গ্রিক ইতিহাসের ট্রোজান হর্স বা ট্রয়ের ঘোড়ার গল্পটি যে কত সত্য, এ যুগে ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার তা একবার টের পেয়েছিলেন। তিনি এই ঘোড়াদের নাম দিয়েছিরেন ‘এনিমি উইদিন’ বা ভেতরের শত্রু। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বাইরের শত্রুকে ভয় পাই না। কিন্তু ভেতরের শত্রুকে ভয় পাই। তাঁর কথার মর্মার্থ ছিল, শত্রুপক্ষ বাইরে থেকে আঘাত করে কোনো দলকে ঘায়েল করতে না পারলে মিত্র বেশে সেই দলে ঢোকে এবং দলটিকে ধ্বংস করতে চায়। মার্গারেট থ্যাচারের এই সতর্কবাণী মনে হয় দীর্ঘকাল পর বাংলাদেশেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলের কানে ঢুকেছে।
কয়েক দিন আগে ঢাকার কাগজে একটি খবরে বলা হয়েছিল, বিএনপি ও জামায়াতের দুই শতাধিক নেতাকর্মী আওয়ামী লীগের টিকিটে এখন জনপ্রতিনিধি, এমনকি অনেক স্থানে তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেও। এ ছাড়া আওয়ামী লীগে নানা কৌশলে ঢুকেছে এমন বিএনপি-জামায়াতের কর্মী ও সমর্থকের সংখ্যা কয়েক হাজার।
দেরিতে হলেও খবরটি অর্থাৎ দলে দলে বিএনপি ও জামায়াতের কর্মীদের আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশের কৌশলটি দলের হাইকমান্ডের চোখে পড়েছে। শেখ হাসিনা এই অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের আভাস দিয়েছেন। সম্প্রতি গণভবনে আওয়ামী লীগের এক বর্ধিতসভায় তিনি বলেছেন, তাদের দল থেকে বহিষ্কারের ব্যবস্থা করা হবে। সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সাহায্যে সংগ্রহ করা এসব অনুপ্রবেশকারীর নামধামসহ একটি তালিকা তাঁর হাতে এসেছে।
তাদের সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব দিয়েছেন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনির নেতৃত্বে গঠিত ছয় সদস্যের এক কমিটিকে। দলের যেসব নেতা বিএনপি-জামায়াত থেকে আসা এসব লোককে দলে ভিড়িয়েছেন, গণভবনের সভায় তিনি তাঁদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, ‘মনে রাখবেন, যাদের আপনারা দলে ভেড়াচ্ছেন, তারা আপনার মিত্র নয়। তারা আসে মধু খেতে। আমি তাদের সম্পর্কে একটা সার্ভে করিয়েছি, তাদের তালিকা আমার কাছে আছে। কেউ যদি তাদের প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন, এখনই তাদের বিদায় করুন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মীবাহিনী গড়ে তুলুন।’
শুধু হুঁশিয়ারি দেওয়া নয়, দলে অনুপ্রবেশকারী এবং তাদের প্রশ্রয়দানকারীদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন। খবরে বলা হয়েছে, তৃণমূলের সর্বস্তরের নেতার সঙ্গে বৈঠক এবং দীপু মনি-কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর অনুপ্রবেশকারী ও তাদের আশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেবেন। নানা কারণে বিএনপি-জামায়াতের লোকরা আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রদলের বহু সদস্য ও সমর্থক ছাত্রলীগে যোগ দিয়েছে। এই যোগ দেওয়ার প্রথম কারণ, তারা বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকাকালে সাধারণ মানুষের ওপর এত অত্যাচার করেছে যে পরিবর্তিত অবস্থায় জনগণের রোষ থেকে বাঁচার জন্য এখন আওয়ামী লীগে তাদের রাজনৈতিক আশ্রয়গ্রহণ।
বহু আগে সৈয়দ আশরাফ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন যে ছাত্রদলের বহু দুষ্কৃতী ছাত্রলীগে ঢুকেছে। তাদের স্বভাব বদলায়নি। ছাত্রলীগের জার্সি পরে তারা একই দুর্বৃত্তপনা করছে। দুর্নাম হচ্ছে ছাত্রলীগের। লাভ হচ্ছে বিএনপি-জামায়াতের। খবরের কাগজের পাতা খুললেই ছাত্রলীগের দুর্বৃত্তপনার খবর। এই মুখোশধারী ছাত্রলীগারদের মুখোশ খুলে দিতে হবে।
কিন্তু দীর্ঘকাল এই মুখোশ খুলে দেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগেও একই ব্যাপার ঘটেছে। আওয়ামী লীগের বহু নেতা, মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, এমপি স্থানীয়ভাবে তাঁদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বজায় রাখা এবং দলের প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাবু করে রাখার জন্য বিএনপি-জামায়াতের লোকদের নিয়ে নিজেদের গ্রুপ গঠন করেছেন এবং তাদের আওয়ামী লীগার বানিয়েছেন। শুধু আওয়ামী লীগার নয়, বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নমিনেশন পাইয়ে দিয়ে আগের নির্বাচনে বহু পরাজিত প্রার্থীকে জয়লাভে সাহায্য করেছেন এবং বিভিন্ন উঁচু পদে বসিয়েছেন।
এরও দীর্ঘ তালিকা বেরিয়েছে সংবাদপত্রে। উদাহরণ হিসেবে শুধু একটি ঘটনার উল্লেখ করি। নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে বিএনপি থেকে মনোনয়ন নিয়ে পরাজিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন নিয়ে চেয়ারম্যান হয়েছেন উপজেলা বিএনপির সহসাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম। এ রকম উদাহরণ অসংখ্য। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের যেসব নেতাকর্মী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর দারুণ নির্যাতন করেছে, সংখ্যালঘুদের ভিটাছাড়া করেছে, এখন তারা আওয়ামী লীগের হোমরাচোমরা হয়ে সাধারণ মানুষের ওপর একই ধরনের অত্যাচার করছে।
গত বছরের মে মাসে যখন আমি বাংলাদেশে গেছি তখন আমার জেলা বরিশালের এক সংখ্যালঘু নেতা আমার কাছে নানা অভিযোগ জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা আওয়ামী লীগকে আর ভোট দেব কেন? এখন তো আমাদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতারাই।’ আমি তাঁকে বলেছি, দাদা, একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন, এই অত্যাচারীরা প্রকৃত আওয়ামী লীগের কি না, নাকি তারা দুই দিন আগেই বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী ছিল? এই নব্য আওয়ামী লীগারদের অত্যাচারে দেশের মানুষ এখন জর্জরিত। কিন্তু এই নব্য আওয়ামী লীগারদের আসল প্রশ্রয়দাতা আওয়ামী লীগের কিছু পুরনো নেতাকর্মী, মন্ত্রী, এমপি। তাঁরা এলাকায় নিজের ও পরিবারের আধিপত্য বজায় রাখা, তাঁদের শোষণ-লুণ্ঠন-দুর্নীতি ঢাকা দেওয়া, প্রতিপক্ষকে দমন করে রাখা ইত্যাদি কাজে বিএনপি-জামায়াতের দুর্বৃত্ত শ্রেণির নেতাকর্মীদের ব্যবহার করেন। এ কারণে দেশের কোনো কোনো এলাকায় এই দুর্বৃত্তরা এখনো আওয়ামী লীগের প্রকৃত কর্মী ও সমর্থকদের ওপর নির্যাতন চালানোর সাহস ও সুযোগ পায়।
রাজবাড়ীর এক এমপির কথা শুনেছি, যিনি তিন-তিনবার জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হয়েছেন। তবু তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, এলাকায় নিজের একাধিপত্য বজায় রাখার জন্য তিনি বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের ব্যবহার করেন। সরকারি গম-চাল বণ্টন নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ আছে। তা চাপা দেওয়ার জন্য সাধারণ মানুষের ওপর নির্মম অত্যাচার চালান। তাঁর যারা সমর্থক নয়, আওয়ামী লীগের এমন নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের হয়রানি করে।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিএনপি, জামায়াত ও শিবিরের লোকরা আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশের সুযোগ পেয়েছে তাদের অর্থবিত্তের সাহায্যে এবং আওয়ামী পরিবারের সঙ্গে কৌশলে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকাকালে তারা বৈধ ও অবৈধ পথে ব্যবসা-বাণিজ্য করে অঢেল অর্থের মালিক হয়। এখন বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতাহারা হওয়ার পর তারা এই অর্থ, ব্যবসা-বাণিজ্য রক্ষার জন্য নতুন কৌশল গ্রহণ করে। তারা আওয়ামী লীগের এক শ্রেণির নেতাকর্মীকে প্রলোভন দেখিয়ে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের পার্টনার করে ডিরেক্টর, ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পদে বসায়। তখন এই পার্টনারদেরই দায়িত্ব হয় তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থসম্পদ রক্ষা এবং তা পাহারা দেওয়ার।
জামায়াতিদের আত্মরক্ষার আরেকটি কৌশল হলো, সুযোগমতো তাদের সমর্থক নয় এমন পরিবারের, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সমর্থক পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা। এসব পরিবারে পরিকল্পনামতো নিজেদের ছেলে বা মেয়ের বিয়ে দিয়ে ওই পরিবারে অনুপ্রবেশ করা এবং পরিবারটির সমর্থন জামায়াতের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। রাজশাহীতে, বিশেষ করে বিনোদপুর এলাকায় তাদের এই এক্সপেরিমেন্ট অত্যন্ত সফল হয়েছে। রাজশাহী এখন জামায়াতের ও ছাত্রশিবিরের শক্ত ঘাঁটি। সাম্প্রতিক কোটা পদ্ধতিবিরোধী আন্দোলনেও এটা দেখা গেছে।
একটি সাধারণ নির্বাচন একেবারে সামনে নিয়ে দলে ব্যাপক সংস্কারের পদক্ষেপ নেওয়া সহজ নয়। এই সংস্কারে হাত দেওয়া উচিত ছিল বহু আগে। কারণ আওয়ামী লীগ যে অনুপ্রবেশকারীদের দখলে চলে যাচ্ছে, বিভিন্ন মহল থেকে এই সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে বহু আগে। এখন নতুনভাবে উচ্চারিত হলো মাত্র। আওয়ামী লীগে এত দিনে ট্রয়ের ঘোড়ার দল শক্তভাবে ঘাঁটি গেড়েছে।
তবু শেখ হাসিনা এই ট্রয়ের ঘোড়াদের সম্পর্কে সতর্ক হয়েছেন এবং তাদের কবল থেকে দলকে মুক্ত করার শক্ত পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন—এটা আশার কথা। স্থানীয় সরকারের মতো যাতে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে অনুপ্রবেশকারী ঢুকতে না পারে সে জন্য আওয়ামী লীগ সভানেত্রী দীপু মনি-কমিটির প্রতিবেদনসহ অন্যান্য প্রতিবেদন ব্যাপক যাচাই-বাছাই শেষে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তা ছাড়া বলেছেন, যাঁরা ক্ষমতায় থেকে জনবিচ্ছিন্ন, দখলবাজ, নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে সংগঠনের ক্ষতি করেছেন, এলাকায় গডফাদারের ভূমিকা নিয়ে দলকে করেছেন বিতর্কিত, এমন এমপি, মন্ত্রী নৌকা প্রতীক পাবেন না। দলের বর্ধিতসভায় তৃণমূলের নেতারাও অনুপ্রবেশ ঠেকাতে এমন ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নেত্রীকে অনুরোধ জানিয়েছেন।
‘আওয়ামী লীগের শত্রু আওয়ামী লীগ’—এই প্রবচন সত্য হয়েছে দলে অনুপ্রবেশকারীদের অবাধ প্রভাব বিস্তারের জন্য। দেরিতে হলেও তাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। সে ব্যবস্থা অবশ্য গ্রহণ করতে যাওয়া হচ্ছে। তবে কথা হলো, ‘লোম বাছতে কম্বল উজাড় হয়ে না যায়।’ সূত্রঃ কালের কন্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন