সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে রেডিও-টিভি এবং প্রার্থীরা বড় বেশি উতালা। বিশেষ করে মেয়রপ্রার্থী আওয়ামী লীগ-বিএনপির দুই দুই চারজন সারা শহর চষে বেড়ানোর চেষ্টা করছে। প্রতিশ্রুতির শেষ নেই। দেওয়া প্রতিশ্রুতির একশ ভাগের দশ ভাগও কেউ যদি বাস্তবায়ন করতে পারেন কোনো সমস্যা থাকবে না। জয়ের জন্য নির্বাচনী প্রার্থীরা যত প্রতিশ্রুতিই দেন ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মেয়রদের হাতে সেসব সমস্যা সমাধানের কোনো ক্ষমতা নেই। টাকা-পয়সা কিছু থাকলেও ঢাল-তলোয়ারহীন তারা নিধিরাম সর্দার। যা কিছু ক্ষমতা সবই সরকারের হাতে, জনপ্রতিনিধিদের হাতে এখন কোনো ক্ষমতা নেই। প্রশাসনের কাছে আগে জনপ্রতিনিধিদের যথেষ্ট সম্মান ও গুরুত্ব ছিল। এখন তার লেশমাত্রও নেই। আমি নির্বাসনে থাকতে এরশাদের সময় উপজেলা হয়েছে। সখিপুরের প্রথম উপজেলা চেয়ারম্যান শওকত আলী মাস্টার। এখনকার ইউএনও তখন ছিল টিএনও। টিএনও-র সঙ্গে চেয়ারম্যানের বনিবনার অভাব হওয়ায় একদিনে চেয়ারম্যান তাকে সখিপুর থেকে বিদায় করেছিলেন। তখন টিএনওর বদলির ক্ষমতা ছিল চেয়ারম্যানের হাতে। এখন মনে হয় ইউএনও-ই চেয়ারম্যানকে বাতিল বা বরখাস্ত করতে পারেন। শুনছি আমার স্নেহের লেবু মোটামুটি ভোট পেয়েই নির্বাচিত হয়েছে। তার সঙ্গে ইউএনওর বনিবনা হচ্ছে না। শুধু তার সঙ্গে কেন ইউপি চেয়ারম্যানদের সঙ্গেও না। কিন্তু ইউএনও বহাল তবিয়তে ছড়ি ঘুরিয়ে চলেছেন। কারণ সরকারি ক্ষমতা তার হাতে। এ ব্যাপারে ডিসির কাছে জানার জন্য কয়েকবার ফোনে চেষ্টা করেছিলাম। ভদ্রলোক ঢাকায় মিটিংয়ে ছিলেন। তিনিও ২-৩ বার ফোন করেছেন আমি ধরতে পারিনি। ব্যাপারটা এমন হয়েছিল আমি ফোন করি তো তাকে পাই না, তিনি ফোন করেন তো আমাকে পান না। কয়েক দিন কেটে গেলে আর খোঁজ করিনি। তবে ডিসিকে যখন যে কাজে ফোন করেছি খুবই সম্মানের সঙ্গে করার চেষ্টা করেছেন। অনেক সরকারি নেতা দেখা হলে কেউ দাদা, কেউ নেতা, কেউ ভাই বলে অভিযোগ করে, আপনি ভালোই আছেন। আপনার কথা তবু আমলা-ফইলারা শুনে, আমাদের কথা তো দারোগা-পুলিশ-সরকারি কর্মকর্তারা শুনতেই চায় না, শোনে না। সেটা এমপি হোক আর মন্ত্রী হোক সবার ব্যাপার এক সমান। তাই সিটি করপোরেশন কী করবে। কদিন আগে পুরনো ঢাকায় গিয়েছিলাম। দু-এক জায়গায় অভিযোগ শুনলাম পোস্টার লাগাতে পারছে না। সরকারি দল ছিঁড়ে ফেলছে। ছোটখাটো পোস্টার ছিঁড়াছিঁড়ি সব সময়ই হয়। কিন্তু সেখানে নির্বাচন কমিশন অথবা সরকারের ইন্ধন থাকলে সেটা মারাত্মক ব্যাপার। নির্বাচন কমিশন আন্তরিকভাবেই এসব অপকর্ম রোধ করার চেষ্টা করবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা যদি না হয় সেটা স্বচ্ছ নির্বাচনের জন্য এক বিষফোঁড়া। বাংলাদেশ এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়েছে। অনেকে একে মুক্তিযুদ্ধ বলেন। কিন্তু যুদ্ধটা মুক্তিযুদ্ধ না স্বাধীনতা যুদ্ধ এ ব্যাপারে আমি এখনো পরিষ্কার না। মুক্তিযুদ্ধ হলে তো আমরা এসব অব্যবস্থা থেকে সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সর্বক্ষেত্রে মুক্তি পেতাম। তা তো পাইনি। বরং অযোগ্য অদক্ষতা আমাদের চারদিক থেকে অক্টোপাসের মতো চেপে ধরেছে। যে দেশের জন্মের বেদনার সঙ্গে জড়িত ছিলাম সেই দেশের একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এত অদক্ষতা ও অযোগ্যতায় নিমজ্জিত হতে পারে ভাবাই যায় না। নির্বাচন কমিশন ৩০ ডিসেম্বরের মতো ৩০ জানুয়ারি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন ঠিক করেছিল। কেমন অপদার্থ তারা। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ যেখানে একই সঙ্গে হিন্দু-মুসলমানের রক্ত ঝরেছে। পাকিস্তানি হানাদারদের কাছে তখন হিন্দুরা ছিল বলির পাঁঠা। কোনো অপরাধের প্রয়োজন পড়ত না, শুধু হিন্দু হওয়ার কারণে কত হাজার মানুষকে যে মারা হয়েছে তার হিসাব নেই। একটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দিন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলেন ক্যালেন্ডারও দেখলেন না, পঞ্জিকাও দেখলেন না। ঘরে বসে পালন করার মতো পূজা নয়, হিন্দু সমাজের সব থেকে বড় দুর্গাপূজা, দ্বিতীয়টি বিদ্যাদেবী সরস্বতী। ছাত্র থাকতে পাড়ার সরস্বতী পূজায় অংশগ্রহণ করেছি, স্কুলে পূজার প্যান্ডেল বানিয়েছি। আর সেই পূজার দিনে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। তারিখ পিছানোর জন্য হিন্দু সম্প্রদায় হাই কোর্টে গেল, আমরণ অনশন করল তারপর নির্বাচনের তারিখ দুই দিন পেছালেন। এ কাজটি কিন্তু অনেক আগেই করতে পারতেন। এসব অদক্ষতার পরিচয়। আমাদের প্রয়োজন ছিল দক্ষ নির্বাচন কমিশন, আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন নয়। আমাদের দরকার ছিল বুক চিতিয়ে অহংকার করার মতো বিচার বিভাগ, শক্তিশালী নীতিবান প্রশাসন। কেন যেন ধীরে ধীরে সব কিছু হারিয়ে যাচ্ছে। রেডিও-টিভিতে সারা দিন নির্বাচন নিয়ে যা দেখছি দলীয় প্রচারকরা যা করছেন মানুষের মধ্যে তেমন সাড়া নেই, তেমন আলোচনা নেই। বেশ কিছুদিন বাড়ি ভাঙচুর চলছে। তাই কোনো কিছুই সিজিল-মিছিল নেই। সর্বত্র অব্যবস্থা। লোকজন ভালো করে দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারে না, কথা বলতে পারে না। তবু চলছে। কয়েক দিন আগে কেবলই নাস্তা খেতে বসেছি। আমার সকালের নাস্তা খুবই সাদামাটা। দুই ধরনের সবজি, ২-৩টা ছোট্ট রুটি, কখনো একটা ডিম। ইদানীং কেন যেন খেতে ইচ্ছে করে না। তেমন কোনো কষ্ট নেই। কিন্তু খেতে বসলেই মনে হয় খাওয়া হয়ে গেছে। সেদিনও তেমনটাই হয়েছিল। এক টুকরা রুটি হাতে নিয়েছি এমন সময় কাগজ হাতে একজন হাজির। আমি কিছু বলার আগেই কে যেন তাকে নিচতলায় নিয়ে গেল। নিচতলায় বসার ভালো জায়গা নেই। নাস্তা খেয়ে আধঘণ্টা পর নিচে নেমে দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে। কী ব্যাপার জিজ্ঞেস করতেই একটা বই এবং কিছু কাগজ দিল। তাকিয়ে দেখি ‘মুক্তিযুদ্ধ ৭১-মির্জা মো. এছ্হাক’ ৪৯ পৃষ্ঠার বই। দেখতে চমৎকার। বারবার বলছিল, ‘স্যার, বইয়ে অনেক ভুল আছে।’ এক নিঃশ্বাসে পড়েছিলাম। সত্যিই অনেক ভুল আছে। কিন্তু তবু বইটি এক অমূল্য সম্পদ। বানান ভুল, গাঁথুনি ভুল, তারিখ ভুল, এক জায়গার ঘটনা আরেক জায়গায়। কিন্তু তবু অনেক সত্য আছে। যার মূল্য অমূল্য। আমি মনে করি মুক্তিযুদ্ধের ওপর বই লেখা এক জাতীয় দায়িত্ব। প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধা যদি একটি করে বই লিখত কাদেরিয়া বাহিনীর সব সদস্য একটি করে বই লিখে নিজেরাই যদি কাদের সিদ্দিকী হতো তবু আমার আপত্তি ছিল না। অমন হলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে শকুনীর টানাটানি এটা হতে পারত না। মুক্তিযুদ্ধ ৭১-এ কিছু না থাকলেও লেখক মির্জা মো. এছ্হাককে আমি ধন্যবাদ দিতাম। তারা কয়েক বন্ধু ট্রেনিং নিতে ভারতে যাওয়ার জন্য যেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিল সেটুকুতেই তার বই এক অমূল্য সম্পদে পরিণত হয়েছে। লেখক লিখেছেন, ভারতে যাবেন রাস্তা খরচ কোথায়? তার কাছে ২০-২৫ টাকা ছিল। ওতে তো ভারত যাওয়া হবে না। তাই গোপালপুরের নলিন হাটে পুরনো বইখাতা ২৫ টাকায় বিক্রি করে। মা জিজ্ঞেস করেন, বাবা, তুমি কাগজপত্র বিক্রি করছ কেন? তুমি কী করবে? এছ্হাক বলে, মা সারা দেশে যুদ্ধবিগ্রহ, আমি ভারতে যেতে চাই। মা খুব কান্নাকাটি করে। মা বলে ওতে তো তোমার ভারত যাওয়া হবে না। মা আন্ডা বেচা ৪০ টাকা দেয়। রওনা হওয়ার আগে বাবাকে জানায়। বাবা খুব কান্নাকাটি করেন। কিন্তু কোনো বাধা দেন না। এছ্হাকরা ৮-৯ জন রওনা হয়। বাড়ি থেকে বাহাদুরাবাদ ঘাটের কাছে কাবলি বাড়ির এক চেয়ারম্যানের বাড়িতে ওঠে। বাড়ির মালিক নলিন-অর্জুনা চিনে। বিশেষ করে অর্জুনার বহুদিনের চেয়ারম্যান মতিয়ার কাজীর পরিচয় পেয়ে সে নৌকা ঠিক করে দেয়। প্রত্যেকের ভাড়া ১০ টাকা। উজান বেয়ে ৩ দিনে তারা মহেন্দ্রগঞ্জ পৌঁছে। সেখানে ১-২ দিন চিড়া-মুড়ি খেয়ে ইয়ুথ ক্যাম্পে জায়গা পায়। সেখান থেকে যায় তেলঢালা জিয়াউর রহমানের ব্রিগেডে। সেখানে অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টে কাজ করে। একদিন কাদেরিয়া বাহিনীর এনায়েত করিম দেশে লোক পাঠানোর জন্য ঘাটাইল-গোপালপুর-ভুয়াপুরের ২-৪ জন ট্রেনিংপ্রাপ্ত লোক আনতে বীরউত্তম জিয়াউর রহমানের ক্যাম্পে যায়। সেখান থেকে এছ্হাককে নিয়ে আসে। তাকে দেশে পাঠানো হয়। আর তার অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টে ফিরে যাওয়া হয়নি। সে কাদেরিয়া বাহিনীর কমান্ডার ফেরদৌস আলম রঞ্জুর হিরো কোম্পানির সঙ্গে থেকে যায় এবং নানান জায়গায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সে ভারতে থাকার সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে এক জায়গায় বলেছে, তারা মাসিক মাসোহারা পেত। মুক্তিযুদ্ধে প্রায় সবাই মাসোহারা পেয়েছে। টাকার পরিমাণ যাই হোক, পেয়েছে। সেনাবাহিনী-ইপিআর-পুলিশ যারাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার তাদের বেতন দিয়েছে। যারা ইয়ুথ ক্যাম্প বা অন্যান্য জায়গা থেকে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে গিয়েছিল তারাও ৫০ টাকা করে মাসিক ভাতা পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ওপর অনেক বইয়ে এ ভাতার কথা দেখেছি। ১৫-১৬ দিন সীমান্তে ছিলাম। আমি নিজেও সীমান্তের মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ৫০ টাকা ভাতা পেতে দেখেছি। শুধু মুক্তিযুদ্ধে নয়, ১৭৫৭ সালে যে সিপাহি বিপ্লব শুরু হয়েছিল যার শেষ ১৮৫৭ সালে। সেই সিপাহি বিপ্লবের যোদ্ধাদেরও বাহাদুর শাহ জাফর যখন বেতন দিতে পারেননি তখন তারা অনেকে চলে গেছে। অনেকে ইংরেজ শিবিরে যোগ দিয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর কাউকে মাসিক বেতন বা ভাতা দেওয়া হয়নি। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দেশপ্রেমিক স্বেচ্ছা সৈনিক দল দ্বিতীয়টি ছিল কিনা আমার জানা নেই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনী একমাত্র দল যারা বেতনভুক্ত ছিল না। ছিল দেশপ্রেমে মত্ত। মুক্তিযোদ্ধারা খুব একটা বাড়ি যায়নি। ২-৪ জন মা-বাবাকে দেখতে গেলে যাওয়ার পথে ৫-১০ টাকা নিয়েছে। মনে হয় না ২০ টাকার বেশি কোনো মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধকালে নিয়েছে বা পেয়েছে। যারা ক্যাম্প থেকে গেছে তারা বেশির ভাগই মা-বাবা যখন বাড়িতে থাকতে পারেনি, বাড়ি-ঘর ছেড়ে অন্য কোথাও গেছে সেই খবর পেয়ে ২-৪ জন যোদ্ধা যাওয়ার অনুমতি পেয়েছে। আমার মনে হয় কাদেরিয়া বাহিনীর ১৮ হাজার যোদ্ধার মধ্যে বড়জোর এক-দেড় হাজার ২-১ দিনের জন্য ক্যাম্প ছেড়ে গেছে। ‘মুক্তিযুদ্ধ ৭১’ বইটিতে বেতন-ভাতার কথা পড়ে ভালো লাগল। ভুল সংশোধন করা গেলে মুক্তিযুদ্ধের ওপর চমৎকার বই হবে। আমি সব সময়ই মনে করি সবার লেখা উচিত। তাতে সভ্যতা স্থায়ী হয়, সময়কে ধরে রাখা যায়।
’৭২-এর ১০ জানুয়ারি দেশের পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল এক ঐতিহাসিক বিজয়। হানাদারদের বিতাড়িত করে বা পরাজিত করেও আমরা পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করতে পারিনি। পিতাকে ছাড়া সবই মনে হচ্ছিল অধরা। তাই ৮ জানুয়ারি করাচি থেকে লন্ডন হয়ে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানে দিল্লি থেকে তার ঢাকায় আসা ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা। তাই মুজিব শতবর্ষ ক্ষণগণনায় তেজগাঁও বিমানবন্দরে গিয়েছিলাম। ’৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যেখানে লক্ষ কোটি মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তিনি তার মাতৃভূমিতে অবতরণ করেছিলেন। বুঝতে পারলাম না এমন ভুল কী করে হলো। বঙ্গবন্ধু যে রাজকীয় বিমানে এসেছিলেন সেই বিমান না দেখিয়ে একটা মালবাহী বিমান কেন দেখাল? ব্যবস্থাপনা সরকারিভাবে হচ্ছে, না দলীয়ভাবে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। একটা প্যান্ডেল ছিল দক্ষিণে, আরেকটা পশ্চিমে। পশ্চিমেরটা দেখে মনে হচ্ছিল পরিত্যক্ত কিছু। যেখানে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন, দেশের বরেণ্য ব্যক্তিরা ছিলেন। কিন্তু তেমন গুরুত্ব ছিল না।
গত ৮ জানুয়ারি মানবজমিনে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি খবরে আমার বুকটা দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল এসব দেখার আগে কেন মৃত্যু হলো না। খবরটি ছিল, “ত্রিশালে মুক্তিযোদ্ধার মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ। ত্রিশাল ময়মনসিংহ সংবাদদাতা। গতকাল ময়মনসিংহের ত্রিশালে জেলা মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সংস্থার উদোগে তিন শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে উপজেলা পরিষদ স্টাফ কোয়ার্টার মাঠে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মেজর আফসার বাহিনীর প্রথম যুদ্ধকালীন কমান্ডার চাঁন মিয়া, জেলা মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সংস্থার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম মোমেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ত্রিশাল মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার আ. মান্নান, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোখলেছুর রহমান, হুরমুছ আলী, ফজলুল কবীর চৌধুরী, ইব্রাহীম খান প্রমুখ।” খবরটি যিনি দিয়েছেন নিশ্চয়ই পরম আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দিয়েছেন। মেজর আফসার বাহিনীর প্রথম যুদ্ধকালীন কমান্ডার চাঁন মিয়াকে ঠিক জানি না। তবে আফসার যখন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তখন সে ছিল একজন বিডি মেম্বার। প্রথম আমার কাছে যোগদান করেছিল, বহেরাতলীতে শপথ নিয়েছিল। খুবই ভালো কাজ করেছে। আগস্টে আমি গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত কাদেরিয়া বাহিনীর ৬ নম্বর কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে দুর্দান্ত সফলতার পরিচয় দিয়েছে। মেম্বারকে মেজর হিসেবে কাদেরিয়া বাহিনীই আখ্যায়িত করেছিল। কাদেরিয়া বাহিনীর প্রায় ৯৬ জন মেজরের মধ্যে মেজর আফসার অন্যতম। এরকম মানুষের অবদানেই বাংলাদেশ হয়েছে। আমার কষ্ট এখানে নয়, আমার কষ্ট জেলা মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সংস্থার উদ্যোগে তিন শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ। মহামতি সুকর্নর নেতৃত্বে ইন্দোনেশিয়া স্বাধীন হয়েছিল। স্বাধীনতার পর সুহার্তো ক্ষমতায় এসে সুকর্নকে গৃহবন্দী এবং সুকর্নের নেতৃত্বের প্রায় ১০ লাখ স্বাধীনতা সংগ্রামীকে কচুকাটা করেছিল। আমাদের দেশেও তার খুব একটা ব্যতিক্রম হয়নি। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর বা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ইতিহাস বদলে গিয়েছিল। ১০ লাখ না হলেও ১০’শ মুক্তিযোদ্ধাকে যে মারা হয়নি তা নয়। আমার কষ্ট যে মুক্তিযোদ্ধারা একদিন পাকিস্তানি হানাদারদের পদানত করেছে দিগি¦দিক কাঁপিয়ে জয় ছিনিয়ে এনেছে তাদের চরম শৈত্যপ্রবাহে শীতবস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে তাদেরই মতো আরেক দল সামর্থ্যবান মুক্তিযোদ্ধা- এখানেই আমার কষ্ট। মুক্তিযোদ্ধারা অসহায় থাকবে কেন, অসহায় হবে কেন। যাদের রক্ত ঘামে স্বাধীনতা তারা যদি অসহায় ভিখারি হয় তাহলে সে দেশের মর্যাদা কোথায়? এখানেই আমার কষ্ট। আমরা তো এখন আর অত ছোট নই। সরকারি উদ্যোগে সরকারি কর্মচারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সালাম ঠুকে রাষ্ট্রীয় উপহার শীতবস্ত্র দিতে পারেন, ঈদে উপহার পৌঁছে দিতে পারেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকারি উপহারও এমনভাবে দেওয়া হয় এ যেন ফকিরকে ভিক্ষে। উপজেলা হেড কোয়ার্টারে মুক্তিযোদ্ধারা গিয়ে ইউএনও অথবা সমাজসেবা অফিসারের অফিসে লাইন করে সেখান থেকে ছাগল-ভেড়া-বকরি-সেলাইয়ের কল যা কিছু হোক দুস্থ গরিব মুক্তিযোদ্ধাদের অথবা তার পরিবার-পরিজনদের দেওয়া হয়। এটা যে কত বেদনাদায়ক ও লজ্জার শান্তভাবে একটু ভাবলেই বোঝা যায়। যতদিন বেঁচে আছি মুক্তিযোদ্ধাদের যথার্থ সম্মানের পরিবেশ সৃষ্টি করে যেতে পারলে ভালো লাগত, নিজেকে সার্থক মনে হতো।
লেখক : রাজনীতিক।
উৎসঃ বিডি প্রতিদিন
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন