বেগম জিয়া কি নিজের অবস্থান বুঝতে পারছেন?
16 November 2014, Sunday
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বেগম জিয়া বেশ কিছুদিন অনেকটা নীরব ছিলেন। গত মাস দু’এক ধরে তিনি আবার সরব হয়েছেন এবং ইদানীং কয়েক সপ্তাহ পর পর তাঁর গণসংযোগের অংশ হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় জনসভা করছেন। সেইসব জনসভায় অনেক ক্ষেত্রে তাঁর নিজের দলের নেতাকর্মীদের চেয়ে জামায়াত-শিবিরের আধিক্য লক্ষণীয়। যথারীতি জামায়াত নেতারা এইসব জনসভায় দাঁড়িয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দ-প্রাপ্ত তাদের ক্রিমিনাল নেতাদের মুক্তি দাবি করেন। এটা অনেকটা স্বাভাবিক, কারণ মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদের বিচার শুরু হওয়ার পর হতে দল হিসেবে বর্তমানে জামায়াত এখন অনেকটা কোণঠাসা। ইতোমধ্যে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। তাদের মন্ত্রগুরু গোলাম আযমের ৯০ বছর সাজা ভোগ করাকালে কারাগারে মৃত্যু হয়েছে।
সুপ্রীমকোর্টের আপীলের চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির দ-াদেশ কার্যকরের অপেক্ষায় আছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নিজামীসহ আরও কয়েকজনের রায় হয়েছে। সকলেরই মৃত্যুদ-। অবস্থা এমন চলতে থাকলে অচিরেই জামায়াতের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে। আপাতদৃষ্টিতে তাদের প্রধান মিত্র বিএনপি জামায়াত হতে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার ভান করছে বলে মনে হচ্ছে। এটি তাদের রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বেশ কিছুদিন ধরে বেগম জিয়া হতে শুরু করে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ অনেকটা কাতর কণ্ঠে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন দাবি করে আসছেন। বিএনপি মনে করেছিল যেহেতু তারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি এবং তাদের ভাষায় আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতায় গেছে সুতরাং বহির্বিশ্বে বর্তমান সরকারের তেমন একটা গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। সুযোগ পেলেই তারা বলে আসছে বর্তমান সরকার একটি ‘অবৈধ’ সরকার, কারণ বিএনপি আর তার মিত্ররা এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। তবে অনেকটা শেখ হাসিনার বিভিন্ন সাহসী পদক্ষেপ ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্যের কারণে বিএনপির সকল প্রত্যাশাই ব্যর্থ হয়েছে।
চীন, জাপান, রাশিয়া, ভারত, ব্রিটেন, ইইউ, জাতিসংঘ এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশের নির্বাচনকে মেনে নিয়েছে। মাঝে মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বা ইইউ শুধু বলে, বাংলাদেশে সকলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হওয়া উচিত। তবে বলেন না এটি একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন হতে হবে বা বর্তমান সরকার অবৈধ। সাংবিধানিকভাবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন হয়েছে। সেই নির্বাচনে শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার চেষ্টা করেছেন; কিন্তু বিএনপি তাতে তো সাড়া দেয়ইনি বরং ঘোষণা করেছিল তারা এই নির্বাচন প্রতিহত করবে, যা তারা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
২০১৩ সালের মার্চ মাসে আফ্রিকার কেনিয়ায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রার্থী ছিলেন সেই দেশের ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার উহুরু কেনিয়াট্টা। তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করার অভিযোগ ছিল। পশ্চিমের প্রায় সকল দেশ তাঁকে নির্বাচিত না করার জন্য কেনিয়ায় ব্যাপক প্রচার চালিয়েছিল। তারা সেই দেশের ভোটারদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছিল, ‘নির্বাচনে নাগরিকদের পছন্দের একটি পরিণতি আছে।’ সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে কেনিয়াট্টাকে ভোট না দিতে এই পশ্চিমা কূটনীতিকরা আহ্বান জানান। অভিযোগ আছে, তারা কেনিয়ায় বিশাল অঙ্কের অর্থও ব্যয় করেছিল। সেখানে কর্মরত এনজিওগুলোকে টাকা পয়সা দিয়ে হাত করে দেশটিতে একটি অশান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টাও করেছিল; কিন্তু তা ধরে ফেলে কেনিয়ার সরকার। অনেকটা ’৭৩ সালের চিলির পুনরাবৃত্তি ঘটানোর প্রচেষ্টা। সেই সময় যুক্তরাষ্ট্র ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে চিলির নির্বাচিত মার্কসবাদী প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দেকে সামরিক ক্যু ঘটিয়ে উৎখাত করেছিল।
কেনিয়ার কাহিনী আলাদা। নির্বাচনে বিজয় লাভ করার পর এই কূটনীতিকরাই আবার কেনিয়াট্টার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে কেনিয়ার নির্বাচনের পার্থক্য হচ্ছে সেখানে সকল দল এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং কেনিয়াট্টাকে সে দেশের জনগণ সামান্য ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী করে। সেখানে বিরোধী দলসমূহ লাগামহীন সন্ত্রাসের মাধ্যমে নির্বাচন বানচাল বা প্রতিহত করার চেষ্টা করেনি। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা কূটনীতিক বা দেশগুলোর অবস্থাও অনেকটা একই। বিশ্বব্যাংক চেয়েছিল পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে বাংলাদেশকে ব্ল্যাকমেইল করতে। তাতে তারা ব্যর্থ হয়ে এখন অজুহাত খুঁজছে কিভাবে আবার তারা এর অর্থায়নে ফিরতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এখনও তৈরি পোশাক শিল্পে জিএসপি সুবিধা নিয়ে খেলছে। আসলে পশ্চিমা দেশগুলো বুঝতে পারে না ২০১৪ সালের বাংলাদেশ আর সত্তরের দশকের বাংলাদেশ এক না।
বেগম জিয়ার মাঝে মধ্যে যে জনসভার বক্তৃতা তা অনেকটা দলকে টিকিয়ে রাখার জন্য। তিনি হয়ত বুঝতে পারছেন এভাবে চলতে থাকলে বিএনপির অবস্থাও অচিরেই অনেকটা মুসলিম লীগের মতো হবে। তারেক রহমানের ওপর যা ভরসা ছিল তাও এখন অনেকটা নিভে গেছে। লন্ডনে বসে তিনি সম্প্রতি যে সকল ফতোয়া দিচ্ছেন তাতে তিনি একজন রাজনৈতিক ক্লাউনে পরিণত হয়েছেন। বেগম জিয়ার চার পাশে যারা আছেন তারা প্রায় সকলেই সামরিক বেসামরিক আমলা। তাদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। তাদের যদি সেই দূরদর্শিতা থাকত তাহলে তারা বিগত নির্বাচনে বেগম জিয়াকে শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে সংলাপে যেতে পরামর্শ দিতেন। শেখ হাসিনা যদি তাদের দাবি মেনে না নিতেন তাহলেও তাদের উচিত ছিল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা এবং এই নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে তারা সংসদ হতে পদত্যাগ করতে পারতেন। তারপর তারা কোন আন্দোলনের সূত্রপাত করলে তাতে নিশ্চিতভাবে সাড়া মিলত। এখন বেগম জিয়া আর তাঁর পারিষদরা আন্দোলন আন্দোলন করেন; কিন্তু জনগণ তাতে কোন সাড়া দেন না, কারণ তারা নির্বাচনের আগে আন্দোলনের নামে সেই ভয়াবহ সহিংসতার যুগে ফিরে যেতে চান না। বেগম জিয়া তাঁর জনসভায় এখন অনেকটা ক্ষীণ গলায় বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছাড়েন; কিন্তু তা হালে পানি পায় না। সম্প্রতি কিশোরগঞ্জের জনসভায় তিনি দলীয় কর্মীদের ঢাল তলোয়ার নিয়ে রাজপথে থাকতে বলেছেন। গত বছর কোরবানির আগে সাদেক হোসেন খোকা দলের কর্মীদের বলেছিলেন, কোরবানির পর যেন তারা কোরবানির দা-কুড়াল তুলে না রেখে তা নিয়ে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত থাকে। তেমনটা হয়নি। ৫ জানুয়ারির পরও চারদিকে চুপচাপ। সাধারণ জনগণ বর্তমানে আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। তারা বেগম জিয়ার আমলের দুঃশাসন দেখেছেন।
জনসভায় যা বলুন না কেন বেগম জিয়া সম্ভবত রাজনীতিতে তাঁর নাজুক অবস্থা বুঝতে পারছেন।
সম্প্রতি তিনি তাঁর দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন এবং সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে তাঁর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। বলেছেন, নির্বাচনের পর তাঁর আন্দোলনে না থাকাটা ভুল ছিল। দলের সিনিয়র নেতারা আন্দোলনের ডাক দিলে রাজপথে না নামার কারণে তিনি বেশ অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। দলের ঢাকা কমিটি নিষ্ক্রিয় থাকায় তিনি হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তবে বেগম জিয়া ভুলে গেছেন যে নিজ বাড়ির সামনে একটি বালির ট্রাক তার আন্দোলন থামিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
তাঁর সঙ্গে শেখ হাসিনার তফাত হচ্ছে শেখ হাসিনাকে যখন জঙ্গীদের হামলায় গুরুতর আহত ড. হুমায়ুন আজাদকে সিএমএইচে দেখতে যেতে বাধা দেয়া হয়েছিল, শেখ হাসিনা সেনানিবাসের জাহাঙ্গীর গেটে নেমে প্রায় তিন কিলোমিটার হেঁটে সিএমএইচে হাজির হয়েছিলেন। নিজের ও দলের পরিস্থিতি বেগম জিয়া কিছুটা আঁচ করতে পারলেও তাঁর দলের অরাজনৈতিক নীতি-নির্ধারকরা এখনও তাদের পুরনো চিন্তাধারায় রয়ে গেছেন। তারা এখনও বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। এখনও মির্জা ফখরুল আর রুহুল কবির রিজভী দলীয় কার্যালয়ে প্রতি সন্ধ্যায় অর্থহীন বাগাড়ম্বর করেই যাচ্ছেন। একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হলে দেশে এক বা একাধিক শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন। সেই ঘাটতি বাংলাদেশে বামপন্থী দলগুলো পূরণ করতে পারত।
কিন্তু বামপন্থী দলগুলোর বাংলাদেশে আর কোন ভবিষ্যত আছে বলে মনে হয় না। বিএনপি এই শূন্যস্থান পূরণের চেষ্টা করতে পারে। তবে তার জন্য তার পুরো খোলনলচে পাল্টাতে হবে। আমলানির্ভর রাজনৈতিক দলের কথা চিন্তা না করে রাজনৈতিক নেতাকর্মীনির্ভর দল গড়ে তুলতে হবে। জামায়াতের শক্তির ওপর নির্ভর করে আগামী দিনের রাজনৈতিক পরিকল্পনার ছক আঁটলে সর্বনাশ অনিবার্য। সামনের দিকে সঠিকভাবে চলতে হলে নেতৃত্বেও থাকা চাই দূরদর্শিতা যা এখন বেগম জিয়া অথবা দলের অন্য কারও তেমন একটা আছে বলে মনে হয় না। বেগম জিয়া যদি নিজের এবং দলের বাস্তব অবস্থা নির্মোহভাবে চিন্তা করেন তা হলে দলটি টিকতে পারে। না হলে অদূর ভবিষ্যতে বিএনপির মুসলিম লীগ হওয়া হতে কেউ রুখতে পারবে বলে মনে হয় না। অনেকটা গুডবাই বিএনপি। রাজনীতির জন্য তা ভাল না খারাপ হবে তা আগামী দিনের রাজনীতিই বলতে পারে।
( জন কণ্ঠ )
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন