১৪ মার্চ বিনা দরপত্রে রপ্তানির সুযোগ রেখে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রের ১২ নম্বর ব্লকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে সরকার দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি পস্কো দাইয়ু করপোরেশনের সঙ্গে উৎপাদন বণ্টন চুক্তি বা পিএসসি স্বাক্ষর করেছে। শুধু রপ্তানি নয়, বিদেশি কোম্পানির অংশীদারত্ব বৃদ্ধি, শুল্ক মওকুফ, গ্যাসের কেনা দাম বৃদ্ধিসহ আরও নানা সুবিধা দিয়ে যে চুক্তি করা হয়েছে, তা দেশের জন্য আরেকটি আত্মঘাতী জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তির নজির হয়ে থাকল।
এ রকম বলা হচ্ছে কারণ প্রথমত, একদিকে দেশের গ্যাস-সংকটের কথা বলা হচ্ছে অন্যদিকে সেই সংকট সমাধানের ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো রপ্তানির সুযোগ রেখে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, পুরো চুক্তি প্রক্রিয়াটি অস্বচ্ছ। বিনা দরপত্রে গোপন সমঝোতার ভিত্তিতে এটি করা হয়েছে। তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বেশি দামসহ নানা সুবিধা দিয়ে তাদের কাছ থেকে গ্যাস কেনার চুক্তি হয়েছে এবং চতুর্থত, এই ধারার চুক্তির জন্য অপেক্ষায় চীন, ভারত, মার্কিনসহ বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি। ব্লু ইকোনমির আড়ালে, সীমানা নিষ্পত্তির সুযোগে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্র সম্পদে বিদেশিদের কর্তৃত্ব কায়েম করার পথে সরকার অগ্রসর হচ্ছে। একই ধরনের চুক্তি হলে সমুদ্রের বিশাল সম্ভাবনাময় তেল-গ্যাস সম্পদ উজাড় হতে বেশি সময় লাগবে না।
এর আগে ২০১৪ সালে ভারতের ওএনজিসি অগভীর সমুদ্রের ৪ ও ৯ নম্বর ব্লক, সিঙ্গাপুরের কোম্পানি ক্রিস এনার্জি এবং অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানি সান্টোস যৌথভাবে ১১ নম্বর ব্লকের ইজারা পেয়েছে। দায়মুক্তি আইন, যা ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০’ নামে পরিচিত, তাকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করেই জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সরকার একের পর এক চুক্তি করছে। এই দায়মুক্তি আইন হচ্ছে অস্বচ্ছতা-দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে জবাবদিহির পথ বন্ধ করার চেষ্টা।
২০১২ সালের সংশোধিত পিএসসি মডেলে চুক্তি সই হয়েছে পস্কো দাইয়ুর সঙ্গে। কস্ট রিকভারি বা বিনিয়োগ না উঠে আসা পর্যন্ত তেল-গ্যাসের হার ৫৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৭০ শতাংশ। বাকি ৩০ শতাংশের অর্ধেক পাবে পেট্রোবাংলা, যা মোট গ্যাসের ১৫ শতাংশ, বাকি অংশ কেনার দামও এবার বাড়ানো হয়েছে। প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম সাড়ে ৬ ডলার বা প্রায় ৫০০ টাকা। উপরন্তু প্রতিবছর ২ শতাংশ করে গ্যাসের মূল্য বাড়ানোর সুযোগ রাখা হয়েছে।
মার্কিন আর্থিক সংস্থা নাসদাকের বিবরণীতে, ১৯ মার্চ, ২০১৭-এর তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের ভবিষ্যৎ দাম এখন ৩ মার্কিন ডলার থেকেও কম। এটা আকস্মিক নয়, কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাজারের এই চিত্র। তেলের ব্যারেলপ্রতি দাম এখনো কমের দিকেই, সর্বশেষ হিসাবে ব্যারেলপ্রতি অপরিশোধিত তেলের দাম ৫০ মার্কিন ডলারের নিচে। কয়েক বছর ধরে তেলের দামের এই নিম্নগতি। কিন্তু আমাদের সরকারের সিদ্ধান্ত হলো, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের যা দাম সে অনুযায়ী বাংলাদেশে তেলের দাম কমানো হবে না, বরং আগের বেশি দামেই বাংলাদেশের মানুষকে তেল কিনতে হবে। আর আমাদের নিজেদের প্রাকৃতিক গ্যাস বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে কিনতে হবে আন্তর্জাতিক দামের দ্বিগুণেরও বেশি দামে। জ্বালানির দাম হ্রাসের সুবিধা অর্থনীতি পাবে না, উদ্যোক্তারা পাবে না, দেশের মানুষ পাবে না। বরং গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে এদের সবার ওপর বোঝা বাড়ানো চলতেই থাকবে। এটাই সরকারের ‘দৃঢ়তা’, এটাই উন্নয়ন দর্শন!
বলা হয়, তেল-গ্যাস অনুসন্ধান অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ। আসলে কতটা? প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে পাঁচ বছরে ১২ নম্বর ব্লকে এই কোম্পানি ৩ হাজার ৫৬০ বর্গকিলোমিটারে এক হাজার মিটার গভীর থেকে দুই হাজার মিটারে অনুসন্ধান করবে। সব মিলিয়ে এই পাঁচ বছরে পস্কো দাইয়ু করপোরেশন নিচে প্রায় ৬ কোটি এবং ওপরে প্রায় ১১ কোটি ডলার খরচ করবে। টাকার অঙ্কে তার পরিমাণ হয় নিচে প্রায় ৪৫০ কোটি এবং ঊর্ধ্বে প্রায় ৮৮০ কোটি টাকা। এসব কাজও তারা করাবে সাব কন্ট্রাক্টরের মাধ্যমে। সর্বোচ্চ সীমাও যদি ধরি এই ব্যয়ের পরিমাণ হয় বছরে ২০০ কোটি টাকারও কম। এই পরিমাণই বিশাল পুঁজি, যা বিরাট ঝুঁকি এবং যা বাংলাদেশের নেই?
মাগুরছড়ায় মার্কিন কোম্পানি ও টেংরাটিলায় কানাডীয় কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছিল উন্নয়ন আর দক্ষতার কথা বলেই। এই দুটো ক্ষেত্রে এসব বিদেশি কোম্পানি ৫০০ বিলিয়ন ঘনফুটেরও বেশি গ্যাস নষ্ট করেছে, যা দিয়ে দেশের বর্তমান ব্যবহারে দেড় বছরের বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। তার তৎকালীন দাম ধরলে ক্ষতিপূরণ আদায় করার কথা অন্তত ৪০ হাজার কোটি টাকার। কোনো সরকার এই ক্ষতিপূরণ দাবি করেনি, আদায়ের উদ্যোগ তো নয়ই। আর এবারের চুক্তিতে ক্ষতিপূরণ বিষয়ে পরিষ্কার কোনো কথাই নেই। কোম্পানির কারণে সমুদ্রে বিস্ফোরণ বা দুর্ঘটনা ঘটলে তার ক্ষতি আরও অনেক বেশি হবে, কিন্তু কোনো সুরক্ষার ব্যবস্থা নেই।
প্রধানমন্ত্রী বরাবরই দাবি করেন, তিনি দেশে ৫০ বছরের গ্যাস মজুত নিশ্চিত না করে গ্যাস রপ্তানির বিরোধী, তাহলে এ ধরনের চুক্তি কেন? তাহলে আমাদের প্রস্তাবিত ‘খনিজ সম্পদ রপ্তানি নিষিদ্ধ আইন’ প্রণয়নে অসুবিধা কী? ৫০ বছরের মজুত কি নিশ্চিত হয়েছে? গ্যাস-সংকট বহাল থাকা অবস্থায় কীভাবে গ্যাস রপ্তানি চুক্তি হয়? কীভাবে সরকারের রপ্তানি নীতিতে খনিজ সম্পদ রপ্তানিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়?
বস্তুত বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ-সংকট সমাধানে বঙ্গোপসাগরের গ্যাস সম্পদ আগামী কয়েক দশকে প্রধান অবলম্বন হতে পারে। এই সম্পদ অনুসন্ধান, উত্তোলন ও ব্যবহারের যথাযথ নীতি গ্রহণ করলে সুন্দরবনবিনাশী রামপাল কিংবা দেশধ্বংসী রূপপুর প্রকল্পের কোনো যৌক্তিকতা থাকে না। বরং গ্যাস সম্পদের ব্যবহার করে সুলভে, পরিবেশবান্ধব উপায়ে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোও সম্ভব হয়, উৎপাদনশীল খাতও ব্যাপক গতি পেতে পারে। অথচ সরকার উল্টোযাত্রা করছে, এই সম্পদ দেশের কাজে শতভাগ ব্যবহারের নীতিমালা গ্রহণ না করে যে দামে এবং রপ্তানির যে ধারা রেখে এই চুক্তি করা হচ্ছে, তাতে এই সম্পদ দেশের কাজে লাগানো সম্ভব হবে না বরং এই চুক্তির কারণে দেশের ওপর আরও আর্থিক বোঝা বাড়বে। সম্পদও হারাবে দেশ।
সাগরের গ্যাস নিয়ে আত্মঘাতী চুক্তির পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীসহ একাধিক কর্মকর্তা মিয়ানমারের দৃষ্টান্ত টানেন। এটা ঠিক, বাংলাদেশের নিকটবর্তী প্রতিবেশী মিয়ানমার গ্যাস রপ্তানিভিত্তিক চুক্তির ওপর নির্ভরশীল থেকেছে দশকের পর দশক। তাদের গ্যাসের মজুত বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। তারপরও সেখানে রয়েছে বিদ্যুতের সংকট, শিল্পায়নের সংকট। দারিদ্র্য, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদিতে বাংলাদেশের চেয়েও পিছিয়ে সেই দেশ। সেখানে মোট রপ্তানি আয়ের অর্ধেকই আসে গ্যাস রপ্তানি থেকে। বিশ্বজুড়ে গ্যাসের দাম পড়ে যাওয়ায় সেই আয়ও কমে গেছে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত আয় হয়েছে ১৮২ কোটি মার্কিন ডলার, গত বছর এই সময়কালে আয় ছিল ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। রপ্তানি দাম প্রতি হাজার ঘনফুটে ২০১৬-র মার্চ মাসে ১ দশমিক ৬৬ মার্কিন ডলারে নেমে গিয়েছিল। (মিয়ানমার টাইমস, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬) নিজেদের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি-সংকট সমাধান না করে মিয়ানমার কেন তার সীমিত সম্পদ রপ্তানি করছে?
করছে কারণ তার সুবিধাভোগীরই ক্ষমতা আঁকড়ে ছিল। দেশি সামরিক জান্তা, তার সহযোগী ক্ষুদ্র গোষ্ঠী এবং বিদেশি কোম্পানি। নিজেদের সক্ষমতা বিকাশেও তারা নজর দেয়নি। আফ্রিকার খনিজ সম্পদ-সমৃদ্ধ অনেক দেশের অভিজ্ঞতা এ রকমই। কতিপয় গোষ্ঠীর স্বার্থ নিশ্চিত করতে গিয়ে দেশে অগণতান্ত্রিক শাসন টিকে থেকেছে দশকের পর দশক। গোত্রীয় সংঘাত, সহিংসতার পাশাপাশি মানুষের দুর্ভোগ, দেশের চাকচিক্যের আড়ালে দেশের দৈন্যদশা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে।
বাংলাদেশ যদি মিয়ানমার বা নাইজেরিয়াকে আদর্শ বিবেচনা না করে মালয়েশিয়া, ভারত, চীন বা নরওয়ের দিকে দৃষ্টি দেয়, তাহলে জাতীয় মালিকানা, সক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠানের বিকাশের দিকেই তার নজর দেওয়ার কথা। এসব দেশের কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিতে সরকারের আগ্রহ, কিন্তু এসব দেশ কীভাবে জাতীয় সক্ষমতা তৈরি করেছে, তার থেকে শিক্ষা নেওয়ার কোনো আগ্রহ নেই। উল্টো জ্বালানি মন্ত্রণালয়, পেট্রোবাংলা বা বাপেক্সে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার যোগ্যতা হলো এই ঘোষণা দেওয়া যে ‘আমরা কিছুই করতে পারব না, আমাদের যোগ্যতা নেই।...এসব চুক্তি করতেই হবে।’
কদিন পরই বাংলাদেশের ৪৬তম স্বাধীনতা দিবস পালিত হতে যাচ্ছে মহাসমারোহে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত দেশে সর্বজনের বন, খনিজ সম্পদ দেশি-বিদেশি কতিপয় গোষ্ঠীর লোভের শিকার বানানো হচ্ছে, দেশকে স্বাধীন সক্ষম করে গড়ে তোলার গাছে মারা হচ্ছে কুড়াল!
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন