আমি অনেকটা নিশ্চিত, পাঠকদের অনেকে শর্মিলা বোসের নাম ভুলে গেছেন। ভুলে যাওয়ারই কথা। কারণ ইতিহাস খলনায়ক আর ইতিহাস বিকৃতিকারীদের মনে রাখে না। নবাব সিরাজদ্দৌলা ১৭৫৬ সালের ২০ জুন ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির কাছ থেকে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ দখল করার পর ১৪৬ জন ইংরেজকে বন্দি করে দুর্গের একটি স্বল্পপরিসর কক্ষে আটকে রাখেন, যার মধ্যে শ্বাস বন্ধ হয়ে ১২৩ জনের মৃত্যু হয় বলে ইংরেজ ঐতিহাসিকরা প্রচার করেন। তাঁরা এটিকে নামকরণ করেছিলেন অন্ধকূপ ট্র্যাজেডি। এই ঘটনার প্রায় ১৬০ বছর পর ১৯১৬ সালের ২০ মার্চ বাঙালি ইতিহাসবিদ অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় কলকাতা ইতিহাস পরিষদের এক সেমিনারে তাঁর গবেষণালব্ধ প্রবন্ধ প্রকাশ করে বলেন, সেই ছোট কক্ষে চেষ্টা করেও তিনি ১৪৬ জন মানুষকে ঠেলেঠুলে ঢোকাতে পারেননি এবং পুরো ঘটনাটিই ছিল নবাব সিরাজদ্দৌলাকে একজন বড়মাপের নৃশংস খলনায়ক বানানোর ইংরেজদের অপচেষ্টা। গত ডিসেম্বরে আমি নিজে সেই স্থানে সরেজমিনে পরিদর্শন করে বুঝেছি, ইংরেজরা কত বড় মাপের ফেরেববাজ ছিল।
এক ঢিলে অনেক পাখি বধ
২০১১ সালে নেতাজি সুভাষ বোসের নাতনি শর্মিলা বোস বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে 'Dead Reckoning : Memories of the 1971 War' শিরোনামে এক গ্রন্থ লিখে সে সময় চারদিকে হইচই ফেলে দেন। শর্মিলা দাবি করেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ ও ভারতে যে ৩০ লাখ মানুষ হত্যা অথবা আড়াই লাখ নারী নির্যাতনের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়, তা একেবারেই অতিরঞ্জিত। তিনি আরো লেখেন, টিক্কা-নিয়াজিসহ পাকিস্তানি জেনারেলরা সাধারণত ভালো মানুষ; কিন্তু বাংলাদেশের যুদ্ধ তাদের অনেককে হিরো থেকে জিরোতে পরিণত করেছে। তিনি দাবি করেন, তাঁর এই গ্রন্থটি গবেষণালব্ধ ও প্রাথমিক তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে রচিত। তাঁর এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় যখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির উইথড্রো উইলসন সেন্টারে রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করছিলেন। তাদের সহায়তায় গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। শর্মিলা বোসের এই গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েন। শর্মিলার বই নিয়ে হইচই হওয়ার কারণ, তিনি নেতাজির নাতনি আর নেতাজি পরিবারের অন্য সবাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাধ্যমতো সহায়তা করেছেন। অক্সফোর্ডশিক্ষিত শর্মিলার জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন শহরে ১৯৫৯ সালের ৪ জুলাই। ১৯৭১ সালে তাঁর বয়স মাত্র ১২ বছর। বইটি প্রকাশের সময় অনেকের সঙ্গে ঢাকার একটি ইংরেজি দৈনিকে শর্মিলার গ্রন্থের সমালোচনা করে আমারও একটি লেখা ছাপা হয়। এই সময় তাঁরই এক সহকর্মী পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত গবেষক আয়েশা সিদ্দিকা এক মন্তব্যে লেখেন, 'শর্মিলার গ্রন্থটি আমার সামনেই লেখা হচ্ছিল। এই সময় তাঁর সঙ্গে একাধিক পাকিস্তানি জেনারেলের যোগাযোগ ছিল এবং তিনি তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত পানাহার করতেন। আমি বুঝতে পারি না, শর্মিলা কেন এমন একটি বিতর্কিত কাজ করেছেন। তবে এটি নিশ্চিত, পাকিস্তানে বইটি বেস্ট সেলার হবে।'
শুরুতে ওপরের কথাগুলো লিখলাম। কারণ গত কয়েক দিনে আমার অনেক শুভানুধ্যায়ী অনুরোধ করেছেন যেন আমি এ কে খন্দকারের সদ্য প্রকাশিত ও তুমুল সমালোচিত গ্রন্থ 'ভেতরে বাইরে' নিয়ে কিছু লিখি। তাঁদের বলেছি, না পড়ে কিছু লেখা ঠিক নয়। প্রথমদিকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে বইটি জোগাড় করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। একজন বিক্রেতা আমাকে জানালেন, তাঁর কাছে ১০ কপি ছিল, তার সব কটিই স্থানীয় একজন জামায়াত কর্মী কিনে নিয়ে গেছেন দলের কর্মীদের মধ্যে বিতরণ করবেন বলে। কয়েক দিন আগে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ সংগ্রহ করি। বইটি পড়ার পর আমার মনে হয়েছে, যাঁরা এই বই নিয়ে শুরু থেকে হইচই করছেন, তাঁদের অনেকেই হয়তো বইটি পড়েননি। এই কথাটি বিশেষ করে বিএনপির নেতা-নেত্রীদের বেলায় বেশি প্রযোজ্য। এম কে আনোয়ার থেকে শুরু করে মির্জা ফখরুল, সবাই মিলে চিৎকার শুরু করে দিলেন, এত দিনে আওয়ামী লীগের থলের বিড়াল বের হয়ে পড়ল, সে জন্য তাদের গায়ে আগুন লেগেছে। বিএনপি নেতা-নেত্রীদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা নিয়ে তেমন একটা উচ্চ ধারণা পোষণ করি না। দু-একটি ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। বিএনপির যাঁরা এই গ্রন্থ নিয়ে এতটা উচ্ছ্বসিত, তাঁরা বইটি পড়লে বুঝতেন, এ কে খন্দকার এক ঢিলে অনেক পাখি বধ করার চেষ্টা করেছেন; যার মধ্যে আছেন তাঁদের নেতা জিয়াউর রহমানও। এ ছাড়া খন্দকারের বধ করার তালিকায় আছে ১. আওয়ামী লীগ, ২. জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, ৩. মুজিবনগর সরকার, ৪. জেনারেল ওসমানী, ৫. মুজিববাহিনী, ৬. মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর সফিউল্লাহ, ৭. ভারতীয় মিত্র বাহিনী, ৯. সাধারণ মুক্তিবাহিনী এবং ১০. ভারত সরকারসহ আরো অনেকে। তাঁর গ্রন্থে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর সক্ষমতা সম্পর্কে বেশ উচ্চ ধারণা পোষণ করেছেন। একাধিকবার তিনি তাঁর শ্বশুরকুল সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অবদানের কথা বলতে ভোলেননি। জানা গেছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুলের পরিবারে এ কে খন্দকার বিয়ে করেছেন (এই তথ্য ভুল হলে ক্ষমা প্রার্থী)। সব বিষয়ে স্বল্পপরিসরে আলোচনা সম্ভব নয়।
এ কে খন্দকার পেশায় একজন বিমানসেনা। ২০ বছর পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন বলে তিনি তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন। বয়স এখন তাঁর ৮৪। সাধারণত এই বয়সে মানুষ স্মৃতিভ্রংশতা বা ডেমেনসিয়া (Dementia) নামক রোগে ভোগেন। এই রোগ হলে মানুষের স্মৃতি দুর্বল হতে শুরু করে। অনেক সময় ঘরের মানুষকেও চিনতে পারেন না। আমার মার বয়স এখন ৯১। বছর দুই আগেও ভালো ছিলেন। ইদানীং তিনি কিছুটা এই রোগে আক্রান্ত। ঘরের মানুষ তাঁর সঙ্গে কথা বলে তাঁর স্মৃতিকে যতটুকু সম্ভব তাজা রাখার চেষ্টা করেন। কয়েক দিন আগে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন। ১৯৭১ সালে আমার ছোট বোন বাংলাদেশের একটি পতাকা বানিয়েছিল। মা ৯ মাস সেটি কোমরে গুঁজে রেখেছিলেন, যাতে যে দিন বাংলাদেশ স্বাধীন হয় সে দিন তিনি তা ছাদে ওড়াতে পারেন। ১৭ ডিসেম্বর ভোরে নামাজ পড়ে প্রথমে তিনি সেই কাজটিই করেছিলেন। মা কিন্তু এই ঘটনাটি ভোলেননি। 'ভেতরে বাইরে' পড়ে নিশ্চিত হয়েছি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এই রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন। অবশ্য তিনি তাঁর ভূমিকায় স্বীকার করেছেন, 'মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ৪২ বছর পর আমি বইটি লিখছি। স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই আমি অনেক কিছু বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছি।' তাঁর বই লেখার উদ্দেশ্য হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন, 'মূলত তরুণ প্রজন্মের ইতিহাস জানার আগ্রহ থেকে।' খন্দকার যাঁদের নিয়ে লিখেছেন, তাঁদের প্রায় সবাই প্রয়াত। কারো কাছ থেকে তাঁর বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করার তেমন একটা সম্ভাবনা নেই। তিনি কিছু মীমাংসিত সত্যকে উড়িয়ে দিয়ে নিজের মতকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তার মধ্যে দুটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। প্রথমটি হচ্ছে একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক বক্তৃতা 'জয় পাকিস্তান' দিয়ে শেষ করেছেন। এক সপ্তাহের মাথায় তিনি তা শুধরে লিখেছেন বঙ্গবন্ধু প্রথমে 'জয় বাংলা' তারপর 'জয় পাকিস্তান' বলেছেন। সে দিনের সেই পড়ন্ত বিকেলের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে তাঁর পক্ষে সেই জনসভায় উপস্থিত থাকা সম্ভব হয়নি। আমাদের পক্ষে সেই মুহূর্তের সাক্ষী হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। দুপুর ২টায় মহসিন হল থেকে দল বেঁধে সেই জনসভায় উপস্থিত হয়েছিলাম রাজনীতির কবির সেই হাজার বছরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা শোনার জন্য। খন্দকারের কথা যদি সত্য হয়, তাহলে হয় আমরা সেই জনসভায় উপস্থিত ছিলাম না অথবা রাজনীতির কবি সে দিন অন্য কোনো জনসভায় বক্তৃতা করেছিলেন।
এ কে খন্দকার একা নন, যিনি সে দিন 'জয় পাকিস্তান' শুনেছিলেন। প্রয়াত বিচারপতি হাবিবুর রহমান ২০০৮ সালে তাঁর 'বাংলাদেশের তারিখ' নামক গ্রন্থের নতুন সংস্করণে লিখেছিলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ শেখ মুজিব 'জয় বাংলা' ও 'জিয়ে পাকিস্তান' ধ্বনি দিয়ে ভাষণ শেষ করেন। তথ্যসূত্র হিসেবে তিনি কবি শামসুর রাহমানের শেষ বয়সে স্মৃতি হাতড়ে লেখা আত্মজীবনী 'কালের ধুলায় লেখা'র লেখা ব্যবহার করেন। শামসুর রাহমানের ভুলটি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আলী যাকের ধরিয়ে দিলে কবি 'সাপ্তাহিক ২০০০'-এ একটি বিবৃতি দিয়ে বলেন, 'আমার এই ভুলত্রুটির জন্য সব বঙ্গবন্ধুপ্রেমীর কাছে আমি লজ্জিত, নিজের কাছে তো বটেই।' এতে কবি মহিমান্বিত হয়েছেন। বিচারপতি কবির ভুলের এই স্বীকারোক্তি এড়িয়ে গেছেন। অথচ তিনি আগের সব সংস্করণেই সঠিকভাবে লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু সে দিনের বক্তৃতা 'জয় বাংলা' দিয়ে শেষ করেন। বিচারপতি ২৬ মার্চ রাত থেকে শুরু হওয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যাকে 'পিটুনি অভিযান' বলে পত্রিকায় তাঁর এক লেখায় উল্লেখ করেছেন। বিচারপতি হাবিবুর রহমান সম্পর্কে কোনো কিছু বলার যোগ্যতা আমার নেই; তবে ইতিহাসের দায়বদ্ধতা থেকে অনেক সময় সত্য লিখতে হয়। বিচারপতি বা কবি কেউ সেদিন সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হতে রমনার রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত ছিলেন না।
এ কে খন্দকার লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এমন কোনো গ্রহণযোগ্য প্রমাণ তাঁর কাছে নেই। যদিও এই বিতর্কটি বর্তমানে একেবারেই অবান্তর; তথাপি খন্দকার সাহেবের উদ্দেশে বলতে চাই, ছয়টি মহাদেশের ২৫টি দেশের অসংখ্য পত্রিকায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার খবরটি প্রচারিত হয়, যার অনেক ক্লিপিং আমার কাছে আছে। এসব দেশের মধ্যে আছে নেদারল্যান্ডস, আইসল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, কানাডা, কোস্টারিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, তুরস্ক, নরওয়ে, হংকং। দুই-একটি নমুনা। 'Moedjiboer roept onafhankelijkheit Oost-Pakistan uit’ (Leeuwarder Courant, March 27, 1971, Netherlands), ‘Mujibur Rahmanlysir yfir sjalfstaeoi landshlutans’ (Morgunblaoio, March 27, 1971, Iceland), ‘Bengali independence declared by Mujib’ (Buenos Aires Herald, March 27, 1971, Argentina) ‘Declaration unilateral d’independence La ‘ligue Awami’ declare hors la loi’ (L’Artisan, Montreal, March 27, 1971, Canada), ‘Pakistan Oriental se declare independiente’ (La Nacion, March 27, 1971, Costa Rica), স্থানাভাবে এখানেই থামতে হলো।
খন্দকার সাহেব লিখেছেন, যুদ্ধের জন্য আওয়ামী লীগের কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না। তাই যদি হবে, তাহলে বঙ্গবন্ধু কেন কর্নেল ওসমানীকে ১০ মার্চ তাঁর সামরিক উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়েছিলেন? এই কথাটি খন্দকার তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন। খন্দকার আক্ষেপ করে বলেছেন, কেন বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ একতরফাভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। খন্দকারের ইতিহাসের জ্ঞান সম্ভবত খুব দুর্বল। কারণ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে তিনি তফাত বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। খন্দকার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে লিখেছেন, 'বর্তমানে প্রতি তিন সপ্তাহে কুড়ি হাজারকে (গেরিলা) প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এই বিশাল পরিমাণে গেরিলা ভর্তির কারণে তাদের আনুগত্য, সাহস ও আত্মোৎসর্গের মতো ব্যক্তিগত গুণাবলির প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেওয়া হয়নি। ...ফলে রিক্রুটদের অধিকাংশই হয় প্রণোদিত, নয় অথবা গেরিলা হওয়ার যোগ্যতা নেই। এতে ফল দাঁড়িয়েছে : কিছু গেরিলা ভেতরে গিয়েছে মূলত অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে যেমন লুট, হত্যা, ডাকাতি ইত্যাদি এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রচণ্ড ক্ষতি করেছে। শতকরা মাত্র ১০ থেকে ১৫ ভাগ ছেলে সত্যিকার অর্থে যথাযথ অভিযান পরিচালনা করেছে।...উল্টো ফল হচ্ছে এবং সাধারণ মানুষ আমাদের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে।' জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের কী অপমান! ওসমানী সম্পর্কে খন্দকার লিখেছেন, 'সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে থেকে একটা গুঞ্জন ওঠে যে তাঁরা যেভাবে যুদ্ধ চালাতে চান, কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি রেখে সেটা সম্ভব হবে না। সর্বসম্মতভাবে কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দাবি ওঠে, শুধু খালেদ মোশাররফ এ বিষয়ে আপত্তি তোলেন। ...তিনি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি রেখে সব সেক্টর অধিনায়ককে নিয়ে যুদ্ধ পরিষদ বা ওয়ার কাউন্সিল গঠন করে তাঁদের হাতে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত করার পক্ষে মত দেন। যুদ্ধ পরিষদ বা ওয়ার কাউন্সিলের ধারণাটির সূত্রপাত করেছিলেন মেজর জিয়া। (এই ব্যাপারে) খালেদ মোশাররফের অবস্থান ছিল বিপরীতমুখী।' ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি করার একটি রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। কারণ তিনি ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার, তখন সিভিলিয়ান ও জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্য। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধটি কোনো সামরিক অভিযান ছিল না, ছিল একটি জনযুদ্ধ, যেটি খন্দকার সাহেব অনুধাবন করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁদের এসব কার্যকলাপ দেখে ওসমানী পদত্যাগ করার কথা বলেন। এ কে খন্দকার তাঁর ভূমিকায় অনেক বই পড়েছেন বলে জানিয়েছেন। তালিকায় নেই মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তমের 'লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে'। তিনি তা পড়লে উপকৃত হতেন। খন্দকার মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণাটি সম্পর্কে একটি সত্য কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, 'মেজর জিয়ার ঘোষণাটি কোনোভাবেই স্বাধীনতার ঘোষণা বলা চলে না। মেজর জিয়া রাজনৈতিক নেতাও ছিলেন না বা স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার মতো উপযুক্ত ব্যক্তিও ছিলেন না।' তাই বলি, খন্দকারের 'ভেতরে বাইরে' নিয়ে যেসব বিএনপি নেতা-নেত্রী উল্লাস নৃত্য করেন, তাঁরা কেউ এই বই পড়েননি।
খন্দকার লিখেছেন, 'প্রথমবার পালানোর চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর আমি ১৮ বা ১৯ এপ্রিল অফিসে যোগদান করি।' একজন বাঙালি অফিসার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কতটুকু আস্থাভাজন হলে এই কাজটি করতে পারেন? তিনি ১৫ মে সীমান্ত অতিক্রম করেন। অনেক বাঙালি অফিসার পাকিস্তানের হয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কেউ যুদ্ধবন্দি হিসেবে পাকিস্তান ফেরত গেছেন অথবা কেউ কেউ যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই পোস্টিং নিয়ে চলে যান। তাঁদের বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন; আর বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর যাঁরা পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন তাঁদের ১৪ জনকে পুলিশে আত্তীকরণ করেছিলেন জেনারেল জিয়া; যাঁদের মধ্যে দু-একজন আইজিপি পর্যন্ত হয়েছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার বীর উত্তম সীমান্ত অতিক্রম করতে না পারলে কী করতেন তা বলা মুশকিল। তবে তাঁর এই গ্রন্থ আমাদের নতুন প্রজন্মকে চরমভাবে বিভ্রান্ত করবে। বইটি বাজেয়াপ্ত বা নিষিদ্ধ করার পক্ষে আমি নই; তবে সব চেয়ে ভালো হয়, তিনি নিজেই বইটি বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নিলে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে খাটো করার চেষ্টা ৪০ বছর ধরে করা হচ্ছে। খন্দকারের প্রচেষ্টা শেষ নয়। তবে ইতিহাস তার নিজের গতিতেই চলে, কারো হুকুমে নয়। মনে হয় খন্দকার হিরো থেকে জিরো হলেন।
লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক
( কালের কণ্ঠ )
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন