বঙ্গভঙ্গ :জয়া চ্যাটার্জির নয়া পর্যবেক্ষণ
04 October 2015, Sunday
পাঠকেরা যারা জয়া চ্যাটার্জীকে চেনেন না, তাদের তথ্য ঘাটতি পূরণের জন্য কিছু কথা শুরুতেই বলে দিচ্ছি। জয়া চ্যাটার্জী লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্সে আন্তর্জাতিক ইতিহাস বিষয়ে লেকচারার হিসাবে কর্মরত। তাঁর সাড়া জাগানো বইয়ের নাম হচ্ছে ‘বেঙ্গল ডিভাইডেড’। ইউপিএল বঙ্গানুবাদ করে প্রকাশ করেছে ২০০৩ সালে। ২০০৭ সালে এর দ্বিতীয় মুদ্রণ ও ২০১৪ সালে তৃতীয় মুদ্রণ। গবেষণায় ঋদ্ধ এই বই বাংলা বিভাগের উপরে (১৯০৫ থেকে এবং ১৯৪৭-এ) এক নতুন আলোকরশ্মি নিক্ষেপ করেছে। এ যাবত্ ধারণা করা হতো মুসলিম লীগ, ব্রিটিশের কূটনীতি, ধর্মভিত্তিক আর্থসামাজিক পৃথকায়ন, দ্বিজাতিতত্ত্ব এবং কায়েদে আযম এসব বিভিন্ন পক্ষ ও শক্তির চাপেই ভারত বিভাগ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। পক্ষান্তরে গান্ধির নেতৃত্বাধীন সর্বভারতীয় কংগ্রেস যেহেতু ভারতীয় জাতীয়তাবাদের কথা বলে এসেছে—সেহেতু তারা ভারত বিভাগের বিরুদ্ধেই মূলত অবস্থান নিয়েছে বা নিতে চেয়েছে-অন্তত তাদের মূল নেতা গান্ধিজীর ক্ষেত্রে তা সম্পূর্ণ সত্য। সেই অর্থে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের তথা বাংলা বিভাগের দায়-দায়িত্ব অনেক বেশি পড়বে তদানীন্তন মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভাগ কর ও শাসন কর এই কূটকৌশলের ওপর। ইতিহাসের এই সুপ্রচলিত বয়ানটি জয়া চ্যাটার্জী তার “বেঙ্গল ডিভাইডেড” গ্রন্থে ভেঙে দিয়েছেন। বস্তুত জয়া চ্যাটার্জীর লেখায় কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এলিট নির্ভরতা এবং তাদের স্বার্থে বাংলা ও পাঞ্জাবের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের পক্ষে সমর্থন দান খুব চমত্কার তথ্য-সূত্রসহ বর্ণিত ও প্রমাণিত হয়েছে। বস্তুত ঢাকা থেকে প্রকাশিত তাঁর বইয়ের মূল শিরোনাম “বাংলা ভাগ হলো”-এর সঙ্গে উপ-শিরোনামে তিনি নতুন দুটি লাইন যোগ করেও লিখেছেন:“হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও দেশ বিভাগ: ১৯৩২-১৯৪৭”। এ থেকেই বুঝা যায় নিজ সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক ঝোঁক উন্মোচনে জয়া চ্যাটার্জীর কোন দ্বিধা ছিল না।
এবারের সেমিনারে তিনি অবশ্য এসেছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিমন্ত্রণে এবং ছেলেমেয়েদের-কে সঠিক গবেষণা পদ্ধতি সম্পর্কে লেকচার দিতে। আর গত ২৩.৯.২০১৫ তারিখে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত সেমিনারে তিনি একটি বক্তৃতা দেন। যেদিনের কথা বলছি, সেদিন তার লেকচারের বিষয়বস্তু ছিল জন্মভূমিতে নানা কারণে বাধ্য হয়ে আটকে থাকা মানুষের দারিদ্র বা অন্য কথায় বহতা জীবনের ধারায় স্বাভাবিক গতিশীল বহির্গমনে অক্ষম ব্যক্তিদের ট্রাজেডি। বিষয়টি অভিনব এবং দারিদ্রের অন্য অনেক কারণের মধ্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অথবা গণ্ডিবদ্ধ এলাকায় সংকুচিত জীবনও যে কারণ হতে পারে সেটা এই আলোচনায় চমত্কার ট্রাজেডির আকারে উঠে এসেছিল। এই আলোচনার পোশাকী শিরোনামটি ছিল: “অন দি স্টাক: ইমমোবিলিটি এন্ড পভার্টি ইন ডিভাইডেড বেঙ্গল” (আটকে পড়া: বিভক্ত বাংলার গতিহীনতা ও দারিদ্র)। কাঁটায় কাঁটায় ঠিক ৬টায় ব্র্যাক সেমিনার কক্ষে সেমিনারটি শুরু হয়। প্রশ্নোত্তরসহ প্রায় ৮টা পর্যন্ত চলে। সৈয়দ মনজুর (সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম) তাকে পরিচয় করিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথের ভাষায়: “তিনি তো আমাদেরই লোক” বলে। আসলে জয়া চ্যাটার্জী শিলিগুড়ির মেয়ে। সেখান থেকে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা, তারপর অক্সফোর্ডে পিএইচডি, অবশেষে এখন লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্স-এ অধ্যাপনা করছেন।
আমরা জানি বাংলা বিভাগের পর এপার-ওপার দু’পার থেকেই ব্যাপক মানুষ চালাচালি হয়েছে। প্রশ্ন হলো, যেসব মুসলমান পশ্চিমবঙ্গ থেকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে আসতে চেয়েছিল তারা কি সবাই আসতে পেরেছিলেন? জয়ার নিশ্চিত উত্তর না। সবার সেই গতিশীলতা ছিল না। অনেকেই বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে ভিন্ন জায়গায় নতুন জীবনের ঝুঁকি নিতে চান না। অনেক দুর্বলচিত্তের ও শারীরিকভাবে অক্ষম মহিলা তার শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে সীমা পেরুনোর ধকল সহ্য করতে সক্ষম ছিলেন না। সেই হৈ-চৈ আর ভিড়ের মধ্যে ট্রেনে উঠে পড়ার সামর্থ তাদের ছিল না, এছাড়া ভিটেমাটির টান এবং অসহায় নির্ভরশীল মানুষদের প্রতি মায়া-মমতা তাদেরকে প্রতিকূল শত্রু পরিবেষ্টিত জন্মভূমিতেই একধরনের বন্দী করে রেখেছিল। এ এক অদ্ভুত ট্রাজেডি। নিজ দেশে কেউ একজন যখন পরবাসী হয়ে যায় তখন তার মনোবেদনা খুবই তীব্র হয়। করিম যখন দেখে তার আজন্ম বন্ধু রাম, শ্যাম, যদু, মধুর সঙ্গে তাদের বৈরিতামূলক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তখন দেশই শুধু ভৌগোলিকভাবে বিভক্ত হয় না মানসিকভাবে সম্প্রদায় দুটিও পরস্পর বিভক্ত হয়ে যায়। বন্ধুকে আমরা ভয় পেতে শুরু করি, জন্মভূমিকে শত্রুভূমি ভাবতে শুরু করি এবং বিদেশকে জন্মভূমি ভাবতে শুরু করি। এই ট্রাজেডি শুধু পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলমানদের ক্ষেত্রে ঘটেনি পূর্ববঙ্গের বাঙালি হিন্দুদের ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। বাঙালি হিন্দুরাও ব্যাপকভাবে ১৯৪৭ সালে পূর্ববঙ্গ থেকে ওপার বাংলায় পাড়ি জমিয়েছিলেন। সেখানেও খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে ধনী সক্ষম ব্যক্তিরা যত সহজে পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে যেতে পেরেছিলেন গরিব হিন্দুরা বিশেষত দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থানকারী দুর্বল ব্যক্তিরা এবং বিশেষভাবে নারী প্রধান পরিবারগুলো তত সহজে পরিব্রাজক হতে পারেন না। ইচ্ছার বিরুদ্ধে জন্মভূমিতে আটকে থাকতে হয়েছে তাদেরকে। অনেক পরিবারের বৃদ্ধ মাতামহী নিজ গৃহে দিনের পর দিন সন্ধ্যা বাতি জ্বালিয়েছে। তার পুত্র, কন্যা, নাতি, নাতনি হয়তো ওপার বাংলায় স্থিতিশীল হয়েছে। তার নিজস্ব জীবন জীবনসঙ্গীবিহীন, আত্মীয়বিহীন সংকুচিত জীবনে পরিণত হয়েছে। প্রথমদিকে তাকে ওপারে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার পুত্র-কন্যারা চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন কিন্তু এখন সেই চেষ্টাও আর নেই। যারা চলে গিয়েছে তারা এখান থেকে শিকড় উপড়ে ফেলে নতুন জায়গায় নতুন শিকড় স্থাপন করেছে। নতুন জীবন তাদেরকে গ্রাস করেছে। ফেলে আসা জীবনের হাতছানিটুকুও এখন আর তাদের মনে কোনো ছায়া ফেলে না। মায়ের সঙ্গে পুত্রের নিবিড় সম্পর্কও দূরত্বের কারণে একসময় শুকিয়ে যায়। হয়তো খোঁজ করলে দেখা যাবে পুত্র ঐপারে মোটামুটি সচ্ছল জীবন-যাপন করছেন। আর আটকেপড়া মা নিজ দেশে পরবাসী হয়ে এক যন্ত্রণাময় দারিদ্রে ভরপুর জীবন-যাপন করছেন। জয়া চ্যাটার্জী কতগুলো কেইস স্টাডির মাধ্যমে এই মর্মান্তিক গল্পগুলো সেদিনকার সেমিনারে তুলে ধরেছিলেন। কথা বলতে বলতে দুঃখে তাঁর গলা ধরে গিয়েছিল বলে আমার মনে হয়েছে।
তার বক্তৃতায় উঠে এসেছে জেনেভা ক্যাম্পে অবস্থিত বিহারী মুসলিমদের অভিনব এবং অপরিসীম ট্রাজেডির কথা। তারা প্রকৃতপক্ষে দু’বার দেশত্যাগী হয়েছেন। একবার বিহার থেকে পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৪৭ সালে, আরেকবার পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে ১৯৭১ সালে। জেনেভা ক্যাম্পের এক বৃদ্ধার জীবনের বর্তমান বন্দীদশার যে চিত্র জয়া বর্ণনা করলেন, তাতে বুঝা মুশকিল এতে দায়ী কে? এ কথা আমরা হয়তো এক কথায় বলতে পারি বিহার থেকে এসব মুসলমান এখানে আসলেন কেন? আসলেনই যখন তখন আবার পশ্চিম পাকিস্তানে গেলেন কেন? কিন্তু এই সব প্রশ্নের উত্তর অত সহজে দেয়া যায় না। স্ট্যান্ডার্ড সমকালীন অর্থনৈতিক পরিভাষায় বলে: “মানুষের গতিশীলতা” তার উপরে অর্থনৈতিক শক্তি বা প্রণোদনার আকর্ষণ, বিকর্ষণের ক্রিয়া-বিক্রিয়া দ্বারাই নির্ধারিত হয়। যদি তার অর্থনৈতিক অবস্থানের প্রতি তার কোন আকর্ষণ না থাকে অথবা অর্থনৈতিক অবস্থা যদি প্রবলভাবে তাকে বিকর্ষণ করে এবং অন্য কোথাও উন্নততর জীবনের সুযোগ যদি থাকে এবং তা যদি ততোধিক তীব্রভাবে তাকে আকর্ষণ করে তাহলে সে কক্ষচ্যুত হতে বাধ্য। স্থায়ী অভিবাসনে এটিই প্রধান অর্থনৈতিক রসায়ন। কিন্তু এই মডেলে ব্যক্তিগত শারীরিক অক্ষমতা, মায়া-মমতা, দেশপ্রেম, আত্মীয়তা ও নির্ভরতার বন্ধন এগুলোকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। এগুলো থাকলে অর্থনীতিকে উপেক্ষা করে মানুষ এক জায়গায় আটকে থাকতে বাধ্য হয়। কিন্তু এই আটকে থাকার জন্য তাকে বরণ করে নিতে হয় অনেক নিদারুণ দুঃখময় জীবন। চৌকস নাগরিকেরা (Smart Citizens) স্বেচ্ছায় এই দুঃখ বরণকে তাই অনুমোদনও করেন না, বুঝতেও পারেন না!
বিশ্বায়নের এই যুগে সেসব চৌকস মানুষই হবেন সফল, দারিদ্রমুক্ত এবং আধুনিক যারা কোথাও আটকে থাকবেন না, প্রবল গতিবেগে চরে বেড়াবেন বিশ্বের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত। আর আটকে থাকা ছাপোষা মানুষরা বলে যাবেন: “হে দারিদ্র তুমি মোরে করেছ মহান”। এরকম একটি অন্তর্লীন বক্তব্যের আভাস পাওয়া গেল সেদিনের জয়া চ্যাটার্জীর বক্তৃতায়। আমি বাসায় ফিরতে ফিরতে অবশ্য সেদিন অমর্ত্য সেনের কথা ভাবছিলাম। অমর্ত্য সেন মনে করেন, একজন লোক একই সঙ্গে স্মার্টও হতে পারে, মহত্ও হতে পারে। জয়া চ্যাটার্জী সেদিনের সেমিনারে অবশ্য সেইসব স্মার্ট ধনী ও মধ্যবিত্তদের অভিভাষণ নিয়ে কোন কথা বলেন নি। অবশ্য সময়ও ছিল না। তাই ট্রাজেডিটাই বেশি আলোচনা হয়েছে। ট্রাজেডি অতিক্রমণের জন্য পুঁজির প্রভাবমুক্ত নতুন মানবিক বিশ্বায়ন নিয়েও কোন আলোচনা হয়নি। কিন্তু তাঁর করুণ কথাগুলো এখনো আমার প্রাণে বেজে চলেছে। আর সে জন্যই এই লেখা।
n লেখক:অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
akash92hotmail.com
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন