নৈরাজ্য সৃষ্টি করার কোনো কারণ নেই
27 July 2014, Sunday
বিশ্বে খুব কম দেশই আছে যেখানে সাধারণ মানুষ বাংলাদেশের মানুষের মতো রাজনীতি নিয়ে এত ভাবনা-চিন্তা করেন। পাড়ার তরকারি বিক্রেতা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কেউই বাদ যান না। ব্যতিক্রম বর্তমান প্রজন্মের একটি বড় অংশ। তাঁরা নিজের পেশার বাইরে কিছু চিন্তা করার তেমন প্রয়োজন মনে করেন না, রাজনীতি তো দূরের কথা। এর ফলে রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন বিষয়টা আরো সহজ হয়েছে। সে প্রসঙ্গে অন্য আরেক সময় আলোচনার ইচ্ছা রইল। যদিও আমার এক প্রাক্তন ছাত্র স্বপ্রণোদিত হয়ে রাত জেগে ট্রেনের টিকিট কেটে দিয়েছিল সপরিবারে বাড়ি ফেরার জন্য, যাত্রা নিয়ে শঙ্কা ছিল। সোনার হরিণের মতো টিকিট তো জোগাড় হলো, যাত্রাটা কেমন হয় জানি না। অবাক করে দিয়ে চট্টগ্রামগামী সুবর্ণ এক্সপ্রেস ঠিক সময়মতো ৩টায় ছাড়ল। আরো অবাক করার বিষয় হচ্ছে, চট্টগ্রাম পৌঁছানোর নির্ধারিত সময়ের কিছু আগেই সুবর্ণ তার যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দিল। ট্রেনে কমপক্ষে ডজনখানেক আমার পুরনো ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে দেখা। সবাই চট্টগ্রাম যাচ্ছে পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে। নিজেদের পরিবারের দেখভাল করাটা বাদ দিয়ে সবাই আমাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, পাছে স্যারের কোনো অসুবিধা হয়। শিক্ষক হিসেবে আমি সব সময় আমার ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে গর্বিত। আমার পাশের সিটের ভদ্রলোক একটি বিদেশি বহুজাতিক কম্পানিতে কাজ করেন। পরিচিত হয়ে বললেন, তিনি আমাকে নিয়মিত টিভিতে দেখেন। আমার কথা শোনেন। তবে অকপটে স্বীকার করলেন আমার সব কথার সঙ্গে সব সময় তিনি একমত হতে পারেন না। তাঁকে বলি এটাই স্বাভাবিক। সবাই সবার সব কথার সঙ্গে একমত হলে সমাজে কোনো বিষয় নিয়ে সুষ্ঠু বিতর্ক করার সুযোগ থাকে না। আমাকে জানালেন, ঈদের পর তিনি নির্বিঘ্নে বাড়ি থেকে ফেরা নিয়ে কিছুটা শঙ্কিত। কারণ বিএনপি ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে তারা ঈদের পর ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করবে; আর অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, তাদের এই আন্দোলনে দেশে আবার চরম নৈরাজ্য সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা আছে, ঠিক যেমনটি হয়েছিল ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগের প্রায় এক বছরে। ভদ্রলোককে মনে করিয়ে দিই বিএনপি আন্দোলন করবে বলেছে বর্তমান সরকারকে উৎখাত করার জন্য, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়। তার উত্তর ওই একই কথা। এই সরকারকে উৎখাত করার অর্থই হলো বিএনপি তার মিত্রদের নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া অথবা কোনো একটি অসাংবিধানিক শক্তিকে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম করে দেওয়া। তবে তিনি বলতে ছাড়লেন না তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের অন্ধ সমর্থক নন, তিনি দেশে শান্তি বিরাজ করুক তাই প্রত্যাশা করেন। তিনি এ-ও বোঝেন দেশের সব মানুষ রাজনীতি করেন না, তবে কিছু ব্যক্তি বা দলের অপরাজনীতির কারণে মূলত দেশেরই ক্ষতি হয়। তাঁর কথা শুনে বেশ চমৎকৃত হই। দেশের রাজনীতিবিদরা যদি এমন একজন সাধারণ মানুষের মতো চিন্তা করতেন, তাহলে দেশ অনেক দূর এগিয়ে যেত।
নৈরাজ্য সৃষ্টি করার কোনো কারণ নেই
ট্রেনে পাশের সহযাত্রীর শঙ্কার সঙ্গে অনেকেরই একই শঙ্কা। কী হতে যাচ্ছে ঈদের পর? নিজের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে কিছুটা বিচার-বিশ্লেষণ করে তাদের বলি, আমার মনে হয় না তেমন একটা কিছু হবে, যদি সরকার শক্ত হাতে সব ধরনের নৈরাজ্য দমন করতে সচেষ্ট থাকে। আর বিএনপির দলীয় অবস্থা তো এখন অনেকটা নড়বড়ে। জামায়াত নিজের অস্তিত্ব নিয়ে শঙ্কিত। তবে কোনো একটি রাজনৈতিক দল যদি শান্তিপূর্ণভাবে তাদের কর্মসূচি পালন করতে চায়, তাহলে সরকারের উচিত হবে তাদের সহায়তা করা এবং সেই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি যদি কোনো কারণে অশান্ত হয়ে ওঠে, তাহলে তাকে দমন করতে প্রশাসনকে সচেষ্ট থাকতে হবে। মানুষ কোনো অবস্থাতেই দেশে ২০১২ সালের ৫ মে-র হেফাজতের নারকীয় তাণ্ডব দেখতে চায় না। দেখতে চায় না আন্দোলনের নামে জামায়াত-বিএনপির পেট্রলবোমা মেরে শতাধিক মানুষ হত্যা করছে অথবা দেশের কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট করছে। মানুষের মনে নতুন করে বিএনপি-জামায়াতকে নিয়ে শঙ্কা আর আতঙ্ক সৃষ্টির কারণ যত না তাদের আন্দোলনের ঘোষণা তার চেয়েও বেশি নাশকতার আশঙ্কা। সম্প্রতি পবিত্র মক্কা ও মদিনা নগরীতে খালেদা জিয়ার ওমরা উপলক্ষে সেখানে গমন, তাঁর সঙ্গে লন্ডনে আইনের দৃষ্টিতে পলাতক থাকা তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমান, ওয়ান ম্যান পার্টি বিজেপির সর্বময় নেতা আন্দালিব রহমান পার্থের ও একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পুত্রের একান্ত বৈঠক, যাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে আখ্যায়িত করেছেন রাজনৈতিক মিসকিনদের ষড়যন্ত্রমূলক বৈঠক হিসেবে। অনেকের মতে, এই বৈঠকের পেছনে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের হাত আছে। কারণ ভারতে বর্তমানে যে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আছে তাদের সত্যিকার অর্থে পাকিস্তানের বন্ধু হওয়ার সম্ভাবনা কম। অনেকের ধারণা, এই সরকারের মেয়াদকালে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা তেমন একটা নেই। তেমনটা যদি হয়, তাহলে ভারতের পূর্ব সীমান্তে বাংলাদেশে পাকিস্তানবান্ধব একটি সরকার থাকলে পাকিস্তানের সুবিধা। আর এটি তো সত্য, বিএনপি বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে তাদের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে অনেক বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপি আর তার মিত্ররা দাবি তুলল, তারা দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক বাতিলকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায়। এটি ঠিক ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ও এর মিত্রদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি তড়িঘড়ি করে একটি একতরফা নির্বাচন করে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের নিয়ে সংসদ গঠন করে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। তারা এটি করতে বাধ্য হয়েছিল, কারণ তারা প্রমাণ করেছিল দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব নয়। আবার এই বিএনপিই এ ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল, যখন তাদের পছন্দসই একজনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকরের উপদেষ্টা করার জন্য বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা দুই বছর বৃদ্ধি করে। ২০০৬ সালের নির্বাচনটি তারা তাদের একটি সাজানো ছকে করতে চাইলে শুরু হয় দেশে চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা। যার ফলে এক-এগারোর আবির্ভাব। ২০০৮ সালেও আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো একটি উপদেষ্টা সরকারের (তত্ত্বাবধায়ক নয়, কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ সংবিধান অনুযায়ী ছয় মাস হওয়ার কথা, আর উপদেষ্টা সরকার দুই বছর ক্ষমতায় ছিল) অধীনেই নির্বাচন করেছিল এবং সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটই বিজয় লাভ করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার উচ্চ আদালতে বাতিল হয় আওয়ামী লীগের কারণে নয়, ২০০৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী আবদুল মান্নান খানের রিট পিটিশনের কারণে। যখন এই রিট পিটিশনটি হয় তখন বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায়। হাইকোর্ট মামলাটি চূড়ান্ত শুনানি করতে অপারগ হলে তা সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে রেফার করা হয়। সুপ্রিম কোর্টে মামলাটি প্রথমে শুনানি হয় ২০১১ সালে। তত দিনে মূল আবেদনকারীর মৃত্যু হয়েছে। মোট ১১টি শুনানির পর দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দেন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক চিন্তাধারার সম্পূর্ণ পরিপন্থী বিধায় এটি 'ভাবী সাপেক্ষভাবে (prospectively) অসাংবিধানিক তথা অবৈধ ঘোষণা করা হইল।' এ বিষয়টিই একমাত্র তর্কিত বিষয় ছিল, অন্য কিছু নয়। বাদবাকি যা কিছু বলা হয়েছে তা সম্পূর্ণভাবে আদালতের মন্তব্য। তাঁরা বলেছেন, সংসদ যদি চায় তাহলে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে, তবে তা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এক মুহূর্তের জন্যও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব কোনো অনির্বাচিত ব্যক্তির হাতে যাওয়া উচিত নয়। আর ওই রকম সরকার হলে তা থেকে বিচারকদের দূরে রাখতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকার যেটি করেছে তা হচ্ছে আদালতের নিদের্শনা সংবিধানে প্রতিস্থাপন করেছে, অন্য কিছু নয়। আর সংসদ চায়নি বলে আদালতের মন্তব্যের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আর এসব কর্মকাণ্ড যখন হচ্ছিল তখন বিএনপি ও তার মিত্ররা সম্পূর্ণ সময় ধরে সংসদে অনুপস্থিত থেকেছে। এরপর বিএনপি-জামায়াত জোট যখন তাদের অসাংবিধানিক দাবি আদায়ে দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত তখনো প্রধানমন্ত্রী নিজে উদ্যোগী হয়ে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে সমস্যার একটি সমাধানের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি যখন দৃঢ়তার সঙ্গে পরিস্থিতির মোকাবিলা করে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি করেই ফেললেন, তখন বিএনপির বোধোদয় হলো তারা নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছে। এখন বলছে, তারা সরকারের ওপর আলোচনার চাপ দিতে ঈদের পর আন্দোলন শুরু করবে। তবে খালেদা জিয়া বলেছেন, তিনি যুদ্ধ নয়, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে চান। তিনি যদি তা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, তাহলে এটি একটি শুভ লক্ষণ। খালেদা জিয়া শনিবার পবিত্র মক্কা নগরী থেকে দেশে ফিরেছেন। ওমরা বা হজ মানুষকে পাক-পবিত্র করে। দেশের মানুষ আশা করে তিনি জামায়াতের ফাঁদে পা দিয়ে দেশকে আবার একটি চরম নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দেবেন না। প্রয়োজনে পরবর্তী নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করবেন। মনে রাখতে হবে, পরবর্তী নির্বাচনে তাঁর দল অংশগ্রহণ না করলে তাঁদেরসহ ২৮টি দলের নিবন্ধন নির্বাচনী আইন অনুসারে বাতিল হয়ে যাবে। আশা করি সময় থাকতে সবার শুভবুদ্ধির উদয় হবে। পাঠকদের ঈদের শুভেচ্ছা।
লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন