মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর প্রথম দিকে রাখাইন (আরাকান) থেকে উৎখাত করা এবং বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার কথা কয়েকবার শোনা গেলেও এখন আর শোনা যায় না; বরং হালে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের মুখে উল্টো সুর শোনা গেছে। তাদের মুখপাত্র সম্প্রতি বলেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যা তাঁদের অগ্রাধিকার তালিকায় নেই। এর অন্যতম কারণ মিয়ানমার আর রাখাইন অঞ্চলের রাখাইন জাতীয়তাবাদী নেতাদের চাপ।
সেনাশাসন জারির পর মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ক্ষমতাচ্যুত এনএলডির (ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি) সমর্থক ও জনগণের তরফ থেকে যে বিরোধের মুখে পড়েছে, তা তাদের কল্পনারও বাইরে ছিল। জান্তা সরকার এখনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অপেক্ষায় রয়েছে। আসিয়ান দেশগুলো দ্বিধাবিভক্ত, তাদের কাছেও রোহিঙ্গা ইস্যু খুব বড় বিষয় নয়। অন্যদিকে আসিয়ান দেশগুলোর মধ্যে সামরিক জান্তার বিরোধিতাও নেই।
এমন নয় যে সামরিক জান্তার পেছনে কোনো দেশেরই সমর্থন নেই। দুই বৃহৎ প্রতিবেশী ও এশিয়ার অন্যতম দুই শক্তিধর ভারত ও চীনের সমর্থন রয়েছে এই সরকারের প্রতি। ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় মিয়ানমার চীনের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ২০১৩ সালে চীনের বিশ্বব্যাপী নতুন ভূকৌশলগত পরিকল্পনা ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা বিআরআইয়ের যাত্রা শুরুর পর থেকে মিয়ানমারের বঙ্গোপসাগরতীরের রাখাইন (আরাকান) অঞ্চল বিশ্বের অন্যতম কৌশলগত ভূমিতে পরিণত হয়েছে। এখান থেকেই ‘কাচিয়াপু’ বন্দর ও ‘মাড়’ দ্বীপ মিলিয়ে গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে বর্তমানে মিয়ানমারের ‘সোয়ে’ গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস এবং বৃহৎ জ্বালানি তেলের টার্মিনাল থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে মিয়ানমারের মধ্যশহর মান্দানম হয়ে চীনের কুনমিং পর্যন্ত স্থাপিত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে সঞ্চালনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে এখান থেকেই চীন দ্রুতগতির রেললাইন স্থাপনার প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ হাতে নিয়েছে, যার একটি শাখা মিয়ানমারের বৃহৎ নগরী ও প্রধান বন্দর ইয়াঙ্গুনকে (রেঙ্গুন) যুক্ত করা হবে।
এসব পরিকল্পনা, সঙ্গে বৃহৎ এলাকাজুড়ে স্পেশাল এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন ২০১৫ সালের আগের পরিকল্পনা হলেও অং সান সু চির সময়ে তা গতিশীল হয়েছে। ওই সময় আরাকানবাসী এবং তাদের রাজনৈতিক দল এএনপি (আরাকান ন্যাশনাল পার্টি) এবং সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ) ও ইউএলএ (ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান) সু চি ও সামরিক বাহিনীর বিরোধী ছিল। একই সঙ্গে স্থানীয় জনগণের ৬০ শতাংশ, যারা মূলত বৌদ্ধধর্মাবলম্বী, তারা ৩০ শতাংশ মুসলমান ও বিশেষ করে রোহিঙ্গাবিরোধী ছিল এবং এখনো রয়েছে। রাখাইনের সংখ্যাগরিষ্ঠ এই ৬০ শতাংশ জনগোষ্ঠী এনএলডি, সামরিক বাহিনী এবং মিয়ানমারের বিরোধীও বটে। তবে সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে রাখাইনের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে জান্তার সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি হয়েছে এবং আরাকান আর্মিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ফলে আরাকানে ‘জান্তা’ সরকারের নিয়ন্ত্রণ বজায় রয়েছে।
আরাকান রাজ্যে ভারতের কালাদান প্রকল্প ও সিতওয়েতে (আকিয়াব) স্পেশাল ইকোনমিক জোনের বিরোধিতায় ছিল আরাকান আর্মি। ভারতীয় প্রকল্পে কর্মরত নাগরিকদের ওপর হামলা, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়—এগুলো ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। বর্তমানে জান্তার প্রতি ভারতের মৌন সমর্থনের কারণে পরিবেশ অনেকটাই শান্ত। তবে উত্তর রাখাইন অঞ্চলে ভারতের উপস্থিতি এবং আন্দামান-নিকোবরে নৌঘাঁটি ও বিমানঘাঁটির শক্তি বৃদ্ধি নিয়ে চীন খুব যে উদ্বিগ্ন তা নয়। কারণ, বঙ্গোপসাগরের প্রায় মাঝামাঝি আন্দামান থেকে উত্তর–পশ্চিমে মিয়ানমারের কোকো দ্বীপে চীনের পর্যবেক্ষণচৌকি বহুদিন থেকে বঙ্গোপসাগরকে নিরীক্ষণে রেখেছে।
রাখাইনে শুধু চীন-ভারতই নয়, তৃতীয় শক্তি হিসেবে প্রবেশের পথে রয়েছে মিয়ানমারের পঞ্চম বৃহৎ লগ্নিকারী দেশ জাপান। মিয়ানমারে চীনের যে ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত প্রভাব রয়েছে, তার কাছাকাছি না হলেও জাপান অং সান সু চির সময়ে, বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলে প্রচুর অর্থ লগ্নি করেছে। রাখাইনের মংডুর কাছাকাছি পরিকল্পিত ইকোনমিক জোনে জাপান বিশাল লগ্নিরও পরিকল্পনা করেছে। জাপান জান্তা সরকারের প্রতি সমর্থন না জানালেও খুব বিরোধিতাও করছে না। স্মরণযোগ্য যে ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরে চীনবিরোধী জোট ‘কোয়াড’-এর অন্যতম সদস্য জাপান। চার দেশের ওই জোটে (বাকি দেশগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত) জাপান বিশাল অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশ।
বর্তমানে বিশেষ করে রাখাইনে এই তিন শক্তির প্রতিযোগিতার কারণে একসময়ের মিয়ানমারের সবচেয়ে গরিব অঞ্চল রাখাইন এখন অন্যতম ভূকৌশলগত ভূমি হিসেবে সমাদৃত। এর প্রধান কারণ বিশাল সমতল প্রান্তর এবং বঙ্গোপসাগরের ১ হাজার ২০০ মাইল সাগরতীরের অঞ্চল।
বর্তমান বিশ্বের পরিবর্তিত ভূরাজনীতি ও অ্যাডমিরাল আলফ্রেড থায়ার মাহানের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘এশিয়াকে প্রভাববলয়ে রাখতে হলে ভারত মহাসাগরকে প্রভাবে রাখতে হবে।’ সেই বিবেচনা থেকে ভারত তার নৌশক্তি বৃদ্ধি করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভারত মহাসাগর নীতির প্রধান শক্তি হিসেবে এখন ভূমিকা পালন করছে। এ মাসেই বঙ্গোপসাগরে ‘মালাবার’ সামরিক অনুশীলন হওয়ার কথা রয়েছে, যেখানে প্রথমবারের মতো ‘কোয়াড’ সদস্যরা ছাড়াও ফ্রান্সের নৌবাহিনীর যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে।
একদিকে ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরে চীনবিরোধী জোটের শক্তির মহড়া, অন্যদিকে রাখাইনের পরিবর্তিত ভূকৌশলগত গুরুত্ব—এসব কারণে ‘রোহিঙ্গা’ বাস্তুহারারা এখন আন্তর্জাতিক ও মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ জান্তাবিরোধীদের রাজনীতির ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে ধারণা করা যায়।
জান্তাবিরোধী জোট ‘ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট’ (এনইউজি) গঠিত হয়েছে মূলত এনএলডির পার্লামেন্ট সদস্যদের সমন্বয়ে। সেখানে কিছু কাচিন ও কারেন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সদস্য রয়েছে। এনইউজি শুধু রাজনৈতিকভাবেই নয়, সশস্ত্র বিদ্রোহের জন্য তৈরি করেছে ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্স’ (পিডিএফ)। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে পরাস্ত বা দুর্বল করার মতো শক্তি তারা এখনো সঞ্চয় করতে পারেনি। তবে বিভিন্ন তথ্যমতে, সামরিক বাহিনীর কিছু নিম্নস্তরের সৈনিক ও কিছু তরুণ কর্মকর্তা পিডিএফে যোগ দিয়েছেন। লক্ষণীয় যে কারেন ও কাচিনদের সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর প্রায়ই সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেলেও রাখাইন অঞ্চলে এদের তৎপরতা একেবারেই শূন্য।
অন্যদিকে, এনইউজি ছায়া সরকার ক্ষমতা দখল করতে পারলে মিয়ানমারে ফেডারেল ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। সে একই সঙ্গে রাখাইনের বিতাড়িত এবং যারা রাখাইন অঞ্চলে বিভিন্ন ক্যাম্পে রয়েছে, তেমন রোহিঙ্গাদের শুধু নাগরিকত্ব প্রদানই নয়, বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা ফেরত এনে নাগরিকত্ব প্রদান করে পুনর্বাসন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এনএলডি–নিয়ন্ত্রিত এই এনইউজি ‘ছায়া’ সরকার ‘রোহিঙ্গা’ শব্দ ব্যবহার করেছে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের জান্তাবিরোধী সংগ্রামে যোগ দেওয়ার ডাক দিয়েছে। কিন্তু আরাকানের জাতীয়তাবাদী নেতারা এর বিরোধিতা করছেন এবং তাঁরা এনইউজির ‘রোহিঙ্গা’বিষয়ক পরিকল্পনায় একেবারেই সন্তুষ্ট নন। তবে আরাকান আর্মি এখনো এই রোহিঙ্গা পরিকল্পনার বিপক্ষে কোনো বিবৃতি দেয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এনইউজি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও সহযোগিতা বাড়াতে রোহিঙ্গা ইস্যুকে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে। বিশ্বের কোনো সরকারই এই ছায়া সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি এবং তেমন সম্ভাবনা খুবই কম। চীনের একটি কারিগরি ও সরকারি দল সম্প্রতি জান্তাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে দেখা করে এবং তাঁকে মিয়ানমারের প্রশাসক ও শীর্ষ নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। অন্যদিকে, ভূকৌশলগত বিবেচনায় এনইউজি সরকারের প্রতি ভারত সমর্থন জানাবে বলে মনে হয় না। জাপানও এই ছায়া সরকারের প্রতি কোনো ধরনের সমর্থন জানায়নি।
মিয়ানমারের জান্তাকে হটিয়ে এনইউজির ক্ষমতা দখল ও বর্তমানে সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধানে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করার বিষয়টি একধরনের অলীক স্বপ্ন। রোহিঙ্গা পুনঃপ্রত্যাবর্তনের যেকোনো প্রয়াস রাখাইনরা যে গ্রহণ করবে না, তা তাদের নেতারা একাধিকবার ব্যক্ত করেছেন। সবকিছু মিলিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন যে দীর্ঘায়িত এবং অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া ছাড়া বাংলাদেশের সামনে আপাতত কোনো পথ খোলা নেই। তবে রাখাইন অঞ্চলের পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক ও ভূকৌশলগত পরিবেশের দিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। রোহিঙ্গাদের অবশ্যই ফিরে যেতে হবে, তবে আরও কত বছর লাগবে, তা বলা কঠিন।
● ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন