দেখতে দেখতে বিজয়ের মাস এবং বছর শেষ হয়ে গেল। পুরনো পচা জরাজীর্ণ, করোনার আক্রমণে সাধারণ মানুষ দিশাহারা। দিন এনে দিন খাওয়াদের কষ্টের শেষ নেই। তার ওপর আবার তীব্র শীতে মানুষের একেবারে মরণদশা। দেশের মালিক জনগণ, সেই দেশের ওপর জনগণের তেমন প্রভাব না থাকায় প্রায় সবার মুখ মলিন। একটা স্বাধীন দেশের আনন্দিত উৎফুল্ল জনগণকে দেখে যেমন লাগার কথা তার লেশমাত্র নেই। চারদিকে আবহাওয়া কেমন যেন গুমোটবাঁধা অস্বস্তিকর। হাসিমুখ খুব একটা দেখা যায় না। মানুষ কী নিয়ে হাসবে? হাসির জন্য যে সামান্য উপকরণ দরকার, যে অস্তিত্ববোধ দরকার তার তেমন কিছুই নেই। তাই সাধারণ মানুষ কেমন যেন মূক ও বধির হয়ে আছে। চারদিকে কত বড় বড় কাজ হচ্ছে, সে জন্য কারও তেমন গর্ববোধ নেই। মানুষের আনন্দের, শাশ্বত গৌরবের প্রায় সব দ্বার কেমন যেন রুদ্ধ হতে চলেছে। আজ আমাদের যে বয়স, স্বাধীনতার পরপর এমন বয়সের মানুষের মুখের দিকে তাকালে বুক ভরে যেত, ভালো লাগত। ইদানীং মানুষের স্বাস্থ্যেও যেমন টান পড়েছে, মুখেও কেমন যেন বিস্বাদের ছাপ। কোথাও তেমন স্পষ্ট উজ্জ্বল আভা বিকীর্ণ হয় না। আজ ২০২০ সাল। ১৯৭১ সালের এই দিনে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস, আমাদের অনন্য প্রেরণা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানের জেলখানায়। তবু তাঁকে ফিরে পাওয়ার, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে গড়ে তোলার যে উদ্দীপনা ছোট-বড়-ধনী-নির্ধন সবার মধ্যে ছিল তেমন কিছুই নেই। তাই চেষ্টা করেও ভালো থাকতে পারি না।
গত সংখ্যায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেছিলাম- সত্যিই তিনি যদি ভুল করতেন তাহলে আমাদের পরিণতি কী হতো? জিয়াউর রহমান একসময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন, কত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-এমপি, কত হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক- এসবের কী হতো? এটা তো জোর গলায় বলতে পারি, বাংলাদেশ না হলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমারও ফাঁসি হতো, জিয়াউর রহমানেরও হতো, খালেদ মোশাররফ, শাফায়েত জামিল, কর্নেল অলি কারও মাথা তুলে দাঁড়ানোর সুযোগ ছিল না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে আকাশ থেকে বোমা ফেলা হতো। এমনকি জনাব এ কে খন্দকার যিনি ত্রুটি ধরেছেন, তাঁকে আদেশ করা হলে তিনিও বোমা ফেলতেন। ভদ্রলোক ২৫ মার্চ বা ২৬ মার্চ অথবা এপ্রিলে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেননি। তিনি যুদ্ধবিমান চালাতে জানতেন, তিনি নাকি পাকিস্তান বিমান বাহিনী প্রধান আজগর খাঁকে ঝড়-তুফানে বিমান চালনার কৌশল শিখিয়ে ছিলেন। কিন্তু এক স্কোয়াড্রন যুদ্ধবিমান নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে বা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেননি। তিনি নিজেই বলেছেন, মার্চের শেষ দিন অথবা এপ্রিলের ১-২ তারিখ আরিচা হয়ে পালাতে চেষ্টা করেছিলেন। রাস্তায় মিলিটারি দেখে ফিরে এসে চাকরিতে যোগদান করেন। ১৫ মে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে গিয়েছিলেন। তিনি নিজেই আফসোস করেছেন, সীমান্ত পার হতে এক রাত যাদের বাড়ি ছিলেন তাদের একজন কলকাতায় তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। কিন্তু তাকেও তিনি এক রাত আশ্রয় দেননি বা দিতে পারেননি। এই মানুষকে কেন মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বসূচক খেতাব দেওয়ার কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়েছিল জানি না। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী এবং যুদ্ধবিশারদরা যুদ্ধক্ষেত্রে যোদ্ধাদের উৎসাহ বৃদ্ধির জন্য সাহসিকতা পদকের প্রস্তাব করেছিলেন। নীতিমালা ছিল, ‘যারা যুদ্ধক্ষেত্রে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেবে তাদের তৎক্ষণাৎ পদক দিয়ে প্রশংসা করা হবে যাতে অন্যদেরও সাহসী হতে উৎসাহিত করা যায়।’ প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ নেওয়া ছাড়া কাউকে সাহসিকতা পদক বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম, বীরবিক্রম, বীরপ্রতীকে ভূষিত করা হয়নি। প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা যদি না থাকত তাহলে প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানীকে নিশ্চয়ই বীরত্বসূচক পদক দেওয়া হতো। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে যাননি বলে তাঁকে কোনো পদক দেওয়া হয়নি। উপ-প্রধান মেজর জেনারেল রব তিনিও যুদ্ধক্ষেত্রে যাননি বলে তাঁকেও পদক দেওয়া হয়নি। তাহলে এ কে খন্দকার, তিনিও তো যুদ্ধক্ষেত্রে যাননি। ১৫ মে বাংলাদেশ ত্যাগ করার পর ১৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার সঙ্গে ঢাকায় এসেছিলেন। এর মাঝে তিনি কখনো সীমান্ত পার হননি। তাহলে তিনি নিজের খেতাব নিজেই নিলেন কী করে? পায়ে হেঁটে বাংলাদেশের সীমানায় যেমন আসেননি, তেমনি আকাশপথেও না। তাহলে তিনি বীরউত্তম খেতাব কী করে নিলেন? এ তো গেল খেতাবের কথা।
বঙ্গবন্ধু যদি সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন তাহলে তাঁকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করে ফাঁসি দিতে আর কোনো কোর্ট-কাচারি লাগত না। রাস্তায় সৈন্যরা অতর্কিত গুলি চালিয়ে জাতির পিতাকে হত্যা করতে পারত। যুদ্ধের সময় সারা বিশ্বে কূটনীতির ক্ষেত্রে পাকিস্তানি কূটনীতিকরা কোথাও কোনো কথা বলতে পারেননি। সব সময় তাদের জবাব দিতে হয়েছে। অবাধ নির্বাচনে নির্বাচিত একটি দলকে তারা ক্ষমতা দেয়নি, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে রেখে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে অন্যায় যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ বঙ্গবন্ধু সে সময় সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে এই একই রকম অভিযোগের তলে পড়তাম আমরা। দু-চার জন বলার চেষ্টা করেছেন, তাজউদ্দীন সাহেব স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে নিয়ে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু নাকি তাতে স্বাক্ষর করেননি। যদি অমন কোনো স্বাক্ষরিত কাগজ পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ দেখাতে পারত তাহলে বঙ্গবন্ধুকে ন্যায়ত ফাঁসি দিতে তাদের বাধত না। ’৭৭-এ ভারতে ইন্দিরা গান্ধী সরকারের পতনের পর যখন শাহ কমিশন গঠিত হয়, শাহ কমিশনে নানা দুর্নীতির প্রায় ৫ হাজার ফাইল জমা পড়েছিল। কিন্তু তার একটিতেও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর স্বাক্ষর ছিল না। শাহ কমিশন প্রায় দুই বছর সর্বতোভাবে চেষ্টা করেও কোনো প্রমাণ জোগাতে পারেনি, দন্ড দেওয়া দূরের কথা। তাই যারা কাজ করে বুদ্ধিমানের মতোই করে। কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসার ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে একটি ফাইল বগলদাবা করে মোরারজি দেশাইয়ের কাছে গিয়েছিল। ফাইলটি দিতেই মহান ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী মোরারজি দেশাই ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। অফিসারদের বলেছিলেন, ‘আজ ইন্দিরাজির বিরুদ্ধে ফাইল বানিয়ে আমার কাছে এসেছ। আমার পরে যিনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে আসবেন তার কাছেও আমার নামে এ রকম ফাইল নিয়ে যাবে। তোমাদের ফাইল আমার লাগবে না। আমি ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে লড়াই করব।’
আজ ভাবতে অবাক লাগে সেই মূল্যবোধগুলো কোথায় গেল। এখন আর কোনো রাজনৈতিক দল অন্য দলের প্রশংসা করে না। এক নেতা আরেক নেতাকে বন্ধু নয়, শত্রু ভাবেন। বিষয়টা সামাজিকভাবেও ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষে মানুষে সেই আগের মেলবন্ধন নেই, নেই কোনো দরদ। যে অন্যের প্রশংসা করতে না পারে, যে অন্যের হাসি-কান্নায় শরিক হতে না পারে সে আবার মানুষ কীসের? মানুষ হবে সেই যে নিজের চাইতে অন্যকে নিয়ে, অন্যের আনন্দ-বেদনা নিয়ে, পরের কষ্ট নিয়ে বেশি ভাবে সে-ই হলো প্রকৃত মানুষ। যে মনুষ্যত্বে, যে ভালোবাসা-ত্যাগ তিতিক্ষায় আমরা সারা পৃথিবীকে জয় করেছিলাম, যে কারণে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমাদের চাইতে হাজার গুণ শক্তিশালী একটি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছিলাম। সেসব গুণের কিছুই আজ অবশিষ্ট নেই। তবু আমরা অনেকেই ভাবী, আমরা ভালো আছি, আমরা বড় নীতিমান-ন্যায়পরায়ণ। আমাদের কী পরিমাণ অধঃপতন হয়েছে কী পরিমাণ পতন হয়েছে এ থেকেই বোঝা যায়। নিজের ত্রুটি নিজের ভুল আমরা নিজেরা ধরতে পারি না। অথচ একসময় পারতাম। একসময় চোরের কষ্ট আমরা বুঝতে চেষ্টা করতাম। আমরা চুরি করতাম না। নিজে চুরি না করে চোরকে বারণ করতাম। এখন সেসবের লেশমাত্র নেই। অন্যকে চোর বলি অথচ নিজে চুরিতে ডুবে থাকি- এ আর যাই হোক সভ্যতা হতে পারে না।
আমরা অনেক সময় অনেক কিছু খুব একটা তলিয়ে দেখি না। বঙ্গবন্ধু ভারতে আশ্রয় নিলে আমরা স্বাধীন হতে পারতাম না- কথাটা একেবারে ফেল না নয়। যুদ্ধের প্রায় পুরো সময়জুড়ে সারা দুনিয়ায় পাকিস্তান বলে বেরিয়েছে বাংলাদেশে কোনো মুক্তিযুদ্ধ নয়, সেখানে ভারত গোলমাল করছে, সীমান্তে গুলি ছুড়ছে। এমন একটি ঘটনা নিয়ে ’৭১-এর আগস্টের শেষ সপ্তাহে আমাদের প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্সে বলেছিলেন, ‘আমাদের বীর সন্তান কাদের সিদ্দিকী যাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। ভারত সীমান্ত থেকে দেড়-দুই শ কিলোমিটার বাংলাদেশের ভিতরে যমুনায় পাকিস্তানিদের অস্ত্রবোঝাই জাহাজ দখল করে নিয়েছে- এট কি ভারতের কারসাজি?’ হাউস অব কমন্স আবু সাঈদ চৌধুরীর যুক্তি মেনে নিয়েছিল। তাই মুক্তিযুদ্ধটাও অত সহজ ছিল না। শুধু রণাঙ্গনেই নয়, বিশ্বদরবারে কূটনীতিতেও আমাদের লড়াই করতে হয়েছে। সেখানে সমানভাবে আমরা জয়ী হতে না পারলে আমেরিকার সপ্তম নৌবহরকে রাশিয়া বাধা না দিলে আমরাই যে সব করে ফেলেছি এক বাঁশির ফুঁতেই স্বাধীন হয়ে গেছি- এটা সত্য নয়।
সমালোচনা করাই যায়, বঙ্গবন্ধু ধরা দিয়েছিলেন। এ রকম কঠিন সময়ে পাকিস্তানিদের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর সাহস আমার মনে হয় আর কোনো বাঙালির ছিল না। ব্যাপারটা খেলা খেলা নয়, ব্যাপারটা স্থির মস্তিষ্কের অবিচল আস্থা ও সাহসের। এ কাজটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে করতে পেরেছিলেন বলেই তিনি মহান নেতা, তিনি জাতির পিতা। যে যেভাবেই বলুন, বঙ্গবন্ধু ভারতে আশ্রয় নিলে রণাঙ্গনে যেমন আমাদের অস্ত্র ভোঁতা হয়ে যেত, বহির্বিশ্বেও কূটনৈতিক আন্দোলনে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়তাম। আমাদের বীরত্ব আমাদের রক্ত হতো খেলার বস্তু। এসব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে আমরা ’৭১-এ বিজয়ের লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছিলাম।
করোনা আক্রান্ত জরাজীর্ণ ২০২০ আমরা অতিক্রম করছি। নিশ্চয়ই আশা করব, স্বাধীনতার অর্ধশত বছর শুরু হবে ঝলমলে নিরাপদ নিশ্চিত বাধামুক্ত, গণতন্ত্রের ভিত হবে ইস্পাতকঠিন শক্তিতে বলীয়ান। ভোটাধিকার হবে সরকারি প্রশাসনের সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত।
লেখক : রাজনীতিক।
উৎসঃ বিডি প্রতিদিন
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন