বিএনপি কেন ড. কামাল হোসেনকে নেতা মানতে রাজি?
09 October 2018, Tuesday
বাংলাদেশের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে এখন নানা ধরনের নাটকের অভিনয় চলছে। দুঃখ হয় শারীরিক অসুস্থতার জন্য এই মুহূর্তে দেশে আসতে পারছি না এবং এই নাটক স্বচক্ষে দেখে উপভোগ করতেও পারছি না। বেশির ভাগ নাটকেই একজন বিদূষক থাকেন। তিনি নাটকটির অভিনয় চলাকালে দর্শকদের হাসানোর দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের রাজনীতির মঞ্চেও এখন দেখছি একজন নয়, একাধিক বিদূষকের আবির্ভাব হয়েছে। তাঁরা আবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি বিদূষক ফ্রন্টও গঠন করেছেন। তাঁরা অবশ্যই তাঁদের দর্শকদের প্রচুর হাসাচ্ছেন। বিদূষকসুলভ গুরুগাম্ভীর্য নিয়ে তাঁরা কথা বললেই মানুষ হাসে। অতীতেও তাঁদের ভূমিকা মানুষ দেখেছে, হেসেছে এবং এখনো হাসছে।
এই কৌতুক-নাট্যের একটা সিরিয়াস দিকও আছে। সেটা হলো এই বিদূষক সমিতিতে যুক্ত হতে বিএনপির গড়িমসি। প্রথম দিকে তারা মহানগর নাট্যমঞ্চে অন্যদের বাহুতে বাহু মিলিয়ে দাঁড়িয়ে অভিন্ন কণ্ঠে ‘আওয়ামী বধ কাব্য’ আবৃত্তি করেছে। এর পরই এই বাহুবন্ধন ছিন্ন হয়ে গেছে। এই ঐক্য ঐক্য নাটকের অন্যতম প্রধান বিদূষক বাতের ব্যথা সারাতে সিঙ্গাপুরে চলে যান। বিএনপি-জামায়াত একা একা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করে। এতে এত যে ঢাকঢোল পিটিয়ে ঐক্যপ্রক্রিয়ার শুরু তাদের কোনো নেতাকে দেখা যায়নি। বিএনপি, যুক্তফ্রন্ট ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার মধ্যে কর্মসূচিগত ঐক্যের কথা এখনো শোনা যাচ্ছে; কিন্তু প্রক্রিয়ার কোনো অগ্রগতি নেই। বিএনপি-জামায়াত ৩ ও ৪ অক্টোবর একা তাদের কর্মসূচি পালন করেছে। ঐক্যপ্রক্রিয়ার কেউ তাতে যায়নি।
মাঝখানে এই ঐক্য প্রচেষ্টায় একটা বাগড়া পড়েছিল। ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারা থেকে বলা হয়েছিল, জামায়াতকে ছেড়ে না এলে বিএনপির সঙ্গে ঐক্য হবে না। এ ব্যাপারে ড. কামাল হোসেনের অবস্থান খুব স্পষ্ট নয়। ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব। তারেক ও জামায়াত মিলে তাঁকে দল ও রাষ্ট্রপতির পদ ছাড়তে বাধ্য করে। এই অপমানবোধ থেকে তিনি জামায়াতের কোলে বসা বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করতে চাইবেন না, এটা স্বাভাবিক। আবার বিএনপি-জামায়াতের পক্ষেও ঐক্যপ্রক্রিয়ায় যোগ দিয়ে ডা. চৌধুরীর নেতৃত্ব মেনে নেওয়া কষ্টকর। তাদের আশঙ্কা, ডা. বি চৌধুরী ফ্রন্ট, প্রক্রিয়া ও বিএনপির মিলিত ঐক্যজোটে অন্যতম শীর্ষ নেতা হলে এই জোট থেকে জামায়াতকে তো তাড়াবেনই, বিএনপিতে তারেকের নেতৃত্বের জন্যও এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবেন।
ডা. চৌধুরী অতীতে বিএনপির দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা ছিলেন। দলে এখনো তাঁর অনুরাগীর সংখ্যা কম নয়। বিএনপির এক সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা ও কর্মী তারেক রহমানকে নেতা হিসেবে মানতে রাজি নয়। কিন্তু মুখে তারা সে কথা প্রকাশ করতে সাহস ও সুযোগ পাচ্ছে না। এখন ঐক্যজোটে যদি তারা ডা. চৌধুরীর নেতৃত্ব পায়, তাহলে দলে তাঁকে ফিরিয়ে এনে নেতৃত্বে বসাতেও তারা উৎসাহী হতে পারে। এই আশঙ্কায় তারেক রহমান এবং জামায়াতও ঐক্যপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হতে অরাজি। কিন্তু হাসিনা সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের লক্ষ্যে এই ঐক্যপ্রক্রিয়ার সঙ্গে আলাদা অবস্থানে থেকে কর্মসূচিগত ঐক্য গড়ায় উৎসাহী। আমার ধারণা, সে জন্যই শুরু থেকেই তারা বলে আসছে এবং সম্প্রতিও বলেছে, ‘বিএনপি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্ব মেনে নিতে রাজি আছে।’ ড. কামাল হোসেনের নামের সঙ্গে ঐক্যপ্রক্রিয়ার দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা ডা. বদরুদ্দোজার নামটি তারা উচ্চারণ করছে না। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় থেকেই তাঁর সঙ্গে ড. কামাল হোসেনের সৌহার্দ্য এবং মুখে জামায়াতের নিন্দা করলেও ইফতার পার্টিতে তাঁদের সঙ্গে একসঙ্গে বসে খানাপিনা ড. কামালকে বিএনপি ও জামায়াতের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।
সবচেয়ে বড় কথা, তারেক রহমান বিএনপিতে তাঁর নেতৃত্বের জন্য ড. কামাল হোসেনকে কোনো বিপদ মনে করেন না। ড. কামাল কোনো দিন বিএনপির নেতা ছিলেন না। ছিলেন বিএনপির প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের নেতা। বিএনপিতে এই নেতার কোনো অনুগামী নেই। সুতরাং ঐক্যজোটে তিনি নেতা হলে তারেক বা জামায়াতের আশঙ্কার কিছু নেই। তাঁর সঙ্গে ডা. বি চৌধুরী জোটে দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা হলেও ড. কামালের মাধ্যমেই তাঁকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন বলে তারেক ও জামায়াত আশা করে। এটা আমার অনুমান নয়, লন্ডনে তারেকসংশ্লিষ্ট সূত্র থেকেই এ খবর পাওয়া।
এটা আমার প্রেডিকশন, ড. কামাল হোসেন ও ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি খোঁড়া যুক্তফ্রন্ট গঠিত হবে এবং বিএনপি তাতে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচির ভিত্তিতে অংশ নেবে। কিন্তু এটা বেশিদিন টিকবে না। নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হলেই এ ঐক্যজোট মেদিনী কাঁপিয়ে আন্দোলনে নামবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এর আগে অক্টোবর মাস থেকে দুর্বার আন্দোলন শুরু করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। সেই আন্দোলনের চেহারা দেশের মানুষ দেখেছে। এখন দেখার রইল নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হওয়ার পর রাজপথে বাঘ না বিড়াল বের হয়। দুষ্ট লোকেরা বলছে, তখন আবার ডা. চৌধুরী অসুস্থ হয়ে না পড়েন এবং ড. কামাল হোসেনকে হাঁটুর ব্যথা বেড়ে যাওয়ায় আবার সিঙ্গাপুরে যেতে না হয়।
বাঘ আর মোষ কি এক ঘাটে পানি খেতে পারবে? সাম্প্রতিক ঐক্যপ্রক্রিয়া তো গণতন্ত্রের জন্য নয়, ক্ষমতা দখলের জন্য। ঐক্যপ্রক্রিয়ার তিন গ্রুপ কি নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নে ও নিজেদের মধ্যে আসন বণ্টনে ঐকমত্যে পৌঁছতে পারবে? আর নির্বাচনে জয়ী হলে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর গদি নিয়ে কাড়াকাড়ি এবং মারামারি এড়াতে পারবে? খালেদা জিয়ার জেলমুক্তি ও তারেক রহমানকে সব দণ্ডাদেশ থেকে মুক্ত করে স্বদেশে ফিরিয়ে আনতে পারবে?
তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনলেও যুক্তফ্রন্টের বিপদ। আবার না ফিরিয়ে আনলেও বিপদ। তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে না পারলে যুক্তফ্রন্টের বিরুদ্ধে বড় শরিক বিএনপি ঘোঁট পাকাবে। এতে যুক্তফ্রন্ট বিযুক্ত ফ্রন্ট হতে পারে। আবার তাঁকে সব দণ্ড থেকে মুক্ত করে দেশে আনতে পারলে যুক্তফ্রন্টের নেতাদের জন্য আরো বড় বিপদ হবে। তারেক রহমান ষড়যন্ত্রে পারদর্শী। দেশের মাটিতে পা দিতে পারলেই তিনি স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করবেন। ডা. বদরুদ্দোজাকে আগে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে তাড়িয়েছিলেন। এবার যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় কোনো শীর্ষ পদে থাকলেও তা থেকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করবেন। কৌশলগত কারণে ড. কামাল হোসেনকে কিছুদিন শিখণ্ডীর মতো ব্যবহার করা হবে। এরপর তাঁকেও দেশের রাজনীতি থেকে অগস্ত্যযাত্রা করতে হবে। আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখ যেসব পাতিনেতা যুক্তফ্রন্টে আছেন, তারেক রহমানের সন্ত্রাস ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে তাঁরা শিশু। তাঁদের পরিণতি সম্পর্কে কিছু না লেখাই ভালো।
১৯৫৪ সালের হক-ভাসানীর যুক্তফ্রন্ট কোনো দুই নম্বরি যুক্তফ্রন্ট ছিল না। ছিল জনগণের সমর্থনপুষ্ট আসল যুক্তফ্রন্ট। সেই যুক্তফ্রন্টেরও পরিণতি আমরা দেখেছি। যুক্তফ্রন্টের নেতা হিসেবে প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিতে না নিতেই হক সাহেবের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়েছিল। মন্ত্রী পদ নিয়ে শুরু হয়েছিল শরিকি কোন্দল। এর সুযোগ নিয়ে কেন্দ্রের মুসলিম লীগের শাসকরা যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করে কিছুকালের জন্য আধাসেনা শাসন চাপিয়ে দেয়।
ইন্দিরাবিরোধী যুক্তফ্রন্টের একই পরিণতি ভারতেও দেখেছি। চরম সাম্প্রদায়িক দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইন্দিরা হটাও আন্দোলনে মিলিত হয়েছিল অনেক অসাম্প্রদায়িক দলও। তখনকার সমাজতন্ত্রী নেতা জয় প্রকাশ নারায়ণ ইন্দিরা গান্ধীকে হটানোর জন্য চরম সমাজতন্ত্রবিরোধী এবং প্রতিক্রিয়াশীল নেতা মোরারজি দেশাইয়ের সঙ্গে জোট বেঁধেছিলেন। নির্বাচনে এই জোট জয়ীও হয়েছিল। এর পরই দেখা দিল চরম বিভ্রাট। নীতিগত ও শরিকি বিবাদে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে গেল এবং ‘তিন দিনের নবাব’ মোরারজি দেশাইকে অবমাননাকর পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল। ইন্দিরা হটাও আন্দোলন করতে গিয়ে সেই যে ভারতের রাজনীতিতে খাল কেটে কুমির আনা হয়েছিল, সেই কুমিরই এখন উগ্র হিন্দুত্ববাদের মুখোশে ক্ষমতায় সমাসীন।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া বা যুক্তফ্রন্ট সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে উপমহাদেশের অতীতের দু-দুটি যুক্তফ্রন্টের পরিণতির উদাহরণ টানলাম বটে; কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে অতীতের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে বলে মনে করি না। কারণ এটি ঐক্যজোট নয়, চক্রান্তের ঐক্যঘোঁট। বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন এই চক্রান্ত মোকাবেলার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী। দেশের মানুষও সতর্ক ও সচেতন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর তারা আন্দোলনে নামবে বলে তড়পাচ্ছে। এর আগেই এই জগাখিচুড়ির ঐক্য প্রচেষ্টার দশা কী ঘটে, তা নিয়ে আর ভবিষ্যদ্বাণী করতে চাই না। ড. কামাল হোসেন জাতীয় ঐক্যের নেতা হতে চান। তিনি দেশে তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে কিছুদিনের জন্য বিএনপি-জামায়াতের অঘোষিত নেতা হতে পারবেন, তার বেশি কিছু নয়। পরম করুণাময় আল্লাহ তাঁকে শেষ বয়সে সুমতি দিন।
উৎসঃ কালেরকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন