মুশতাক এবং ‘দোদুল্যমান’ প্রতিবাদী - ছবি : নয়া দিগন্ত
হায়দার হোসেনের গান এবং স্বাধীনতা কী?
প্রায় ১২ বছর একনাগাড়ে নিয়মিতভাবে নয়া দিগন্ত পত্রিকায় কলাম লিখেছি। কিন্তু বিবিধ কারণে গত প্রায় ১২ মাস নিয়মিত কলাম লিখতে পারছি না। স্বাধীনতার বা মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীর বছর শুরু হয়েছে চলমান মার্চ মাসে। আজ বুধবার ৩ মার্চ। ২০২১ সালের মার্চে আমার লেখা প্রথম কলামটি হওয়া উচিত ছিল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী নিয়ে। কিন্তু লেখা হয়ে গেল স্বাধীনতার বছরে সংঘটিত একটি ঘটনা নিয়ে। একটি আইনের অসৎ ব্যবহার নিয়ে। লেখা হয়ে গেল একটি মর্মস্পর্শী ঘটনা নিয়ে। বয়সে কনিষ্ঠ কিন্তু বন্ধুপ্রতিম একজন ওল্ড ফৌজিয়ান স্পষ্টবাদী লেখকের মৃত্যু নিয়ে। প্রখ্যাত গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী হায়দার হোসেনের বিখ্যাত গানের কথা মনে আসছে। গানটির শুরু এই রকম- ‘কী দেখার কথা কী দেখছি, কী শোনার কথা কী শুনছি, কী ভাবার কথা কী ভাবছি, কী বলার কথা কী বলছি।’ ওই গানে ২৪টি লাইন আছে, প্রথম চারটি লাইন এবং শেষের চারটি লাইন ছাড়া মাঝখানে ১৬টি লাইনই হলো প্রশ্নবোধক, যথা স্বাধীনতা কী? আজ ওল্ড ফৌজিয়ান রাজনৈতিক কর্মী ইবরাহিম তার কলামের মাধ্যমে হায়দার হোসেনের গানের অনুকরণে একটি লাইন যোগ করছেন, ‘স্বাধীনতা কি স্বাধীনচেতাদের হত্যা করার হাতিয়ার?’
২০২১ সালের মুশতাক
এক ‘মুশতাক’ সংবাদ শিরোনাম হয়েছিলেন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সকালবেলা, নৃশংসভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিয়ে। নামটি আরেকবার সংবাদ শিরোনাম হয়েছে এবার গত ২৬ ফেব্রুয়ারি। প্রথমে অনলাইনে, কিছুক্ষণ পরই টিভি ও মুদ্রিত মিডিয়ায় এসেছে। অনেকের মতে, এই মুশতাকের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। তাদের মূল্যায়নে এ জন্য দায় কর্তৃপক্ষের। কোনো দিন যদি কাউকে অভিযুক্ত করতে হয়, তাহলে হবেন যারা ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের সাবেক কৃতী ছাত্র, সফল উদ্যোক্তা, স্পষ্টভাষী বক্তা ও লেখক মুশতাক আহমেদকে হয়তো গ্রেফতারের আদেশ দিয়েছিলেন এবং মুশতাকের ওপর আলোচিত নির্যাতনের আদেশ দিয়েছিলেন। মুশতাকের স্ত্রীর নাম লিপা আক্তার, তার বাবা মো: আবদুর রাজ্জাক এবং মা জেবুন্নেসা রাজ্জাক। তার বাবা-মা ও তার স্ত্রীর প্রতি সম্মান জানাচ্ছি। মুশতাক ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের কৃতী ছাত্র ছিলেন। একই কলেজে আমার থেকে ১৫-১৬ বছরের কনিষ্ঠ। ছয় বছর সেখানে লেখাপড়া শেষ করে আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে কলেজ থেকে বের হয়েছিলেন। গত ১৫-২০ বছর ধরে তিনি যুগপৎ একজন শিল্প-বাণিজ্য উদ্যোক্তা এবং স্পষ্টভাষী লেখক হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কুমির চাষের ‘পথপ্রদর্শক’ উদ্যোক্তা ছিলেন ওল্ড ফৌজিয়ান এই ব্যক্তি। মুশতাক থেকে কনিষ্ঠ বা জ্যেষ্ঠ বহু ওল্ড ফৌজিয়ান এবং তার অন্যান্য বন্ধু তাকে ‘কুমির মুশতাক’ বলেই ডাকতেন। এরূপ স্নেহ ও ভালোবাসা মিশ্রিত সম্বোধনে মুশতাক উৎফুল্ল থাকতেন। মিশুক এবং আমুদে মেজাজের বন্ধুবৎসল ছিলেন। অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া এবং উচিত কথা উপস্থাপন করায় মুশতাক কার্পণ্য করতেন না। মৃত্যুকালে মুশতাকের বয়স ছিল ৫৩। তিনি ঢাকা মহানগর থেকে কিছু দূরে, গাজীপুর জেলার কাশিমপুরে অবস্থিত হাই সিকিউরিটি কারাগারে বন্দী ছিলেন। বর্তমান আমলে, বন্দী অবস্থায় এবং অভিযোগ মতে, আত্মরক্ষায় অক্ষম অবস্থায় মৃত্যুবরণ করার কারণে অনেকের দৃষ্টিতে মুশতাকের মর্যাদা অনেক। ব্যক্তি ইবরাহিম যেমন করছে, অনুরূপ ব্যক্তি ইবরাহিম যে দলের চেয়ারম্যান, সেই পার্টিও প্রতিবাদ করছে, নিন্দা জানাচ্ছে এবং একই সাথে মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করছে তার জন্য। ২ মার্চ মঙ্গলবার অপরাহ্ণে, কল্যাণ পার্টি দোয়া মাহফিল করে তার জন্য প্রার্থনা করেছে। রাজনৈতিক অঙ্গনের নেতারা জোরালো প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, আন্দোলন করছেন। গণতন্ত্রমুখী ছাত্রসমাজ প্রতিবাদ গড়ে তুলেছে এবং প্রতিবাদী আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে। তারুণ্যের প্রতি আমার স্যালুট। প্রকাশিত রিপোর্ট মতে, পুলিশ বাহিনী মারমুখী হয়ে প্রতিবাদী জনগণের অনুভূতিকে অসম্মান করছে।
কেন প্রাণ দিলেন?
২০২০ সালের ৪ মে রাতে মুশতাকের স্ত্রী লিপা আক্তারের ফেসবুকের স্ট্যাটাস থেকে দেশের মানুষ জানতে পারে, মুশতাকের ওপর ‘বিপদ নেমে আসছে’। লিপা প্রথম স্ট্যাটাসে জানান, একটি বাহিনীর লোক এসেছে তার বাসায় এবং কিছুক্ষণ পর দ্বিতীয় স্ট্যাটাসে জানান, ওই লোকেরা মুশতাককে ধরে নিয়ে গেছে এবং সাথে তার কম্পিউটারের সিপিইউ নিয়ে গেছে। তার বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা হয়েছিল। মুশতাকসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২১,২৫(১), ৩১ ও ৩৫ নম্বর ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছিল। মুশতাক ছাড়া অন্যান্য আসামি হলেন- কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, ‘রাষ্ট্রচিন্তা’ নামক একটি তারুণ্যনির্ভর সংগঠনের সদস্য দিদারুল ইসলাম ভূঁইয়া, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক পরিচালক এবং ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের সাবেক ছাত্র মিনহাজ মান্নান, তাসনিম খলীল, সায়ের জুলকারনাইন, আশিক ইমরান, ফিলিপ শুমাখার, স্বপন ওয়াহিদ, সাহেদ আলম, আসিফ মহিউদ্দীন ও নামবিহীন তথা অজ্ঞাত আরো পাঁচ-ছয়জন। মুশতাকসহ এদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সারমর্ম ও প্রাসঙ্গিক দু’টি বাক্য, একটি প্রখ্যাত দৈনিকে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি যেমন লেখা হয়েছে সেটি থেকে উদ্বৃত করছি।
উদ্ধৃতি শুরু- এজাহারে অভিযোগ : ‘এঁরা ফেসবুকের বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে জাতির জনক, মহান মুক্তিযুদ্ধ, মহামারী করোনাভাইরাস সম্পর্কে গুজব, রাষ্ট্রের/সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করিবার অভিপ্রায়ে অপপ্রচার বা বিভ্রান্তি মিথ্যা বলে জ্ঞাত সত্ত্বেও গুজবসহ উপরোক্ত তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল করার উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ আকারে প্রকাশ বা প্রচার করে রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি, অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার অপরাধ করেছেন।’ এজাহারে কিন্তু এদের ‘গুজব রচনাকারী’ বলা হয়নি, বরং তা জেনেও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারের অভিযোগ আনা হয়েছে এবং এর পেছনে রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিপ্রায়ের কথা বলা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে চারটি ধারায় মামলা করা হয়েছে, সেগুলো অজামিনযোগ্য। এ কারণে ধারণা করা অযৌক্তিক হবে না যদি কেউ গুজবের জন্ম দিয়েও থাকে, তাহলেও গুজব সৃষ্টিকারীদের ধরা বাহিনীর মূল লক্ষ্য ছিল না। যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, তাদের একধরনের ‘শিক্ষা’ দেয়ার মানসে অজামিনযোগ্য ধারাগুলোই বেছে নেয়া হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যেসব ধারায় মুশতাক ও অন্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল, এগুলো চিন্তুা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী হিসেবে বিতর্কিত। আইনের ২৫(১)(খ) ধারায় রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের কথা বলা হয়েছে। ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি’র সংজ্ঞা কী? ৯ মাস জামিন না দিয়ে এবং বিনাবিচারে জেলে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে একজন নাগরিকের মৃত্যুতে কি রাষ্ট্রের মর্যাদা বেড়েছে? এজাহারে রাষ্ট্র/সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অভিযোগ আনা হয়েছে। রাষ্ট্র এবং সরকারকে একাকার করে দেখানোর উদ্দেশ্যটা যে ঠিক নয়, তা বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। -উদ্ধৃতি শেষ।
গায়ের ঘা
মুশতাকের মৃত্যুর জন্য বাকশক্তিবিহীন রাষ্ট্রকে দায়ী করার কোনো জায়গা নেই। যারা বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের জন্য রাষ্ট্র দায়ী, আমি তাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করি। রাষ্ট্র এই দায় নিতে পারে না। এর জন্য দায়ী হতে পারে অপরিচ্ছন্ন নোংরা শরীরের প্রশাসন। মানুষের শরীরে যদি ঘা হয় এবং সেটি যদি না শুকায়, তবে সেখান থেকে পুঁজ বের হয় এবং অনেক সময়ই পচন ধরলে সেখান থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। কর্তৃপক্ষকে শরীরের সাথে তুলনা করে আমি বলছি, এই শরীরে অনেক স্থানে ঘা হয়েছে এবং সেখানে পচন ধরেছে। এখন দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। এরূপ একটি স্থান হলো, আইনের অপপ্রয়োগ। এই কলামের একটি জায়গায় আমি লিখেছি, আইনটির অসৎ ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। যাদের কলম দিয়ে আইনটির ভাষ্য লেখা হয়েছিল, যাদের সম্মতিতে আইনটি পাস হয়েছিল এবং যাদের হুকুমে এর অপব্যবহার হচ্ছে, তারা সবাই একটা ভুল করেছেন। মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার হচ্ছে মতপ্রকাশের অধিকার বা বাকস্বাধীনতা। কিন্তু এই স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ নয়। অন্যের মতপ্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করে বা অন্যের সম্মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে বা সমষ্টির নিরাপত্তাকে ক্ষুণ্ন করে কোনো প্রকার মত প্রকাশ বা বাক্য রচনার স্বাধীনতা এই মৌলিক অধিকারের অংশ নয়। বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে শব্দগুলো এমনভাবে চয়ন করা হয়েছে যেগুলো যার যেমন ইচ্ছা, তেমনভাবে প্রয়োগ বা অপপ্রয়োগ করা যায়। আইনটি প্রণয়নের অন্যতম উদ্দেশ্য, অভিযোগ মতে, বিরুদ্ধ-মতাবলম্বীদের দমন করা। এই আইনটির মাধ্যমে আইনগত আরেকটি অধিকারকে দমন করা হয়েছে; যথা- মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জামিন পাওয়ার অধিকার।
গত দুই মাস ধরে রাজধানী দিল্লির চার পাশের অঞ্চলসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে জোরালো কৃষক আন্দোলন চলমান। মিডিয়ার কারণে বিশেষত ভারতীয় টেলিভিশনের কারণে বাংলাদেশের মানুষ এ সম্বন্ধে ভালোভাবেই অবগত। কিছু দিন আগে ভারতের চলমান কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে ২২ বছরের একজন ভারতীয় তরুণী যার সংক্ষিপ্ত নাম দিশা, ডিজিটাল মাধ্যমে ভারত সরকার বিরোধী বক্তব্য দেন। এরূপ বক্তব্য দেয়ার অপরাধে তাকে আটক করা হয়। অতঃপর দিল্লির হাইকোর্ট পাঁচ-ছয় দিন আগে দিশাকে জামিন দিয়েছেন। সেই জামিনের আদেশে দিল্লির হাইকোর্ট বলেছেন, ‘জামিন প্রত্যেকের অধিকার এবং তা ব্যতিক্রমী অপরাধ ও ঝুঁকি ছাড়া প্রত্যাখ্যান করা যায় না।’ ওই আদালত আরো বলেছেন, ‘সরকারের সমালোচনা করা নাগরিকদের অধিকার এবং মতপ্রকাশের অধিকার চর্চা করা অপরাধ নয়।’
যদিও দিল্লি হাইকোর্টের রায় বাংলাদেশের জন্য প্রত্যক্ষভাবে প্রযোজ্য নয়; কিন্তু এ রায়ের মর্ম বাংলাদেশের উচ্চতর আদালত আমলে নেবেন আশা করি। অপর দিকে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ এতই বেড়েছে যে, এটাকে এক ধরনের হাতিয়ার বললে অত্যুক্তি হবে না। সংবিধান রক্ষার অন্যতম দায়িত্বপ্রাপ্ত, রাষ্ট্রের অঙ্গ হচ্ছে বিচার বিভাগ। বিচার বিভাগের মুরব্বি হচ্ছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। কোর্টের দালানের দেয়াল কথা বলে না, কোর্টের ভেতরে বিচার কার্যের জন্য ব্যবহৃত টেবিল-চেয়ার কথা বলে না। কথা বলেন কিছু জ্ঞানী-গুণী, বিবেকবান মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি, যাদেরকে সম্বোধন করার সময় আইনজীবীরা ‘মাই লর্ড’ বলেন। তারা বাংলাদেশে কী হচ্ছে সেটি দেখছেন। আমি তাদের বিবেকের প্রতি আবেদন করছি, আইনের অপপ্রয়োগের হাত থেকে নিরীহ মানুষকে রক্ষা করুন। আসলে ফেসবুকে দুই-তিনটি কথা লিখলে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় না। ‘ভাবমূর্তি’ শব্দটির এমন কোনো ব্যাখ্যা নেই যেটি শতভাগ মানুষের কাছে শতভাগ বিতর্কহীনভাবে গ্রহণযোগ্য। প্রশাসনের ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করে বা পুলিশ কর্মকর্তাদের ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করে মানুষের জীবনকে বিপন্ন করার যে প্রক্রিয়া চলমান, সেখান থেকে মানুষকে নিরাপত্তা দেয়ার জন্য সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি আবেদন রাখছি।
আমি কে? কেন এ আহ্বান?
আমি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ঘোষিত এবং জাতি কর্তৃক গৃহীত একটি বিশেষণে ভূষিত ব্যক্তি। সমষ্টিগতভাবে যারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, আমি তাদেরই একজন। ব্যক্তিগতভাবে আমি মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখসমরে ব্যতিক্রমী বীরত্ব প্রদর্শনকারী একজন মুক্তিযোদ্ধা। ইংরেজিতে একটি শব্দ আছে- ‘ফাউন্ডিং ফাদার্স’। বাংলাদেশের ফাউন্ডিং ফাদার্স বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যদি দেড় লাখ বা দ্ইু লাখ বা এক কোটিও থাকেন, আমি তাদেরই একজন। আমাদের হাত দিয়ে বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছে। আমাদের হাত দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের হাত দিয়ে নবজাত শিশু বাংলাদেশ হাঁটি হাঁটি পা পা করে শৈশব থেকে কৈশোরে পা রেখেছে, কৈশোর থেকে যৌবনে পা রেখেছে। অতএব আমি আহ্বান জানানোর অধিকার রাখি। এটা একজন মুক্তিযোদ্ধার, ‘ফাউন্ডিং ফাদার’দের একজনের ইনহেরেন্ট বা অন্তর্নিহিত অলঙ্ঘনীয় অধিকার। যে রাষ্ট্রের জন্মের জন্য যুদ্ধ করেছিলাম, সেই রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য আবারো আমরা যুদ্ধ করতে প্রস্তুত, যদি কেউ এই দেশকে আক্রমণ করে। সেই রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ও সম্মান রক্ষার জন্য প্রয়োজনে এখনো জীবন দিতে প্রস্তুত। যে বাঙালি-গণমানুষের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলাম, সেই গণমানুষের মৌলিক অধিকারগুলো রক্ষার জন্য আহ্বান রাখতে পারি। প্রয়োজনে প্রতিবাদ করতে হবে, আন্দোলন করতে হবে এবং বাধ্য করতে হবে মানুষের অধিকারকে সম্মান করতে। আন্দোলন এবং প্রতিবাদ পরিশ্রমের কাজ এবং অনেকসময় রক্তক্ষরণের কাজ। এটা বন্ধ করতে পারেন মাননীয় আদালতের হস্তক্ষেপ।
প্রতিবাদ করবেন কি করবেন না?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এখন প্রতিবাদে উত্তপ্ত। ছাত্রসমাজ প্রতিবাদ করেই যাচ্ছে। বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সম্মিলিতভাবে একটি বিবৃতি দিয়ে মুশতাকের মৃত্যুতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং এ নিয়ে সুষ্ঠু তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। মুশতাক যে ক্যাডেট কলেজের ছাত্র, সেই ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের সাবেক ছাত্রদের সংগঠন ‘ওল্ড ফৌজিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ তাদের যথাযথ ভূমিকা রাখবেন বলে আশা করি। অন্যান্য ক্যাডেট কলেজের ছাত্ররাও তাদের ভূমিকা রাখবেন বলে আশা করি। ক্যাডেট কলেজে যারা পড়েন বা সরকারি মেডিক্যাল ও সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে যারা পড়েন, তারা জাতির কাছে কৃতজ্ঞ থাকার এবং সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার কারণ আছে। ক্যাডেট কলেজ বা মেডিক্যাল বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে প্রত্যেক ছাত্রের পেছনে যত খরচ হয়, তার বৃহদংশই জনগণের ট্যাক্সের টাকা। অতএব, জনগণের কষ্ট অনুভব করা এই প্রতিষ্ঠানের সাবেক ছাত্রদের নৈতিক দায়িত্ব। যদি কোনো জ্ঞানী সাবেক ছাত্র বলেন, এ মৃত্যুর প্রতিবাদ করা তো একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ হয়ে গেল, তার প্রতি এই কলাম লেখকের উত্তর হবে, আপনার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত, বিয়ে থেকে তালাক পর্যন্ত, চাকরি পাওয়া থেকে অবসরে যাওয়া পর্যন্ত, ব্যবসায়ে লাভ করা বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া পর্যন্ত সব কিছুই নির্ভর করে রাজনীতিবিদদের সিদ্ধান্তের ওপর। অতএব, তাদের মন্দ কাজের কুফল যেমন আপনার ওপর বর্তায়, তেমনি সৎকর্মের সুফলও আপনি ভোগ করবেন। সারা জীবন পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন, গোসল করবেন কিন্তু কাপড় ভেজাবেন না, এইরূপ কর্ম দেশপ্রেমের সাথে খাপ খায় না। আমার শেষবাক্য- আজকে মুশতাক মারা গেছে, কালকে যে আপনি যাবেন না তার কোনো নিশ্চয়তা কি আছে?
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন