খোমেনির ‘অবরুদ্ধ’ জনপদে যা দেখলাম
09 July 2019, Tuesday
আমরা কয়েকজন বন্ধুবান্ধব গত মাসের মাঝামাঝি গিয়েছিলাম পারস্য উপসাগরের সর্ববৃহৎ দেশ ইরানে। প্রায় ১৪ দিন ছিলাম। সফরের ব্যবস্থা করেছিলেন আমাদেরই এক চিকিৎসক বন্ধু। ওই বন্ধু ইরানে চাকরি করার সুবাদে সেখানে বিয়ে করেছিলেন। বর্তমানে সস্ত্রীক ঢাকায় থাকেন। ডাক্তার গিন্নি সুন্দর বাংলা বলেন; মাতৃভাষা ফারসি তো রয়েছেই। আমাদের ডাক্তার বন্ধু নিজেও খুব ভালো ফারসি বলেন। কাজেই ইরান ঘুরতে ভাষাগত অসুবিধা থাকলেও এই দুজনের সুবাদে সে অসুবিধা বহুলাংশে কম হয়েছিল। আমরা তেহরান ছাড়াও কাশান, ইস্পাহান, হামদান এবং কাস্পিয়ান সাগরতীরের রামসার শহরে গিয়েছিলাম। রামসার যাওয়ার পথে রুদবার শহর পড়ে। সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়েছি। ১৯৯০ সালে এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে এই রুদবারের জনবসতি সম্পূর্ণ মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। ওই ভূমিকম্পে রুদবার ও আশপাশের গ্রামের ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় এবং লক্ষাধিক মানুষ আহত হয়। পরবর্তী সময়ে এই শহর এবং আশপাশ পুনর্গঠিত হয়। এখন এটি ছিমছাম ছোট একটি দৃষ্টিনন্দন শহর।
১৯৭৯ সালে ইরানে যে বিশ্বকাঁপানো ইসলামিক রেভল্যুশন হয়, তার পুরোধা ছিলেন আয়াতুল্লাহ রুহুল্লা খোমেনি, ইমাম খোমেনি নামে যিনি অধিক পরিচিত। শিয়া মুসলিমপ্রধান দেশ ইরান ওই সময়ের আধুনিক দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। সেখানে ধর্মীয় অভ্যুত্থান ছিল অবাক করার মতো বিষয়। ওই সময়ের বিশ্লেষণগুলো এখনো আমাকে ভাবিয়ে তোলে। সেই থেকে ৪০ বছর ইরান শিয়া ধর্মীয় গুরুদের দ্বারা শাসিত। সেখানে সর্বোচ্চ কাউন্সিল অব এলভারলির নেতা আলী খোমেনিই সুপ্রিম নেতা। তিনিই সবচেয়ে শক্তিধর নেতা। দেশটির পার্লামেন্ট এবং প্রেসিডেন্ট থাকলেও দেশের সামরিক বাহিনী ও রেভল্যুশনারি গার্ড খামেনির অধীন।
প্রায় আট বছরের ইরান-ইরাক যুদ্ধে ইরানের অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল। এরপর পর্যায়ক্রমে অবরোধ, যা বর্তমানে আরও তীব্র হয়েছে। এটি ইরানের অর্থনীতির ওপর দারুণ চাপ ফেলেছে। যেহেতু দেশটিতে প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল এবং অন্যান্য খনিজ পদার্থ রয়েছে অফুরন্ত, তাই এই প্রভাব চোখে পড়ে না। এখনো দেশটির মাথাপিছু আয় ১৪ হাজার মার্কিন ডলার। ইরানিদের মতে, এই আয় হওয়া উচিত ছিল ৪০ হাজার ডলার। অবরোধের কারণে তাদের প্রবৃদ্ধি কমেছে। বেকারত্ব বেড়েছে এবং ইরানি মাপদণ্ডে গরিবের মাত্রাও বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি, তথ্যমতে, ৫১ দশমিক ৪ থেকে ২০১৮ সালে দাঁড়িয়েছে ৫২ দশমিক ১ শতাংশে। খাবারের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮১ দশমিক ৭০ শতাংশ। তেল ও অন্যান্য দ্রব্য রপ্তানিতে বাধানিষেধ থাকায় সরকারের আয় কমে গিয়েছে।
এ ধরনের আন্তর্জাতিক অবরোধ ইরানের সামাজিক অঙ্গনেও বেশ প্রভাব ফেলেছে। একসময় ইরানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল পর্যটন। এখন বিশেষ করে কাস্পিয়ান সাগর তীরে এবং অন্য শহরগুলোতে পর্যটক আসে না বললেই চলে।
ইরানের মানুষ অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ এবং বন্ধুসুলভ। কিন্তু ওই সব অঞ্চলের মানুষের আক্ষেপ, এখন তারা তাদের দেশে ‘মেহমান’ই খুঁজে পায় না। অপরদিকে সরকারের কড়াকড়ির কারণে সামাজিক যোগাযোগব্যবস্থাগুলো প্রায় বন্ধ। ফেসবুক-ইউটিউব বন্ধ। ইন্টারনেট অত্যন্ত ধীরগতিতে চলে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ডের লেনদেন বন্ধ। তেহরানের খোমেনি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ অন্য আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে হাতে গোনা কিছু মধ্যপ্রাচ্যের বিমান যোগাযোগ রয়েছে।
বিগত বছরগুলোতে মাদকাসক্তি, বিশেষ করে আফিমের ব্যবহার বেড়েছে বহুগুণ। এই আফিম আসে আফগানিস্তান থেকে। ইরান এই অঞ্চলের সবচেয়ে শিল্পোন্নত দেশ। বাস, ট্রাক থেকে পশ্চিমা ব্র্যান্ডের গাড়ি—সবই দেশে তৈরি হয়। এখনো ফ্রান্স এবং জার্মানির লগ্নি রয়েছে শিল্প খাতে, বিশেষ করে অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রিতে। রাস্তাঘাট ও যোগাযোগব্যবস্থা গত ৪০ বছরে ইউরোপিয়ান মানে উন্নীত হয়েছে। শহরগুলো সবুজ আর দারুণ পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন। তথাপি একঘরে হয়ে পড়ার চাপ প্রত্যক্ষ করা যায়।
২.
ইরান বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কোপানলে রয়েছে। তার ওপরে মার্কিন চাপ পারমাণবিক চুক্তি (যা ছয়টি বৃহৎ শক্তির সঙ্গে ২০১৫ সালে সম্পাদিত হয়েছিল)। সে চুক্তি থেকে সরে আসার অজুহাত বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ২০১৫ সালে বারাক ওবামার প্রশাসনের মাধ্যমে এই চুক্তিতে যুক্ত হলেও বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসন ইরান চুক্তি থেকে বের হয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছে। এরপর থেকেই সামরিক চাপ বৃদ্ধি করতে উপসাগরীয় এলাকায় যুক্তরাষ্ট্র সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে।
অনেক ইরানির সঙ্গে আলাপচারিতায় পরিষ্কার ধারণা হলো যে সাধারণ ইরানিরা যুক্তরাষ্ট্রের এহেন আচরণে মোটেও শঙ্কিত বা আতঙ্কিত নয়। কয়েকজন আমাকে বললেন, মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে ইরানে, যুক্তরাষ্ট্রে কোনো ধরনের দুঃসাহসিক অভিযান শুরু করলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশ ইসরায়েল। কারণ লেবানন, সিরিয়ায় ইরানের উপস্থিতি ও হিজবুল্লাহদের শক্তি বৃদ্ধি এবং একই সঙ্গে ইরানের দূরপাল্লার মিসাইল ইসরায়েলকে কাবু করতে যথেষ্ট। এমনটাই ধারণা সাধারণ মানুষের। ইরানিরা বিশ্বাস করে, ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর সামরিক দিক থেকে ইরান যথেষ্ট শক্তিশালী হয়েছে। অন্যান্য কারণে বর্তমান সরকারের ব্যবস্থাপনা ও দেশ পরিচালনার নীতির সঙ্গে দ্বিমত থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের কারণে জাতীয়তাবাদী এবং অতীত গৌরব ইরানিদের একতাবদ্ধ রেখেছে।
ইরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের দ্বারপ্রান্তে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আজকের মার্কিন-ইরান বৈরী সম্পর্ক এবং মধ্যপ্রাচ্যে একের পর এক মার্কিন প্রশাসনের ভুলের কারণে ইরান এ অঞ্চলে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ইরাক প্রায় সম্পূর্ণভাবে ইরানের মুখাপেক্ষী। অপরদিকে সিরিয়ার তিন বছরের গৃহযুদ্ধ ইরানকে সামরিক ও ভূকৌশলগত দারুণ সুবিধা করে দিয়েছে। বিশেষ করে লেবাননের হিজবুল মুজাহিদের সঙ্গে যোগাযোগের পথ প্রশস্ত ও সহজ হয়েছে। সৌদি আরব এখন ইরান আতঙ্কে ভুগছে। বিশেষ করে ইয়েমেনের হুতিবিরোধী অনৈতিক যুদ্ধে আটকে পড়ার পর। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব ইরানের অভ্যুত্থানকে দুর্বল এবং নস্যাৎ করতে ইরাক-ইরান যুদ্ধের মাধ্যমে শিয়া-সুন্নির যে বিভেদ সৃষ্টি করেছিল, তা বুমেরাং হতে চলেছে।
ইতিমধ্যে উপশহরে উত্তেজনা বাড়ছে বৈ কমেনি। ইরানকে কোণঠাসা করতে যুক্তরাষ্ট্র আব্রাহাম লিঙ্কন নামক পারমাণবিক শক্তিধর এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারসহ যে যুদ্ধজাহাজগুলো পাঠিয়েছে, তা ইরানের মিসাইল থেকে দূরেই রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সমরবিদেরা ভালোভাবেই জানেন যে ইরানের মিসাইল প্রজেক্ট কওসার-এর অধীনে যেসব প্রাথমিক পর্যায়ের ব্যালিস্টিক মিসাইল রয়েছে, সেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ ডোবাতে সক্ষম। এমন কিছু হলে ক্ষয়ক্ষতি যুক্তরাষ্ট্রের এবং ইসরায়েলের হবে সবচেয়ে বেশি।
ইরানকে এ পর্যায়ে ঠেলে আনার পেছনে যে যুক্তরাষ্ট্রের অবিবেচক ভুল ভূরাজনৈতিক প্রকল্প ছিল, তার কারণে ক্রমেই মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত বিস্তৃত হয়েছে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরিতা এবং একঘরে করার চেষ্টা ইরানের বর্তমান সরকারের জন্য একধরনের আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। ইরানের অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যেও জাতীয়তাবাদী ও ঐতিহ্যবাদী ইরানিদের একত্র রেখেছে।
উপসাগরে মৃদু যুদ্ধভাব হয়তো চলবে যুক্তরাষ্ট্রের আগামী নির্বাচন পর্যন্ত। কিন্তু উভয় পক্ষই ভালো করে জানে যে যেকোনো সংঘর্ষের পরিণতি ভয়াবহ হবে। বিশ্ব অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সপক্ষে ইরান নিয়ে ধর্মীয়, আদলের তফাতের কারণে, মুসলিম বিশ্বে যে দুই জোট হতে দেখা দিয়েছে তা বিশ্বশান্তির জন্য শুভ নয়। বরং কথিত সমগ্র মুসলিম দেশগুলোর উচিত হবে উপসাগরের উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করা।
যাহোক আমার দেখা ইরান দূর থেকে যতখানি কট্টর ধর্মীয় অনুশাসনপন্থী দেশ মনে হয়, বাস্তবে তেমন নয়। পোশাক–পরিচ্ছদে কিছু বাধ্যবাধকতা থাকলেও কর্মক্ষেত্রে নারীর বিচরণ পুরুষের চেয়ে বেশি। এত নারীকে গাড়ি, এমনকি ট্যাক্সি চালাতেও আমি বিশ্বের বহু দেশে দেখিনি। একেই হয়তো বলে ‘সিয়িং ইজ বিলিভিং (চোখের দেখাই বিশ্বাস)’।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, বর্তমানে অনারারি ফেলো এসআইপিজিএনএসইউ
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন