অনিশ্চিত রাজনীতি
14 January 2015, Wednesday
৫ জানুয়ারি (২০১৪) আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য ক্ষমতাসীন হয় এবং শপথ গ্রহণ করে ১২ জানুয়ারি। আরেক ৫ জানুয়ারি (২০১৫) তাদের ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ ২০ দলীয় জোট একটি মরণপণ লড়াই শুরু করেছে। আমি অতীতে অনেক লেখায় বলেছি যে, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের ধারায় পরিচালিত হবে, নাকি পাকিস্তানের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক ধারাতে ফিরে যাবে_ এই মৌলিক দ্বন্দ্বের সমাধা না করা পর্যন্ত এদেশের উন্নম্নয়ন প্রশ্নের স্থায়ী কোনো সমাধান হবে না। পাকিস্তানি ধারা বলতে আমি বোঝাতে চাইছি লুটেরা-বুর্জোয়াদের সেই অংশের অনুসৃত ধারা, যারা স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক ঐক্যজোট গঠন করেছে এবং সামগ্রিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরোধী অবস্থানে রয়েছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর এ ধরনের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো ক্রমশ একজোট হয় এবং ১৯৯০ সাল পর্যন্ত নানা ধরনের সুবিধাবাদী কোয়ালিশনের সাহায্যে সামরিক ছত্রছায়ায় ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়। ১৯৮০-৯০ কালপর্বে জেনারেল এরশাদের তথা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিএনপি জোট, আওয়ামী জোট, স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতি জোট ও বামরা পরবর্তী সময়ে পরস্পর পৃথক অবস্থান থেকে এক বিশাল সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে। তার পরিণতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ও পাঁচ বছর পরপর এক ধরনের গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের সুষ্ঠু সংস্কৃতি এখনও গড়ে ওঠেনি। আওয়ামী লীগ নানা অগণতান্ত্রিক পন্থায় এখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছে। অন্যদিকে বিএনপি একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর যাবতীয় দুষ্কর্মের সহযোগী ফ্যাসিস্ট আলবদর-রাজাকার বাহিনীর দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ঐক্যজোট গঠন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও গণতন্ত্রের দাবিতে এমন এক আন্দোলন শুরু করেছে, যেখানে আন্দোলনের চেয়ে জামায়াতের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডই ক্রমাগত বাড়ছে ও প্রধান হয়ে উঠেছে।
সুতরাং এই দুই শক্তি আবারও মুখোমুখি অবস্থানে পেঁৗছাবে_ তাতে আশ্চর্য কী। এর সঙ্গে যুক্ত করুন দুই নেত্রী হিসেবে পরিচিত দেশের প্রধান দুই দলের দুই শীর্ষ নেতার ব্যক্তিগত তিক্ত অভিজ্ঞতা। অন্তত শেখ হাসিনার জন্য তা খুবই মর্মান্তিক। শেখ হাসিনা বলতেই পারেন, তার বাবা-মাসহ পরিবারের সব সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। তাকেও হত্যার জন্য একাধিকবার চেষ্টা চালানো হয়। বিশেষভাবে তিনি উল্লেখ করেন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার প্রসঙ্গ, যাতে মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী নিহত হন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্ধারিত নির্বাচন ভণ্ডুলের জন্য যে ব্যাপক সহিংসতা পরিচালিত হয়েছে, সেজন্যও তিনি বিএনপি ও তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করে থাকেন। এসব কারণে তার কাছে মরি-বাঁচি যা-ই হোক, এদের সঙ্গে চূড়ান্ত লড়াইয়ের বিকল্প নেই। গণতন্ত্র থাকল কি থাকল না সেটা তার কাছে সম্ভবত বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে না। তার কাছে প্রধান বিষয় হচ্ছে_ বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর জোট ক্ষমতায় যাবে, নাকি আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা ক্ষমতায় থাকবে।
এই একই মৌলিক প্রশ্নে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে সময়ে আমরা দেখেছি রাজনীতির 'বুদ্ধি/কূটকৌশল'-এর খেলায় শেখ হাসিনার কাছে খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়া পরাজিত হয়েছিলেন। এখন এটা মোটামুটি সবাই (বিএনপিরও অনেকে) স্বীকার করেন যে, বিএনপি যদি ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করত তাহলে কম করে হলেও ৩০০ আসনের সংসদে ১২০টি আসনে অনায়াসে জয়ী হতো। আর যে আসনগুলো কারচুপি করে আওয়ামী লীগ নিয়ে নিয়েছে বলে তারা মনে করত, সে ইস্যু নিয়েও তারা আন্দোলনে নামার সুযোগ পেত। এটা নিশ্চিত করে বলা চলে, বিএনপির এ ধরনের আন্দোলন অন্তত এখনকার মতো জামায়াত পরিচালিত চোরাগোপ্তা সন্ত্রাসে পরিণত হতো না। তার গণসম্পৃৃক্তি অনেক বেশি হতো।
শেখ হাসিনা স্বয়ং এটা বোঝেন। সে জন্য তার উক্তি_ আপনি (খালেদা জিয়া) ভুল করেছেন। তার খেসারত দিতে হবে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো_ গত এক বছরে আওয়ামী লীগের কর্মকুশলতা লক্ষ্য করে আমরা কি এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, আগামী চার বছর তারা নির্বিঘ্নে ক্ষমতায় থাকতে পারবে? ধারণা করি, আওয়ামী লীগের উচ্চপদস্থ নেতাদের কথাটা এ রকম_ 'আমরা জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৫ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশে উন্নম্নীত করতে পেরেছি। আমরা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৪০০ কোটি ডলারে উন্নম্নীত করেছি। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী লোকের সংখ্যা কমিয়ে এনেছি। মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট লক্ষ্যমাত্রার বেশিরভাগ অর্জন করেছি নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই। শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু, নারীশিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভারতকে অতিক্রম করেছি। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ভূ-রাজনৈতিক শক্তি ভারসাম্যে চমৎকার অবস্থা তৈরি করেছি।
এ দলের নেতারা ঠিক এভাবে হয়তো বলেন না। কিন্তু ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছেন_ শেখ হাসিনার পিতা দেশটি তৈরি করেছেন এবং শেখ হাসিনা দেশটি গড়ছেন ও রক্ষা করছেন। অর্থাৎ ধরে নেওয়া যায় যে, শেখ হাসিনার ক্ষমতাকে দিলি্ল অনুমোদন দেয়। চীনের সঙ্গে শেখ হাসিনার সম্পর্ক এখন মনে হয় যথেষ্ট উষ্ণ। বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশ হিসেবে গণ্য ওই দেশটির হাতে এখন বিনিয়োগ করার মতো ৫০০ বিলিয়ন ডলার রয়েছে। 'এশিয়ার জন্য এশিয়া'_ তাদের এ নীতিও আমাদের স্মরণ রাখা চাই। বাংলাদেশও সেটাই চায়। সুতরাং চীনের কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা লাভের সম্ভাবনা প্রচুর। পদ্মা সেতু নির্মাণে তারা ইতিমধ্যেই যুক্ত হয়েছে। গভীর সমুদ্রবন্দর ও এশিয়ান হাইওয়েতেও তারা আগ্রহী।
সর্বশেষ থাকে দুই পরাশক্তি আমেরিকা ও রাশিয়া। আমেরিকা আর আগের মতো নখদন্তের অধিকারী দেশ নয়। এই মুহূর্তে তার এ অঞ্চলে মূল আগ্রহ বঙ্গোপসাগর। 'কিন্তু সেখানে কোনো দেশকে ঘাঁটি করতে দেব না'_ এ ধরনের কথা শেখ হাসিনার উপদেষ্টা মসিউর রহমান এক টেলিভিশন টক শোতে আমাকে বলেছেন। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যে, যুক্তরাষ্ট্রকে শেখ হাসিনা ঠাণ্ডা করবেন কী করে? সেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মতো রাশিয়া ও ভারতের সাহায্য নিয়ে? হয়তো তাই। এবারে বাড়তি সুবিধা_ চীনও পক্ষে থাকবে। এসব বিবেচনায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কিছুটা আত্মসন্তুষ্টিতে ভুগতেই পারেন।
কিন্তু আমরা এটাও জানি যে, রাজনীতির ব্যারোমিটার শুধু কতগুলো ম্যাক্রো অর্থনৈতিক সূচক এবং ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। মূলত তা নিয়ন্ত্রিত হয় অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন শ্রেণীর প্রত্যাশা এবং তা পূরণের মধ্যে ব্যবধানের দ্বারা। তাদের সক্রিয় শক্তির মধ্যে ভারসাম্য দ্বারা। ইতিমধ্যে একটি শক্তিশালী শ্রেণী ব্যবসায়ীরা বলতে শুরু করেছেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে তারা বিনিয়োগ বাড়াতে আগ্রহী হতে পারছেন না। এর সঙ্গে যোগ করুন গ্যাস-বিদ্যুৎ খাতে সরকারের নিজস্ব পরিকল্পনা পূরণে ব্যর্থতার কথা। কুইক রেন্টাল পদ্ধতিতে জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। কিন্তু সেই বিদ্যুতের দাম এত বেশি পড়েছে যে, তা দিয়ে সাধারণ ও জনগণ বা ব্যবসায়ীদের সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎ দেওয়া যায় না। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম আরও বাড়লে রাজনীতিতে দাহ্য বস্তু যুক্ত হবে, তাতে সন্দেহ নেই। আগামীতে সরকারের জন্য এটি একটি সম্ভাব্য অগি্নপরীক্ষা হবে বলে অনেকে মনে করছেন।
বাংলাদেশের বড় ধনিকরা আজ ব্যাংক ব্যবস্থাকে নিয়ে গেছেন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ছিল ৫৬ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। এক বছর পর তা বেড়ে হয়েছে ৫৭ হাজার ২৯১ কোটি টাকা, যদিও মোট ঋণে খেলাপির অংশ ১২ দশমিক ৭৯ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ। সবচেয়ে উদ্বেগজনক খবর হচ্ছে, এ ঋণের ৭৯ শতাংশ কুঋণ, যা হয়তো আর ফেরত পাওয়া যাবে না। ভারত, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশের দিকে তাকালে দেখা যাবে, সেখানে খেলাপি ঋণের আপেক্ষিক গুরুত্ব তিন ভাগের এক ভাগেরও কম অর্থাৎ তিন শতাংশের নিচে। সরকারের ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট অনুযায়ী এ ব্যর্থতার পেছনে চারটি কারণ রয়েছে। এক. সরকারের ধনিক তোষণ নীতি। এ কারণে যার যা প্রকৃত প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি ঋণ দেওয়া হয়েছে; দুই. ঋণ প্রদানে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব; তিন. ঋণ বিতরণ ও আদায় সংক্রান্ত আইনের দুর্বলতাগুলো দূর না করা এবং চার. অর্থঋণ আদালতে বিচারসংখ্যার স্বল্পতা। এ রিপোর্টে বর্ণিত কারণগুলো দূর করা অসাধ্য নয়। কিন্তু কথা আছে না_ ভূত তাড়ানোর সরিষায় ভূতের আছর হলে তা দিয়ে ভূত তাড়ানো যায় না।
খেলাপি ঋণ বেশি থাকলে ঋণের সুদের হার বেশি হতে বাধ্য। সুদের হার বেশি হলে বিনিয়োগে উৎসাহ কমে যেতে বাধ্য। উদ্যোক্তারা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় গ্যাস-বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। সুদের হার বেশি। বন্দর ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় অনিশ্চয়তা। রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা। এ অবস্থায় দেশের বাইরে অর্থ পাচার করে দিলে তেমন কোনো শাস্তিও এখন পেতে হয় না। নিজের কাছে থাকা অর্থের একটি অংশ রাজনৈতিক বিনিয়োগের মাধ্যমে রাজনীতিকে একবার কিনে ফেলতে পারলে যে কোনো বিপদও এড়ানো চলে। রাজনীতিকে কিনতে পারলে বা না পারলেও আমলাতন্ত্রকে তো কিনতে পারা যাবেই। সুতরাং সব মিলিয়ে রাঘববোয়ালদের আর চিন্তা কী?
কিন্তু রাঘববোয়ালরা বিনিয়োগ না করে বাইরে অর্থ পাচার করলে এদেশে বৃহদায়তন শিল্প কীভাবে স্থাপিত হবে? জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ থেকে বাড়িয়ে ৮ শতাংশ হবে কীভাবে? বিনিয়োগের হার এখন জিডিপির ২৪ শতাংশ। সেটা কীভাবে ঈপ্সিত ৩২ শতাংশে উন্নম্নীত হবে? এ অবস্থা থাকা সত্ত্ব্বেও শেখ হাসিনা যখন জোর গলায় বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার কথা বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলেন, তখন কিন্তু জনগণ ঠিক তাতে আস্থা পায় না।
তাই এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, আওয়ামী লীগ নেত্রী প্রত্যাশা তৈরি করতে পেরেছেন, কিন্তু তা পূরণের যে বাস্তবতা দরকার তাতে রয়ে গেছে বিস্তর ব্যবধান। এটা ঠিক যে, আওয়ামী লীগ 'কল্যাণ পুঁজিবাদ'-এর প্রত্যাশা সৃষ্টি করেছিল। অন্তত তাদের ঘোষণা, বক্তৃতা ও ইশতেহারে সেটা আমরা দেখি। কিন্তু তাদের একটি বড় অংশ লুটেরা পুঁজিবাদকে অব্যাহত প্রশ্রয় দিচ্ছে। এভাবে ব্যাপক মানুষের আশা ভঙ্গ ও দ্বন্দ্ব জমা হতে থাকলে অবশ্যম্ভাবীভাবে কোনো অগ্রসর শক্তি না হয় কোনো পশ্চাৎপদ শক্তি তার সুযোগ নিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারে। এক সময় বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলা হতো, তার পতন 'অনিবার্য'। ডান বা বাম কে সেটা করবে_ সেটাই প্রশ্ন। কোনো কোনো সাবেক বামপন্থি শেখ হাসিনা সম্পর্কে সেটাই বলতে চান। তবে ১৯৭৫ সালের তুলনায় এখনকার অবস্থা ততটা খারাপ নয়। শেখ হাসিনার পায়ের তলায় রয়েছে অপেক্ষাকৃত মজবুত অর্থনীতি। বৈদেশিক শক্তির ভারসাম্যও পূর্বের তুলনায় অনুকূল। প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি একটি আত্মঘাতী দলে পরিণত হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীকে না ছেড়ে এবং 'স্বনামধন্য' তারেক রহমানের বিভিন্নম্ন অপরিণামদর্শী উক্তির বেড়াজালে পড়ে বিএনপি ইতিমধ্যেই অকার্যকর হয়ে পড়তে শুরু করেছে। এখন তার একমাত্র হাতিয়ার সন্ত্রাস বা চোরাগোপ্তা আক্রমণ। বামদের এবং উদারনৈতিক ধারায় যারা আছেন (সিভিল সোসাইটি ইত্যাদি) তাদের মধ্যেও সম্পূর্ণ ঐকমত্য নেই। সিভিল সোসাইটি, ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখ উদারনৈতিক শক্তি দ্বন্দ্বরত প্রধান দুই দলের মধ্যে সমঝোতার প্রয়োজন অনুভব করেন। এ দাবিতে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করেন। কিন্তু বাস্তবে সেটা হওয়ার নয়। কারণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ছাড়া আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলে কপালে কী আছে সেটা তারা ভালো করেই জানে। সুতরাং সংগ্রামের এই স্তরের প্রধান দ্বন্দ্ব সমাধা করতেই হবে। কিন্তু জনগণের প্রকৃত ক্ষোভের ইস্যুগুলোরও সমাধা করতে হবে এবং সে জন্য জোরদার আর্থসামাজিক অঙ্গীকার চাই। আর তা না থাকলে সেসব বিশেষ ইস্যুতে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত সব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ চাপ ও গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সে কর্তব্য বিশেষভাবে বামপন্থিদের সামনে রয়েছে। এ জন্য কিছু চেষ্টাও আছে। কিন্তু প্রধান দ্বন্দ্ব যতদিন অমীমাংসিত থাকবে ততদিন দুই মেরুভিত্তিক রাজনীতি থেকে বের হওয়া কঠিন।
মুক্তিযুদ্ধের ইস্যুটির ফয়সালার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার লড়াই অগ্রসর করে নিতে হবে। যেই অর্থনীতি পরিবর্তিত বিশ্বপ্রেক্ষাপটে অপুঁজিবাদী বিকাশের পথে সমাজতন্ত্রে পেঁৗছাবে না বরং বুর্জোয়া বিপ্লবের অসমাপ্ত দায়িত্ব পালন করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পূর্বশর্ত নির্মাণ করবে। আওয়ামী লীগ যদি লুটপাটের ক্ষেত্রে সংযম প্রদর্শন করতে পারে এবং ইতিমধ্যে তলদেশ থেকে পুঁজিবাদের যে স্বতঃস্ফূূর্ত অগ্রগতি হয়েছে (ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ, শ্রমজীবী জনগণের শ্রম এবং কৃষকদের অবদান), তাকে আরও বিকশিত করার পাশাপাশি এই শক্তিগুলোর জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ইত্যাদি মৌলিক প্রয়োজন সরবরাহের পাশাপাশি জমি ও নূ্যনতম আর্থিক পুঁজির সংস্থান করতে পারে, তাহলে এটা ত্বরান্বিত হবে। অন্য কথায় বৃহৎ বুর্জোয়াকে পরিত্যাগ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি বুর্জোয়ার কাছে ও পারলে জনগণের শক্তিগুলোর কাছে ফিরে যেতে হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলোকে। এটাই শাসক দলটির টিকে যাওয়ার পথ। নইলে দলটির পরাজয় হবে অথবা দেশে একটি স্থায়ী অনিশ্চয়তা থেকেই যাবে। এর বেশি এখন কিছু বলা সম্ভব নয়। কেউ হয়তো বলতে পারেন, এখন আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়ে বিএনপি জোট ক্ষমতায় এলেই-বা ক্ষতি কী? পরিবর্তনশীল আওয়ামী লীগ সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক প্রবচন উল্লেখ করে এই প্রশ্নটির জবাব দিতে চাই_ 'আওয়ামী লীগ ভাসলে একাই ভাসে, কিন্তু ডোবার সময় সবাইকে নিয়ে ডোবে!'
অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎসঃ সমকাল
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন