আইএসের নতুন কৌশল ও আমাদের সতর্কতা
17 May 2019, Friday
তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের (আইএস) রাজধানী সিরিয়ার রাকা শহর যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রি সিরিয়ান আর্মির হাতে পতনের পর এর তথাকথিত খেলাফত ভেঙে যায়। কিন্তু এর পরপরই যুক্তরাষ্ট্র আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় এবং দখলে থাকা ভূখণ্ড সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হওয়ার ঘোষণা দেয়নি। রাকার পতনের পরও আইএস যোদ্ধাদের একটি বড় অংশ সিরিয়ার বাগুজ শহর দখলে রাখে ২০১৯ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত বাগুজেরও পতন ঘটেছে। কিন্তু ভূখণ্ড হারালেও কথিত ক্রুসেডের বিরুদ্ধে জিহাদতত্ত্ব থেকে আইএস সরে এসেছে, এমন ভাবার কোনো অবকাশ নেই।
সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অভিযান পরিচালনাকারী সেন্ট্রাল কমান্ড জেনারেল জোসেফ ভোটেল বলেছেন, আইএস যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ছত্রভঙ্গ হলেও তার মানে এই নয় যে নিঃশেষ হয়ে গেছে। এর নেতৃত্ব, যোদ্ধা ও সম্পদ যোগদানকারীরা রয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, সমগ্র বিশ্বে তাদের যে মতাদর্শ ছড়িয়ে পড়েছে, তা যোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করবে। এমন পরিস্থিতিতে প্রায় পাঁচ বছর পর আইএস নেতা কথিত খলিফা আল–বাগদাদির নতুন ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে তিনি তাঁর অনুসারীদের প্রতিশোধ গ্রহণে বিভিন্ন টার্গেটের ওপরে হামলার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
আইএসের যখন বেশ রমরমা অবস্থা, তখন জাতিসংঘের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছিল যে সিরিয়া-ইরাকে আইএস যোদ্ধাদের সংখ্যা ৪০ হাজারের বেশি। প্রায় ১১০টি দেশ থেকে যোদ্ধারা তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। বিদেশি যোদ্ধাদের মধ্যে আড়াই হাজার নিজেদের দেশে ফিরেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার যোদ্ধার মধ্যে প্রায় ৩ হাজার বিদেশি সদস্য ইরাক, সিরিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার আফগানিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে। আফ্রিকার বুরকিনা ফাসো ও মালেতে আইএস উপস্থিতি টের পাওয়া গেছে; যা একেবারেই নতুন।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মালদ্বীপ থেকে বেশি যোদ্ধা যোগ দিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কা থেকেও যোদ্ধারা গেছে। শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক হামলার ঘটনা বিশ্ববাসীকে হকচকিয়ে দিয়েছে। সিরিয়ায় আইএসের পতনের পর এটাই সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী হামলা। এশিয়া অঞ্চলে এ ধরনের হামলা আইএসের সিরিয়ায় পরাজয়–উত্তর সময়ের সবচেয়ে বৃহৎ এবং ভয়াবহ হামলা। হামলার ধরনে এটা বোঝা যায় যে এর পেছনে আইএসের মতবাদ কাজ করেছে।
আইএস মনে করে, পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে খ্রিষ্টান জগৎ, ১০৯৫ সালে পোল আরবানার ‘ক্রুসেড’–এর আহ্বানে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে ধর্মযুদ্ধ শুরু করেছিল, তা এখনো চলমান রেখেছে পশ্চিমা জগৎ। এমনিই কথা বিখ্যাত ইতিহাসবিদ লেখক কারেন আর্মস্ট্রং তাঁর রচিত বিশ্বখ্যাত বই হোলি ওয়ার: দ্য ক্রুসেড অ্যান্ড দেয়ার ইমপ্যাক্ট অন টুডেস ওয়ার্ল্ড–এ বিস্তারিতভাবে লিখেছেন। তাঁর মতে (উপসংহারে), মধ্যপ্রাচ্যে আরব আর ইহুদিদের মধ্যে সংঘাতের হোতা পশ্চিমা বিশ্ব এবং এখান থেকে পশ্চিমা বিশ্ব বের হয়ে না আসা পর্যন্ত এ সংঘাত শেষ হওয়ার নয় (পৃ: ৫৩০)।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য তথাকথিত মুসলিম বিশ্বে রাজনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা। এ ধরনের অস্থিরতার মধ্যে আইএস এবং সমমনা সংগঠনগুলো যে বেড়ে ওঠে, তার উদাহরণ বর্তমান মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান। মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর কর্তৃত্ববাদী শাসন আর সংকুচিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আইএস ও আল-কায়েদা অনুসারীদের ইসলামের পূর্ব গৌরব ফিরিয়ে আনতে নিজেদের দেশে জিহাদ চালানোর নির্দেশ দিয়েছে। কাজেই আইএসের পরাজয় অথবা একেবারে ধ্বংস হয়েছে, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।
আইএস এখন কোন নতুন কৌশল নিয়ে হাজির হয়, তা নিয়ে বেশ উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব। কৌশলটি অনেকটা গেরিলা পদ্ধতির নতুন রূপ ‘লোন উলফ’ অপারেশন। অতি সম্প্রতি ভারতীয় ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি দক্ষিণ ভারতের কেরালা এবং পশ্চিমবঙ্গের কয়েকজন আইএস–সমর্থককে (কথিত সদস্য) গ্রেপ্তারের পর এ অঞ্চলে লোন উলফ কৌশলের বিষয়টি সামনে চলে আসে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আগাম খবর এবং নিশ্চিত তথ্য না পাওয়া গেলে এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রতিহত করা খুবই দুরূহ। লোন উলফ অপারেশন এক বা দুই সদস্যের গ্রুপের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে। একজন নিয়ন্ত্রক, যার নির্দেশেই আক্রমণ এবং হামলার লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করা হয়। লোন উলফ লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণে বেশ কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় রাখে। সাধারণত বিদেশি, বিশেষ করে ইউরোপিয়ানদের অথবা এমন দেশ লক্ষ্যবস্তু বা ব্যক্তি, যেখানে বা যাদের টার্গেট করলে সর্বাধিক প্রচার পাওয়া যায়। লক্ষ্যবস্তু হতে পারে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। নিয়ন্ত্রকেরা সাধারণত টার্গেট এলাকায় খুব কমই থাকে। ‘লোন উলফ’ প্রশিক্ষণের বিষয়টিও খুব কঠিন নয়। ধারালো অস্ত্র ছাড়া তারা এমন কিছু বহন করে না, যাতে তাদের সহজে শনাক্ত করা যায়।
অনেক সময় লোন উলফ সদস্যরা কোনো সংগঠিত গ্রুপের না–ও হতে পারে। বিশেষ কোনো গ্রুপের মতাদর্শের অনুসারী হয়ে তারা কাজ করতে পারে। ব্যবহার এবং সহজলভ্যতার কারণে লোন উলফ অপারেশনের জন্য সবচেয়ে সহজে ব্যবহারযোগ্য হিসেবে শুধু ধারালো অস্ত্রই নয়, যেকোনো বস্তুকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। ফ্রান্সের নিস শহরে মানুষের ওপরে ট্রাক চাপিয়ে দেওয়ার ঘটনাটি এখানে স্মরণ করা যেতে পারে।
গত বছর পশ্চিমবঙ্গে সিআইডি মসিউদ্দিন ওরফে আবু মুসাকে আটক করে এবং তার কাছ থেকে কয়েকটি চাপাতি উদ্ধার করা হয়। তাকে গ্রেপ্তারের সূত্রেই কেরালা, তামিলনাড়ু ও কর্ণাটকে লোন উলফ ধরনের কয়েকজনকে আটক করা হয়। শ্রীলঙ্কার ঘটনার পরে আটক কয়েকজনের কাছ থেকেও জানা গেছে যে আইএসের অনুসারীদের ওপর বর্তমানে লোন উলফ আক্রমণের নির্দেশনা রয়েছে। ভারতের দক্ষিণে আইএস অনুসারীদের অস্তিত্ব রয়েছে বলে ভারতের জাতীয় অনুসন্ধানী সংস্থা বলেছে। একই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেও এদের গোপন তৎপরতার কথা উল্লেখ রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই বুদ্ধপূর্ণিমায় পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে হামলার সম্ভাবনার তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। নিশ্চয়ই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে এ ধরনের তথ্য রয়েছে এবং তাদের তরফে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে হোলি আর্টিজানের ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সফল অভিযানের ফলে জঙ্গিদের সংগঠিত হওয়ার ক্ষমতা কমলেও লোন উলফ আক্রমণের কৌশলকে কোনোভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কয়েক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সৌদি আরবে বেড়ে ওঠা এবং আইএস যোদ্ধা মোতাজ আবদুল মজিদ কফিলুদ্দিন ব্যাপারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁর সহযোগীদের ধরা যায়নি। তিনি গত ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন, কাজেই এই তিন মাস তিনি কী করেছেন, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে সিরিয়াফেরত ডেসকোর প্রকৌশলী গাজী কামরুস সালাম সোবহানকে আটক করা হয়। তিনি বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন বলে জানা গেছে। সিরিয়ায় আইএসের যোদ্ধা হিসেবে তিনি সক্রিয় ছিলেন।
বাংলাদেশ থেকে ৪০ থেকে ৬০ জন আইএসে যোদ্ধা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। এর মধ্যে অনেকের মৃত্যু হলেও আইএস–নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের পতনের পর অনেকেই বিভিন্নভাবে দেশে ফিরে থাকতে পারেন। তাঁরা এবং যাঁরা ফিরতে পারেননি, তাঁরাও অন্য কোনো অঞ্চলে বসে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে অনেক তরুণকে মতাদর্শে দীক্ষিত করার চেষ্টা চালাতে পারেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং কাউন্টার টেররিজম বিভাগ যথেষ্ট সজাগ থাকলেও জনগণের সচেতনতা ও সহযোগিতা ছাড়া এ ধরনের লোন
উলফ অপারেশনকে ব্যর্থ করা খুবই দুরূহ বিষয়। জনসচেতনতা বৃদ্ধি করার দায়িত্ব শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরই নয়, সংবাদমাধ্যমও বড়
ভূমিকা রাখতে পারে। আত্মতৃপ্তিতে নয়, সচেতনতাই এ ধরনের আক্রমণকে যথাসম্ভব প্রতিহত করার অন্যতম কৌশল।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, বর্তমানে অনারারি ফেলো এসআইপিজিএনএসইউ
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন