জননেতা তোফায়েল আহমেদের ‘যে বেদনা চিরদিন বইতে হবে’ শিরোনামে লেখাটা পড়ে আমার স্ত্রী নাসরীন খুব কেঁদেছেন। লেখাটা আমাকেও স্পর্শ করেছে। আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর পাগল ছিলাম তারা সবাই রসুনের কোয়ার মতো একে অন্যের সঙ্গে পাতায় পাতায় জড়িয়ে ছিলাম। বঙ্গবন্ধু চলে গিয়ে আমাদের বাঁধন আলগা করে দিয়েছেন। জানি তোফায়েল ভাই এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আমার লেখা নিয়মিত পড়েন। ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে যতবার দেখা হয়েছে ততবারই আমার লেখা নিয়ে কথা বলেছেন। তাঁর সমালোচনা থাকলেও বলেছেন। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় ‘জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন’ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এ বক্তব্যের ব্যাখ্যা চেয়েছিলাম। ব্যাখ্যা দিতে না পারায় নির্বাচন কমিশনের আলোচনা প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। পরদিন সকাল ৭টা সাড়ে-৭টার দিকে ওবায়দুল কাদের ধন্যবাদ জানাতে ফোন করেছিলেন। একবার আমি খুব অসুস্থ হয়ে সুহৃদ মেজর মান্নানের বদান্যতায় টাঙ্গাইল থেকে হেলিকপ্টারে এসে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। সেখানেও ওবায়দুল কাদের দেখতে এসে লেখা নিয়ে কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আপনার অনেক পাঠক আছে। আপনার লেখা আমাদের শক্তি দেয়।’ প্রত্যেক লেখকই পাঠকের উৎসাহে খুশি হয়। নিশ্চয় আমিও হয়েছিলাম। তবে তোফায়েল আহমেদ সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। তোফায়েল আহমেদের তুলনা তিনি নিজেই। অন্যের সঙ্গে তাঁর কোনো তুলনা চলে না। ’৬৯-এর ছাত্র-গণ-আন্দোলনের মহানায়ক তোফায়েল আহমেদ। বঙ্গবন্ধু তাঁকে ভীষণ স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন। যারা জাতির জন্য এমন অবদান রাখেন তাদের কোনো দলমত থাকার কথা নয়, ক্ষমতাসীন আর ক্ষমতাহীনের দ্বন্দ্বে তাদের নির্যাতিত হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তিনি তা হয়েছেন।
ছাত্রজীবনে তোফায়েল আহমেদ স্কাউট ছিলেন। খুব সম্ভবত ’৬৪-৬৫-তে চিটাগাং স্কাউট জাম্বুরিতে বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর সঙ্গে তাঁর পরিচয়। প্রথম ছোট ভাই, পরে বন্ধু। তাঁদের দুজনের কত শত চিঠি আমরা দেখেছি, মনে হয় ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় সেসব চিঠিপত্র সবই পুড়ে গেছে। তোফায়েল আহমেদ আমার লেখার নিয়মিত পাঠক জানি। যতবার যোগাযোগ হয়েছে আমার লেখা নিয়ে কথা বলেছেন। গত ১৫ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার প্রয়াত প্রণব মুখার্জিকে নিয়ে কিছু স্মৃতিচারণা করেছিলাম। মাগরিবের নামাজের পর তোফায়েল ভাইয়ের ফোন পাই, ‘কাদের, তোমার এত কিছু মনে থাকে!’ বলেছিলাম, জানি না। সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলাম, আপনার ১২ তারিখের ‘যে বেদনা চিরদিন বইতে হবে’ পড়ে আমার সমস্ত অস্তিত্বে তোলপাড় জেগেছে, আমার স্ত্রী নাসরীন কেঁদেছেন। এত কষ্টের পরও আমরা নিখাদ স্বীকৃতি পেলাম না। সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলেন, ‘কাদের, আমার লেখায় তোমার নাম থাকা উচিত ছিল। কী করে যেন মস্তবড় ভুল হয়ে গেল।’ বলেছিলাম, এতে ভুলের কিছু নেই। সত্য সত্যই। লিখলেও সত্য, না লিখলেও সত্য। কী বলি, সব দোষ রাজনীতিকদের। অথচ আসল দোষীরা সব সময় গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আমাদের সবারই দোষত্রুটি আছে। কিন্তু ত্যাগ কারও চেয়ে কম নেই। অতীতকে ছুড়ে ফেললে বর্তমানও স্থায়ী হবে না, ভবিষ্যৎ তো সম্পূর্ণ অন্ধকার। ওয়ান-ইলেভেনের পর হঠাৎই একদিন জলিল ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়। সিংহহৃদয় জলিল ভাই। ’৭৫-এ আমরা একসঙ্গে জেলা গভর্নর হয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘কাদের ভাই, আমার ছেলের বয়সী বাচ্চারা কি অপমান আর নির্যাতনই না করেছে, নেত্রীকে বললাম। বুঝতে পারলাম না তিনি শুনলেন কি শুনলেন না!’ জলিল ভাইয়ের কথায় বড় কষ্ট পেয়েছিলাম। তোফায়েল আহমেদের সেদিনের লেখা বাংলাদেশের হৃদয় স্পর্শ করেছে। আমি জানি, কথাই নেতৃত্ব করে কথাই কর্তৃত্ব করে। কিন্তু লেখা যে কথার চেয়ে লক্ষ গুণ শক্তিশালী তা যারা লেখেন এবং পড়েন তারা হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করেন। তোফায়েল আহমেদকে অপমান, শারীরিক নির্যাতন কল্পনা করা যায়! তিনি বলেছিলেন, ‘কাদের, শত নির্যাতনের পর আমি যখন জেলে গেলাম মনে হলো স্বর্গে এসেছি।’ জেল সাধারণ মানুষের কাছে কত ভীতিপ্রদ। আর একজন জননেতা দেশের ধাত্রীদের অন্যতম সরকারি নির্যাতনের পর জেলে গিয়ে ভাবছেন স্বর্গে এসেছেন! কতটা নির্যাতন কতটা কষ্টের পর কেউ জেলকে স্বর্গ মনে করতে পারেন।
আমাদের আত্মার সঙ্গে মিশে থাকা প্রণব মুখার্জির কারণে দুই সপ্তাহ দেশের কোনো পরিস্থিতি নিয়ে কলম ধরতে পারিনি। প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সময় প্রণব মুখার্জির কংগ্রেস ত্যাগ এবং আবার ফিরে আসা এবং তাঁকে একটি পানির জার দেওয়ার কাহিনি বলেই প্রণব মুখার্জি প্রসঙ্গ শেষ করব। কারণ প্রণবদাকে নিয়ে একটা বই লেখার চেষ্টা করছি।
শ্রীপ্রণব মুখার্জির জীবনের সব থেকে কঠিন সময় শ্রীরাজীব গান্ধীর সময় তাঁর মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়া এবং একসময় অরুণ নেহরু, রাজেশ পাইলট, সতীশ শর্মা ও ললিত মাকেনের মতো কিছু লোকের প্ররোচনায় প্রণব মুখার্জিকে কংগ্রেস থেকে বের করে দেওয়া- সে এক উথাল-পাথাল অভাবনীয় অবস্থা। শ্রীপ্রণব মুখার্জি বহিষ্কৃত হয়ে নতুন দল গঠন করেন। নাম দেন ‘রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস’। তাঁর নতুন দল নিয়ে সারা ভারত ঘুরতে শুরু করেন, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গ সফরে একবার জুনের তপ্ত রোদে বর্ধমান আসেন। বর্ধমানের টাউন হলে ব্যাপক লোকসমাগম হয়েছিল। আমি গিয়েছিলাম সেখানে। আমাকে দেখে প্রণব মুখার্জি বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলেন,
-বাঘা, তুমি এখানে! তোমার কোনো অসুবিধা হবে না তো?
বলেছিলাম, হতে পারে। কিন্তু তাই বলে কাপুরুষের মতো আপনাকে দেখতে আসব না, কথা বলব না- এ রকম মাথা বন্ধক দিয়ে আমি চলি না। জনতা পার্টির সরকারের সময়ও দেখেছেন। অল্প একটু দূরেই আমি থাকি। মা আপনাকে খাবার জন্য নিমন্ত্রণ করেছেন। কিছু একটা ভেবে বললেন,
-দিনে তো হবে না, রাতে আসব।’ জিজ্ঞেস করেছিলাম, কজন?
-কত আর ১০-১২ জন।
আমি রাজনীতি করা মানুষ। জানি একজন নেতার সফরে কতজন থাকে। আমরা প্রায় ২০০ জনের ব্যবস্থা করেছিলাম। প্রণব মুখার্জি এসেছিলেন গভীর রাতে। তাঁর কর্মীরা আসা শুরু করেছিল ৯টা থেকেই। কেউ আসছে, কেউ যাচ্ছে, কেউ খাচ্ছে। প্রায় সাড়ে ১২টায় ১৫-২০ জন নিয়ে প্রণব মুখার্জি এলেন। তাঁর ছোট্ট মারুতি মাইক্রোবাসের দরজা খুলতে গিয়ে পুরোটাই আমার হাতে চলে এলো। আমি খুব একটা নাবুঝ ছিলাম না যে টান মেরে গাড়ির দরজা ভেঙে ফেলব। মারুতির দরজা আমার হাতে চলে আসায় সবাই হেসেছিল। কিন্তু আমি হাসতে পারিনি, শঙ্কিত হয়েছিলাম। বলেছিলাম, দাদা, এমন খেলনা গাড়িতে চড়বেন না। এরপর আর তিনি অমন খেলনায় চড়তেন না। প্রণবদা এলেন। তাঁর সাথীরা অনেকে খেতে বসে গেলেন। দাদা ¯œান সেরে আমার ঘরে আহ্নিক করলেন। তারপর খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লেন। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ পোস্ত ভীষণ ভালোবাসে। অনেক কিছুর মধ্যে মা পটোল পোস্তের আয়োজন করেছিলেন। প্রণবদার ভীষণ পছন্দ হয়েছিল। ওর পর মায়ের পটোল পোস্ত রান্নার কথা বহুবার বহু জায়গায় বলেছেন। পরদিন ৯টায় বেরোনোর কথা। ¯œান সেরে পূজা করে গল্পে মেতে গেলেন। প্রায় ১০টা পর্যন্ত কত গল্প। পরে প্রণবদা অনেকবার বলেছেন, ‘বাঘা, তোমার ঘরে শুয়ে আমি এক অনাবিল আনন্দ অনুভব করেছিলাম। বুঝতেই পেরেছ ঘুম থেকে উঠে আমার কত ভালো লেগেছিল। গত ২৫-৩০ বছরে এমন আনন্দময় সকাল আমি খুব একটা পাইনি।’ সাড়ে ১০টায় নাস্তায় বসে ছিলেন। সেখানেও প্রায় এক ঘণ্টা। সকালে গল্পের সময় আমার ছেলে নাদুসনুদুস দীপ সারা বাড়ি তোলপাড় করছিল। ছোটবেলায় দীপ খুব হাসত, কিচিরমিচির করত। খাওয়ার টেবিলে বারবার দীপের আমার গলা জড়িয়ে ধরা, কোলে বসা দেখে দাদা বলছিলেন, ‘বাঘা, ওর নাম কী?’ বলেছিলাম, মা রেখেছেন দীপ। দাদা বললেন, ‘খুব সুন্দর হয়েছে। তবে ওর নাম সদানন্দ হলে আরও ভালো হতো।’ দাদা সব সময় ওকে সদানন্দ বলেই ডাকতেন। প্রণবদা ছিলেন পেটের চিররোগী। মুক্তিযুদ্ধের পর আমার পেটেও মারাত্মক যন্ত্রণা ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধযুদ্ধে যখন মেঘালয়ে ছিলাম তখন দুই দিনও শান্তিতে থাকতে পারতাম না। পেটে একটা তীব্র যন্ত্রণা সব সময় বয়ে বেড়াতে হতো। গোহাটি মেডিকেলে দু-চার বার চিকিৎসার পর ফুটানো পানি খাওয়া শুরু করেছিলাম। সেই থেকে আজওবধি পেটে কোনো কষ্ট নেই। প্রণবদা আমাদের বাড়ি থেকে যাওয়ার দু-তিন দিন পর মা বলেছিলেন, ‘তোর দাদা যেখানে সেখানে পানি খায়। তাকে একটা পানির জার কিনে দিতে পারিস না?’ কদিন পর তাঁকে ৮-১০ লিটারের একটা মিল্টন কোম্পানির পানির জার কিনে দিয়েছিলাম। সে জারটি নিয়ে তিনি বহু জায়গায় ঘুরেছেন। কংগ্রেসে ফিরে তিনি যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, দেশরক্ষা মন্ত্রী এমনকি রাষ্ট্রপতি- গেলেই বলতেন, ‘বাঘা, তোমার পানির জার আমার থেকেও পরিচিত। ভুলে একবার শিলিগুড়ি ফেলে এসেছিলাম। দুই দিন পরই কলকাতার বাসায় হাজির। বিহারের কোথায় যেন মুখা ফেলে এসেছিলাম। কোনো এক সুহৃদ পৌঁছে দিয়ে যায়। বাঘা, আমি হারাতে পারি। কিন্তু তোমার পানির জার হারাবে না। সবাই এটা চিনে ফেলেছে। এমনকি যেখানে যেখানে যাই বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে দেখা হলেই তোমার পানির জার নিয়ে কথা হয়।’
প্রণব মুখার্জিকে স্কুলের বন্ধুবান্ধবদের প্ররোচনায় রাজীব গান্ধী ভুল বুঝেছিলেন, তাঁর কেবিনেট থেকে বাদ দিয়েছিলেন, এমনকি তাঁর মায়ের দুঃসময়ে সাহা কমিশনে সবাই যখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল তখন যে প্রণব মুখার্জি হিমালয়ের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। বহিষ্কারের পর নতুন দল করে প্রণব মুখার্জি সারা ভারত তোলপাড় করেছিলেন। বিপুল সাড়া না পেলেও আলোচনা করার মতো যথেষ্ট সাড়া পেয়েছিলেন। প্রণব মুখার্জি আমাদের সঙ্গে ছায়ায়-মায়ায়, লতায়-পাতায় জড়িয়ে গিয়েছিলেন। তাই তাঁকে নিয়ে সব সময় ভাবনা হতো। খাবার টেবিলে আলোচনার অনেকটা জুড়েই থাকতেন প্রণব মুখার্জি। প্রতিদিনের মতো বিকালে দামাদোরের কৃষক সেতুর পাড়ে ঘোরাফেরা করছিলাম। হঠাৎ দেখি যারা দেখাশোনা করেন তাদের একজন। সালাম দিয়ে জানাল, ‘দিল্লি থেকে কেউ একজন এসেছেন। তিনি কথা বলতে চান।’ তখন ৫টার মতো হবে। বাড়ি ফিরতে সাড়ে ৫টা। এখন আর তার নাম মনে নেই। একজন অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসতেই বললেন, ‘স্যার, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান। তাই দিল্লি যেতে হবে। আজ যেতে পারলেই ভালো। নয় তো কাল যেতেই হবে।’ বললাম, ঠিক আছে যেতে যখন হবে আজ যেতেই বা অসুবিধা কোথায়? ৬টায় রওনা হলাম দমদমে নেতাজি সুভাষ বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশে। বর্ধমান থেকে জিটি রোড ধরে দমদম যেতে তখন ঘণ্টাদেড়েক লাগত। দিল্লির ফ্লাইট ৮টা ২০ মিনিটে। আমরা পৌনে ৮টায় বিমানবন্দরে পৌঁছেছিলাম। মনে হয় সে ফ্লাইটে তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী চট্টগ্রামের আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ছিলেন। তিনি উঠে এসে আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। সেই প্রথম পরিচয়, যা এখনো একই রকম আছে। ১০টা ২০ মিনিটে পালাম বিমানবন্দরে নেমে সোজা গিয়েছিলাম খুব সম্ভবত ৭ নম্বর রেসকোর্স রোডের প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি। তিনি আমার অপেক্ষায় ছিলেন। প্রথম প্রথম বুঝতে পারিনি আমার সঙ্গে তাঁর কী কথা। পরে বুঝলাম। কুশল বিনিময়ের পর বললেন, ‘আমার মা আপনাকে আমাদের দুই ভাইয়ের মতোই দেখতেন। আপনাকে ভীষণ ¯েœহ করতেন। মা থাকতে প্রণবদা আপনাকে দেখাশোনা করতেন। আপনি আমাদের পরিবারের একজন। আমি অনেক চিন্তা-ভাবনা করে আপনাকে খবর দিয়েছি। দাদার সঙ্গে আপনার এখনো আগের মতোই যোগাযোগ আছে। দাদাকে আমাদের খুবই প্রয়োজন। তিনি কী ভাবছেন তা জানার জন্য আপনার চেয়ে উত্তম আমার চোখে আর কেউ নেই। তাই আপনি যদি মেহেরবানি করে দাদার মনোভাব জেনে নেন এবং তাঁকে যদি আমাদের কাছে ফিরতে সাহায্য করেন তাহলে খুবই ভালো হয়।’ প্রধানমন্ত্রী শ্রীরাজীব গান্ধীর কথায় গভীর আন্তরিকতা ছিল। বলেছিলাম, চেষ্টা করে দেখি। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আবার কবে দেখা হবে? যিনি আপনাকে নিয়ে এসেছেন তিনি সব সময় যোগাযোগ রাখবেন। কোনো কিছু হলে তাকে জানাবেন এবং যখন খুশি আসবেন। আপনার জন্য সব সময় আমার দরজা খোলা।’ বলেছিলাম, ঠিক আছে। কথা বলে দেখি। পিএম হাউস থেকেই কলকাতায় প্রণবদার সাউদার্ন এভিনিউর বাড়িতে ফোন করেছিলাম। অত রাতে ফোন করায় প্রণবদা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন,
-কী ব্যাপার, এত রাতে!
বলেছিলাম, কাল সকালে আসতে চাই।
-সকালে কি, ১২টার পরে আসো। আমরা একসঙ্গে খাবার খাই।
দিল্লি-কলকাতা এয়ারবাস ও দমদমে পৌঁছতে সাড়ে ১০টায়, বেরোতে ১১টা, শহরে পৌঁছতে ১২টা-সাড়ে ১২টা এমনিতেই লেগে যেত। মনে হয় সেদিন ১টায় প্রণবদার বাড়ি গিয়েছিলাম। দাদা খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ‘হঠাৎ আগমন?’ ’৭৯ সালে ইন্দিরাজির কথা নিয়ে পাটনার কদমকুয়ায় জয় প্রকাশজিকে যেভাবে বলেছিলাম, ঠিক সেভাবে প্রণবদাকে বলেছিলাম, পিএম ডেকে পাঠিয়েছিলেন। সেখান থেকেই ফোন করেছিলাম। অনেক কথার মধ্যে আপনাকে নিয়ে কথা হলো। তাঁর কথায় আমি গভীর আন্তরিকতা দেখেছি। আপনাকে তাঁরা পেতে চান। এ ব্যাপারে আপনি কিছু ভাবছেন কিনা? প্রণবদা বলেছিলেন, ‘বাঘা, সর্বভারতীয় দল করা খুব কঠিন। তবে এ ব্যাপারে এখনো কোনো চিন্তা নেই। তুমি যদি বল তাহলে আমি আলাপ করে দেখতে পারি।’ বলেছিলাম, নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে দেখুন। চার দিন পর আবার দিল্লি গিয়েছিলাম। আমাকে দেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুব খুশি হয়েছিলেন। যতবার কথা হয়েছে অসম্ভব সম্মান দিয়েছেন। মনে হয় আমার অপেক্ষায়ই ছিলেন। খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চেয়েছিলেন দেখা হয়েছে কিনা। বলেছিলাম, অনেক কথা হয়েছে। সবকিছু করার জন্য সময় এবং পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়োজন। সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ আগ্রহ নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার কী করণীয় বলুন?’ গান্ধী পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে আমার কোনো জড়তা ছিল না। তাই বলেছিলাম, প্রণবদা যে একজন ভালো অর্থমন্ত্রী ছিলেন কোনো আলোচনায় ওটা বলুন এবং তা প্রচারের ব্যবস্থা করুন। খুব সম্ভবত পরদিনই নয় জাতি অর্থমন্ত্রী সম্মেলন ছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীরাজীব গান্ধী প্রণব মুখার্জি সম্পর্কে সেই সম্মেলনে প্রায় তিন-চার মিনিট বলেছিলেন। সবকটি প্রচারমাধ্যম সে কথা বেশ হাইলাইট করেছিল। পরের সপ্তাহে প্রণবদা ডেকে পাঠিয়েছিলেন। যেতে যেতেই জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আমি শুনেছি। এখন তুমি কী করতে বল?’ বলেছিলাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেমন করেছেন আপনিও তেমন একটা কিছু করুন। প্রণবদা বলেছিলেন, ‘আমি হিন্দুস্থান টাইমসে একটা লেখা দিয়েছি। তোমার ভাবনামতই সেটা হবে।’ দিল্লির ভদ্রলোক লেখা ছাপার আগেই কপি পিএম হাউসে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। যাতে রাজীব গান্ধী অর্থনীতির সাফল্যের যুক্তিসংগত প্রচুর প্রশংসা ছিল। পরদিনই রাজীবজি আবার ডেকে পাঠিয়েছিলেন। দেখা হতেই তিনি বলেছিলেন, ‘দাদার লেখা খুব ভালো হয়েছে। এখন কী করতে হবে?’ বলেছিলাম, দলীয় কোনো সভায় প্রণবদার অভাবের কথা বলুন এবং তাঁকে পেলে কংগ্রেস শক্তিশালী হবে তা জানিয়ে দিন। সপ্তাহ বা ১০ দিন পর এআইসিসির এক মিটিংয়ে প্রণবদার ভূয়সী প্রশংসা করে কংগ্রেসে তাঁর যে খুবই প্রয়োজন এ ধরনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। প্রণবদাও কলকাতা নেতাজি সুভাষ ইনডোর স্টেডিয়ামে তাঁর দলের সবাইকে নিয়ে আলোচনা করে কংগ্রেসে ফিরে গিয়েছিলেন। আমি সাধারণত কখনো একা কোথাও যাতায়াত করিনি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ২৮ অথবা ২৯ আগস্ট গোহাটি থেকে একা গিয়েছিলাম ইন্দিরাজির সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু ’৭৭ সালে গ্রেফতার করে যখন শ্রীমোরারজি দেশাইয়ের কাছে নিয়ে গিয়েছিল তখনো রাঙামাটির রাজা দীপঙ্কর আমার সঙ্গে ছিল। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর কাছে শ্রীপ্রণব মুখার্জির দূতালি করতে বেশ কয়েকবার একাই গেছি। সে সময় একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি, কোনো প্রয়োজন হলে তার জন্য সময়ের কোনো বাছবিচার থাকে না। সব সময়ই সে হয় আদরণীয়। তাই রাজীব গান্ধীর কাছে তখন ছিলাম খুবই আদৃত। প্রণব মুখার্জিকে নিয়ে বলার শেষ নেই। তবে একসময় নেত্রী শেখ হাসিনাকে পুরোপুরি সমর্থন দেওয়া নিয়ে প্রণব মুখার্জির প্রতি অভিযোগ অনেকেই আনবেন। আমার কাছে মনে হয় ব্যাপারটা ওভাবে ভাবলে চলবে না। শ্রীপ্রণব মুখার্জির চেষ্টায় ভারত সরকার বেগম খালেদা জিয়াকে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে এক অতুলনীয় রাষ্ট্রীয় সম্মান দেখিয়েছিল। ভারত কোনো বিরোধী দলের নেতাকে খালেদা জিয়ার মতো অমন দুর্লভ রাষ্ট্রীয় সম্মান কখনো দেখায়নি। কিন্তু ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফরে এলে খালেদা জিয়া তাঁর নির্ধারিত সাক্ষাৎ বাতিল করেছিলেন। যাতে প্রণব মুখার্জির রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছিল এবং ভারত মারাত্মকভাবে বিব্রত হয়েছিল। যে কারণে ২০১৪-এর নির্বাচনে অমন করা ছাড়া ভারতের আর কোনো পথ ছিল না- ব্যাপারটা নিরাসক্তভাবে বিশ্লেষণের প্রয়োজন।
বাংলাদেশের একজন সুহৃদ এবং প্রিয় বাঙালি আমাদের ছেড়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছেন। তাঁকে নিয়ে যত কম সমালোচনা করা যায় ততই মঙ্গল। সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসেবে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে মেয়ে মুন্নীকে নিয়ে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে সোনারগাঁও হোটেলে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেবার কুশিকে তিনি খুব আদর করেছিলেন। দীপ-কুঁড়িকেও কম করেননি। সেদিনও দীপকে সদানন্দ বলে ডেকেছিলেন। মানুষটি আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছেন- স্রষ্টা তাঁর মঙ্গল করুন, তাঁর আপনজনদের শোক সইবার শক্তি দিন।
লেখক : রাজনীতিক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন