বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম
পুরো এক সপ্তাহ শৈত্যপ্রবাহে সারা দেশ জেরবার। যারা ধনবান, কাপড়-চোপড় আছে, যারা ঘরে বসে কাজ করে তাদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। কিন্তু বাইরে যাদের কাজ করে খেতে হয় তাদের এ যেন এক মস্ত গজব। আমাদের সখীপুরের নেতা কীর্তনখোলার আবদুস সবুর প্রায় দুই মাস আগে তার মাদ্রাসার ধর্মসভার তারিখ নিয়ে কথা বলেছিল। আমার সঙ্গে কথা বলেই সে তারিখ ঠিক করেছিল। কিন্তু এমন শৈত্যপ্রবাহ পড়বে, এমন ঠান্ডা পড়বে কল্পনাও করা যায়নি। এদিকে আমার শরীরটা হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। খারাপ শরীর নিয়েই টাঙ্গাইল থেকে ৬টায় রওনা হয়ে রাত ১১টায় ফিরেছিলাম। আল্লাহর ইচ্ছা এবং তাঁর দয়ায় ৯টার দিকে সভায় কিছু সময় বসেছিলাম, এমনকি দু-চার কথা বলেছিলাম। এও বলেছি, কোনো নারী যদি নবী হতেন তাহলে সবার আগে নবী হতেন রাবেয়া বসরি। তাঁর মতো পুণ্যবান মহিলা এ জগৎসংসারে আর দ্বিতীয়জন নেই। মনটা গত দুই সপ্তাহ থেকে খারাপ। হঠাৎ করে শরীরটা খারাপ হয়ে এক নাস্তানাবুদ অবস্থা। এর মধ্যে ২১ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রবীণ দল আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়ে গেল। একটা রাজনৈতিক দলের সম্মেলন সে দলকে নবজীবন দান করে। আওয়ামী লীগের এ সম্মেলনে সেটা কেমন হলো সবাই জানেন। এখন আর আওয়ামী লীগের তেমন কিছু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ভাই ওবায়দুল কাদের আগেই বলেছিলেন, এই দলের সব পদের অদলবদল হতে পারে, কিন্তু সভাপতি পদের কোনো অদলবদল হবে না। কথাটা প্রায় ধ্রুবসত্য। এখন নেত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের জন্য অবশ্যম্ভাবী। সত্যিই তাঁর কোনো বিকল্প নেই। তবু অন্য কাউকে সভাপতি করে তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারতেন। যারা দলে কাজ করবেন তাদের কারোরই মন্ত্রিসভায় থাকা উচিত নয়। যা হবে না তা নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। সাধারণ সম্পাদক নিয়ে মাঝেমধ্যে আলোচনা হতো। ঠিক এই মুহূর্তে এবং সামনের কিছুদিন ওবায়দুল কাদেরেরও বিকল্প নেই। নির্বাচনী প্রহসনের পর একটা বছর তিনি দারুণভাবে চালিয়েছেন। অসুস্থতার পর সুস্থ হয়ে তাঁর মেধার আরও বিকাশ ঘটেছে। নেত্রী শেখ হাসিনা এবারই প্রথম তাঁর সঠিক সাধারণ সম্পাদক পছন্দ করেছেন। আওয়ামী লীগের সদ্যসমাপ্ত কাউন্সিলে নবনির্বাচিত সবাইকে অভিনন্দন জানাই। তাঁরা একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে তুলতে পারলে দেশের জন্য খুবই মঙ্গল হবে। নেত্রী হাসিনা পুনর্নির্বাচিত হওয়ায় আন্তরিক অভিনন্দন। আন্তরিক অভিনন্দন জানাই ওবায়দুল কাদেরকে। সেদিন তিন-চার বার ফোন করেছিলাম, পাইনি। কিন্তু তিনি যখন ফিরতি ফোন করেন তখন ফোনটা আমার কাছে ছিল না। তিনি দুবার ফোন করেছিলেন। কথা হয়নি। দু-তিন দিন পর তাঁর সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা রাখি। তবে অনেকের না থাকলেও ফিরতি ফোন দেওয়ার তাঁর এক দারুণ শুভ অভ্যাস রয়েছে। তাঁর এ অভ্যাস যত দিন থাকবে তত দিন শত্রুর কাছেও তিনি সম্মান পাবেন। রাজনীতিতে শুধু সমর্থক নয়, যে রাজনীতিক সমালোচক ও বিরোধীদের আস্থা ও সম্মান কুড়াতে পারেন তিনি প্রকৃত রাজনীতিক। আমি আবারও ওবায়দুল কাদেরকে আমার, আমার দল এবং পরিবারের পক্ষ থেকে অভিনন্দন, শুভেচ্ছা জানাচ্ছি ও তাঁর সফলতা কামনা করছি।
শুরুতেই বলেছিলাম বেশ কিছুদিন মনটা খারাপ। পাঠক আপনারাই বলুন, ভালো থাকি কী করে? আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু নাকি একজন ‘রাজাকার’। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর যদি রাজাকার হন তাহলে যুদ্ধাপরাধের বিচার এটা কিন্তু চ্যালেঞ্জ করা যায়। উদ্দেশ্য যদি তেমন হয় তাহলে কাজটি যথার্থই হয়েছে। সিরাজগঞ্জের লতিফ মির্জা গণবাহিনী করে অনেক লোককে হত্যা করেছেন। তারা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর নামও রাজাকার তালিকায়। কোনো উদ্দেশ্য করে এ তালিকা যদি প্রকাশ করা হয়ে থাকে তাহলে সে উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। নেত্রী হাসিনার সরকার যে ব্যর্থ তাও এতে প্রমাণিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী এত দিন কী করে মন্ত্রিসভায় আছেন সেটাই ভেবে পাই না। এখন আর তাঁর মন্ত্রিসভায় থাকা উচিত নয়। তিনি সরকারে থাকলে, মন্ত্রিসভায় থাকলে ন্যায় ও সত্যের অপমান হবে, অন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে। তিনি বলেছেন, তিনি তালিকা করেননি। পাকিস্তানিদের করা যে তালিকা ছিল সেটাই শুধু প্রকাশ করেছেন। তাই তো তিনি করবেন। তিনি রাজাকার বানাবার কে? তাঁর তো রাজাকার বানাবার কোনো ক্ষমতা নেই। যখন রাজাকার হয়েছে তখন তিনি খুব একটা নামিদামি ছিলেন না। তবে হ্যাঁ, দু-চারটা মুক্তিযোদ্ধা বানানোর ক্ষমতা তখন তাঁর ছিল, এখনো আছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাঁকে তালিকা দিয়েছে। সেই তালিকায় রাজাকার, আলবদর, শান্তি কমিটির যেমন নাম আছে, সেই তালিকায় মিসক্রিয়েন্টেরও নাম আছে মানে যারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছিল, যারা মুক্তিযোদ্ধা ছিল, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল। চোখ বন্ধ করে তালিকা ছেপে দিলে রাজাকারের পক্ষে যারা ছিল বাংলাদেশের বিপক্ষে যারা কাজ করেছিল তাদের পক্ষে তো আসবেই। সেটা আসার কথা ছিল মিসক্রিয়েন্ট হিসেবে পাকিস্তানের দুশমন হিসেবে, রাজাকার হিসেবে নয়। ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু আমাকে জেলা গভর্নর বানিয়ে ছিলেন। খুব সম্ভবত সেটা ছিল জুলাইয়ের ১৬ তারিখ। ওই রাতেই টাঙ্গাইল এসেছিলাম। বাবা-মাকে দেখতে, তাদের দোয়া নিতে, হুজুর মওলানা ভাসানীকে সালাম জানাতে। ওই রাতেই এসপি ও ডিসিকে বলেছিলাম, নেতাদের পলিটিক্যাল ফাইল, রাজাকার-আলবদর-শান্তি কমিটির তালিকা আমার কাছে পাঠান। পরদিন দুপুরের মধ্যে ডিসি-এসপি দুজনকে দিয়ে প্রায় ৭০-৮০ খানা ফাইল পাঠিয়েছিলেন। পাঁচ-ছয় দিন দেখে সেগুলো কপি করে দিতে বলেছিলাম। তারা সব কটি কপি করে দিয়েছিলেন। অবাক হয়েছিলাম, আমরা সল্লা স্কুলে মিটিং করতে গিয়েছিলাম। তারও বিবরণ ছিল। উদ্যোক্তাদের চেষ্টা ছিল চেয়ারম্যানের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার। চেয়ারম্যান ছিলেন খুবই চালাক এবং আওয়ামী লীগ করতেন। তাই নেতাদের নিয়ে আগেই তার বাড়িতে ভূরিভোজ করিয়েছিলেন। পেট ভরে খেয়ে মাঠে এসে সবাই দেখে জট, কেউ কথা শুনছে না। আমরা বসেছিলাম সবার মাঝখানে। অনেক বলেকয়ে, বুঝিয়ে শেষে সভা করা হয়েছিল। চেয়ারম্যান দুদু মিয়া চমৎকার এক বক্তৃতা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ও ওই শালার চেয়ারম্যান। আমি সারা দুনিয়া বক্তৃতা দিয়ে বেড়াই কেউ কিছু বলে না। ওই শালায়ও চেয়ারম্যান। শালার বাড়ি জ্বালিয়ে দিতে চায়। নিশ্চয়ই শালায় খচ্চর হবে। না হলে আমার বাড়ি পোড়ায় না জ্বালায় না। ওই শালার বাড়ি জ্বালাতে চায় কেন?’ শ্রোতারা শান্ত হয়ে এসেছিল। অনেকে ভেবেছিলেন দুদু মিয়া তাদের পক্ষে বলছেন। তখন তিনি এক গল্প বললেন। আপনারা শোনেন, ‘এক গ্রামে একজনের খুব অসুখ হইছিল। কোনো ওষুধে কাজ হয় না। কত জায়গায় কত বৈদ্যি আসে কত ওষুধ দেয়, কিন্তু রোগী ভালো হয় না। বিছানায় পড়ে থাকতে থাকতে লোকটার জীবন শেষ। একদিন অনেক দূর থেকে এক বৈদ্যি আসে। চোখ-জিহ্বা-হাত-পা টিপে টিপে দেখে সে ওষুধ দেয়। ওষুধ দিয়ে চলে যাওয়ার সময় রোগী কাতর হয়ে বলে, “বৈদ্যিমশাই ওষুধ দিলাইন, পথ্যি দিলাইন না”। বৈদ্যিমশাই দরজার কাছ থেকে ফিরে এসে বললেন, “সত্যিই তো বড় ভুল হয়ে গেছে। আপনি সিদ্ধ চাল খাবেন না, আতপ চালের ভাত গুরুপাক। হাঁটাচলা করা যাবে না, বইস্যা থাকা যাবে না, কাইত হতে পারবেন না, চিত হয়ে শুবেন না, উপুড় হবেন না”। রোগী অস্থির হয়ে বলে উঠল, “তাইলে আমি কীবা করমু”। বৈদ্যিমশাই বললেন, “হায় হায়! কীবাও করন যাইব না। ওইটাই তো সব থেইক্যা বড় অসুখ। এটা একেবারেই করা যাবে না”।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! সময় থাকতে মন্ত্রীসহ যাঁরা এ তালিকার সঙ্গে জড়িত তাঁদের বিদায় করুন। এঁদের এখনই বিদায় না করলে আপনার যেমন সর্বনাশ হবে, তেমনি দেশের মারাত্মক ক্ষতি হবে। তাই সময় থাকতেই সাবধান!
১১ ডিসেম্বর ছিল টাঙ্গাইল হানাদারমুক্ত দিবস। সেদিন টাঙ্গাইলেই ছিলাম। হানাদারমুক্ত দিবসের অনুষ্ঠানে টাঙ্গাইলের মানুষ বড় আঘাত পেয়েছে। সে নিয়ে সমালোচনাও হচ্ছে প্রচুর। আমরা আওয়ামী লীগ করি না বলে অনুষ্ঠানে আমাদের দাওয়াত করেনি। ভালো করেছে। কিন্তু রাজাকারদের মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিযোদ্ধাদের রাজাকার বানানো মানুষ পছন্দ করে না। এখন যারা ভোট ছাড়া এমপি হয়েছেন তাঁদের বেশ কয়েকজন স্বাধীনতাবিরোধীর ছেলে। তাঁরা টাঙ্গাইল স্বাধীন করলে তো চলবে না। জনাব আবদুর রাজ্জাক এখন অবশ্যই মন্ত্রী হতে পারেন। কিন্তু যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন একজন অতি সাধারণ যোদ্ধা। তাঁর ভাগ্যে একটি যুদ্ধও জোটেনি। তাঁকে দিয়ে টাঙ্গাইল স্বাধীন করে ফেলবেন! দাইন্যার কমান্ডার নিয়ত আলী জনাব রাজ্জাকের চেয়ে অনেক শক্তিশালী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিলেন। ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমানের মোছের এক বাড়িতে এখনকার নেতা আবদুর রাজ্জাকের মতো ১০টা কুপোকাত হতেন। আমি এসব কথা বলি না। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলি, ইতিহাস বিকৃত হওয়ায় আপনি এত ব্যথিত ও উদ্বিগ্ন। অথচ প্রতি পদে পদে আমাকে মুছে ফেলার জন্য যা করা হচ্ছে তা কি ইতিহাস বিকৃত নয়? আমাকে বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে সাবলীল করবেন তা কী করে সম্ভব? আমাকে বাদ দিলে বঙ্গবন্ধুও তো বাদ পড়েন। দু-একটা ছবি তো এখনো আছে, পিতা-পুত্র আমরা কীভাবে সটান দাঁড়িয়ে আছি। ১১ তারিখ কয়েক শ মুক্তিযোদ্ধাকে এনে তাঁদের বসার চেয়ার পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। একজন মুক্তিযোদ্ধাকেও মঞ্চে নেওয়া হয়নি। এসব কীসের হানাদারমুক্ত দিবসের অনুষ্ঠান? নাচানাচি হচ্ছে, গান হচ্ছে, কবিতা হচ্ছে। ৩০ লাখ শহীদ, ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা গানের কলির মতো বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু সেখানে কোনো দরদের চিহ্ন নেই। গায়ক যেমনি গান গায় তেমনি যেন ৩০ লাখ শহীদ গানের সুরের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। বড় ভয় হয়। নারী যোদ্ধাদের নিয়ে প্রত্যক্ষ মাঠে কামান-বন্দুক-রাইফেল হাতে তাঁদের যুদ্ধের মাঠেও নামানো হয়েছে। বাংলাদেশের নারীদের মুক্তিযুদ্ধে প্রকৃত ভূমিকা মহিমান্বিত হচ্ছে। মায়েরা বোনেরা মেয়েরা যুদ্ধকে যে মনেপ্রাণে সমর্থন করেছেন। স্বামীর জন্য সন্তানের জন্য ভাইয়ের জন্য যে দোয়া করেছেন সেটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধে নারীদের প্রকৃত অবদান। আমার বিশ্বাস, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ২-৪ লাখ পুরুষ থাকলেও ২-১ হাজার নারী ছিল না। রাজাকার শান্তি কমিটির ঘরের মেয়েরাও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দোয়া করেছে। তা ছাড়া আহতদের সেবা-শুশ্রুষা, মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার এসব নারীদের আরও মহিমান্বিত করেছে। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকা তুলে ধরতে গিয়ে বরং তাঁদের অনেক ছোট করা হচ্ছে। কিন্তু এ ব্যাপারটা থেকে অনেককেই বিরত করা যাচ্ছে না।
লেখক : রাজনীতিক।
উৎসঃ বিডি প্রতিদিন
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন