‘যদি’ ‘কিন্তু’র নির্বাচনটা আসলে কবে
21 December 2024, Saturday
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আশ্বাসের পরও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে সংশয় কাটছে না। বিজয় দিবসে তিনি দেশবাসীর উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে দুটি সম্ভাব্য তারিখের কথা বলেছেন। এক. যদি রাজনৈতিক দলগুলো অল্প কিছু সংস্কারে সন্তুষ্ট থাকে, তাহলে ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন হওয়া সম্ভব। আর যদি তারা ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার চায়, তাহলে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে।
নির্বাচনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও মতভেদ আছে। একেক দল একেক অঙ্ক কষছে। বিএনপিসহ কয়েকটি দল মনে করে, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন হওয়া উচিত। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পর বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলীয় নেতাকর্মীদের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। আবার জামায়াতসহ বেশ কিছু দল নির্বাচনের জন্য সময় নিতে চায়। তারা মনে করে, দ্রুত নির্বাচন হলে বিএনপি বেশি লাভবান হবে। কেননা, তাদের নেতাকর্মীরা সংগঠিত। যেসব দল বিএনপি’র সঙ্গে মিলে আন্দোলন করেছে, নির্বাচনে তারাই প্রতিদ্বন্দ্বী হবে। আওয়ামী লীগ মাঠে নেই। জাতীয় পার্টিকেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজ মাঠে নামতে দিতে চাইছে না। এ অবস্থায় বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনো দল থাকবে না।
সরকারের পক্ষ থেকে ধারণা দেয়া হয়েছিল, ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পাওয়ার পর নতুন বছরের শুরুতে নির্বাচনের রোডম্যাপ জানানো হবে। কিন্তু বিজয় দিবসে প্রধান উপদেষ্টা সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করে বল রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে ঠেলে দিলেন। এখন তারাই ঠিক করুক, সংস্কারের মাত্রা কী হবে।
প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে বলেন, ‘যেকোনো সংস্কারের কাজে হাত দিতে গেলে রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রয়োজন। অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম পর্যায়ে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এরা শিগগিরই চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করবে বলে আমি আশা করি। আমরা এই ছয় কমিশনের চেয়ারম্যানদের নিয়ে একটি “জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন” প্রতিষ্ঠা করার দিকে অগ্রসর হচ্ছি। এর কাজ হবে রাজনৈতিক দলসহ সব পক্ষের সঙ্গে মতবিনিময় করে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য স্থাপিত হবে, সেগুলো চিহ্নিত করা এবং বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ করা।’
তবে নির্বাচনসহ অন্যান্য সংস্কার নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা খুবই দুরূহ কাজ হবে। বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ আছে। আনুপাতিক নির্বাচনের বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী ও বাম দলগুলোর আগ্রহ থাকলেও বিএনপি প্রবলভাবে বিরোধিতা করছে। রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির বিষয়েও বাম দলগুলো মোটামুটি সহমত প্রকাশ করছে; কিন্তু বিরোধিতা আসছে ইসলামী দলগুলোর কাছ থেকে। দ্বিকক্ষ বা এক কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট হবে, সে বিষয়েও সব দলের মধ্যে মতৈক্য নেই।
অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদে যে অধ্যাদেশ নীতিগতভাবে অনুমোদন করেছে, তাতে বলা হয়েছে, সরকারের কেউ পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদনের পর বেশ কিছুদিন পার হলেও সেটি অধ্যাদেশ আকারে জারি না হওয়ায় অনেকের মনে প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়েও সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করা উচিত।
নির্বাচনের দিন-তারিখের এই ধোঁয়াশার মধ্যে হাইকোর্ট একটি ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন। এতে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালে যে পঞ্চদশ সংশোধনী জারি করেছিল, সেটি বাতিল করে দিয়েছে। আদালত একই সঙ্গে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের বিধান পুনর্বহাল করেছেন। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত মঙ্গলবার এ রায় দেন।
উল্লেখ্য, ২০১১ সালে যখন আওয়ামী লীগ সরকার দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবিধানবিশেষজ্ঞ ও বিরোধী দলের মতামত উপেক্ষা করে জবরদস্তিমূলকভাবে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে সংসদে আইন পাস করে। অথচ নব্বইয়ের দশকে আওয়ামী লীগই আন্দোলন-সংগ্রাম করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল।
সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ রায় দেয়ার ক্ষেত্রেও দ্বিচারিতা করেছেন। সংক্ষিপ্ত রায়ে তারা আরও দু’টি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার কথা বলেছিলেন। অথচ সাবেক প্রধান বিচারপতি অবসরে যাওয়ার পর লেখা পূর্ণাঙ্গ রায়ে সেটা পরিবর্তন করে বলা হয়েছিল, সংসদ চাইলে সেটি হতে পারে। উচ্চ আদালতের রায় কিংবা সংসদের আইন দুটোই হতে হবে বৃহত্তর জনগণের কল্যাণে। কিন্তু বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যত সংশোধনী হয়েছে, তার বেশির ভাগই হয়েছে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থে।
নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে কেবল রাজনৈতিক দল নয়, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যেও মতভেদ আছে। উপদেষ্টাদের একাংশ মনে করেন, সরকার যেসব সংস্কারে হাত দিয়েছে, সেগুলো শেষ করেই নির্বাচন হওয়া উচিত। আবার কোনো কোনো উপদেষ্টার মতে, অন্তর্বর্তী সরকার বেশি দিন ক্ষমতায় থাকলে জনপ্রিয়তা ধরে রাখা যাবে না। এক্ষেত্রে তারা ২০০৭-২০০৮ সালের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদাহরণ টানেন।
প্রথমে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বললেন, ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব। এরপর শ্রম ও নৌপরিবহন উপদেষ্টা সাখাওয়াত হোসেন লন্ডনে গিয়ে জানিয়েছিলেন, ছাব্বিশের মাঝামাঝি নির্বাচন হতে পারে। এরপর শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ঢাকার এক অনুষ্ঠানে বললেন, ‘আমি মনে করি, ২০২৫ সালে আমরা একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার পাবো।’ প্রধান উপদেষ্টা নিজে কোনো অবস্থান নিতে চান না বলেই রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ছেড়ে দিয়েছেন।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বিদেশি একটি সংবাদ সংস্থার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিত। প্রধান উপদেষ্টার প্রতি সেনাবাহিনীর অকুণ্ঠ সমর্থন আছে। ১৮ মাস হলে ২০২৫-এর শেষে কিংবা ২০২৬-এর শুরুতে হওয়ার কথা। নির্বাচনী পরিবেশের জন্যও শীতকাল অনুকূল। বাংলাদেশে যত জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে বেশির ভাগই অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে। ১৯৯৬ সালের ১২ই জুন সপ্তম সংসদ নির্বাচন হয়েছিল তিন মাসের বাধ্যবাধকতার কারণে।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা মনে করেন, বিগত সরকারের আমলে যারা গণহত্যা ও লুটপাটের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাদের বিচার করার পরই নির্বাচন হওয়া উচিত। ইতিমধ্যে তারা নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়াও শুরু করেছেন, যার প্রাথমিক উদ্যোগ জাতীয় নাগরিক কমিটি।
নির্বাচনের সময় নিয়ে সরকার গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের মধ্যেও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছে। তারা মনে করেন, যদি সংস্কার ছাড়াই নির্বাচন হয়, তাহলে এত পরিশ্রম করে সুপারিশ তৈরি করছেন কেন? দু’টি সংস্কার কমিশনের প্রধান তাদের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া নির্বাচন কমিশন ও দুদক গঠন করায় প্রকাশ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
সরকার প্রথম ধাপে যে ক’টি সংস্কার কমিশন করেছে, তার মধ্যে আছে নির্বাচন, সংবিধান, জনপ্রশাসন, দুদক, পুলিশ ও বিচার বিভাগ। তাদের ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার কথা।
প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত রয়েছে কমিশন। প্রধান উপদেষ্টা বা অন্তর্বর্তী সরকার যখন চাইবে, তখনই নির্বাচন করতে প্রস্তুত ইসি।’
সিইসি নাসির উদ্দীন আরও বলেন, ‘মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, সেটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তিনি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে কোনো কিছু বলেননি। আমাদের যারা স্টেক হোল্ডার, রাজনৈতিক দল, তারাও সংসদ নির্বাচনের কথা বলেছেন।’
তবে সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করেন, সরকার স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করতে পারে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা পদ থেকে হাসান আরিফকে সরিয়ে দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন নেতাকে দায়িত্ব দেয়ায় এ সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস সম্ভাব্য তারিখের কথা বলেছেন সংস্কারের দোহাই দিয়ে। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি, সে কথাও স্বীকার করেছেন তিনি। কিন্তু এর প্রতিকার হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা যে পরিকল্পনার কথা বলেছেন, সেটা কতোটা কার্যকর হবে, সে বিষয়ে সংশয় আছে। বিগত সরকারের আমলেও বিকল্প কৃষিবাজার বা কৃষকের বাজার হয়েছিল বিভিন্ন স্থানে। খুব একটা সুফল মেলেনি। এবারে মিলবে তার ভরসা কম।
উৎসঃ জনতার চোখ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন