৩১ জুলাই ২০২০ কক্সবাজারের টেকনাফে পুলিশ চেকপোস্টে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানকে যে কায়দায় হত্যা করা হয়েছে, একে ঠান্ডা মাথায় খুন ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। সিনহাকে বহনকারী প্রাইভেট কার থামানোর পর তিনি চেকপোস্টের ইনচার্জ এসআই লিয়াকতের কাছে তাঁর পরিচয় দিয়েছিলেন, এরপরও লিয়াকত প্রথমে সিনহার কোমরে একটি গুলি করেন এবং বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য, চিত্র ও রিপোর্ট অনুয়ায়ী, এরপর সিনহাকে মাটিতে চেপে ধরে চিবুকের নিচে হত্যার উদ্দেশ্যে আরও দুটি গুলি করেন। এমন তথ্যও আমরা পেয়েছি যে গুলিবিদ্ধ সিনহাকে ট্রাকে ওঠানোর পর সেখানেও আরও কয়েক দফা গুলি করা হয়েছে মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য। এর দুই ঘণ্টা পর তাঁকে কক্সবাজার হাসপাতালে নেওয়া হয় মৃত ঘোষণা করার জন্য। হাসপাতালের সুরতহালের ছবি এবং এ–সংক্রান্ত নানা তথ্য এখন হাতে হাতে ঘুরছে।
তা ছাড়া এরই মধ্যে সংবাদমাধ্যমগুলোতে হত্যা–পরবর্তী বিভিন্ন ফোনালাপ দেশের মানুষ শুনেছে। এসআই লিয়াকতের তাৎক্ষণিকভাবে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশকে অকুস্থলে আনা থেকে শুরু করে কক্সবাজারের এসপির সঙ্গে কথোপকথন, এমনকি ওসি প্রদীপের কোনো এক আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলা, পুলিশের মামলা সাজানো বিষয়ে পরামর্শ—সবই জনগণ শুনেছে। এ ঘটনার মূল তিন আসামিসহ সাতজন এখন কারাগারে, র্যাব ঘটনার তদন্ত করছে।
টেকনাফ থানায় পুলিশ এ মামলাকে যেভাবে সাজিয়েছে, তাতে নতুনত্ব নেই। এই গল্প তথাকথিত যেকোনো বন্দুকযুদ্ধের গল্পের মতোই। পুলিশের এফআইআরে প্রথমত সময়ের হেরফের যেমন আছে, তেমনি বিশ্বাসযোগ্যতারও সমস্যা রয়েছে। বলা হয়েছে, এসআই লিয়াকতকে মেজর (অব.) সিনহা তাঁর পিস্তল থেকে গুলি করেছিলেন, যা তাঁর গায়ে লাগেনি, তাই পাল্টা জবাব। আমার সামরিক বাহিনীর যৎসামান্য অভিজ্ঞতা এবং মেজর সিনহার এসএসএফে থাকাকালীন অস্ত্র প্রশিক্ষণের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে বলা যায়, যেখানে চার সেকেন্ডে আটটি গুলি টার্গেটে লাগার কথা, সেখানে একটি গুলির গল্প ফাঁদা খুবই হাস্যকর।
ঘটনাকে তাৎক্ষণিকভাবে চাপা দিয়ে অন্য খাতে প্রবাহিত যাতে না হতে পারে, সে কারণে অকুস্থলে আর্মি সিকিউরিটি ইউনিটের সার্জেন্ট আইয়ুব আলী ৯টা ৪০ মিনিটে উপস্থিত হয়ে পরিচয় দিয়ে ভিডিও ধারণ করতে গেলে তাঁর কাছ থেকে মুঠোফোন ও পরিচয়পত্র ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
পুলিশের হাতে মেজর (অব.) সিনহার মৃত্যুর ঘটনা সেনাসদস্যদের মর্মাহত করেছে। সেনাপ্রধান ও পুলিশের আইজির ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও যৌথ সংবাদ সম্মেলন প্রমাণ করে যে এ নিয়ে একধরনের চাপা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারাও প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (আরএওডব্লিউএ) প্রথমবারের মতো দিনব্যাপী আলোচনা ও সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে দ্রুত বিচারসহ বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করেছে। এরই মধ্যে আইএসপিআরের এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানতে পারলাম, পুলিশের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে এটাই শেষ ঘটনা।
কক্সবাজারের টেকনাফে ওই দিন যে ঘটনা ঘটেছে, তা শুধু সামরিক বাহিনী নয়, দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছে। এ ধরনের বিচারবহির্ভূত শত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও এবারের মতো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। টেকনাফের ঘটনা পুলিশ প্রশাসনকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের সূত্রে জানা যাচ্ছে, ‘সামরিক’ বরখাস্ত ওসি প্রদীপ দাশ বিগত প্রায় ১৫ বছর বৃহত্তর চট্টগ্রামেই কর্মরত ছিলেন এবং কোনো কোনো কর্মকাণ্ডের জন্য তাঁকে একাধিকবার প্রত্যাহার এবং সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও কোনো অদৃশ্য শক্তির বলে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে এখন প্রচুর অভিযোগ শোনা যাচ্ছে, অথচ এতগুলো বছর পুলিশ প্রশাসন কিছুই আমলে নেয়নি অথবা নিতে পারেনি। তিনি পিপিএম ও বিপিএমে ভূষিত হয়েছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, এসব ‘বন্দুকযুদ্ধের’ সঙ্গে পুলিশের স্বল্পসংখ্যক সদস্য বা থানার ভারপ্রাপ্তরা জড়িত হলেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পুরো পুলিশ বাহিনীকেই জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশে ঘটে আসছে বহু বছর ধরে। বিএনপি সরকারের আমলে অপারেশন ক্লিনহার্ট থেকে শুরু করে মেজর (অব.) সিনহা হত্যা একই ধারাবাহিকতার অংশ। বিগত এক যুগ এ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো সোচ্চার হলেও তা থামেনি।
নারায়ণগঞ্জে সাত হত্যা মামলায় প্রথম র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সেনাবাহিনীর কর্নেল র্যাঙ্কের অফিসারকে মামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বরখাস্ত করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও এর কোনো বিচার হয়নি। এসব ঘটনা বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যেমন ক্ষুণ্ন করেছে, তেমনি পুলিশ প্রশাসনে প্রদীপ দাশদের উত্থানের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে।
পুলিশ বাহিনীর কমান্ড চ্যানেল শুরু হয় থানা বা পুলিশ স্টেশন থেকে। পুলিশের থানাগুলো হওয়া উচিত বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারের প্রথম নিযুক্তির স্থান। এর মাধ্যমে পুলিশের সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা এবং থানা প্রশাসনের উন্নতি ঘটানো সম্ভব। তবে শুধু প্রশাসনিক পরিবর্তন নয়, পুলিশ বাহিনী ও প্রশাসনকে রাজনীতিমুক্ত, বিশেষ করে ওসি পর্যায়ে না করা গেলে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না। বর্তমানে দেশের থানায় ওসিদের আনুগত্য অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ প্রশাসনের চেয়ে স্থানীয় সাংসদ, বিশেষ করে সরকারি দলের সাংসদদের প্রতিই বেশি। এ অবস্থা চলতে থাকলে পুলিশ প্রশাসন ভেঙে পড়বে, যার আলামত দেখা যাচ্ছে।
যা–ই হোক, এ ধরনের আর কোনো ঘটনা ঘটবে না বলে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এবং আইএসপিআরের সূত্রে তা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না বলতে পুলিশ প্রশাসন কি শুধু সামরিক বাহিনীকে আশ্বস্ত করেছে, নাকি দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছে—তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। বিষয়টির ব্যাখ্যা অবশ্য দেওয়া উচিত।
পুলিশের একাংশের এ ধরনের কর্মকাণ্ড সরকারের জন্য সুখকর নয়। এ ধরনের বাড়াবাড়ির রাশ টানার এখনই সময়। পুলিশ প্রশাসনের, এমনকি মাঠপর্যায়েও প্রচুর সৎ ও নীতিমান সদস্য রয়েছেন, যাঁরা প্রদীপ দাশদের দাপটে কোণঠাসা হয়ে আছেন। তাঁদের সামনে নিয়ে আসা হোক।
পরিশেষে বলতে চাই, যে হত্যা মামলা রুজু করা হয়েছে, তা যেন দ্রুত নিষ্পত্তি হয় এবং দোষী ব্যক্তিদের চরম শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যথায় কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপরই সাধারণ জনগণ আস্থা রাখতে পারবে না। আমরা চাই, এ ধরনের সাজানো মামলার চল বন্ধ হোক। মাঠপর্যায়ে পুলিশ প্রশাসনে পরিবর্তন আনা ও পুলিশকে দুর্নীতিমুক্ত রাখা হোক। সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তদন্ত হোক এবং দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অবশ্যই শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হোক। সিনহা হত্যা মামলার দ্রুত পরিণতি কাম্য। একই সঙ্গে সব ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করে পুলিশ প্রশাসনের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর হোক। কতিপয় পুলিশ সদস্য, বিশেষ করে কতিপয় ওসির কর্মকাণ্ডের রাশ টানতে না পারলে সমগ্র পুলিশ প্রশাসনকে জনসমক্ষে দাঁড়াতে হবে।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন