কামারুজ্জামানের রায় বাস্তবায়ন কি ঝুলে গেল?
15 November 2014, Saturday
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির দণ্ডাদেশের রায় বাস্তবায়ন কি ঝুলে গেল? এমন প্রশ্ন ও সন্দেহ এখন সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে যারা এই রায় দ্রুত বাস্তবায়ন দেখতে চায় তাদের মুখে মুখে। কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিকের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হচ্ছিল। তাঁরাও একই আশঙ্কা প্রকাশ করলেন। আরো বললেন, সরকারের ওপর নিশ্চয় বিদেশি কোনো শক্তির চাপ আছে; নতুবা যে রায় গত ৩ তারিখ ঘোষিত হলো, তা বাস্তবায়নে এত দিন লাগবে কেন? যুক্তি হিসেবে তাঁরা বললেন, সাঈদীর রায় যেভাবে সুপ্রিম কোর্টে বদলে গেল তা থেকে কি কিছু আঁচ করতে পারছেন না? সাংবাদিক বন্ধুদের বলি, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ওপর আমাদের এখনো আস্থা আছে। সুপ্রিম কোর্ট ট্রাইব্যুনালের রায়ের কাগজপত্র পর্যালোচনা করে যা যৌক্তিক মনে করেছেন, সেই মতে রায় দিয়েছেন। এতে অন্য কিছু ভাবার কোনো অবকাশ নেই। তাঁদের আরো বলি, কাদের মোল্লার রায় বাস্তবায়নের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে দৃঢ়তা দেখিয়েছেন, যেভাবে তিনি আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলা করেছেন, জাতিসংঘ মহাসচিব থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির অনুরোধ অগ্রাহ্য করেছেন, তাতে আমাদের আশান্বিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। মনে হলো না আমার দুই সাংবাদিক বন্ধু আমার কথায় তেমন আশান্বিত হলেন। তাঁদের কথা, ভুলে যাবেন না জামায়াত এই বিচার ঠেকানোর জন্য দেশে ও বিদেশে কোটি কোটি ডলার খরচ করছে।
বাসায় এসে দেখি জামায়াতের বিদেশি আইন উপদেষ্টা ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত ইহুদি ব্যারিস্টার টোবি ক্যাডমেনের ফার্ম বেডফোর্ড রো ইন্টারন্যাশনালের ১০ পৃষ্ঠা দীর্ঘ এক প্রেস রিলিজ ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্যাডমেন বাংলাদেশে এসে তাঁর জামায়াতি যুদ্ধাপরাধী মক্কেলদের জন্য যা যা আদালতে বলতেন, তার সবটুকুই মোটামুটি ওই প্রেস রিলিজে স্থান পেয়েছে। বার কাউন্সিলের অনুমতি না মেলাতে তিনি বাংলাদেশে আসতে পারেননি। ট্রাইব্যুনাল থেকে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকার্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য যা যা লেখার প্রয়োজন, তার সবটুকুই ক্যাডমেন তাঁর প্রেস রিলিজে উল্লেখ করেছেন। একই দিন, অর্থাৎ সোমবার, কামারুজ্জামানের ছেলে হাসান ইকবাল সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তাঁর বাবাকে অন্যায়ভাবে ফাঁসির দণ্ড দেওয়া হয়েছে। তিনি এই রায়কে 'ন্যায়ভ্রষ্ট' রায় হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, তাঁরা রিভিউ করার সুযোগ পেলে তাঁর বাবা খালাস পেয়ে যাবেন। হাসান ইকবালের সংবাদ সম্মেলন প্রায় সব কয়টি গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। আমাদের সব গণমাধ্যম সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। অভিযোগ আছে, জামায়াতের কোটি কোটি টাকার একটি বড় অংশ দেশের ভেতর ব্যয় হয়েছে।
যদিও কামারুজ্জামানের ছেলে একজন আইনজীবী, কিন্তু এর আগে তাঁকে কখনো কোনো সংবাদ সম্মেলন করতে দেখা যায়নি। আর এই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তিনি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া রায়কে 'ন্যায়ভ্রষ্ট' আখ্যা দিয়েছেন; আদালতকে অনেকটা চ্যালেঞ্জ করেছেন; তা-ও আদালত প্রাঙ্গণে বসে। বর্তমানে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতির দায়িত্বে আছেন বেগম জিয়ার উপদেষ্টা খোন্দকার মাহবুব হোসেন; যিনি একই কথা কামারুজ্জামানের রায়ের পর থেকে বলে আসছেন। কামারুজ্জামানের রায় সম্পর্কে তাঁর ছেলের এহেন মন্তব্য আদালত অবমাননা হবে কি না তা আদালতই নির্ধারণ করতে পারেন। জামায়াত তাদের নেতাদের ট্রাইব্যুনাল অথবা সুপ্রিম কোর্টে বিচারের জন্য সব ধরনের আইনি লড়াই চালিয়ে যায়। কিন্তু রায় যখন নিজেদের পক্ষে যায় না, তখন বলে, এই রায় মানি না। তখন তারা দেশে চরম নৈরাজ্যের আরেকটি নতুন অধ্যায় চালু করে।
আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সরকার যখন দালাল আইন করে ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর ও দালালদের আটক ও বিচার করা শুরু করে, তখন সরকার এই আইনে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করার জন্য সরকারের পক্ষে অন্যতম প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল এই খোন্দকার মাহবুব হোসেনকে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর আগে এই দালালদের বিচার করার জন্য দেশে ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল। খোন্দকার মাহবুব হোসেন ও তাঁর সহকর্মীদের চেষ্টায় তিন হাজার মামলার নিষ্পত্তি হয় এবং মৃত্যুদণ্ডসহ ৭৫২ জনের সাজা হয়। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর জিয়া ক্ষমতা দখল করে ১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্ট সেই দালাল আইন বাতিল করে সব সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে জেল থেকে মুক্ত করে দেন। তাঁদের একজন শাহ আজিজ, যাঁকে জিয়া পরবর্তীকালে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন; আর মশিউর রহমান যাদু মিয়াকে বানিয়েছিলেন সিনিয়র মন্ত্রী। বিচারের জন্য অপেক্ষমাণসহ মোট ১১ হাজার পাকিস্তানি দালাল আর মানবতাবিরোধী অপরাধীকে জিয়া মুক্ত করে দিয়ে তাদের অনেককে নিয়ে তিনি পরবর্তীকালে বিএনপি গঠন করেন।
কামারুজ্জামানের রায় বাস্তবায়ন কি ঝুলে গেল?
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য জাতি দীর্ঘ ৪৩ বছর অপেক্ষা করেছে। তাদের এই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য একজন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আসতে হয়েছে। কিন্তু এখন বাস্তবে দেখা যাচ্ছে অনেকটা 'শেষ হইয়াও হইল না'র মতো অবস্থা। পরিস্থিতিতে আরো ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছে আইনমন্ত্রী আর অ্যাটর্নি জেনারেলের বিভ্রান্তিমূলক কিছু বক্তব্য। একজন বলেন, এক সপ্তাহ পার হলে রায় কার্যকর হবে। অন্যজন বলেন, রায়ের শর্ট কপির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এটি কারাগারে পৌঁছলে রায় কার্যকর শুরু হবে। রায়ের রিভিউ সম্পর্কে একজন বলেন, রিভিউর কোনো সুযোগ নেই। অন্যজনের বক্তব্য, রিভিউ করতে পারেন, তবে তা গ্রহণ করা না-করা একান্তভাবে আদালতের এখতিয়ার। একজন আবার বলেন, ফাঁসির রায় বাস্তবায়ন করার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করার জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জানামতে, এই নির্দেশ দেওয়ার এখতিয়ার একান্তভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। এসব যখন চলছে, তখন জামায়াতের অর্থে কোনো কোনো আন্তর্জাতিক মিডিয়া এই মামলা ও রায়ের বিরুদ্ধে নতুন করে প্রচারণা শুরু করেছে, যার মধ্যে কাতারভিত্তিক আল জাজিরা টিভি অন্যতম। এই টিভি চ্যানেলটি যুক্তরাষ্ট্র আর তার মিত্রদের ইরাক দখল সমর্থন করেছে। হোসনি মুবারক আর গাদ্দাফির ক্ষমতাচ্যুতিতে ইন্ধন জুগিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গিবাদ উত্থানে সহায়তা করেছে। সাদ্দাম হোসেন আর গাদ্দাফি আর যাই হোন, জঙ্গিবাদের সমর্থক ছিলেন না।
এমনিতে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে। একেকটা বিচার শেষ হতে দীর্ঘ সময় লাগছে। ট্রাইবু্যুনালে রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে কয়েক মাস। তারপর তা যাচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে। সেখানে আবার অপেক্ষার পালা। একসময় শুনানি শেষ হয়। তারপর আবার রায়ের জন্য অপেক্ষা। অনেক সময় সেই অপেক্ষা যেন আর শেষ হয় না। মাঝখানে আবার সাঈদীর মতো রায় উল্টে গেলে ঘটে ছন্দপতন। এর মধ্যে ৯০ বছর সাজাপ্রাপ্ত জামায়াতের মন্ত্রগুরু গোলাম আযমের হাসপাতালে মৃত্যু হয়। তাঁর পরিবার বলে বিদেশে থাকা তিন ছেলে দেশে ফিরলে তাঁকে দফন করা হবে। তারা ঠিকই জানে, এই তিন ছেলে বাবার জানাজায় অংশ নিতে দেশে আসবে না। জামায়াত সরকারকে বোকা বানিয়ে তিন দিন সময় নিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তাদের সব সমর্থক আর ক্যাডারকে জড়ো করে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে বিশাল জানাজার আয়োজন করে জামায়াতকে ৩০ লাখ শহীদ আর দুই লাখ লাঞ্জিত মা-বোনের গালে থাপ্পড় মারার সুযোগ করে নেয়। এসবের মধ্যে শুরু হয়েছে কামারুজ্জামানের ফাঁসির নতুন অধ্যায়, মানুষ যাকে বলছে নতুন নাটক। বড় প্রশ্ন, এই অনাকাঙ্ক্ষিত নাটক কখন শেষ হবে? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য দেশের মানুষকে অপেক্ষা করতে হবে। প্রশ্ন- এই অপেক্ষা কত দীর্ঘ হবে?
লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক
(কালের কণ্ঠ )
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন