গত ১৪ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ায় অ্যাবরজিন বা আদিবাসীদের অধিকারের স্বীকৃতি নিয়ে একটি গণভোট হয়, যাতে দেশটির ১ কোটি ৭৬ লাখ ভোটারের বেশির ভাগ বিপক্ষে ভোট দেন। ফলে ক্ষমতাসীন লেবার পার্টি আদিবাসীদের পক্ষে সংবিধান পরিবর্তনের যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তা বিফলে যায়।
গণভোটে দুটি প্রস্তাব ছিল যথাক্রমে আদিবাসীরা যে এ দেশের আদি নাগরিক, তার স্বীকৃতি এবং আদিবাসীদের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সংসদীয় কমিটি গঠন, যারা তাদের স্বার্থরক্ষার বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দেবে। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ–অধ্যুষিত অস্ট্রেলিয়াবাসী সেটি গ্রহণ করার মতো ঔদার্য দেখাতে পারেননি।
এই গণভোটে আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন, এ রকম একজন প্রবাসী বাংলাদেশি মানবাধিকারকর্মী খেদের সঙ্গে বলেছেন, ‘আমরা হেরে গেছি।’ তিনি ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির সমর্থক। লেবার পার্টি ও লিবারেল পার্টির মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যত মতবিরোধ থাকুক না কেন, বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে আশ্চর্য সহমত রয়েছে।
গণভোটের ফল যা–ই হোক না কেন, এর প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলতে পারেননি দেশি বা বিদেশি কোনো পর্যবেক্ষক। নির্বাচনে অস্ট্রেলিয়াও আমাদের মতো ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতি অনুসরণ করে, যেখানে এক ভোটের ব্যবধানে জয়–পরাজয় নির্ধারিত হয়। এখানকার গণভোট ও সাধারণ নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় যুক্ত নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ ও কেউ কারও বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না।
আইনগত বা কাঠামোগতভাবে অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের তেমন ফারাক নেই। যদিও অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির কাছে জবাবদিহি করতে হয়। আমাদের কমিশন কারও কাছে জবাবদিহি করে না। এমনকি নিজেদের বিবেকের কাছেও নয়।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কয়েক জন অস্ট্রেলীয় নাগরিককে ভোটের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। তাঁরা জানান, অস্ট্রেলিয়ায় ভোট দেওয়া বাধ্যতামূলক। কোনো নাগরিক যৌক্তিক কারণ ছাড়া ভোট না দিলে তাঁকে জরিমানা দিতে হয়।
এ কারণে অস্ট্রেলিয়ায় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর যেকোনো নাগরিক পোস্টাল ভোট দিতে পারেন, দ্বিতীয়ত নাগরিকেরা চাইলে ভোটের নির্ধারিত দিনের সপ্তাহখানেক আগে থেকে নির্দিষ্ট ভোটকেন্দ্রে গিয়ে সেখানে সংরক্ষিত বাক্সে নিজের ভোটটি দিয়ে আসতে পারেন। আগে ভোট দিলেও ব্যালট বাক্স দখল বা ভোট কারচুপির আশঙ্কা নেই। বাংলাদেশের মতো ভোটের রক্ষকেরা এখানে আমানত খিয়ানত করেন না। ফলে শত বছর আগে অস্ট্রেলিয়ায় নির্বাচনপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর কোনো ভোট নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি, বিতর্ক হয়নি। অস্ট্রেলিয়ায় নির্বাচন হয় তিন বছর পরপর।
অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের শত্রু ভাবে না। কেউ নিজেকে দেশপ্রেমের সোল এজেন্সিও দাবি করেন না। বাংলাদেশের মতো নির্বাচন নিয়ে অযথা মাতামাতি নেই। রাস্তা বন্ধ করে কিংবা মাঠ দখল করে কেউ জনসভা করেন না। প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রার্থীরা একযোগে টিভি বিতর্কে অবতীর্ণ হন। জাতীয় প্রেসক্লাবকে তাঁরা উচ্চ মূল্য দেন। জাতীয় প্রেসক্লাব আয়োজিত বিতর্কে সব দলের প্রার্থী সক্রিয় অংশ নেন। রাজনৈতিক দলগুলো কেবল প্রতিশ্রুতি দেয় না, সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ কীভাবে হবে, কোন তহবিল থেকে টাকা আসবে, সেসবও ভোটারদের কাছে ব্যাখ্যা করতে হয়।
ঢাকা থেকে প্রতিদিন মন খারাপ করা খবর আসছে। একদিকে পুলিশের গ্রেপ্তার অভিযান, অন্যদিকে বিরোধী দলের অবরোধ–হরতাল। ২৫ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে যখন ঢাকা ছাড়ি, তখনই বিএনপির কর্মসূচি নিয়ে টান টান উত্তেজনা চলছিল। এক সাংবাদিক বন্ধু ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ‘তুমি যে বাংলাদেশ রেখে যাচ্ছ, ফিরে এসে সেই বাংলাদেশ পাবে না।’ ২৮ অক্টোবরের আগে রাজনৈতিক উত্তেজনা থাকলেও কোনো সহিংসতা ছিল না। কিন্তু ওই দিনই বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করল প্রাণহানি, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, গ্রেপ্তার, তল্লাশি, রিমান্ড ইত্যাদি।
বিএনপির কয়েকজন কর্মী ও এক পুলিশ সদস্য মারা গেলেন। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর থেকে শুরু করে কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করা হলো। অনেকে আত্মগোপনে গেলেন। পাকিস্তান আমলেও বিনা গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় মধ্যরাতে বাসায় হানা দিয়ে রাজনীতিকদের এভাবে গ্রেপ্তার করা হতো না।
পাকিস্তান আমলে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আন্দোলনের অংশ হিসেবে শহীদদের স্মরণে গায়েবানা জানাজা পড়তেন। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর করিতকর্মা সদস্যরা চালু করলেন গায়েবি মামলা। আর এসব মামলায় জ্ঞাত আসামির চেয়ে অজ্ঞাত আসামির সংখ্যা বরাবর বেশি থাকে, যাতে পরে সুবিধামতো যে কারও নাম বসিয়ে দেওয়া যায়।
২৮ অক্টোবরে অঘটনের দায় নিয়ে এখন সরকার ও বিরোধী দলের নেতাদের পাল্টাপাল্টি নালিশ চলছে। সরকারের দাবি, বিএনপি-জামায়াত আবার অগ্নিসন্ত্রাস শুরু করেছে। বিএনপির সাফাই, সরকার একতরফা নির্বাচন করার জন্য এজেন্ট ঢুকিয়ে সন্ত্রাস ও নাশকতা চালাচ্ছে।
এই পাল্টাপাল্টি নালিশের নিচে চাপা পড়ে যায় আপনজন হারানো মানুষগুলোর দীর্ঘশ্বাস, হরতাল–অবরোধে কাজ হারানো খেটে খাওয়া মানুষের আহাজারি। গণতন্ত্রের জন্য সব সরকারের আমলেই সাধারণ মানুষকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে, হচ্ছে; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশে গণতন্ত্র অধরাই থেকে গেল।
এই যে পুলিশ সদস্য মারা গেলেন, পুলিশের গুলি ও ধাওয়া খেয়ে কয়েকজন বিএনপির কর্মীকে জীবন দিতে হলো, এক সপ্তাহের ব্যবধানে এক দিনের হরতাল ও পাঁচ দিনের অবরোধে দেশ অচল হলো, তার কারণ কিন্তু একটি সুষ্ঠু ভোট না হওয়া। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরও একই দাবিতে লগি–বইঠার আন্দোলন হয়েছিল। সে সময় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। এখন ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। দেশ উন্নয়নের সূচকে যত এগিয়ে যাক না কেন, গণতন্ত্রের সূচকে, মানবাধিকারের নিক্তিতে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে।
আওয়ামী লীগের যে নেতারা এত দিন প্রচার করে আসছিলেন যে বিএনপির আন্দোলন করার মুরোদ নেই, তাঁরা এখন কী বলবেন?
আওয়ামী লীগের নেতারা দাবি করতে পারেন, বিএনপির হরতাল-অবরোধে জনগণের সমর্থন নেই। মাঠ এখন ক্ষমতাসীনদেরই দখলে আছে। কিন্তু মাঠ দখলে থাকা আর অর্থনীতির চাকা সচল রাখা যে এক কথা নয়, সেটা সরকার স্বীকার না করলেও ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। দেশের অর্থনীতি এমনিতেই খুব নাজুক অবস্থায়। এরই মধ্যে হরতাল–অবরোধের খাঁড়া দেশকে মহা অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যাবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সৈয়দ মনজুর এলাহী প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার–এ কলাম লিখে এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতার মধ্যে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে যে সংলাপ করল, তা সংকট কাটানোর কোনো ইঙ্গিত দেয় না। নির্বাচন কমিশনের বাহক যেদিন বিএনপির অফিসের কলাপসিবল গেটের ফাঁক দিয়ে শূন্য টেবিলে একখানা চিঠি রেখে এলেন, তার আগের দিন দলের মহাসচিবকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
স্বাধীন ও সার্বভৌম নির্বাচন কমিশন এ কথা নির্বাহী বিভাগকে বলতে পারল না, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে আমরা সংলাপ ডেকেছি। বিরোধী দলের দ্বিতীয় প্রধান নেতাকে ছেড়ে দিন। এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন সংলাপকেই প্রহসনে পরিণত করল না, সংবিধান তাকে যে ক্ষমতা দিয়েছে, তারও অপব্যবহার করল।
অস্ট্রেলিয়ার গণভোটটি এবার আদিবাসীদের অধিকারের স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সেখানে যাঁরা আদিবাসীদের অধিকারের পক্ষে, তাঁদের আশা ভবিষ্যতে এই স্বীকৃতি মিলবে। কেননা সেখানে ভোটের অধিকার আছে। কিন্তু বাংলাদেশে পাঁচ বছর পরপর যে নির্বাচন আসে, তা মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করে না, বরং মৃত্যু ডেকে আনে। নির্বাচনের নামে এই মৃত্যুডাকা বন্ধ হবে কবে?
[৫.১১.২৩, সিডনি থেকে]
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
উৎসঃ প্রথম আলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন