ভয় ডিকশনারিতে নেই আছে আমাদের মনে
03 November 2019, Sunday
ভয় ডিকশনারিতে নেই আছে আমাদের মনে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উনত্রিশে অক্টোবর মঙ্গলবার ঢাকায় তার সরকারি বাসভবনে একটি সফল এবং জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলন করেছেন। দেশের সাম্প্রতিক অবস্থা, পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি থেকে শুরু করে রাশেদ খান মেননের একটি বিতর্কমূলক উক্তি পর্যন্ত অনেক ব্যাপারেই তিনি খোলামেলা আলোচনা করেছেন। এ জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই। বঙ্গবন্ধুর পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে তিনি অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, এজন্যই মাঝে মধ্যে ভয় হয়, মাঝে মধ্যে সেই প্রবাদবাক্যটি স্মরণ হয়—এত সুখ কী আমাদের ভাগ্যে বেশিদিন সইবে?
দেশে যে শুদ্ধি অভিযান, ক্যাসিনোবিরোধী ড্রাইভ শুরু করা হয়েছে তাতে আপন-পর বিচার করা হচ্ছে না। যুবলীগ, ছাত্রলীসহ আওয়ামী লীগের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অনেক প্রভাবশালী সদস্যও এই অভিযান থেকে অব্যাহতি পাননি।
বিএনপির অঘটনঘটনপটীয়সী ব্যবসায়ী নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালুর বিরুদ্ধে পর্যন্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এক কথায় অসম্ভব সাহসের অধিকারী শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছেন। দেশের মানুষ তার এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ অভিযানের প্রশংসা করছেন; কিন্তু আমার মতো অনেকের মনে হয়, তিনি এই বাঘের পিঠ থেকে সাফল্যের সঙ্গে নামতে পারবেন কি না। দেশের সব মানুষের কামনা, শেখ হাসিনা যেন সফল হন। তিনি সফল না হলে দেশ বাঁচবে না।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘ভয় শব্দটি আমার ডিকশনারিতে নেই’। মুশকিল হচ্ছে, ভয় কখনো ডিকশনারিতে থাকে না। থাকে মানুষের মনে। ডিকশনারিতে থাকে মাত্র কয়েকটি অক্ষর। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি আপন-পর বিচার না করে এই দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে নেমেছেন। ভয় পেলে এত বড়ো অভিযানে তিনি নামতেন না। তার এই বক্তব্য দেশের মানুষ বিশ্বাস করে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী এবং ৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি দেওয়ার মতো অসমসাহসী ও অসম্ভব কাজটি যিনি করতে পারেন, তিনি দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে নেমে ভয় পাবেন, একথা দেশের কেউ বিশ্বাস করে না।
কিন্তু ভয়টা এখন অন্যখানে। শেখ হাসিনার ডিকশনারিতে নয়, দেশের কিছু সচেতন মানুষের মনে। তারা দেশের ভালো চান এবং শেখ হাসিনার মঙ্গল চান। শেখ হাসিনার যে শুদ্ধি অভিযান ও ক্যাসিনোবিরোধী ড্রাইভ নিয়ে সারাদেশের মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে প্রশংসা জুড়েছে, তারা সেখানে প্রশংসার সঙ্গে এই শুদ্ধি অভিযানের কিছু সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সতর্কবাণীও উচ্চারণ করতে চান। এই সীমাবদ্ধতা শেষ পর্যন্ত এই অভিযানের সাফল্যকে ব্যর্থ করতে পারে, প্রধানমন্ত্রীর জন্য অমঙ্গলজনক হতে পারে।
অতীত এবং বর্তমানের দুর্নীতি দমন অভিযানগুলোতে দেখা গেছে, অধিকাংশ অভিযান দেশের রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে এবং প্রচার করা হয়েছে রাজনীতিকরা দুর্নীতিপরায়ণ এবং রাজনীতিকদের দুর্নীতির জন্যই দেশের এত সর্বনাশ। এই থিয়োরি কপচে স্বৈরাচাররা দেশে দেশে গণতন্ত্রের উচ্ছেদ সাধন করেছে। রাজনীতিকরা দুর্নীতিপরায়ণ হলে গণতন্ত্রই দূষিত হয়ে পড়ে—এটা ছিল আইয়ুবের পেটিথয়োরি।
এই থিয়োরি কপেচ তিনি প্রোডা অর্ডিন্যান্স দ্বারা দেশে সব রাজনীতিকদের রাজনীতি করা নিষিদ্ধ করে দেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো রাজনৈতিক নেতাকে পর্যন্ত দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়। আইয়ুবের এই দুর্নীতিবিরোধী অভিযান সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। তার প্রশাসন এবং পরিবার বেপরোয়া দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়। তার পুত্র গওহর আইয়ুবের বিরুদ্ধে এমন সব দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, যা ইতিপূর্বে শোনা যায়নি। গণবিক্ষোভে আইয়ুবের পতন হয়।
আইয়ুবের পরবর্তী জেনারেল ইয়াহিয়ার ক্ষমতা দখলেও স্লোগান ছিল, রাজনীতিকরা দুর্নীতিবাজ, তাদের ক্ষমতা থেকে হটাও। পাকিস্তানে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। এবডো (Ebdo) অর্ডিন্যান্স দ্বারা রাজনীতিকদের রাজনীতি চর্চা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ইয়াহিয়াও শেষরক্ষা করতে পারেননি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার পরাজয় ও পতনের আগে তিনি নিজে দুর্নীতিবাজ, মদ্যপ ও চরিত্রভ্রষ্ট বলে অভিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশে আইয়ুব-ইয়াহিয়ার অনুসারী জিয়াউর রহমান এবং এরশাদেরও রাজনীতি দূষিত এবং দুর্নীতিপরায়ণ এই তত্ত্ব প্রচার ও প্রয়োগ সফল হয়নি।
বর্তমানে শেখ হাসিনা যে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করেছেন, তাতে তিনি আইয়ুব-ইয়াহিয়া বা জিয়া-এরশাদের পন্থা অনুসরণ করেননি। তিনি সাহস এবং আন্তরিকতা নিয়েই দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছেন, যেজন্য নিজের দলের লোকদের বিরুদ্ধেই প্রথম অভিযানটি শুরু করতে পেরেছেন। তা সত্ত্বেও এই অভিযানেও শুভংকরের ফাঁকিটি রয়ে গেছে। দুর্নীতির আসল উত্স রয়ে গেছে সরকারের অধরা।
এবারের শুদ্ধি অভিযানেও প্রথমেই ধরা পড়েছে রাজনীতিকরা বিশেষ করে ছাত্ররাজনীতিকরা। দুর্নীতির জন্য প্রকারান্তরে রাজনীতি এবং রাজনীতিকরাই দায়ী প্রমাণিত হলো। আসল এবং আরো বড়ো অপরাধীরা রয়ে গেলেন স্পর্শের বাইরে। তারা কারা? দেশের জনগণকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তারা যুগের পর যুগ ধরে দুর্নীতির দাপটে এত অতিষ্ঠ যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলেই তারা উল্লাসে ফেটে পড়েন। আসল দুর্নীতিবাজ ধরা পড়ল কি না, তা খতিয়ে দেখা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।
দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন গত শতকের শেষের দিকে ছিল বিস্ময়কর; কিন্তু সেই সঙ্গে দুর্নীতিতে দেশটা ছেয়ে গিয়েছিল। আমেরিকার একটি ইনভেস্টিগেটিং টিম গিয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়ায়। প্রথমেই তাদের চোখে পড়েছিল দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিকরা ফেঁপে-ফুলে উঠেছে। প্রথমে তারা ভেবেছিলেন, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের সাজা দিলেই দেশটি দুর্নীতিমুক্ত হবে। পরে আরো গভীরে তদন্ত করতে গিয়ে তারা দেখলেন, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকরা হচ্ছে সামনের কাতারের শো। আসল অপরাধী রয়েছে অন্তরালে।
এরা হলো দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক ও অসামরিক আমলাতন্ত্র। আমেরিকা কম্যুনিস্টদের কবল থেকে দক্ষিণ কোরিয়াকে রক্ষার জন্য যে কোটি কোটি ডলারের সামরিক ও অসামরিক সাহায্য দিয়েছে, তার সবই গেছে সামরিক ও অসামরিক আমলাদের পকেটে। রাজনীতিকদের তারা এই লুটের সামান্য ভাগ দিয়েছে। তাতেই রাজনীতিকদের এতো শো-শা। এই আমেরিকান তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হলো, ‘আজ যদি সিউলের রাস্তায় দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে দক্ষিণ কোরিয়াকে সামরিক সাহায্য হিসেবে দেওয়া মোটর টায়ারগুলো খুলে নেওয়া হয়, তাহলে গোটা দেশের যানবাহন ব্যবস্থা অচল হয়ে যাবে।’
আমার বলতে দ্বিধা নেই, বাংলাদেশেও একই অবস্থা ঘটেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে যে বিশাল সাহায্য এসেছে এবং পরবর্তী সময়ে আসা বিদেশি সাহায্যের সিংহভাগ গেছে অভিজ্ঞ ও চতুর আমলাদের পকেটে। দেশ শাসনে অনভিজ্ঞ রাজনীতিকরা অভিজ্ঞ আমলাদের কাছ থেকে তার সিকিভাগ পেয়েই শো-শা করছে। চতুর আমলাদের সেই শো-শা নেই। তারা গভীর জলের মাছ।
বেশ কয়েক বছর আগে নরওয়েজিয়ান অথবা ডেনমার্কের একটি সাহায্যদাতা সংস্থা এসেছিল বাংলাদেশে। তাদের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের রাজনীতিকরা এখনো দেশ শাসনে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেনি। তাদের অনভিজ্ঞতার সুযোগ নিচ্ছে একশ্রেণির অভিজ্ঞ আমলা। তাদের লুণ্ঠিত অর্থের পরিমাণ কী বিশাল, তা সম্প্রসারিত ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধারায় কাদের বাসভবনের সংখ্যা বেশি, রাজনীতিকদের, না এই আমলা ও নব্য ব্যবসায়ীদের, তা একবার গণনা করলেই বোঝা যাবে; কিন্তু সাপের গুহায় হাত দেবে কে?
রাজনীতিকদের হাতে হুঁকো রেখে সামরিক ও অসামরিক আমলারা কীভাবে হুঁকো খায় তার খবর দেশের মানুষ জানে না। ক্যাসিনো ক্লাবগুলোতে কোটি কোটি টাকা উদ্ধারের খবর পেয়ে তারা মুহ্যমান; কিন্তু এর চেয়ে শতগুণ বেশি টাকা রয়ে গেছে অধরা এবং বিদেশি ব্যাংকে। তার খোঁজ পাওয়া সহজে সম্ভব হয় না।
আমরা সব ব্যাপারে রাজনীতিকদের দোষ দেই; কিন্তু দেশ শাসনে রাজনীতিকরা কোথায়? প্রকৃত রাজনীতিকরা তো আজ রাজনীতির মাঠে নেই। আছে রাজনীতির মাঠ দখল করা নব্য ধনীরা। তারা আজ টাকার জোরে রাজনীতিক সেজেছে। সংসদের প্রায় নব্বই ভাগ সদস্য এই নব্য ধনীরা। মিডিয়ার মালিক তারা। শত শত প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি দেশে গড়ে উঠেছে।
শেখ হাসিনা প্রবল সাহস এবং আন্তরিকতা নিয়েই দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছেন। রাঘববোয়ালদের গায়ে হাতও দিচ্ছেন। তাতে দেশের মানুষের মতো আমিও আনন্দিত; কিন্তু সেই সঙ্গে ভয়ও পাচ্ছি। তার যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সাহস, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে অভিযান তিনি শুরু করেছেন, তাতে হয়তো এর উত্সমূলেও তিনি হাত দেবেন; কিন্তু তারপর? এই প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই।
উৎসঃ ইত্তেফাক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন