আর দুই বছর পরেই আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করতে পারব। স্বাধীনতার ৪৮ বছর ধরেই দিবসটি নিয়ে লিখছি। আমাদের বুদ্ধিজীবীরাও লেখেন। এ বছরও লিখেছেন। স্বাধীনতার তাৎপর্য, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি নিয়ে সংবাদপত্রের বিশেষ ক্রোড়পত্রে থাকবে নানা ধরনের পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেখা। আমি সেই ভিড়ে না মিশে স্বাধীনতা দিবসের জন্মলগ্নেই তার নাম নিয়ে একটি বিতর্ক সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই। এতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য বোঝা যাবে।
তখন মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বদেশে ফিরে এসে রাষ্ট্রের হাল ধরেছেন। ১৬ই ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস। ২৬শে মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। দ্বিতীয় বিজয় দিবসের (১৯৭২) প্রাক্কালে আবুল মনসুর আহমদ একটি প্রস্তাব তুললেন। দৈনিক ইত্তেফাকে তিনি লিখলেন, ১৯৪০ সালে লাহোরের মুসলিম লীগের সভায় ধর্মের ভিত্তিতে যে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব উঠেছিল, যা লাহোর প্রস্তাব নামে পরিচিত, সেই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের উদ্ভব।
কিছুদিন পর তিনি আরেকটি কাগজে লিখলেন, যেহেতু লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাংলাদেশের উদ্ভব [লাহোর প্রস্তাবে ছিল ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ করে উত্তর-পূর্ব ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব ভারতে মুসলিম সংখ্যাগুরু স্টেটস (একটি স্টেট নয়) প্রতিষ্ঠিত হবে], সেহেতু বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসকে আজাদি দিবস আখ্যা দিতে হবে। আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন শুধু খ্যাতনামা সাহিত্যিক নন, আওয়ামী লীগের একজন প্রথম সারির নেতাও। বঙ্গবন্ধুরও শ্রদ্ধাভাজন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে মনসুর ভাই ডাকতেন। সুতরাং তাঁর প্রস্তাবকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করার সাহস আওয়ামী লীগেরও কারো ছিল না।
আবুল মনসুর আহমদের এক আত্মীয় ছিলেন খোন্দকার আব্দুল হামিদ। তিনিও বিখ্যাত সাংবাদিক ও রাজনীতিক ছিলেন। তবে ছিলেন আবুল মনসুর আহমদের মতামত দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত। তিনি মনসুর আহমদের দ্বারা প্রভাবিত ও উৎসাহিত হয়ে বাংলাদেশের মানুষ বাঙালি নয়, বাংলাদেশি বলে তাদের চিহ্নিত করলেন। বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য তিনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নামে এক স্বতন্ত্র তত্ত্ব প্রচার করেন। বঙ্গবন্ধু এই তত্ত্ব গ্রহণ করেননি। তিনি আমাকে ডেকে বললেন, ‘ইত্তেফাকে মনসুর ভাইয়ের লেখাটা পড়েছ?’ বললাম পড়েছি। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তোমাকে তো এর একটা জবাব লিখতে হয়।’ আমি আঁতকে উঠে বললাম—বঙ্গবন্ধু, আমি লিখব মনসুর ভাইয়ের লেখার জবাব? তিনি আমার পিতৃপ্রতিম সাহিত্যিক, স্কুলজীবন থেকে আমি তাঁর লেখার ভক্ত। তাঁর ‘আয়না’, ‘ফুড কনফারেন্স’, ‘আসমানী পর্দা’ মুগ্ধ হয়ে পড়েছি। আমার মতো পুঁচকে ছোকরা যাব তার সঙ্গে কলমযুদ্ধে নামতে?
বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তুমি মনসুর ভাইয়ের মত সমর্থন করো?’ বললাম, তা করি না। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তাহলে ওই লেখার জবাব লিখবে না কেন? তুমি তো তাঁকে গালাগাল করবে না। সেটা বেয়াদবি। তুমি যুক্তির উত্তরে যুক্তি দেখাবে। স্বাধীনতার যে আদর্শ ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য কলম হাতে যুদ্ধ করেছ, তার ওপর আঘাত এলে তুমি তার মোকাবেলা করবে না?’
আমি বিনীতভাবে বললাম, বঙ্গবন্ধু, আমি লিখতে পারি; কিন্তু ছাপবে কে? এখন ইত্তেফাকে কলাম লিখি। ওই কাগজেই মনসুর ভাইয়ের লেখা ছাপা হয়েছে। তারা কি তাদের কাগজে সেই লেখার প্রতিবাদ ছাপবে? বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তুমি হীরু ব্যারিস্টার আর মঞ্জু—দুই ভাইকেই জিজ্ঞাসা করে দেখো।’ আমি ব্যারিস্টার মইনুলকে কিছু বলার সুযোগ পাইনি। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে বলতেই তিনি লাফ দিয়ে উঠে বললেন, ‘আলবত ছাপাব। আপনার লেখায় কেউ হাত দেবে না।’
যত দূর মনে পড়ে, ১৯৭২ সালের শেষ দিকে ইত্তেফাকে আমার লেখাটা ছাপা হয়েছিল। আমার লেখার সারকথা ছিল—লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাংলাদেশ হয়নি। লাহোর প্রস্তাবের মূলকথা ছিল ধর্মীয় দ্বিজাতীয় তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হবে। ভারতে অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর অস্তিত্ব ও অধিকার সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য ও অস্বীকার করে শুধু হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দেশ ভাগ করার প্রস্তাব দেওয়া হয় এবং ভারতের পূর্বাঞ্চলের দেশটিকেও মুসলিম রাষ্ট্র করার ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তীকালে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত যুক্ত বাংলা গঠনের প্রস্তাবটিও বানচাল করা হয়।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অবিভক্ত ভারতকে একটি মাল্টিন্যাশন ও মাল্টিকালচারাল দেশ হিসেবে দেখেছেন। বাঙালি, সিন্ধি, পাঞ্জাবি, পশতু ইত্যাদি জাতি-গোষ্ঠী নিয়ে ভারতীয় মহাজাতি গঠিত। ধর্মীয় জাতিতত্ত্বের অবাস্তব ভিত্তিতে ভারত ভাগ হওয়ায় বেশির ভাগ জাতি নিপীড়িত এবং অধিকারবঞ্চিত। ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশই আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার বদলে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার প্রকোপে পড়েছে এবং পারস্পরিক হানাহানি বাড়ছে। এ অবস্থায় ভাষাভিত্তিক ও ভৌগোলিক জাতীয়তা ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় মুসলিম লীগের ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক লাহোর প্রস্তাবকে অবাস্তব প্রমাণ করেছে এবং এই উপমহাদেশে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ যে বড় ধরনের ভুল হয়েছিল, তা স্পষ্ট করে দিয়েছে।
মনসুর ভাইয়ের দ্বিতীয় প্রতিপাদ্য ছিল, ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ করে পাকিস্তান হওয়ায়ই পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম সম্ভব হয়েছে। সুতরাং পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসই আমাদেরও স্বাধীনতা। লাহোর প্রস্তাবের পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়েছে ২৬শে মার্চ ১৯৭১। সুতরাং বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসকেও আজাদি দিবস বলা উচিত।
আমি এই বক্তব্যের প্রতিবাদে লিখি। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ লাহোর প্রস্তাবের পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি, বরং ওই প্রস্তাবকে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার জনক প্রমাণ করে এবং একটি মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার কাঠামো ভেঙে বাংলাদেশের একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠা বিরাট ঐতিহাসিক ঘটনা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা দ্বারা বাঙালি জাতি স্বাধীন হয়নি, বরং নতুন ঔপনিবেশিক প্রভুর দাসত্বজালে বাঁধা পড়েছিল। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার যুদ্ধ দ্বারা পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা ভাষা, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিকভাবে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করে। ২৬শে মার্চই সে জন্য তার প্রকৃত স্বাধীনতা দিবস।
আমি আরো লিখেছিলাম, আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের শুরু যেহেতু ভাষাসংগ্রামের মাধ্যমে, সেহেতু আমাদের স্বাধীনতা দিবসকে আজাদি দিবস আখ্যা দিলে সেই মহান ভাষাসংগ্রামকে অপমান করা হবে। আমাদের ভাষায় কোনো বিদেশি শব্দ তখনই গ্রহণ করা যেতে পারে, যখন সেটি আমাদের নেই; কিন্তু স্বাধীনতার মতো একটি সুন্দর শব্দ বাংলা ভাষায় আছে। আমরা সেখানে আজাদি শব্দটি গ্রহণ করতে যাব কেন? বঙ্গবন্ধু যেখানে তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণে বলেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, সেখানে আমরা আজাদি শব্দ ব্যবহার দ্বারা আমাদের স্বাধীনতার বৈশিষ্ট্য বিসর্জন এবং হানাদার পাকিস্তানিদের লেজুড়বৃত্তি করতে যাব কেন? বরং ভারতেও ব্রিটেনের দেওয়া স্বাধীনতা সম্পর্কে একেবারে সেই চল্লিশের দশকেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি স্লোগান তুলেছিল, ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’।
১৯৭২ সালের শেষ দিকে দৈনিক ইত্তেফাকে আমার এই লেখা বেরিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু আমার লেখাটি পাঠ করে খুশি হয়েছিলেন। আমি আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর কাছে এ জন্যই কৃতজ্ঞ যে তিনি সেই সময়ে লেখাটি ছাপানোর ব্যাপারে এককথায় রাজি হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বাঙালি জাতীয়তাবাদের পাল্টা সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ খাড়া করার পেছনেও ছিলেন আবুল মনসুর আহমদ। তাঁর আত্মীয় এবং প্রিয় শিষ্য খোন্দকার আব্দুল হামিদ জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলের কিছুদিনের মধ্যে তাঁর প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। তাঁর যুব দপ্তরের মন্ত্রীও হয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান তাঁর কাছ থেকেই বাংলাদেশি জাতীয়তার তত্ত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু তখন বেঁচে নেই। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা জবরদখল করেছেন। তখন বাংলা একাডেমির বার্ষিক সম্মেলনে খোন্দকার আব্দুল হামিদকে প্রধান বক্তা করার জন্য জিয়াউর রহমান চাপ দেন। বাংলা একাডেমির তখনকার কর্তৃপক্ষ জিয়াউর রহমানকে জানায়, সম্মেলনের সব প্রস্তুতি শেষ। বক্তাদের নামও কার্ডে ছাপা হয়ে গেছে। এ সময় নতুন কোনো বক্তার নাম অন্তর্ভুক্তি সম্ভব নয়। জিয়াউর রহমান তবু চাপ অব্যাহত রাখলেন। খোন্দকার আব্দুল হামিদ বক্তৃতা দিলেন। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের দীর্ঘ ব্যাখ্যা দিলেন। তাঁর বক্তব্যের সারকথা, মুসলমান বাঙালি ও হিন্দু বাঙালি মিলে এক জাতি হতে পারে না। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি এক হলেও তার মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ হবে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। জিয়াউর রহমান এই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে তাঁর দলের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন।
আমি তখন লন্ডনে। জিয়াউর রহমানের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেশে বসে কিছু বলার বা লেখার সাহস অনেকেরই নেই। ঠিক করলাম, আমি লিখব। কিন্তু ঢাকার কোনো কাগজ ছাপাবে কি? এবারও সাহায্য পেলাম ইত্তেফাকের কাছ থেকে—বিশেষ করে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের কাছ থেকে। তিনি আমার লেখাটি ইত্তেফাকের চিঠিপত্র কলামে ছাপাতে রাজি হলেন। আমার এই লেখাই পরে বর্ধিত আকারে ‘আমরা বাংলাদেশি, না বাঙালি’—নামে বই আকারে বেরিয়েছে। সে জন্য এখানে আর আমার বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করলাম না। আমার বক্তব্যের মোদ্দা কথা ছিল, আমাদের স্থায়ী জাতীয় পরিচয় বাঙালি। নাগরিক পরিচয় বাংলাদেশি। যেকোনো বিদেশি বাংলাদেশে এসে বসবাস করলে নাগরিক পরিচয়ে বাংলাদেশি হতে পারবে। ইচ্ছা করলে ধর্মও পরিবর্তন করতে পারবে। কিন্তু জাতিপরিচয় বদলে বাঙালি হতে পারবে না। ইংল্যান্ডে বহু বিদেশি নাগরিকত্ব বদল করে ব্রিটিশ হয়েছে। কিন্তু ইংলিশ জাতিপরিচয় গ্রহণ করতে পারেনি। বাঙালি জাতীয়তা ও বাংলাদেশি নাগরিকতার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। এই বিরোধ বাধিয়েছেন নিজের শিক্ষা-দীক্ষায় স্বল্পতার জন্য জেনারেল জিয়াউর রহমান। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদকে যখন রোখা যাচ্ছে না তখন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বাতাবরণে একটি সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করা। বর্তমানে বাংলাদেশি নাগরিক—এই পরিচয় প্রতিষ্ঠা করা গেছে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আবরণে পাকিস্তানের ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্ব বাংলাদেশের মানুষকে গেলানো যায়নি।
জিয়াউর রহমানের জীবদ্দশায়ই বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও কবি সৈয়দ আলী আহসান একবার লন্ডনে এসেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন। আমি জানতাম, তিনি অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী মানুষ ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। জিয়াউর রহমানেরও উপদেষ্টা হয়েছিলেন। তিনি লন্ডনে এলে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাই। অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে তাঁর কাছে শুনতে পাই, জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার পতাকা বদল করে সূর্যের বদলে চাঁদ-তারা বসাতে চান। সংবিধানে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিতে চান। ‘আমার সোনার বাংলা গান’ জাতীয় সংগীত হিসেবে বাদ দিয়ে কবি আল মাহমুদকে দিয়ে নতুন জাতীয় সংগীত লেখাতে চান। তিনি এরই মধ্যে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান পাল্টে দিয়ে পাকিস্তানের অনুকরণে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ প্রবর্তন করেছেন এবং বাংলাদেশ বেতার নাম পাল্টে রেডিও পাকিস্তানের অনুকরণে রেডিও বাংলাদেশ রেখেছেন।
এখন এই সামরিক শাসকের অভিলাষ ২৬শে মার্চের স্বাধীনতা দিবসকে বলা হবে ‘আজাদি দিবস’ এবং ১৬ই ডিসেম্বরের ‘বিজয় দিবস’কে বলা হবে ‘ঈদুল ফতেহ’। ঈদ অর্থ উৎসব এবং ফতেহ অর্থ বিজয়। ১৬ই ডিসেম্বর পালন করা হবে বিজয় দিবসের বদলে ঈদুল ফতেহ। সৈয়দ আলী আহসান আমাকে বললেন, (সম্ভবত তাঁর আত্মজীবনীতেও এ সম্পর্কিত কিছু লেখা রেখে গেছেন) সৈয়দ আলী আহসান আমাকে বললেন, “জিয়াউর রহমান আমাকে ডেকে তাঁর এই পরিকল্পনা সম্পর্কে মতামত জিজ্ঞাসা করেছিলেন। আমি তাঁকে বলেছি, ‘আপনি কি পাগল হয়েছেন।’”
সৈয়দ আলী আহসান নিজে মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী হয়েও জিয়াউর রহমানের পরিকল্পনা শুনে বিস্মিত হয়েছেন এবং তাঁকে তাঁর আপত্তি জানিয়েছেন। অবশ্য জিয়াউর রহমান তাঁর সেনাবাহিনীতে অনবরত অভ্যুত্থান এবং দিনরাত কারফিউ জারি রেখে দেশ চালাতে গিয়ে এতই ব্যতিব্যস্ত ছিলেন যে তাঁর এই চক্রান্ত সফল করার সময় ও সুযোগ পাননি। এর আগেই চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে তিনি সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যের গুলিতে নিহত হন।
এরশাদ ও খালেদা জিয়ার আমলে স্বাধীনতা দিবস পালন একেবারেই ম্লান ও অর্থহীন হয়ে পড়েছিল। সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজ, সরকারি অনুষ্ঠানে স্বাধীনতা দিবসের আদর্শ ও উদ্দেশ্যের ভুল ব্যাখ্যা, ইতিহাস বিকৃতকরণ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। স্বাধীনতাযুদ্ধের মহানায়ক ও তাঁর সহযোগীদের নাম উচ্চারণ করা হতো না। এক খলনায়ককে সেখানে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে উপস্থিত করা হতো।
সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় ছিল, যেসব দেশদ্রোহী মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে হানাদারদের সহযোগী হয়েছে, স্বাধীনতার পতাকা পদদলিত করেছে, তারা যখন খালেদা জিয়ার সরকারের ‘মাননীয় মন্ত্রী’ হিসেবে গাড়িতে সেই স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে জাতীয় বীরদের স্মৃতিসৌধে গিয়ে শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর ভান করেছে তখন মনে হয়েছে, কলকাতার বিখ্যাত বামপন্থী সাপ্তাহিক কম্পাস লিখেছিল, ‘এ যেন সিজারকে হত্যা করার পর তাঁর সমাধিতে গিয়ে ব্রুটাসের শ্রদ্ধা নিবেদন।’
আজ ২০১৯ সালের ২৬শে মার্চ। বাংলাদেশের ৪৮তম স্বাধীনতাবার্ষিকী। নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে দিবসটি পালিত হচ্ছে। যারা এই দিবসের সব বৈশিষ্ট্য হরণ করেছিল এবং ৩০ লাখ শহীদের রক্ত রঞ্জিত পতাকার অবমাননা করতে চেয়েছিল তারা আজ মঞ্চ থেকে অপসারিত। এই স্বাধীনতার দিনটি ৪৮ বছর আগে বাংলার মানুষকে দানবমুক্ত করেছে। এখন বাংলার মানুষ এই দিনটিকে, তার পতাকাকে দানবচক্রের কবলমুক্ত করেছে। এবারের সাধারণ নির্বাচনেও এই দানবশক্তির চক্রান্ত সফল হয়নি। জাতি তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের পথে শত বাধাবিঘ্নের মুখেও অগ্রসর হচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলি, ‘...দানবের মূঢ় অপব্যয়/গ্রন্থিতে পারে না কভু ইতিবৃত্তে শাশ্বত অধ্যায়।’
উৎসঃ কালেরকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন