সব সময় জোর গলায় বলবে কী অর্জন করতে পারত বাংলাদেশ, কী অর্জন করেছে তা নয়। তাদের সঙ্গে সুর মেলাবে কিছু সুধী ব্যক্তি আর মিডিয়া। ২০০৬ সালের কথা। তখন বিশ্বের বেশির ভাগ শিল্পোন্নত দেশেই অর্থনৈতিক মন্দা চলছে বা শুরু হয়েছে। একজন বিজ্ঞ সুধী একটি বেসরকারি টিভির রাতের একটি টক শোতে বললেন, এই অর্থনৈতিক মন্দা বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে, তবে এই মন্দা বাংলাদেশে আসবে দেরিতে আর যাবে দেরিতে। সেই মন্দা বাংলাদেশকে তেমন একটা স্পর্শ করে না। দেশের বার্ষিক গড় আয় ৬ শতাংশের ওপর। বাংলাদেশ ছাড়া এমন অবিশ্বাস্য উন্নয়ন ধরে রাখতে পেরেছিল শুধু শ্রীলঙ্কা। তারপর এলো এক-এগারো। সেই বিশেষজ্ঞ ধরনা দিলেন সেনাছাউনিতে ফখরুদ্দীন সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার জন্য। জুটল বিদেশে একটি দূতের চাকরি। তাতেই তিনি বেশ উৎফুল্ল। তবে বাংলাদেশকে কেন সেইবারের মন্দা তেমন একটা ক্ষতি করতে পারেনি তা তিনি কখনো আর খুলে বলেননি। এটি শুধু একটি ঘটনা, যেখানে এসব ব্যক্তি বাংলাদেশে সব সময় গ্লাসের অর্ধেকটা শুধু খালি দেখেন এবং নানা ফন্দি-ফিকিরে ঘোরেন।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সুদূর লন্ডন হয়ে দিল্লিতে সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি করে। বিমান ঢাকার আকাশে চক্কর মারছে। কারণ ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানের বৈমানিক বুঝতে পারছেন না তিনি বিমান কোথায় এবং কিভাবে অবতরণ করাবেন। কারণ তখন বিমানবন্দর এলাকা লাখো মানুষের পদভারে মুখরিত। মহানায়ক দেশে ফিরছেন। তাঁকে দেখার এই বিরল সুযোগ কি আর হাতছাড়া করা যায়? বঙ্গবন্ধু বিমানের সিটে বসে মাথা নিচু আর চোখ বন্ধ করে চিন্তায় মগ্ন। তাঁর সফরসঙ্গীদের একজন ছিলেন ফারুক চৌধুরী, যিনি পরবর্তীকালে পররাষ্ট্রসচিব হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি লিখেছেন, 'বঙ্গবন্ধুকে বলি, নিচে তাকিয়ে দেখুন। তিনি জানালার বাইরে তাকিয়ে বিমানবন্দর এলাকায় (তেজগাঁও) এত বিপুল জনসমাগম দেখে শুধু একটি বাক্য উচ্চারণ করেন- এত মানুষকে খাওয়াব কী?' বঙ্গবন্ধু একটি সম্পূর্ণ যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ফিরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বিমান থেকে নেমে একটি অভূতপূর্ব সংবর্ধনা পেয়েছিলেন এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন। এর সবই ছিল বাঙালির চিরায়ত আবেগের বহিঃপ্রকাশ; কিন্তু দেশ পুনর্গঠনে আবেগ খুব বেশি কাজ করে না। সেখানে প্রয়োজন বাস্তবতার নিরিখে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ। সেটি বঙ্গবন্ধু ঠিকই উপলব্ধি করেছিলেন। কোনো সময়ক্ষেপণ না করে তিনি পরদিন ১১ জানুয়ারি অস্থায়ী শাসনতান্ত্রিক আদেশ জারি করেছিলেন ও রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন এবং মন্ত্রিসভায় ব্যাপক রদবদল করেন। বঙ্গবন্ধুর অনেক গুণের মধ্যে একটি বড় গুণ ছিল, তিনি ঠিক বুঝতে পারতেন কাকে দিয়ে কী কাজ হবে। বাংলাদেশের পুনর্গঠন পর্যায়ে একটি বড় সমস্যা ছিল, সরকার পরিচালনা করার জন্য দক্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তার বড় অভাব। অখণ্ড পাকিস্তানের ২৩ বছরে বাঙালি কখনো পাকিস্তানের প্রশাসনে প্রবেশ করার তেমন একটা সুযোগ পায়নি। একাত্তরে সারা পাকিস্তানে পূর্ণ সচিব ছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন। বেসামরিক প্রশাসনের ৮৪ শতাংশ দখলে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের। সেনাবাহিনীর মাত্র ৫ শতাংশ সদস্য আসতেন পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) থেকে। সে সময় পাঞ্জাব ছাড়া পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশও এমন বৈষম্যের শিকার হয়েছিল। পাকিস্তানের আমলাতন্ত্র ছিল অনেকটা সম্পূর্ণভাবে পাঞ্জাবিদের নিয়ন্ত্রণে। আমলাতন্ত্রের যতই সমালোচনা করা হোক, আমলা ছাড়া তো প্রশাসন চলবে না। এই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাটি বঙ্গবন্ধু সমাধান করেছিলেন যে স্বল্পসংখ্যক অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি আমলা বা দক্ষ প্রশাসক জীবিত ও কর্মক্ষম ছিলেন তাঁদের কাজে লাগিয়ে। বঙ্গবন্ধু ঠিকই বুঝেছিলেন, দেশ পুনর্গঠনের জন্য সঠিক পরিকল্পনার কোনো বিকল্প নেই। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ২০ দিনের মাথায় তিনি গঠন করেছিলেন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশন। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এই কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রধানমন্ত্রী (বঙ্গবন্ধু) আর ডেপুটি চেয়ারম্যান করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ ড. নুরুল ইসলামকে (পূর্ণ মন্ত্রীর পদমর্যাদায়)। সদস্য করা হয়েছিল ড. রেহমান সোবহান, ড. মোশাররফ হোসেন আর ড. আনিসুর রহমানকে। তাঁরা সবাই বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার অর্থনৈতিক বিষয়গুলো প্রণয়নে যথেষ্ট অবদান রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সময় যে কয়টি মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে, তাতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যোগ্যতা, দক্ষতা আর দেশপ্রেমকে। ১৯৭৩ সালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে পরিকল্পনা কমিশনে একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। কিছুদিন পর তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নিয়ে চলে যান।
বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার একজন সদস্য ছিলেন বিজ্ঞান, কারিগরি ও আণবিক শক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ড. মফিজ চৌধুরী। তিনি তাঁর গ্রন্থ 'বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী সভা'য় বিবৃত করেছেন কতটুকু বিশ্বাস আর আস্থা নিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁদের ওপর দেশ গঠনের এই গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। তখন সারা দেশের বিদ্যুৎব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময় সারা দেশের বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থাকে অকেজো করে দিয়েছিলেন আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা। সেই ব্যবস্থাকে আবার পুনঃস্থাপন করার জন্য খুঁজে খুঁজে আনতে হয়েছিল অনেক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও শ্রমিককে। বুকে এক অসাধারণ দেশপ্রেম নিয়ে তাঁরা স্বল্পতম সময়ে দেশের বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থাকে পুনর্বহাল করেছিলেন। তখন সারা দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৩০০ মেগাওয়াটের কম। সেই বাংলাদেশ এখন আট হাজার থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুতের জোগান দিতে সক্ষম। বাংলাদেশে এখন ৬০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারে। এই ৪৪ বছরে দেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে।
৪৪ বছর আগে যে বাংলাদেশ তার নবযাত্রা শুরু করেছিল, তার যোগাযোগব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। একাত্তরে পলায়নরত পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর ভাসমান মাইন (এক ধরনের শক্তিশালী বোমা) ফেলে সম্পূর্ণ অকেজো করে গিয়েছিল অথবা দেশের দুটি বৃহত্তম রেল সেতু, হার্ডিঞ্জ আর ভৈরব সম্পূর্ণ ধ্বংস করে গিয়েছিল, যাতে বাংলাদেশের অর্থনীতি সহজে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। একটি শার্টের কাপড়ের জন্য (রিলিফ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে আমাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের এবিসি টেলিভিশনের জন্য সায়মন ড্রিং একাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। ওই চিত্র দেখলে কিছুটা বোঝা যাবে, কেমন ছিল সেদিনের বাংলাদেশ। তখন বিশ্বের অনেক বাঘা বাঘা বিশ্লেষক বলেছিলেন, এই নতুন দেশটির সার্বিকভাবে যে করুণ অবস্থা, তার টিকে থাকাটা হবে এক বিস্ময়। ১৯৭২ সালে বিশ্বব্যাংক তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছিল, 'স্বাধীনতা অর্জন করলেও অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে সব সময় নির্ভর করতে হবে বিদেশি সাহায্যের ওপর।' সেই প্রতিবেদনের রেশ ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তিটি করে বলেছিলেন, 'Bangladesh is a Basket Case, বাংলাদেশ হচ্ছে একটি তলাবিহীন ঝুড়ি। তাদের যতই সাহায্য দেওয়া হোক, কোনো কাজে আসবে না।' বাংলাদেশ শুধু টিকে থাকেনি, বর্তমানে এটি উন্নয়নশীল অন্য দেশগুলোর জন্য এক মডেল হিসেবে বিশ্বদরবারে স্বীকৃত। বাংলাদেশ এখন কোনো মাপেই আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। ১৯৭২ সালে বা তার আগেকার সময় এ দেশ তার সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের দুই-তৃতীয়াংশ উৎপাদন করতে সক্ষম ছিল। বাকিটা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সংগ্রহ করতে হতো অথবা খয়রাত হিসেবে অন্য দেশ থেকে মিলত। এখন বাংলাদেশ শুধু তার ১৬ কোটি মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদনই করে না, কয়েক সপ্তাহ আগে আমরা শ্রীলঙ্কায় এক লাখ টন চাল রপ্তানি করার চুক্তি স্বাক্ষর করেছি। চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে বর্তমানে চতুর্থ স্থান অধিকারী। এই দীর্ঘ ৪৪ বছরে আমাদের আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমেছে ৩০ শতাংশ। এই অভূতপূর্ব অর্জনের জন্য অনেকের অবদান আছে সত্য, তবে সবচেয়ে বেশি অবদান দেশের প্রথম সরকারের, যে সরকার এই নতুন দেশটির বুনিয়াদ রচনা করেছিল। অবদান আছে বাংলার কৃষকের, যে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তার জমিতে ফসল ফলায়। মৎস্যসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বে চতুর্থ। বলতে গেলে, খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশে একাত্তর-পরবর্তীকালে এই বিপ্লব ঘটে গেছে। যে দেশ নিজের খাদ্য নিজে উৎপাদন করতে পারে, সেই দেশের চেয়ে সুখী দেশ অন্য কোনো দেশ হতে পারে না। এখন বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই বলতেন না, 'এত মানুষকে খাওয়াব কী?'
ব্যাংকের শূন্য ভল্ট নিয়ে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু। কেউ বিদেশে গেলে পাসপোর্টে পাঁচ ডলার এন্ডোর্স করার অনুমোদন ছিল। বর্তমানে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৩ বিলিয়ন ডলার। পাসপোর্টে স্বাভাবিক নিয়মে পাঁচ হাজার ডলারের অনুমোদন নেওয়া যায়। বাড়তি নিতে হলে শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন লাগে। বিদেশ থেকে গত বছর প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ২২.৫ বিলিয়ন ডলার, যা ৪৪ বছর আগে অকল্পনীয় ছিল। রপ্তানি করার মতো কিছু পরিমাণের চা এবং পাটজাত পণ্য ছাড়া আর কিছু ছিল না এই বাংলাদেশের। আবার যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু দেশ কিউবাতে কয়েক শ বেল পাটের বস্তা রপ্তানি করায় ১৯৭৪ সালে কিসিঞ্জারের নির্দেশে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের জন্ম দিয়েছিল। সেই দুর্ভিক্ষে কয়েক হাজার বঙ্গসন্তানের মৃত্যু হয়েছিল। তেতাল্লিশের বাংলার মন্বন্তরের জন্য ঐতিহাসিকরা ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে দায়ী করেন। সেই দুর্ভিক্ষে কয়েক লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। এটি ছিল এক ধরনের গণহত্যা। ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের জন্য সহজেই যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করা যায়। এটি এখন অনেকটা নিশ্চিত- বাংলাদেশে আর কখনো দুর্ভিক্ষ হবে না। ১৯৭২-৭৩ সালে বাংলাদেশের বাজেটের পরিমাণ ছিল ৭৮২ কোটি টাকা। চলতি বছর এর পরিমাণ ছিল সোয়া দুই লাখ কোটি টাকা। সামনের বছর সেই বাজেটের আকার তিন লাখ কোটি টাকা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই বাজেটের সিংহভাগ আসে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। আমাদের বাজেটে বিশ্বব্যাংকের মতো অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান আর দাতা সংস্থার অবদান এখন ১০ শতাংশের কম। বিশ্বব্যাংকের ব্ল্যাকমেইলের শিকার না হয়ে বাংলাদেশ এখন নিজের অর্থায়নেই পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ কর্মযজ্ঞ হাতে নিতে পারে।
৪৪ বছর আগের বাংলাদেশ আর ২০১৪ সালের বাংলাদেশের মধ্যে এখন আকাশ-পাতাল তফাত। যে দেশে আমাকে একটি জামা বানাতে রিলিফের কাপড়ের জন্য লাইন দিতে হয়েছিল, সেই দেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। দেশের রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। বাংলাদেশে এখন আর কেউ খালি গায়ে থাকে না। উত্তরবঙ্গে আর মঙ্গা হয় না। শীতের কাপড়ের অভাবে কেউ মারা যায় না। ওষুধ তৈরিতে এখন বাংলাদেশ শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণই নয়, প্রায় ৮০টি দেশে আমাদের দেশের ওষুধ রপ্তানি হয়। যেদিন বাংলাদেশ পাকিস্তানে দুটি সমুদ্রগামী জাহাজ রপ্তানি করল সেদিন কার না গর্ব হয়েছে?
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান শ্যাস ও অর্থনীতিবিদ জন ও'নিল অনুন্নত দেশগুলোর ওপর এক সমীক্ষা চালিয়ে বলেছেন, একবিংশ শতকে প্রথম ধাপে চারটি অর্থনৈতিক পরাশক্তির আবির্ভাব হবে। এগুলো হচ্ছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন। এরপর আরো ১১টি দেশ তাদের পথ অনুসরণ করবে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। উল্লেখ্য, এই ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ হচ্ছে একমাত্র দেশ, যার গায়ে এখনো স্বল্পোন্নত দেশের লেবেল লাগানো আছে। তেমন একটি দেশ এই ১১টি দেশের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় বাংলাদেশের সম্ভাবনা। বিশ্বব্যাংক তাদের ২০১৩ সালের বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, 'বাংলাদেশের উন্নয়ন একটি অমীমাংসিত বিস্ময়।' সুধীরা স্বীকার না করলেও বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশ হবে বলে বিশ্বাস। বাংলাদেশের কাহিনী বিন্দু থেকে বৃত্ত হওয়ার কাহিনী। বাংলাদেশের উন্নয়নের এই ধারা ধরে রাখতে হলে চাই সঠিক ও যোগ্য লোককে রাষ্ট্রের সঠিক কাজে লাগানো এবং দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করে সব সময় দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে দেশ পরিচালনার ভার ন্যস্ত করার অঙ্গীকার করা, যাঁরা দেশ গঠনে নিম্ন বা মধ্যমেধার বদলে মেধাসম্পন্ন দক্ষ মানবসম্পদ কাজে লাগাতে পারবেন। সুজন সখি পার্টি আর সুধীরা তাঁদের বাগাড়ম্বর করতেই থাকবেন। তার মধ্যেই বাংলাদেশ তার পথ খুঁজে নেবে।
লেখক : সাবেক উপাচার্য
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ( কালের কণ্ঠ )
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন